ইসরাইল খান
পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত সাময়িকী-পত্রপত্রিকার জগতে ‘অগত্যা’ নানাকারণেই একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল–। তারজন্যে এই প্রজন্মের সাহিত্যকর্মীদের কাছেও নামটি সুপরিচিত। সাতচল্লিশের আজাদীলাভের পর পূর্ববাঙলার রাজধানী ঢাকা থেকে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়ে ১৯৫২ পর্যন্ত চার বছর এটি বাঙালিসমাজে আলোড়ন তুলেছিল। এ-বছর তার বয়স হয়ে গেল পঁচাত্তর বৎসর। কিন্ত তার স্মৃতি-যে এখনও অবিস্মৃত, তাতেই এর কিছু গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো কিছু পুরনো হলেও যদি তার নাম শ্রুতিতে পরিণত হয়–তখন তার ধ্রুবত্ব অস্বীকার করা যায় না। তাই পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে কি ছিল অগত্যা, কারা ছিলেন এর রথী-মহারথী?
২
চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে সীমান্ত–কৃষ্টি–সংকেত ইত্যাদি প্রকাশিত হলেও কৃষ্টি ও সংকেত এক-দুই সংখ্যার বেশি প্রকাশিত হয়নি। সীমান্ত মাসিকপত্রিকা হলেও অনিয়মিতভাবে বের হতো–তাও চট্টগ্রাম থেকে। অতএব ঢাকার প্রগতিপন্থী লেখকসাহিত্যিকদের ভাব–বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম নতুন দেশ হওয়ার পর তখনও সৃষ্টি হয়নি। মোহাম্মদী–মাহেনও–দিলরুবা প্রভৃতিতে প্রগতিবাদী-প্রতিবাদীদের স্থান ছিলনা। এমতাবস্থায় তরুণ-প্রাণের অকৃত্রিম হৃদয়াকুতি এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের একটি উপযুক্তপত্র প্রকাশের তাগিদ থেকেই আষাঢ় ১৩৫৬, জুন ১৯৪৯ সনে ১০৭ ইসলামপুর, ঢাকা থেকে অগত্যা প্রকাশিত হলো–যার কর্ণধার ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত একদল সমবয়সীতরুণ ; পরবর্তীকালে এঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে একএকটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। কেউকেউ বুদ্ধিজীবীসমাজের অগ্রগণ্য হয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
প্রখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, সাংস্কৃতিকতারকা ফতেহ লোহানী, সাংবাদিক-কলামিস্ট খোন্দকার আবদুল হামিদ, তাসিকুল আলম খাঁ, সাবের রেজা করীম, শিল্পী কামরুল হাসান, সিন্দবাদ, সঙ্গীতজ্ঞ আবদুল আহাদ, কাজি আলাউদ্দিন, আবুসঈদ নাসির, মাহবুব জামাল জাহেদী, ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কবি আতাউর রহমান, নাট্যকার আনিস চৌধুরী প্রমুখ ‘অগত্যার আড্ডায়’ একত্রিত হয়েছিলেন এবং এই পত্রিকাকে ঘিরেই এঁদের উচ্ছাস-আনন্দ-চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মকাণ্ড আবর্তিত হতে শুরু করেছিল। বলাবাহুল্য তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
প্রকাশকাল ১৯৪৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত–এই দীর্ঘকালের ব্যবধানেও ‘অগত্যা‘-যে বিস্মৃতির তলে হারিয়ে যায়নি, নানা প্রসঙ্গে এখনও স্মরণ করা তাকে, তাতেই বোঝা যায় এই পত্রিকা প্রকাশকালে কতোখানি স্থায়ীপরিচিতি অর্জন করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল–কারণ এর প্রাণকেন্দ্রে ছিলেন তখনকার মেধাবী প্রগতিশীল উচ্চাভিলাষী তরুণেরা। রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটির ক্ষেত্রে যাঁদের অবস্থান ছিল মুসলিম লীগ বা পাকিস্তানপন্থি– প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতারকইসলামী ধারার বিপক্ষে। সোজাকথায়, স্টাবলিশমেন্টের বিরোধিতা করা ছিল তাঁদের উৎসাহী কার্যাবলির মূল প্রেরণা। স্টাবলিশমেন্টের ভণ্ডামি প্রতারণা অপকীর্তির মুখোশ উম্মোচন করতে গিয়ে তাঁরা যে পদ্ধতিপন্থা ও ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন–তাতে ছিল তীক্ষ্ণ হুঁল, শ্লীলতাবর্জিত ব্যঙ্গকৌতূক ও হাস্যরস। এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই ‘অগত্যা’ ব্যাপকভাবে পঠিত বহুলপরিচিত হতে পেরেছিল: সঙ্গেসঙ্গে কুখ্যাতিও অর্জন করেছিল ‘ভদ্রলোকের পত্রিকা নয়’ বলে।১
বলা হতো–‘ভদ্রলোকের অপাঠ্য-অশ্লীল’ কিন্তু বিষয়বস্তুর কারণেই তা প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিষ্ঠিত, খ্যাত-অখ্যাত, সরকারিবিরোধি সকল প্রবীণ-তরুণের পাঠ্য হয়েছিল। এর সমালোচনার বিষয় ছিল মুসলিম লীগ সরকারের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক অপপ্রয়াস; আর প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কবিসাহিত্যিক এবং তাঁদের অনুগত অনুসারী হবুখ্যাত ডানপন্থী তরুণ কবিসাহিত্যিক। ফলে অশ্লীল বলে পড়ব না–এমনভাব দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেতো না। যেমন এককালে চলতো না কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), অগ্রগতি (১৯৩৫) অচল পত্র (১৯৪৮) না-পড়ে অবজ্ঞা করা।
অবশ্য একথা বলতে হবে যে, জনপ্রিয় হবার ও পরিচিতি অর্জনের কৌশল ও মেধা, আর সাহস উদ্যোক্তাদের দলপতি ফজলে লোহানীর ছিল। ফজলে লোহানীর প্রকৃতি স্মরণ করলেই কিছুটা অনুমান করা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন বিরতির পর লণ্ডন থেকে প্রবাসজীবন সমাপ্ত করে দেশে এসে মৃত্যুর পূর্বে আশির দশকে বি.টি. ভি.তে ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করে তিনি কিভাবে অতিঅল্পসময়েই একালের তরুণসমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। অতএব দৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল ছিল তাঁর স্বভাবগত। একজন সমালোচক লিখেছেন :…তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গি এই অনুষ্ঠানকে সর্বস্তরের দর্শকের কাছে জনপ্রিয় করেছে।…তৈরি ছক থেকে বের হয়ে নতুনধরনের অনুষ্ঠান করেছিলেন….টিভিমাধ্যম যে কেবল সাংস্কৃতিক বিনোদনের মাধ্যম নয়, এর যে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করার কথা…তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন।…দীর্ঘদিন মুদ্রণ সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে টিভি সাংবাদিকতা করা সহজ হয়েছিল….তাঁর স্মার্টনেস, বাক্চাতুর্য, উপস্থিতবুদ্ধি, হিউমার দিয়ে এধরনের শো-প্রোগ্রামের মাধ্যমে যেভাবে জনগণকে মাতিয়ে রাখতেন তার জুড়ি মেলেনি এখনও।২
কবি আতাউর রহমান ‘অগত্যা এবং আমরা কয়েকজন’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখেছেন : ফজলে লোহানীর ‘ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তাসিকুলেরও ছিল। অগত্যা’য় ব্যঙ্গাত্মক লেখাগুলো ওদের যৌথ রচনা। মোস্তফা (মুস্তাফা নূরউল ইসলাম) সাহেবের কিছু অবদান আছে। ওদের ভাষার কিছু নিজস্ব কোড ছিল–সেটা ওরাই বুঝতো। সেই কোডের ভাষায় কথা বলতো আর হাসতো। … লোহানী ভ্রাতৃদ্বয় থাকেন আজিমপুরে বোন-ভগ্নিপতির বাসায়।—আমরা দলবেধে যেতাম—আমি, আনিস চৌধুরী, তাসিকুল আলম খাঁ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম… আড্ডা জমাতাম …দেশের মূল স্রোতধারা থেকে বিছিন্ন থাকিনি,… বুঝলাম ফজলে লোহানী বামের প্রতি সহানুভ‚তিসম্পন্ন। তখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা ‘অগত্যা’ ছাড়া কেউ করতো না–যদিও সে সমালোচনার চরিত্র ছিল ভিন্ন। ছাত্রআন্দোলন, যুবআন্দোলনের সঙ্গে লোহানীর যোগ ছিল। মধুর রেস্টুরেন্টের সাহিত্যসভায় পঠিত প্রবন্ধ গল্প-কবিতা অগত্যায় প্রকাশ করতেন। আর্থিক টানাটানি ছিল। তাই তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আংশিক সময় কাজ করতেন। অনেক সময় রাতে কাজ করে তাসিকুলের সঙ্গে ইকবাল হলে আসতেন। আমার এবং তাসিকুলের বেডে শুয়ে পড়তেন। ফজলে লোহানীর ছিল তীক্ষ্ণ কাণ্ডজ্ঞান আর দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা। অগত্যা অফিসের কাজ তিনিই করতেন বেশি। নিজের হাতে চিঠিপত্র টাইপ করতেন। সবুজ (আবুসঈদ নাসির, প্রকাশক ও মুদ্রাকর, অগত্যা) করতো বাইরের কাজ। লোহানী আনিস চৌধুরীর সঙ্গে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার দিকে তাসিকুলের মতো তাঁরও অনীহা ছিল। প্রচলিত সামাজিকতা আর বাধাধরা জীবনের প্রতি অবজ্ঞাই ছিল। অগত্যা’য় অনেক লেখায় তার তীব্র ছাপ আছে। অনেক সমস্যার ভারের মাঝেও লোহানী প্রাণবন্ত হাসিখুশি থাকতেন।… ১৯৫২ র ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরপরই লোহানী কবিতা লিখলেন।৩ সে কবিতা সত্যিই বেশ ভাল হয়েছিল। ও হাত দিলে সব রকম লিখতে পারতেন। ‘অগত্যা’র বেনামী লেখাগুলো বেশীর ভাগ লোহানীই লিখতেন। বহু অনুবাদ করেছেন। তাঁকে অনায়াসে সব্যসাচী বলা যায়।৪
আনিস চৌধুরী সম্পর্কে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন: সাতচল্লিশের পার্টিশনের পর ওরা তিনজন এসেছিল কলকাতা থেকে। সবুজ, লোহানী, আর আনিস। প্রথম তারুণ্যের আমরা কয়েকজন মিলেছিলাম,.,তখনকার দুর্দান্ত ‘অগত্যা’কে নিয়ে। কত অজস্র লেখা যে আনিস লিখেছে অগত্যায় স্বনামে, বেনামে, ছদ্মনামে। একটা কম্পিটিশনের মতো ছিল–কে কতো হূঁল-ফোটানো লেখা লিখতে পারে, কতো ত্যাঁড়া করে লিখতে পারে। হামলার লক্ষ্যবস্তু তখনকার পাকিস্তানি প্রভুরা। লেখায় কেউ কারুর চাইতে কম যেত না, তবে আমাদের মধ্যে সবচাইতে নির্বিরোধী, সবচাইতে সরল চেহারার, স্বল্পবাক আনিস চৌধুরী যে ঐ বিশেষ কর্মটিতে অমন ধারালো হয়ে উঠতে পারত, বাজ-পাখির মতো হয়ে যেত, ভেতরের আমরাই কেবল তা জানতাম। আনিসের লেখার একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল। ঐ ভঙ্গিটা যে কেমন করে রপ্ত করেছিল, বিনা আয়াসে তরতরিয়ে সে লিখে যেতে পারত। লেখার উপকরণের ব্যাপারে ভারি সৌখিন ছিল আনিস—সেই আমলেই রেডিওবণ্ড কাগজ আর চাই পাইলট পেন। ‘অগত্যা’র জন্য গল্প লিখতো, আর সম্পাদক লোহানী, আনিস, আমি তিনে মিলে আমরা ‘প্রশ্নোত্তর’ লিখতাম।
বিচিত্রা’য় প্রকাশিত হাসান হাফিজ লিখিত একটি প্রতিবেদনে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেন, একই ছদ্মনামে আমরা তিনজন–লোহানী, আনিস, আমি ঘুরেফিরে লিখতাম। ‘অগত্যা’র কিছু কলাম যেমন আদ্যোপান্ত, ইত্যাদি, প্রশ্নোত্তর, রেডিও বিষয়ক একটি কলাম–এসব আমরা একসঙ্গে বসে লিখতাম। কখনো পাইওনিয়ার প্রেসে বসে, কখনো হ্যাপী রেস্টুরেন্টে, সলিমাবাদ রেস্টুরেন্টে বা মধুর দোকানে এসব লেখা হত। এখন আর বলতে বাধা কী, প্রশ্নগুলো বানানো হত। ঐ কাজ মূলত আনিসই করত। চট জলদি এত অদ্ভুত অদ্ভূত প্রশ্ন ওর মাথায় কোথা থেকে যে আসত। তারপর যৌথপ্রয়াসে জবাব তৈরী করা। লক্ষ্য ঐ একই–শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানের দাঁতাল দখলদার মুরুব্বিরা, যারা কথায় কথায় ইসলামের নামে, দুই পাকিস্তানের ঐক্যের নামে, পাঁচ হাজার বছরের বানোয়াট ঐতিহ্যের নামে ছবক বিতরণ করতেন, ফরমান জারি করতেন। বিশেষ করে আরো ছিলÑবাংলা ভাষা হরফ রবীন্দ্র-নজরুল এবং আমাদের বাঙালিত্ব নিয়ে করাচি-ঢাকার ক্ষমতাধর সেই মাতব্বরদের রক্তচক্ষু নির্দেশ। সবারত জানা রয়েছে তাদের দুশমনি অভিযানকে রাজপথে রুখেছিল আটচল্লিশ-বায়ান্নোর তরুণছাত্র আর সাধারণ মানুষ, সেই সঙ্গে একটু যোগ করি সীমিত সাধ্যে ‘অগত্যা’ নামের পত্রিকাটিও কিছু কাজ করেছিল। সেসব কথা তখনকার পাঠকরা এষনও সম্ভবত স্মরণ করতে পারবেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেন, অগত্যার একেবারে ভেতরবাড়ির চারজনের অন্যতম ছিলেন আনিস চৌধুরী। না, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আনিসকে তেমন দেখিনি–মিছিলে সমাবেশে কিংবা মঞ্চে। তবে প্রতিরোধী এবং প্রতিবাদী লেখালেখিতে কতো অজস্রবার যে ঝলসে উঠতে দেখেছি তাকে। তখন আমাদের ঠাঁই ছিল পুরানো রেললাইনের পাশে বাখারির বেড়াবাঁধা দোচালা টিনের শেডে। সারিসারি শেড–কে বা কারা যেন নামকরণ করেছিল ‘ইকবাল হল’–বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (ঢা. বি.) আদি চেহারা। সামনের সারির ঘরগুলোতে কেমন করে যে জুটেছিলাম আমরা কয়েকজন। এতদিন পরেও স্মরণ করতে পারছি সহবাসীদের কারুকে কারুকে–আখলাকুর রহমান, কে.জি মোস্তফা, শহীদ খোন্দকার আবু তালেব, একদা কবি আতাউর রহমান, খালেক নওয়াজ (৫৪-র নির্বাচনে যিনি ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে পরাজিত করেছিলেন), ছাত্রলীগ নেতা শামসুল হক, সাংবাদিক কবি তাসিকুল আলম খাঁ, আর সেই সঙ্গে আনিস চৌধুরী। সবাই আমরা ছাত্র সে-সময়টায়। ৪৮ থেকে ৫২ কালপর্বের খানিকটা হয়ত ধারণা করা যেতে পারে এইসব মানুষের উল্লেখ থেকে। বলব কী, নানান ঝড়ঝাঁপটার ভেতর দিয়ে আনিস এবং আমরা হয়ে হয়ে উঠেছি এই কাল-ইতিহাসের পরিবেশে।… বিজ্ঞানের ছাত্র আনিস যে শেষঅবধি সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ল এবং জীবনভর সাংবাদিকই রয়ে গেল, বিস্মিত হইনি তাতে। কেননা বিশেষ ঐ কাল-পরিবেশ লালন করেছিল তাকে, আর আমরা ত দেখেছি কী গভীর সচেতন, সংবেদনশীল ছিল তাঁর চিত্ত।
লেখার কলম ছিল দখলে, সমকালে মানুষ হয়ে ওঠা আনিসের জন্যে সম্ভবত অন্যতম বিকল্প কর্ম কিছু ছিল না। কিন্তু আরো একটি লেখা যে ভবিতব্য তাঁর ললাটে লিখে রেখেছেন খুব কাছের জন আমরা কিন্তু তখন তা আন্দাজও করতে পারিনি। বলেছি প্রচুর গল্প লিখেছে আনিস–সংলাপ রচনায় হাতটি ছিল পাকা। ঐটেই পাঠককে টানত আগে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি অকস্মাৎ আবিষ্কার করা গেল আমাদের সেই আনিস রীতিমতো শক্তিশালী নাট্যকার।… এই প্রজন্মও জানুক–একদা আমাদের সেই সময় গেছে, একদা আমরা প্রতিবাদী অমন একটা পত্রিকা বার করেছিলাম, নাম ‘অগত্যা’; আর আনিস চৌধুরী নামের লেখক মানুষটি ছিল সেই প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার।‘৫
৩
অগত্যা’র প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় আত্মপরিচয় দেয়া হয়–‘বিচিত্র মাসিকপত্র’ বলে। বর্ষ আরম্ভ হয় আষাঢ় ১৩৫৬ থেকে। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম এবং খ্রীষ্টিয় মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত হবে বলে ঘোষণায় বলা হয়। মূল্য প্রতিসংখ্যা আট আনা। বার্ষিক ছ টাকা নয় আনা। ষান্মাসিক তিনটাকা আট আনা এবং ত্রৈমাসিক একটাকা বার আনা। ডাক মাসুল অন্তর্ভুক্ত। ‘অগত্যার প্রচার সুরুচিসম্পন্ন পাঠক এবং সুসংস্কৃত ছাত্র সমাজ-এ।’ আরও বলা হয় :
‘‘অগত্যা একমাত্র প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা। জীবন সাহিত্য চলতি ঘটনা বিশ্বপরিস্থিতি সিনেমা বেতার দর্শন বিজ্ঞান কারুকলা সমালোচনা এবং আমাদের কৃষ্টি ও অগ্রগতির একমাত্র পরিচায়ক। মননশীল রুচিসম্পন্ন সাহিত্য রচনাই অগত্যার উদ্দেশ্য। রাজনীতির সঙ্গে অগত্যার কোন সম্পর্ক নেই। কোন দল বা গোষ্ঠীর প্রচারপত্র অগত্যা নয়। অগত্যা আপনার আমার সকলের মুখপত্র। পৃষ্ঠা সংখ্যা চৌষট্টি। প্রতি পৃষ্ঠার মূল্য আধ পয়সা। চৌষট্টি পৃষ্ঠা অন্তত চৌষট্টিবার পড়তে ইচ্ছে করবে আপনার। অগত্যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত। দ্বিবর্ণে ও প্রয়োজনবোধে বহুবর্ণে মুদ্রিত হবে।”
অগত্যা’র প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে নাম ছাপা হত আবু সঈদ নাসিরের। সাধারণ উপদেষ্টা ফতেহ লোহানী। সম্পাদক-সমবায়মণ্ডলীতে ছিলেন–বিশ্বপরিক্রমায় খোন্দকার আবদুল হামিদ, সংস্কৃতি সংবাদে তাসিকুল আলম খাঁ, প্রচারে সাবের রেজা করীম, সৌষ্ঠব রচনা ও আঙ্গিকপরিকল্পনায় কামরুল হাসান এবং সিন্দবাদ, সঙ্গীতে আবদুল আহাদ, স্টুডিওর সংবাদে কাজি আলাউদ্দিন এবং সম্পাদক ফজলে লোহানী। সপ্তম সংখ্যা থেকেই সম্পাদকসমবায়ের সদস্যসংখ্যা কমে যায়। নিশ্চয়ই অগত্যার সঙ্গে সংশিষ্ট থাকতে চাননি কেউকেউ। কারণ নিরাপোষ নিন্দুক ছিল অগত্যা। সরকারবিরোধি ভ‚মিকায় ভয় পেয়ে যাবেন কেউকেউ। ফলে খোন্দকার আবদুল হামিদ, কাজি আলাউদ্দিন, আবদুল আহাদের নাম আর মুদ্রিত হত না। থেকে যান ফতেহ লোহানী তাসিকুল আলম সাবের রেজা করীম কামরুল হাসান সিন্দাবাদ এবং হামিদুর রহমান। অগত্যার যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্যণীয় তাহল–কায়েদে আজম বা ইকবালের কোন স্তুতি না করে রবীন্দ্রনাথের উক্তি পুরোভাগে উদ্ধৃত করে এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ছেপে তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন। মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রণীত ‘রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধ ও বুর্জোয়া সাহিত্যিকের আত্মবিরোধ’ শীর্ষক প্রবন্ধ ছাপা হয় ৪ বর্ষ ২য় সংখ্যায়। সোভিয়েত সাহিত্যিক আন্তন শেকভ সম্পর্কে আলোচনা ও মার্কসীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী সাহিত্যিক খাজা আহমদ আব্বাসের রচনার অনুবাদ এতে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হত। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইলিয়া ইলেনবুর্গ, এ্যালান ম্যরে, আনাতোল ফ্রাঁন্স, বালজাক, বার্নাডশ, হেমিংওয়ে, এ গ্রিনিন, গোর্কী প্রমুখ বিদেশী প্রগতিপন্থী লেখকদের সাহিত্যের অনুবাদ অগত্যায় বিশেষ মর্যাদায় ছাপা হয়। এদেশের পত্রপত্রিকায় এই শ্রেণীর সাহিত্যের প্রকাশ তখন নতুন ছিল। এদিক থেকে মন্তব্য করা সঙ্গতÑবিদেশী সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ প্রগতিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সাহিত্যিকপরিমণ্ডলে অগত্যা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় সৈয়দ আলী আহসানের ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রে নির্দেশ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধও ছাপা হয়। বোঝা যায় আলী আহসান তখনও ততোটা চিহ্নিত পাকিস্তানবাদী ইসলামপন্থী রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে প্রগতিশীলদের কাছে পরিহার্য লেখকরূপে চিহ্নিত হননি। এক পর্যায়ে তিনি যে বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতার জলজ্যান্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন, তখনও পর্যন্ত তাঁর সেস্বরূপ পরিপূর্ণ উন্মোচিত হয়নি। কিন্তু অগত্যা’র আদর্শের সঙ্গে এই প্রবন্ধের বক্তব্য সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। তিনি পাকিস্তানি-ইসলামি সাহিত্যশিল্পের নতুন আদর্শের কথা বলছিলেন।
‘আমাদের চিত্রনাট্য’ সম্পর্কে আলোচনা করেন আল্ নাসির। আন্তন শেকভ থেকে অনুবাদ করেন মনসুর মুসা। ‘রাজদ্রোহী’ শীর্ষক গল্প লেখেন ফতেহ লোহানী। ‘আলেকজাণ্ডার কেন এগোলেন না’ শীর্ষক ব্যঙ্গ-গল্পের রচয়িতা সম্পাদক ফজলে লোহানী। খাজা আহমদ আব্বাসের গল্প ‘বারো ঘন্টা’ অনুবাদ করেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। কবিতা ‘আশির্বাণী’ লেখেন শাহাদাৎ হোসেন। ‘অগত্যা’ নামে কবিতা লেখেন ফররুখ আহমদ । আরও কবিতা লেখেন–শামসুল হুদা বদরুল হাসান নাজির আহমদ তাসিকুল আলম খাঁ উত্তীয় সেন ইরফান প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য ‘বিদ্রোহীর স্টাইলে ‘নাস্তিক’ লিখেছিলেন ইরফান–
‘হে বদ্ধচক্ষু ভগবান, …বজ্রের অসি নামিয়ে রাখো, প্রাচুর্যের সন্ধানে চাহি… অনন্তের প্রতি কোষ পানে, ধরণী কক্ষচ্যুত হলো বুঝি তাই।’ (আষাঢ় ১৩৫৬, পৃ. ৬২)
মার্কসবাদী লেখক কবি আতাউর রহমান লিখেছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতা। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর কথা উদ্ধৃত করে কবিতা রচনার স্টাইল এদেশে সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু অগত্যায় তা ছিল। আতাউর রহমান এই স্টাইল অণুসরণ করেছিলেন। প্রথম সংখ্যার ‘আদ্যোপান্ত’ বিভাগে ১৯৪৯ সনে প্রকাশিত সাহিত্যপত্রিকার পটভূমিরূপে তখনকার সাহিত্যিক পরিস্থিতিটা লক্ষ্যণীয় :
‘বহু শতাব্দী পর আজ আমাদের বুক থেকে পরাধীনতার গ্লানিময় জগদ্দল পাথর নেমে গেছে। আজ আমরা মুক্ত স্বাধীন হয়েছি। আজ আমাদের সাহিত্য মুক্ত হওয়া দরকার। সাহিত্যিককেও সবরকম অনাচার থেকে আজাদ হওয়া প্রয়োজন। আজ আপনার উচিত দেশে সবল সুস্থ ঈঙ্গিত দিয়ে, নতুন প্রেরণা দিয়ে, ভবিষতের শক্ত ভিত্তিমূল তৈরী করার কাজে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। আজ সাহিত্যকে নিতে হবে সংস্কারক আর সংগঠকের কঠিন ভ‚মিকা। যা মিথ্যা যা সত্য নয় যা বাস্তবের অপলাপ তাকে আপনার তুলে ধরতে হবে সকলের চোখের সামনে। জীবনের রন্ধ্রেরন্ধ্রে যে দুর্নীতির সামান্য ছোঁয়া লেগে জীবনমূল ভেঙ্গে যেতে পারে তার প্রবহমান গতিকে প্রতিরোধ করতে হবে দুর্জয় বিক্রমে। আজ সামান্য খ্যাতির তাড়নায় তাড়াহুড়ো করা বা সামান্য স্বীকৃতির জন্যে বা দুটো পয়সার জন্যে সাহিত্যিকের লেবেল গলায় ঝুঁলিয়ে বাজারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ান আপনার উচিত নয়। আজ সাহিত্যিকের গুরুদায়িত্ব, সাহিত্যের সত্যিকার কাজ আপনার স্কন্ধে তুলে নিতে হবে। সাহিত্যের স্রষ্টাকে জানতে হবে কি করে তার সৃষ্টিকে অন্তরঙ্গ করা যায়, তার সৃষ্টিকে দেশের অন্তরের অন্দর মহল ঘুরিয়ে আনার উপায় কি। জীবনদর্শনকে নিয়ে যাঁরা শিল্প গড়েন তাঁদের দৃষ্টিটা খ্যাতির ব্যাপ্তি বা লাভলোকসানের ওপর নিবদ্ধ থাকলে চলবে না। কিন্তু আজ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় পৌনে দু বছর অতিবাহিত হতে চললো–তবুও বাংলা ভাষায় একখানি উৎকৃষ্ট মাসিক পত্রিকা কিংবা দু-একখানা ভালো সাময়িকপত্রিকাও এখানে প্রকাশিত হলো না। আর মুসলিম সাহিত্যের যাঁরা দিকপাল সেজে বসে আছেন তাঁদের কথা ছেড়েই দিন। একখানা সত্যিকার সাহিত্যিক মর্যাদাসম্পন্ন ভালো সৃষ্টি তাঁদের হাত থেকে পাওয়া গেল না। বরঞ্চ সাহিত্যের গুরুত্বকে মর্যাদাকে অনেক ধুরন্ধর আজ বাজারে টেনে এনে যে-ভাবে লাঞ্ছিত আর হাস্যকর করে তুলেছেন তাতে মুখ বুজে থাকা সম্ভব নয়।
বিভাগপূর্ব বাংলায়…যে কজন মুসলমান সাহিত্যিক স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন…তা নিছক নিজেদের গুণেই।… ফাঁকির অবকাশ থাকত না… কিন্তু, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের সাহিত্য এখানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কয়েকজন তথাকথিত স্তাবকদের সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে। তাঁরা স্বল্পপ্রচারিত কুখ্যাত কয়েকটি সাময়িকে আর মাঝেমাঝে প্রকাশিত অল্পসংখ্যক মুদ্রিত কবিতা ও সাহিত্য সংগ্রহেই তাঁদের কার্যকলাপ আবদ্ধ রাখছেন। সত্যিকার মননশীল শিক্ষিত মহলে কিংবা বিদগ্ধ সাহিত্যানুরাগী মহলে তাঁরা আস্তে আস্তে অপাঙতেয় হয়ে পড়ছেন।… এসব অসঙ্গতি, স্বেচ্ছাচার আর বিপর্যয়কে দূর করার জন্যে আজ ‘অগত্যা’র আত্মপ্রকাশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।… অগত্যা কোনো গোষ্ঠী বা স¤প্রদায়ের মুখপত্র নয়, অগত্যা সকলের মুখপত্র।’
অগত্যা’র নিয়মিত বিভাগে আলোচনা হতো সমসাময়িক ঘটনাবলি। এগুলোর নাম ছিল আদ্যোপান্ত, ইত্যাদি, অপ্রাসঙ্গিক, সিনেমা, বেতার, চিঠিপত্র, রোজনামচা ইত্যাদি প্রভৃতি। একনজরে অগত্যা’র লেখকদের তালিকাটা দেখে নিতে পারি :
রবীন্দ্রনাথ (পুনর্মুদ্রণ), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, আল নাসির, মুসা মনসুর, ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী, খাজা আহমদ আব্বাস, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন, ফররুখ আহমদ, শামসুল হুদা, বদরুল হাসান, নাজির আহমদ, তাছিকুল আলম খাঁ, উত্তীয় সেন, ইরফান, হামিদুর রহমান, কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত, হাশমত আজীজ, জয়েনউদ্দীন, ইলিয়া ইলেনবুর্গ, হাবীবুর রহমান, ম্যাক্সিম গোর্কী, আবুসাঈদ নাসির, আনিস চৌধুরী, এ. গ্রিনিন, আবদুর রশিদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলিয়া ইলফ এবং ইউজেন পেট্রভ, শাহাদাৎউল্লাহ, আইউব হোসেন সিদ্দিকী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আতাউর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু তায়েব সাদিদ, সমরেন্দ্র দত্ত, এ্যালান ম্যরে, আবদুল গনি, আনওয়ারুল হাফিজ, আখলাকুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, দৌলতননেসা খাতুন, খান আবদুর রশীদ, হোসেন আরা, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, ফয়েজ আহমদ, আবদুল মোহীত, মাহবুব জামাল জাহেদী, কাজী হাসান ইমাম, আবদুল গাফফার চৌধরী, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হাসান হাফিজুর রহমান, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, নেয়ামাল বাসির, জহিরুল আলম, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ কায়সুল হক, আহমদউজজামান ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সাহিত্যের পর্যায় বিভাগ করলে সাতচল্লিশপরবর্তী সাহিত্যের যে-স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষগোচর হবে–তা সৃষ্টি করেছিলেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবি সাহিত্যিকেরা। একালের সাহিত্যের মূল ধারায় নতুন সংযোজন বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের চেতনা। জাতীয়তাবাদী অসা¤প্রদায়িক আধুনিক সাহিত্যেও প্রভাবান্বিত বাংলাদেশের মানবতাবাদী বুর্জোয়া ভাবাদর্শের সাহিত্যসংস্কৃতির স্রষ্টা যাঁর–সেই কবিসাহিত্যিকেরা অগত্যায় স্বাধীনভাবে সাহিত্যচর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই নিরিখে এর সাহিত্যিক অবদান গৌণ নয়। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস এবং রম্যব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক সংলাপ সৃষ্টিতে আর সাহিত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন মুসলিম জনঅধ্যুষিত একটি দেশের আলাদা অর্থনীতি পররাষ্ট্রীয় নীতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও ভাবিত শৈল্পিক জীবনভাবনা রূপায়নে পূর্ববাঙলার কবি সাহিত্যিকেরা যে-যাত্রা সাতচল্লিশ পরবর্তীকালে আরম্ভ করেছিলেন, পঞ্চাশপূর্ববর্তী দশকে সীমান্ত-অগত্যা ইত্যাদি পত্রিকা তখন রথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সাহিত্যের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অগত্যার ভ‚মিকা তাই গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচিত হয়ে থাকে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শাহাদাৎ হোসেন, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, সরদার জয়েনউদ্দীন, হোসেনে আরা, দৌলতুনেছা খাতুন প্রমুখ বিভাগ-পূর্ববর্তীকালের লেখকেরা ‘অগত্যায়’ তরুণদের সঙ্গে লিখলেও পত্রিকাটি ছিল প্রধানত তরুণদের উচ্ছ্বাস-আনন্দ-উত্তেজনা, রাগ-ক্ষোভ-প্রেম-ভালবাসা মনের বিচিত্র অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম।
পঞ্চাশের দশকের প্রধান সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীবৃন্দের মধ্যে শামসুর রাহমান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আতাউর রহমান, ফয়েজ আহমদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নেয়ামাল বাসির, মাহবুব জামাল জাহেদী, সিরাজুল ইসলাম (আজিজ মিছির) আনিস চৌধুরী, ফজলে লোহানী, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ অগত্যার ঘনিষ্ঠ শুভানুধ্যায়ী লেখকসম্প্রদায়। কবিতা-গল্প-উপন্যাস তাঁরা অনেক লিখেছেন, যা লিখেছেন তা সাহিত্যশিল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হয়নি সবগুলো–কিন্তু এজাতীয় রচনা মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকায় আগে প্রকাশিত হয়নি। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ এবং সমকালীন জীবন-চেতনার প্রতিফলক–সঙ্গে সঙ্গে এতদ্দেশীয় তরুণ লেখকদের সমকালীন জীবনচেতনার প্রতিফলন– এই রচনাভাণ্ডার বাংলা সাহিত্যের গতি পরিবর্তনে যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি সংযোজন ঘটিয়েছে এক নতুন রসভাণ্ডারও। মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকায় মানবতাবাদী বালজাঁক ফ্রাঁন্স শ’ গ্রিনিনি হেমিংওয়ে রবীন্দ্রনাথ গোর্কী প্রমুখের রচনা এবং বামপন্থীসাহিত্যিক মার্কসীয়মতাদর্শে প্রভাবিত বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির সহায়ক প্রাণপ্রাচুর্যেভরা তরতাজা সাহিত্য ছেপে পূর্ববাঙলার জনগণের স্বার্থ সংক্ষণের জন্য অগত্যার প্রয়াস ছিল প্রশংসনীয়। একুশে ফেব্রæয়ারির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অগত্যা বিরোধে বিষাদে বিক্ষোভে স্পর্ধিত হয়েছিল। ‘একুশের সংকলনে’ ফজলে লোহানীর একুশসংক্রান্ত কবিতাটির সূতিকাগার অগত্যা। ১৯৫১/১৩৫৮তে অগত্যার ‘প্রথম অসাধারণ সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়। সংকলনটি আজকের প্রথম শ্রেণীর ‘ঈদসংখ্যা’র মত–গল্পেউপন্যাসেকবিতা রম্যরচনায় পড়বার উপযোগী একগুচ্ছ সাহিত্যের সমাহার। মধ্যবিত্ত নব্যনাগরিক জীবনের এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে লেখাগুলোতে। বাঙলাদেশের সাহিত্যেও প্রধান ধারাওতো ওটাই। এই ধারার বিকাশেও অগত্যা সহযাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে। একটি সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছিলেন–আনিস চৌধুরী (প্রশ্ন জাগে), মুসা মনসুর (আবর্ত্তে) ; আবদুল্লাহ জয়নুল আবেদীন (অভিসারিকা)–যা এখনও অগ্রন্থিত। এতে তখনকার সমাজচিত্র ও রাষ্ট্রীয়ভাবনার পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে, আর আছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ‘উপন্যাস’ এবং আলাউদ্দিন আল আজাদ, ‘এক হাজার এক রাত্রি’ শিরোনামে গল্প লেখেন। ম্যাক্সিম গোর্কীর ৯ই জানুয়ারী (ঘরহবঃয ঔধহঁধৎু) শীর্ষক গল্প অনুবাদ করেন রওশনজাহান বেগম। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এবং সমরেন্দ্র দত্ত-র কবিতার শিরোনাম যথাক্রমে ‘যোদ্ধার গান’ এবং ‘কিষাণ কন্যার জন্য’। এইসব নামের ধরণ বা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। গোলাম মোস্তফাকে ব্যঙ্গ করে লেখা কাজী নজরুলের (ছদ্মনাম হলাম মস্ত বাহ, ইয়ে, ইটি)–‘গর্ভবান’ও এই সংখ্যায় ছাপা হয়। উল্লেখ্য, নজরুল-রবীন্দ্র-গোর্কী-একুশে ফেব্রুআরির প্রতি আনুগত্য ও আকর্ষণ আর গোলাম মোস্তফা আকরম খাঁ আশরাফ সিদ্দিকী আলী আহসান (প্রথম সংখ্যায় তাঁর লেখা ছাপা হলেও) প্রমুখ পাকিস্তানবাদী সাহিত্যকদের প্রতি ঘৃণা ও নি:সঙ্কোচ আক্রমণ বা হামলা-প্রচেষ্টা অগত্যায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
অগত্যা’র প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা যেহেতু জ্যৈষ্ঠের পরে আষাঢ়ে প্রকাশিত হয়–সেহেতু প্রথমেই লেখা হয় নজরুল বিষয়ক একটি বিশেষ সম্পাদকীয়। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ই জ্যৈষ্ঠ বা ২৫ শে মে কে ‘জাতির জন্য চরম লজ্জার দিন’ আখ্যায়িত করে লেখা হয় :
‘হে নজরুল, তোমার জন্মদিন ঘিরে আজ যে আঞ্জাম কলকোলাহল আর আলোড়ন জাগছে দেশময়–তাতে ‘তুমি আছ কি নেই সেই প্রশ্নই বারবার লাঞ্ছনার মতো উচ্চকিত হচ্ছে… কতদিন আর বাঁচবে তুমি ? দেখছো না তোমার জীবন আজ আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। ব্যাপক আয়োজন আর সমারোহ সব-কিছুর মধ্যেই রয়েছে তোমার অস্তিত্বের প্রতি একটা নিরঙ্কুশ ব্যঙ্গ। তুমি বেঁচে আছ তবু তোমাকে ছাড়াই আজ তোমার জন্মতিথি উদযাপন করি। অন্ধকার কক্ষে তুমি পঙ্গু-জীবনের শেষ দিন গুণছো, হয়ত তুমিও জাননা আজ তোমার জন্মদিন….. কিন্তু বাইরে দেখ আমরা কি ঘটা করে তোমার জন্মদিন পালন করছি। তুমি আমাদের প্রিয় কবি, তাই তোমাকে ছাড়াই কত আনন্দ, উচ্ছলতা আর কত অনুপ্রেরণা।…কত মাতামাতি করছি আজ তোমার সাহিত্য দর্শন কাব্য নিয়ে সভাসমিতিতে। যারা তোমার লেখা এক পাতাও পড়েনি এমন কত নেতা আজ অভিনেতার বাক্চাতুর্য্যে সভায় দাঁড়িয়ে তোমার দর্শন আর কাব্যের বুলি কপচাচ্ছে ; চেয়ে দেখ মঞ্চের পেছনে আরো কত জন দাঁড়িয়ে আছে তোমার জীবনতত্তে¡র উপর আলোচনা করার জন্যে। হাজার হোক আমরা প্রতিভার দাম দিতে জানি। তুমি এবার তাদের সুযোগ দাও ! কি হবে আর বেঁচে !
হে আমাদের অমর কবি, জানি তুমি বিদ্রোহী, জানি তুমি সৈনিক, জানি তুমি অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ রোধ করার জন্যে উদাত্তকণ্ঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলে। কিন্তু আজ আর কেন? তুমিতো ভালো করেই চেন এ জাতিকে…জানোই ত আমরা ছেঁড়া জুতোর দাম দিই না। তোমার মৃত্যু হোক, আর এক মাইকেলের জন্ম দাও তুমি। নেতারা পাক সুযোগ তোমার উপর কিছু বলবার–করবার যখন কিছু তাদের নেই-ই। আর তোমার বেঁচে থেকে লাভ কি? কৃতঘ্নতা ও নির্লজ্জতার শেষ তুমি কখনই দেখতে পাবে না।‘’
কবি গোলাম মোস্তফা নজরুল ইসলামের রচনাবলির মধ্যে পাকিস্তানের ধ্যানধারণা তমদ্দুনতাহজিব-বিরোধী কাব্যাংশ উপমা অলঙ্কার সংস্কার সংশোধন পরিমার্জন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁদের ‘নওবাহার’ ছিল এর মিডিয়া। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়ার তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। তাই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন অতি-উৎসাহে নজরুলের কাব্যে হিন্দুয়ানীর অনৈসলামিক উপমারূপক কাব্যালংকারের। তাঁর শখ ছিল পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের। এইসব হাস্যকর প্রয়াসের নির্লজ্জ সমালোচনা করতো অগত্যা, আর গোলাম মোস্তফাকে ব্যঙ্গ করা হত ‘গোলমাল’ বা ‘গোলাম কবি’ বলে। মওলানা আকরম খাঁ কে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হতো ‘হুজুরে আকরম’ বলে। পাকিস্তানি মিনিস্টারদেরকেও ঐরূপ ব্যঙ্গ করা হতো। বই-পুস্তক প্রসঙ্গে সমালোচনার স্টাইলের একটি নমুনা পাওয়া যায়–আশ্বিন-কার্তিক ১৩৫৬ সংখ্যার ‘আদ্যোপান্ত’ বিভাগে। গোলাম মোস্তফার ‘বুলবুলিস্তান’ কাব্য-সংকলনের সমালোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয় :
‘সম্প্রতি গোলাম কবির ‘বুলবুলিস্তান’ বাজারে দেখা দিয়েছে। ‘বুলবুলিস্তান গোলাম কবির সঞ্চয়িতা, তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের কুকীর্তির একটি লোকহাসানো সংকলন। ‘বুলবুলিস্তানে’ ১৯১৫… থেকে …. হালে লেখা কবিতার দর্শন পাওয়া যায় এবং এ সঙ্গে এই সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের প্রতিটি স্তরে স্তরে বিকলাঙ্গ যৌনক্ষিপ্ত মানসিক অপ্রকৃতিস্থ মনোভাবের নিদর্শন দেখতে পাই। এক রকম লোলুপ কামনা, উদগ্র বাসনায় ছিঁড়ে খাওয়া-ভাব প্রতিটি ছত্রেছত্রে ছত্রাকার হয়ে আছে গোলাম সাহেবের ‘বুলবুলিস্তানে’।’
‘অগত্যা’ ‘ভদ্রলোকের পত্রিকা ছিল না–একথা কেন বলা হতো বা হয় তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য আদ্যোপান্ত বিভাগ থেকে কবি গোলাম মোস্তফা সম্পর্কে আলোচনার কিছু নমুনা দেয়া যাক:
‘ইদানিং আবার বাংলা সাহিত্যে এক ডাগর ডোগর বাস্তুঘুঘুর আনাগোনা শুরু হয়েছে। অনেক বনবাদাড় ঝেঁটিয়ে অনেক আবর্জনা কুড়িয়ে ইনি আবার নোতুন করে পুনর্জন্মলাভের চেষ্টায় যে আজকাল একটু তৎপর হয়ে উঠেছেন, এঁর সাম্প্রতিক কার্যলাপে তা স্পষ্ট ধরা দিয়েছে…। এই ঘোমটা ঢাকা হ্যাংলা প্রতিভা, যৌনক্ষিপ্ত গোলাম মোস্তফাকে পাঠকদের কাছে রহঃৎড়ফঁপব করতে চাই… এঁর উৎপাত বাংলা সাহিত্যে আজকে নোতুন করে নয়…’ ইত্যাদি। (পৃ-৬)
মওলানা আকরম খাঁর সমালোচনার একটা উদাহরণ প্রথম বর্ষ চতুর্থ-পঞ্চম সংখ্যা (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৫৬) থেকে নেয়া যাচ্ছে :
‘আমাদের হুজুরে আকরাম দুস্রা মুসলীম লীগের অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে বক্তৃতাদানকালে উদাহরণস্বরূপ জানাচ্ছেন যে, এমামের অনুপযুক্ততার জন্য মসজেদ পরিত্যাগ করে নোতুন মসজেদ স্থাপন করা অযৌক্তিক এবং শরামতে নাজায়েজ।” (পৃ-১৪)
‘চিঠিপত্র’ বিভাগে নিজেদের প্রস্তুতকৃত প্রশ্নের মধ্যদিয়ে অগত্যার সাহিত্যশিল্পভাবনার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। মাঝে মাঝে এই রকম প্রশ্নে সমাজসংস্কৃতি ও সাহিত্যশিল্পের সমালোচনা করা হতো :
‘বাংলা সাহিত্যের এক যুগ ছিল যখন গল্প উপন্যাস কবিতার বই বা মাসিক পত্রিকার নাম নিয়ে হৈচৈ হত। কিন্তু আজকের দিনের বিদগ্ধ পাঠক নামের চাইতে বিষয়বস্তুর বাহার এবং রঙের চাইতে অভ্যন্তরীণ সৌগন্ধের জন্যই লালায়িত বেশি। বর্তমান সময়ে পূর্ববাঙলায় শিল্পসংস্কৃতিকে গতিহীন করে তোলার যে হীন চক্রান্ত এবং সর্ব্বোপরি পাঠক ঠকাবার যে জঘন্য মনোবৃত্তি কাজ করে চলেছে তার মূলোৎপাটন করার কাজে অগত্যা একনিষ্ঠ হোক। তাহলেই অগত্যার স্বীকৃতি নিশ্চিত। অগত্যা জিন্দাবাদ।’
অগত্যা’র জবাব :
‘আমাদের সাধনা সত্যের সাধনা। আজ পূর্ববাঙলার বিষাক্ত নাগিনীর ছোবল বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে অগত্যাকে। পূর্ববাঙলার মূর্খতা এবং অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বীরশক্তি দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে যে কটা ব্যবসায়ী কাগজ হস্তমৈথুন আর করাচীর লাট-বেলাট আর ঢাকার পেয়াদা বরকন্দাজদের ছবির বাহার নিয়ে হৈ চৈ বাঁধিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের আয়ু বেশি দিন নেই…..রবীন্দ্র-নজরুল-চণ্ডীদাস-আলাওলের প্রাণের ভাষা কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য নিয়ে নোতুন পথের যাত্রী অগত্যা।…নজরুলের সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটেনি। কবিগুরু ডাক দিয়ে গেছেন অসমাপ্ত কাজের সম্পূর্ণতার জন্য।’
চিঠিপত্র বিভাগের আর এক প্রশ্ন : নাম শুনে মনে হয় পয়সার অভাবে ‘অগত্যা’ নাম রেখেছেন : ভবিষ্যতে পয়সা হলেও কি অগত্যার নাম ‘অগত্যা’ই থাকবে?’ এর জবাবে পত্রিকার কর্মীদের পরিচয় দেয়া হয়েছে : ‘স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই পয়সার অভাব আমাদের যথেষ্ট রয়েছে। অগত্যা বেরোবার আগে ফজলে লোহানী আবু সঈদ নাসির তাসিকুল আলম খাঁ এঁরা সবাই জর্জেট পরে ঘুরে বেড়াত, আর এখন লোহানীর প্যান্টে তালি উঠেছে। নাসিরের জুতোয় ফাটল ধরেছে। তা আ খাঁ লুকিয়ে লুকিয়ে পয়সার অভাবে বিড়ি খায়। প্রেসের মালিক দু-বেলা টাকার জন্য ধন্না দেয়, বিজ্ঞাপনদাতারা পয়সা মারার জিকির তোলে, সিআইডি পেছনে পেছনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। কাজেই নাম শুনে তোমার যাই মনে হোক অগত্যার অবস্থা আশান্বিত।’
‘কদর্য ব্যবহার’ সম্পর্কিত এক প্রশ্ন: ‘ইচ্ছে করলেই আর একটু ভদ্রতার সঙ্গে উল্টর দিতে পারেন’Ñএর জবাবে বলা হয় : ‘ভদ্রতা ? ছিঃ ওসব ফরমালিটি কেন আমরা করতে যাব? ভাল ভাল কথা, মিষ্টিমিহি সখিসখিভাব দেখাবেন তারা যারা আগামীতে ব্যালট বাক্সের আশায় দিন গুণছেন। যেদিন আমি আপনার কাছে ভোট নিতে গিয়ে হাজারো প্রতিশ্রুতি দেব বড় একজন দেশ সেবক সাজব, মানবতার নামে কেঁদে ফেলবো, ধর্ম্মের নামে শহীদ হবো, বিশ্বপ্রেমিকের পার্ট প্লে করবো–সেদিনই আজকের এই কদর্য্য মানসিকতা ছেড়ে আরেকটু ভদ্র হব, বিনয়ী সেজে গলবস্ত্র হয়ে উপযাচক বলে আপনার পা জাপটে ধরে বলবো–জোড়াপায়ে নাথি মারো বাবা, জোড়া পায়ে নাথি মারো, তার আগে আর নয়।’
সাহিত্যের মাধ্যমে সামাজিক চাহিদা নিবৃত্তির প্রশ্নে অগত্যার পরোক্ষ বক্তব্য : প্রশ্ন– ‘সাহিত্যকে যেভাবে আপনারা ঘোষণা করে রাজনীতি থেকে বাদ দিয়েছেন তাতে আমার কিছু বলবার আছে। আরবি হরফে বাংলা ভাষার চর্চা সম্বন্ধে আপনার মতামতটা সম্পদকীয় প্রবন্ধাকারে দেখতে পেলে খুশি হব।’ জবাবে বলা হয়, ‘আমাদের জীবনের সাথে যে রাজনীতি আজ জড়িয়ে রয়েছে সেইটুকুই আমরা অগত্যা মারফত পরিবেশন করতে পারি। আরবি হরফে বাংলা চর্চা অযৌক্তিক, অবাস্তব এবং অগণতান্ত্রিক।’
অগত্যা পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নিউজপ্রিন্টে ছাপা পত্রিকা। এতে বলা হতো যে– ‘সবচেয়ে কম ছাপা হয়, কিন্তু সবচেয়ে বেশী লোকে পড়ে। এই পড়ার কারণ উপরের নমুনা থেকে বোঝা যায়।’ অপ্রাসঙ্গিক বিভাগের শিরোভাগে বন্ধনীমধ্যে লেখা থাকতো–‘শুরু হইতে আখের তক্ তামদ্দুনিক জবানে লিখিত’। এতে ঢাকার বিচিত্র জীবন ও সমাজব্যবস্থা পর্যালোচিত হয়েছে। ফলে এগুলোর মধ্যে তৎকালের সমাজচিত্র পাওয়া যায়। পাকিস্তান হবার পর ঢাকা শহর কর্পোরেশনে রূপ লাভ করে, কিন্তু ঢাকার রাজধানীর অবস্থা ছিল তখন ক্যামন? রেডিও পাকিস্তানের সমালোচনায় তামদ্দুনিক অনুষ্ঠানের সমালোচনা করা হতো। অগত্যার দুটি চরণ দ্বারাই রেডিওর সম্পূর্ণ সমালোচনা করা যায়:–‘আপনি যদি কাউকে রাগাতে চান তবে রেডিওতে ঢাকা কেন্দ্রের প্রোগাম খুলে ধরুন।’ কেন?
‘রেডিও পাকিস্তানের পরিবেশনায় আমাদের পাকিস্তানকে একেবারে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হালে যেসব অকাল-প্রস্তুত আর্টিষ্ট হালে পানি না পেয়ে অযথা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে খাবি খাচ্ছিল তাদের খেদিয়ে নিয়ে এসে বোধ করি ‘আমাদের পাকিস্তান’ নামক খোঁয়াড়ে ঢোকানো হয়েছে। কারণ এদের প্রতিদিনকার অনুষ্ঠানে, যে-কণ্ঠনিনাদ আমরা শুনতে বাধ্য হই তাতে করে সেই ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। বেতারে অভিনয় উপযোগী কণ্ঠের এমন অপূর্ব সমন্বয় আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।’(১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, পৃ. ৩৪)।
রেডিওতে উর্দুঅনুষ্ঠানের বাহুল্যকে মাহেনও-এর উর্দুবহুল পাকজবানের মতো কঠোর সমালোচনা করা হতো। সিনেমা বিভাগে শুধু সিনেমার শিল্পমান নিয়ে আলোচনাই হতো না। সিনেমার নামে ভণ্ডামী করার জন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে খোলাচিঠি লিখে কুকীর্তির মুখোশ উন্মোচনও করা হত।–
‘সকালে বিকেলে তোমরা ইন্টারভিউ করতে বাঙলার সেরা সুন্দরীদের। তোমাদের সকাল আর বিকেল কাটত বেশ আরামে। তোমাদের সে দিনগুলো হয়ত ফিরে পাবার জন্য তোমরা আজ উন্মুখ …কিন্তু সে সঙ্গে ঝরিহফষবৎ-এর দল, এও মনে রেখ যে বাঙলার যেসব ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে তোমরা ছিনিমিনি খেলেছে, তারা তোমাদের পালাতে দেবে না, তাদের হাতে তোমাদের কপালের লিখন নির্ভর করছে। (১/১, পৃ. ৪৩)
অবশ্য নিয়মিত বিভাগগুলোতেই এরকম ব্যাঙ্গাধিক্য ছিল। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধের এবং অনুবাদের ভাষা ছিল সাহিত্যশিল্প গুণান্বিত। তবে সৈয়দ আলী আহসানের প্রবন্ধ ‘পূর্ব-পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রে নির্দেশ’-এর (আষাঢ়, ১৩৫৬) বক্তব্যটি পত্রিকার চরিত্রবিরোধী হয়ে পড়েছিল। মাহেনও (আগস্ট, ১৯৫১) পত্রিকায় তিনি পাকিস্তানের সংস্কৃতির পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই বক্তব্য অত:পর খুব উদ্ধৃত হয়। কিন্তু ১৯৪৯ সনেই তিনি সাহিত্য শিল্প স্থাপত্য-ভাস্কর্য সমস্ত ক্ষেত্রে ইসলামি-ঐতিহ্য নবরূপায়নের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, সে-তথ্যটি উদ্ধৃত হয় না মনে হয় অগত্যার ভ‚মিকার কারণেই। এতে যে তিনি হিন্দু-সভ্যতা-সংস্কৃতি বর্জনের কথা বলেছিলেন তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। হয়তো রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ স্পষ্ট করে নেই বলেই–এই প্রবন্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। অথবা রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের প্রস্তাব সরকারি পত্রিকায় স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছিল বলেই মাহেনও-এর লেখাটি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। এমনও হতে পারে পাকিস্তানি জোস্ ১৯৪৯ সনেও তীব্র ছিল এবং বায়ান্নোর ঘটনা ঘটতে দেরি ছিল। বাঙালির অসা¤প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের চেতনা তখনো জাগ্রত হয়নি বলেই তাঁর এই রচনাটির কথা পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তার ইতিহাসে যোগ হয়না। সৈয়দ আলী আহসান বলেন:
‘নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বিভিন্নদিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক এবং হওয়া উচিত। এতদিন যে জীবন-প্রথা আমরা মেনে আসছিলাম, যে নির্ধারিত পথে চলছিলাম এখন নতুন পটভ‚মিতে তা নতুনভাবে যাচাই করে নিতে হবে। যে উত্তরাধিকার শুধু এক সময়ের জন্য নয়, চিরকালের জন্য আমাদের হতে পারতো সে উত্তরাধিকার আমাদের সৃজন করতে হবে। জীবন-ক্ষেত্রের পরিচিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছে–বিশেষ করে মানবজীবনের বিভিন্ন আদর্শের ধারার। সাহিত্য শিল্প স্থাপত্য সঙ্গীত সমস্তকিছুই নতুনভাবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে এবং নতুন পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নতুন আদর্শে পরিপুষ্ট করতে হবে। এতদিন আমরা পরাধীন ছিলাম এবং সে কারণে স্বভাবতই আমাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত শিল্প-প্রতিভার স্ফুরণ সম্ভবপর হয়নি। আমাদের গতির পথে বাধা এসেছে, আমরা সহজভাবে অগ্রসর হতে পারিনি।’
সৈয়দ আলী আহসান দীর্ঘ আলোচনায় স্পষ্ট করেই বলেন : সাহিত্য ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটি বড় বেশী স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। সাহিত্যিকরাই জাতির জীবনের মান নির্ণয় করে ও নতুন পথের নির্দেশ দেয়। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে সাহিত্য ক্ষেত্রে যে সমস্যা ছিলো নতুন পরিপ্রেক্ষিতে তার সমাধান করতে হবে। সাহিত্যক্ষেত্রে পরিবর্তনের সঙ্গেসঙ্গে শিল্পক্ষেত্রের পরিবর্তনের কথা এসে পড়ে। ভারতে মুসলমানরা এক সময় শিল্প ও স্থাপত্যে যুগান্তর এনেছিলো। সে-যুগান্তর সম্ভবপর হয়েছিল এ কারণে যে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাদের ধারণা ও নির্দেশ ছিলো স্পষ্ট। স্বাধীন মুক্ত আবহাওয়ায় তারা আপনাদের আপনাদেরকে বিকশিত করেছিল নানাভাবে। পূর্বপাকিস্তানের বিস্তৃত সীমারেখার মধ্যে শিল্পের প্রসার ঘটেছে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে। মৃৎশিল্পের হিন্দুয়ানী বৈশিষ্ট্য বর্জন করে মুসলমানি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে হবে। সে যুগকে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কারো পক্ষেই সম্ভবপর নয় এবং কেউ তা কামনাও করেনা। তবে অতীতের গৌরবের কাহিনী আমাদের জন্য নতুন নির্দেশ বহন করবেই। বিদেশি স্থাপত্যের সেই সহজতা আমরা গ্রহণ করে তার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন যদি আনতে পারি, তবে নতুন কিছু করা হবে। আমাদের বিশিষ্টতা আমাদের প্রকাশ করতেই হবে কেননা সেই বিশিষ্টতা প্রকাশের মধ্যেই আমাদের নিজস্ব রূপ ফুটে উঠবে। প্রাচীনকে মুসলমানেরা কখনও অস্বীকার করেনি কিন্তু তার সংস্কার করেছে ও নতুন রূপে তাকে পরিদৃশ্যমান ও পরিবর্ধমান করেছে। মোঘল উত্তরাধিকার আমাদের রয়েছে কিছুদিন আগেকার ব্রিটিশ আমলের স্থপতিগত চেতনা আমাদের রয়েছে এবং বর্তমানে নতুনভাবে নতুন পথ অনুসরণের স্পৃহা আমাদের রয়েছে। সমস্ত কিছু মিলে আমাদের জন্য একটা নতুন নির্দেশ সৃজিত হবেই। এতদিন এটা সম্ভবপর হয়নি কেননা নিজের করে আমরা কিছু ভাবতে পারিনি। এখন নতুন পৃথিবীতে আমাদের জন্য যে নতুন আলো এসেছে সেই আলোতেই আমাদের সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে হবে। তখন দেখতে পাবো যে শুধুমাত্র সাহিত্যক্ষেত্রে নয় শিল্পক্ষেত্রে এবং জীবনের অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীন সত্তা নতুনভাবে জাজ্যল্যমান হয়েছে। (পৃ. ১০-১২)
যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অগত্যা সমাজ-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সমালোচনা করেছে–তার দলিল হয়ে আছে অগত্যার পাতা। কাজী নজরুল ইসলাম জসীমউদদীন আবুল মনসুর আহমদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সুকান্ত ভট্টাচার্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আশরাফ সিদ্দীকী মাহেনও পত্রিকার সম্পাদক মীজানুর রহমান গোলাম মোস্তফা আকরম খাঁ কবি মঈনউদ্দীন বেদুইন শমসের আকবর হোসেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক সম্পর্কে (শেষ পর্যন্ত অনেকের স্বার্থের পক্ষে যায়, আবার কারো বা বিপক্ষে) কৌতুককর বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা অগত্যা বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রকাশ করেছে। অনেক মতামত তাঁদের অভ্রান্ত! কিন্তু ভ্রান্ত বাচালতাও প্রকাশ পেয়েছে কখনও কখনও। আবুল মনসুর আহমদের’আয়না’র সমালোচনা ছাপা হয়েছে রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সৌজন্যে। এটির রচয়িতা অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ। সমালোচকের মতামত পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং ভারসাম্য রক্ষাকারী, অনেকার্থে যথাযথ। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়, তা কি সর্বাংশে অভ্রান্ত বা যথার্থ ছিল?–
‘উপন্যাস হিসেবে অনবদ্য এবং সার্থক হতে পারত ‘লাল সালু’। কিন্তু তা হয়নি। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সতেজ নয় : বিশেষ কোন বৈজ্ঞানিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেও তিনি ‘লাল সালু লেখেননি। উপন্যাসের প্রাণবস্তু হচ্ছে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার প্রসারতা এবং ব্যাপকতার ওপরেই নির্ভর করে স্বার্থক উপন্যাস সৃষ্টির। লেখকের অভিজ্ঞতা আছে যথেষ্ট কিন্তু তা খুব বলিষ্ঠ নয় বলে ‘লাল সালু দ্বিতীর শ্রেণীর উপন্যাস হতে পারেনি।… ওয়ালীউল্লাহ সাহেব কসরত করে অনেক ঘটনা প্রবাহ বের করেছেন ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ মুসলমানের জীবনযাত্রা থেকে। ধর্মের নামে মজিদ যে ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল তা গ্রহণ করল গ্রামের প্রতিটি মানুষ যারা আজ ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের চাইতে অনেক এগিয়ে গেছে সংগ্রামী আহ্বানে। উপন্যাস এখানেই হয়েছে ব্যর্থ।…সচেতনভাবে হোক বা অচেতনভাবে হোক লেখক গতযুগের ফটোগ্রাফিকসাহিত্য রচনা করেছেন। এবং তারাশংকর অচিন্ত্য বনফুলের দলে ভীড় জমিয়ে আগামী দিনের সবল কৃষককে পঙ্গু করে দেবার কাজে হাত দিয়েছেন। ধর্মতন্ত্রের কাছে সত্যিই কী আজ ময়মনসিংহ জেলার তাহের কাদের ছমিরুদ্দীনরা আত্মসমর্পণ করেছে? শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর বাবুর মাষ্টারপিস্ ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ আজ ব্যর্থ উপন্যাসে পরিণত। ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের ‘লালসালু’ও ব্যর্থতার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে দুদিন বাদে।’
সমালোচক তাসিকুল আলম খার আরও মন্তব্য : ‘লেখকের চরিত্র সৃষ্টির ক্ষমতা নেই বললেই চলে। ১৪৮ পৃষ্ঠার মধ্যে একটি চরিত্রও মেলেনা যার ওপর দু কলম লেখা যায় (১/৩ সংখ্যা, পৃ ২২)। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন অদূরদর্শী সমালোচনা পত্রিকার দুর্বলতার দিক। পাশাপাশি আরবি হরফে বাংলা লেখার বিরোধিতা এবং মীজানুর রহমানের (মাহেনও-এর) তামাদ্দুনিক জবানের সমালোচনা অব্যর্থ হয়েছে। ‘চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল বলেই অগত্যা বহুবিষয়ে স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করেছে, তাঁরা প্রত্যাশা করতেন ‘কৃষ্টি আর প্রগতির ব্যাপক প্রসার। তাই সমালোচনা সবগুলো অব্যর্থ নাহলেও সফল হয়েছে অনেকগুলো। হিন্দুমুসলমানের মধ্যে বিরোধ যে পুঁজিপতিদের সৃষ্ট তাও কবিতা-প্রবন্ধে ব্যক্ত হয়েছে। আতাউর রহমানের কবিতা ‘হিন্দু-মুসলমানে’র কটি লাইন :
‘বুঝেছি তোমরা স্বার্থের তরে সকলি করিতে পার/দাঙ্গা যুদ্ধ আকালে সৃজিয়া ভূখা জনগণে মার,/বুঝেছি আজিকে তোমাদের যত ভণ্ডামি/চালবাজি তোমার জীবনে সত্য কেবল মুনাফার কারসাজি/ভণ্ডামী আর চালাকি শঠতা ধরা পড়িয়াছে আজ,/তোমার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে তাই জনতার ক্রোধবাজ।’ (চৈত্র-বৈশাখ, ১৩৫৭)
সাহিত্য ও সংস্কৃতিচিন্তায়, সামাজিকভাবনার গভীর প্রতিফলন অগত্যার আলোচনা-প্রবন্ধ-উপন্যাস ও গল্পগুলোর প্রধান উপজীব্য। ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৪৬), নির্বাচন (১৯৪৬), দেশ বিভাগ (১৯৪৭) এবং বিভাগোত্তর কৃষ্টিগত ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী হামলা, আরবী হরফে বাংলা লিখন প্রচেষ্টা (১৯৪৯), রাষ্ট্রভাষারূপে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ (১৯৪৮-৫২), লবণ সংকট (১৯৫১), সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৫০) উদ্ধান্ত সমস্যা, রেডিও-সংবাদপত্রে বিশুদ্ধ বাংলার পরিবর্তে উর্দুপ্রধান পাক-বাংলার প্রচলন, এমনকি ঢাকার বেতারেও অধিকাংশ সময় উর্দু অনুষ্ঠানের বাহুল্য–সবকিছু অকপটে ‘অগত্যা’য় সমালোচিত হয়েছে।
বাঙালির কৃষ্টি সভ্যতা ভাষা ও জাতির নিজস্বতা রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা তাঁরা করেছেন। উদ্যোক্তারা বয়সে তরুণ ছিলেন, ‘সীমান্ত’ প্রভৃতির সম্পাদকও ছিলেন তরুণ। অধিকাংশ মুসলিম লীগার পাকিস্তানবাদী ভণ্ড ইসলামপন্থীদের মধ্যে এঁদের প্রচেষ্টাকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য যে ব্যঙ্গ-কৌতুকের সাহায্য নেয়া হয়েছিল, তার অজুহাতে একে ‘অভদ্র’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও এই ‘অভদ্রতা’ করার সৎসাহসটুকুই বা ক’জন তখন দেখাতে স্বীকৃত ছিলেন। অভদ্রতা, বেয়াদবির একটা দায় আছে। সেই দায় বহনের কষ্ট কে নিতে রাজি ছিলেন? হিসেবী কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকেরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন, আর কোন দিকে গেলে ক্ষতির সম্ভাবনা–সেই অংক কষছিলেন যখন, তখন কতিপয় তরুণ যে উৎসাহ নিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলেন এবং তখনকার পরিস্থিতিতে লেখকদের অতৃপ্ত শিল্প-সৃষ্টির এবং গ্রহীতার শিল্পরসপিপাসার আকাক্সক্ষা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে অগত্যা যুগের দাবি পূরণ করেছিল, কালের চাহিদা মেটাতে প্রয়াসী হয়েছিল–এই অভিপ্রায়ের মূল্যই তো অনেকখানি। কতোটা করেছিল সেটার পরিমাপ না করলেও তাই ক্ষতি নেই। মার্কসবাদের ডেডিকেটেড কর্মী আতাউর রহমান লিখেছেন :
‘অগত্যা’কে একটি কারণে স্মরণ করতে হবে। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশবিভাগের পর সেই জাতীয়তাবাদ আমাদের রাজনীতিতে সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাহজিব ও তমদ্দুন ছিল সেদিনের স্বাভাবিক ভাষা। সেই সময়ে আমরা অগত্যায় লিখতাম–বাঙালি মনোভাব নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে। দ্বিতীয়, পূর্ববাঙলায় তখন যারা বামপন্থায় ভাবতো, লিখতো তাদের লেখা প্রকাশের সুযোগ তখন ছিল না। ‘অগত্যা’ এই সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। আজকে যারা বাংলাদেশে সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও উজ্জ্বল তাঁরা প্রায় সবাই অগত্যার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কবি শামসুর রাহমান, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরÑএঁদের প্রথম জীবনের অনেক লেখাই অগত্যায় প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের আত্মপ্রকাশের দুটো মাধ্যমে ছিল–একটা অগত্যা–আর একটি সাহিত্য বৈঠক-যা প্রথমে বসতো মধুর রেষ্টুরেন্টে।”৬
তথ্যপঞ্জি
১. ড. আহমদ শরীফ ‘অগত্যা’ সম্পর্কে বলেন : ‘অগত্যা ভদ্রলোকের পত্রিকা ছিলনা।’ আতাউর রহমানের ‘অগত্যা এবং আমরা কয়েকজন’ প্রকাশিত হয়–দৈনিক বাংলা, ৯ কার্তিক ১৩৯৮ তারিখের সাহিত্যের পাতায়। স্মৃতিকথায় লেখা হয়েছে প্রথম পরিচয়কালে পত্রিকার কর্মী তাসিকুল আলম খাঁকে তিনি বলেছিলেন: ‘ফাজলামিতে ভরা আর নামটাতেই আমার আপত্তি আছে ‘
২. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা, ঢাকা ১৯৮৭, পৃ. ১৩৩
৩. হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি (১০৫৩)-তে ফজলে লোহানী, আতাউর রহমান ও আনিস চৌধুরীর কবিতা আছে।
৪. আতাউর রহমান, পূর্বোক্ত।
৫. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আনিসকে দেখছি, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০শে কার্তিক ১৩৯৭।
৬. মধুর রেষ্টুরেন্টের পরিচয় প্রদানের প্রয়োজন পড়ে না।