মহিবুর রহিম
‘জন্মেছিলাম এক দ্বীপদেশে। মনে হতো যেন
নগ্ন এশিয়ার লতাগুল্ম ঘেরা সপ্রতিভ নাভিতে
একটি সোনালি পাখি আমি। কিংবা একটি
রূপোলি মাছ। যে স্বাদুজলে সাঁতার কাটতে কাটতে
এখন কানকোতে নুনের স্বাদ লাগাতে
লাফিয়ে পড়বে সমুদ্রে।’
কিংবা
‘হাতির পালের মতো মেঘের গম্বুজ নিয়ে কাঁধে
নগ্ন হয়ে নেমে আসে আষাঢ়স্য প্রথম দিবস
বাংলার আকাশ জুড়ে মেঘ আর রোদের বিবাদে
বাতাসও বুঝতে নারে, এ কামিনী কবে কার বশ;’
এমন অজস্র স্মরণীয় স্বর্ণালি পঙক্তির রচয়িতা কবি আল মাহমুদ। যাকে মোটা দাগে বলা হয়ে থাকে ‘সোনালি কাবিনের কবি’। তাঁর সাফল্যের খাতায় শুধু ‘সোনালি কাবিন’ নয়, আছে অঢেল সৃষ্টি সম্ভার। একজন প্রখ্যাত সমালোচক বলেছেন ‘তিনি এক বিরলপ্রজ প্রতিভা।’ তার কবিতা মন্ত্রের মতো পাঠ করা যায়।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে’ কিংবা ‘ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ / দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়/ বরকতের রক্ত’ কিংবা ‘গ্লোবের পেটে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না/ বিশ্বগোলক ফুঁপিয়ে ওঠে আর পারি না আর না’
এই স্বভাব সৌন্দর্যের কবিতা শুধুমাত্র আল মাহমুদের দ্বারাই লেখা সম্ভব!
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের একটি পরিপূর্ণ যুগ। সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে আমি উপলব্ধি করি, মাত্র অল্পকয়েকজন কবি এরকম পরিপূর্ণ যুগ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। যারা ধারাবাহিকভাবে বাংলা কবিতা অধ্যয়নের সঙ্গে যুক্ত তারা জানেন. শিল্পসফল কবিতার জগতটি খুব পরিসর স্থান নয়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে একথাটি আরও বেশি সত্য। আধুনিক নন্দনতত্তে¡র বিবেচনায় যে স্বল্প সংখ্যক কবিকে শিল্প সাফল্যের গৌরব প্রদান করতে হয়–আল মাহমুদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বাংলা সাহিত্যে আল-মাহমুদের আগমন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। সূচনাতেই তাঁকে দেখা যায় প্রবল প্রতিশ্রুতিশীল ও সপ্রতিভ। তিনি একটি অসাধারণ ভাষা ভঙ্গিতে তাঁর কবিতার অবয়ব গড়ে তোলেন। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম অধ্যায় ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের কবিদের সাফল্যের পর আল মাহমুদের এই স্বতন্ত্র অবদান প্রকৃতপক্ষে অসম্ভবকেই সম্ভব করে তোলা। যাকে অনেকে বলেছেন বাংলা কবিতায় অসাধ্যসাধন।
লোকায়ত প্রাঞ্জল সতেজ ভাষা সমেত আল মাহমুদের কবিতা যে ভিন্ন স্বাদ নিয়ে এলো তাকে অনেকে বলেছেন ত্রিশোত্তর আধুনিকতার পরিপূর্ণ রূপায়ণ। বহুদিক থেকে আল মাহমুদের কবিতার ব্যাপক বিশ্লেষণ হয়েছে। একথা সকলেই স্বীকার করেছেন তাঁর কবিতা ত্রিশোত্তর সাফল্যের সূচক। তিনি আধুনিকতার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব দক্ষতায় দেশজ চেতনার মেল-বন্ধন ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পূর্ববঙ্গের আবহমান প্রকৃতি, জন-মানুষ, সম্ভাবনাময় লোকায়ত সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে অধুনিকতমধারায় বাংলা কবিতায় এক অসাধারণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। এই সাফল্য বাংলা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠদের দৃষ্টিকে মুগ্ধ করেছে, শৈল্পিক আস্বাদে উদ্বেলিত করেছে।
আল মাহমুদের প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম এই গ্রন্থেই তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা জানিয়ে দিছেয়েন। যা ইতোপূর্বে অল্প কয়েকজন কবির পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ‘লোক লোকান্তর’ একটি মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ‘লোক লোকান্তর’ সম্পর্কে কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ লেখেন–‘তাঁর নিচু কণ্ঠস্বরে তিনি তাঁর অনুভবের কথা, তাঁর পারিপার্শ্বিক কম্পমান অগ্রসরমান জীবনের কথা বলে গেছেন।…. এক সুস্থ-স্বস্থ-স্বচ্ছ আত্মকেন্দ্রিক, জগতের অধিবাসী এই কবি সযত্ন ও পরিচ্ছন্ন ছন্দ ও ভাষার অধিকারী।’ (‘সমকাল : কবিতা সংখ্যা, ১৩৭১-৭২)। শহীদ কাদরী লিখেছেন–‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতার দ্রাঘিমা চিহ্নিত করতে গেলে যে কাব্যগ্রন্থটির কাছে আমাদের বার বার ফিরে যেতে হবে সেটি আল মাহমুদের ‘লোক লোকান্তর।’ বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ আর আল মাহমুদের ‘লোক লোকান্তর’ একসঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে যে কোন পাঠকই অনুধাবন করতে পারবেন বাংলা ভাষার প্রকৃত শুদ্ধতম কবি আল মাহমুদই। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ ‘কালের কলস’। সেখানেও আছে তাঁর দীপ্ত ও বলিষ্ঠ কাব্যিক উত্তরণ। মাত্র দুটি কবিতা গ্রন্থের জন্য আল মাহমুদ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক। যা ছিল তাঁর মাইলফলক সাফল্য। অনেকেই ধারণা করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছে। ত্রিশের আধুনিকতার অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে স্বদেশমনস্ক প্রকৃত প্রতিভাধর কবির প্রয়োজনীয়তা অনেকে অনুভব করেছিলেন। আল মাহমুদ সে অভাব পূর্ণ করেছেন। আল মাহমুদের কবিতা দুর্বোধ্যতার জটিল গ্রন্থি থেকে মুক্ত, অথচ অভিনব শিল্পের মোড়কে গ্রথিত।
১৯৭৩ সালে তাঁর বহুল আলোচিত কবিতাগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে যে বইটিকে আল মাহমুদের অবিস্মরণীয় সাফল্যের স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যের আগ্রহী পাঠকদের কাছে ‘সোনালি কাবিন’ অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠে। নির্ভার, প্রাঞ্জল ভাষা ও ছন্দে রচিত এমন অসাধারণ কাব্যভুবন, বাংলা কবিতার প্রতি পাঠকের আস্থাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকায় গোলাম মুরশিদ লেখেন–‘আল মাহমুদের ভাষা একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব। যে মগ্নচৈতন্য থেকে ভোরের সহজ আলোর মতো তাঁর অনুভূতি ঝরে পড়ে, তারই উপযোগী ভাষা তাঁর আয়ত্বাধীন। আলো আঁধারী ভাষায়, আভাসে ইঙ্গিতে তিনি তাঁর হৃদয়ের কথা আধখানা ব্যক্ত করেন….. পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ প্রবচনকে আধুনিক কোনো কবি সম্ভবত এমন নিপুণ ও ভাষা শৈল্পিক ভঙ্গিতে ব্যবহার করেননি।…. প্রকৃতপক্ষে, তিনি কাব্যের ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন।….. আল মাহমুদ অত্যন্ত সংবেদনশীল, সচেতন ও বিদগ্ধ শিল্পী, তাঁর উপলব্দির গভীরতা জসীমউদ্দীনের তুলনায় অতলস্পর্শী। তদুপরি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত– ছন্দের এই ত্রিবিধ চলনেই আল মাহমুদের স্বচ্ছন্দ বিহার অনেকের কাছেই ঈর্ষার বস্তু হতে পারে। (পূর্ববাংলার সাহিত্য: কবিতা ‘দেশ, ১০ জুলাই-১৯৭১)
কার্যত হয়েছেও তাই । আল মাহমুদের সপ্রতিভ উত্থান শুরু থেকেই একটি মহল স্বাভাবিকভাবে নেননি। তিনি প্রবলভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঈর্ষা দ্বারা আক্রান্ত হন। কিন্তু প্রকৃত কবিকে কোন কিছুই দমিয়ে রাখতে পারে না। যেমন পরগাছা পারে না কোন মহীরুহকে দমিয়ে রাখতে। আল মাহমুদের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটেছে। প্রবল বৈরীতাকে ঠেলে তার একাকী এগিয়ে চলা, শুদ্ধ কবিতার স্বার্থে আর নতুন শিল্পের প্রয়োজনে। তিনি বাঁক নিয়েছেন। কিন্তু আপোষ করেননি। বাংলার স্রোতবাহী নদীর মতো গতিশীল প্রাণবন্ত এক ভাষায়, সজল সবুজ মায়াবী এক কাব্যভুবন গড়ে নিয়েছেন তিনি। আল মাহমুদ লিখেছেন–‘পরাজিত নই নারী পরাজিত হয় না কবিরা।’ কবির এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তৈরি হয়েছে নতুন মিথ। বাঙালি পাঠকমাত্রই খুঁজে পেয়েছেন জাতির সংগ্রামী সত্তাকে। যা আবহমান এবং মুক্তিকামী। সমৃদ্ধ লোকজ ঐতিহ্যে মোড়ানো যার জীবন বিশ্বাস।
আল মাহমুদের দুঃসময়ে যারা তাঁর পক্ষে কলম ধরে ছিলেন, ওপার বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিত্তাবিদ ড. শিবনারায়ণ রায় তাদেরই একজন। তিনি তাঁর ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার মাধ্যমে আল মাহমুদের পক্ষে একটি বড় অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি কবি ও কবিতার স্বার্থে আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে অনেক সমালোচনারও জবাব দেন। আল মাহমুদের কবিতা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন–‘আল মাহমুদ শুধু শক্তিমান কবি নন, এদিক থেকেও তাঁর কাব্য সাধনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। তাঁর উপজীব্যে বাক প্রতিমা সংযুক্তিতে নাগরিকতা এবং আঞ্চলিকতার টানাপোড়েন অনেক সময় জামদানি শাড়ির কথা স্মরণে আনে। তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী, কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদলজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগড় তাঁর টোটেম। … পঁচাত্তর সালে আল মাহমুদের সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হবার আগে থেকেই আমি তাঁর কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক। …আমার মনে হয়েছে যে বাংলা কবিতায় তিনি নতুন সম্ভাবনা এনে দিয়েছেন। পশ্চিমবাংলার কবিরা যা পারেননি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন, আঞ্চলিক ভাষা, অভিজ্ঞতা, রূপাবলীকে তিনি নাগরিক চেতনায় সন্নিবিষ্ট করে প্রাকৃত অথচ ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ এক কাব্য জগৎ গড়ে তুলেছেন। জসীমউদদীন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকেই তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মান স্বকীয়তাই তঁকে আধুনিক কবিতার জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে।’ ( একজন খাঁটি কবি/ শিবনারায়ণ রায়)
কাব্যচর্চার শুরুতেই আল মাহমুদ বুদ্ধদেব বসুর মতো প্রতিভাধর কবি ও সম্পাদকের দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু আল মাহমুদের কিছু কবিতা তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এটি ছিল আল মাহমুদের প্রতিভার পক্ষে একটি বড় স্বীকৃতি। ষাট ও সত্তরের দশক থেকেই আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে এদেশে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনার সূত্রপাত হয়। আল মাহমুদকে দমিয়ে রাখার প্রবণতাও শুরু হয় সেই সময় থেকেই। তাঁকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। সাহিত্যের জগতে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিভাহীন এই গোষ্ঠিটি কবির বিকাশের পথে হাজার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও চরমভাবে নিরাশ হয়েছে। আল মাহমুদকে বিতর্কিত করার সব প্রচেষ্ট ব্যর্থ করে দিয়েছে প্রধানত এদেশের পাঠক শ্রেণি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে আল মাহমুদের মতো জনপ্রিয়তা অন্য কোন কবির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত মূলধারার আলোচক ও সমালোচকগণ আল মাহমুদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তারা কবিকে রাজনৈতিক কারণে বর্জন করার যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন–’ আল মাহমুদের কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করায় অনেক বাংলাদেশী পাঠক আমাকে পত্র লিখে জানান যে আল মাহমুদ বর্তমানে ইসলামপন্থী প্রচারক হয়ে উঠেছেন। যে তিনি সরকারের সমর্থক ও প্রগতি বিরোধী, যে সেই কারণে তার প্রতি আমার মত র্যাডিক্যাল মানবতন্ত্রীর অনুরাগ অযৌক্তিক ও অসঙ্গত। আমি আল মাহমুদের পাঠানো আরেকগুচ্ছ কবিতা ‘জিজ্ঞাসা’ তৃতীয়বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশ করি এবং পাঠক-পাঠিকাদের জানাই যে, কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অংশভাক অথবা তাঁর বিবিধ ক্রিয়াকলাপের সমর্থক না হয়েও তাঁর কবিতা উপভোগ করা সম্ভব বলেই আমি মনে করি। অনুভববের সততা, কল্পনার মৌলিকতা, শব্দ ব্যবহারের দক্ষতা, উপমা ও ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমার উদ্ভাবনা শক্তি যাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ তাঁর বিশ্বাস ও ব্যবহার যাই হোক না কেন তাঁর কবিতায় সাড়া দেওয়া কব্যানুরাগীর পক্ষে স্বাভাবিক। ( একজন খাঁটি কবি/ শিবনারায়ণ রায়)
জীবনের স্বাভাবিক দ্বন্দ্বের মতো সাহিত্যেরও নিজস্ব কিছু দ্বন্দ্ব আছে। যেহেতু সাহিত্য জীবনেরই অংশ। কোন কবি বা লেখকই এই দ্বন্দ্ব থেকে বিমুক্ত নন। রবীন্দ্রনাথ তার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন-‘মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব কে না জানে চিরকাল আছে/ সৃষ্টির মর্মের কাছে।/না যদি রহে বিশ্বঘেরি/ বিরুদ্ধ নির্ঘাৎ বেগে বাজে না শ্রেষ্ঠের জয়ভেরী।’ মধুসূদন কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা ফররুখ আহমদ সাহিত্যের স্বাভাবিক দ্বান্দ্বিক পটভূমি পার হয়েই আমরা তাঁদের আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারি। উপভোগ করতে পারি তাঁদের সাহিত্যের শিল্পনির্যাস। পঞ্চাশোত্তরকালে সবচেয়ে সমালোচিত কবি আল মাহমুদ। শুরু থেকেই প্রবল বৈরিতার পাথর সরিয়ে তাঁকে সামনে এগোতে হয়েছে। বৈরিতাকে তিনি এক ধরণের বাস্তবতা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। ফলে তাঁর ক্ষেত্রে সবই শাপে বর হয়ে উঠেছে। যতটা সমালোচিত তারও অধিক প্রশংসিত এই কবি।
আল মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনার সূত্রপাত হয় ১৯৭৬ সালে তাঁর ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশের পর। এই কবিতাগ্রন্থে কবির ব্যাপক একটি বাঁক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ বইয়ে তাঁর আদর্শিক অবস্থান বদলে যায়। সেই সাথে কবিতার ভাষা ও শৈলীতে আসে পরিবর্তন। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ থেকে ‘আমি দূরগামী’ পর্যন্ত আটটি কবিতাগ্রন্থে আল মাহমুদ নিজেকে আরও ভিন্নভাবে মেলে ধরার চেষ্টা করেন। পরিপূর্ণ কবির মতোই অনেক কিছু বদলে ফেলেও শিল্পের বিষয়ে তিনি আপোষ করেননি। তিনি যে আত্মস্থ আধুনিকতার মর্মমূলে প্রকৃতি শোভিত লোকায়ত চেতনার গতিশীল প্রাণবন্ত ভাষাকে রপ্ত করেছিলেন এ পর্বে তা আরও উদ্ভাসিত হল। শুধু তাই নয় কবিতা রচনার শুরুতেই তিনি যে প্রধান তিনটি ছন্দে অনায়াস দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তার সঙ্গে যুক্ত হল গদ্যের গীতল ছন্দ। যা আজও তাঁকে বিশিষ্টতার আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে। যারা আল মাহমুদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে রেখেছেন তারাও স্বীকার করেন তাঁর কবিতার ভাষা বৈশিষ্ট্য, ছন্দের সফল বাঁধুনি, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার নতুনত্ব তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এসব প্রসঙ্গকে স্মরণে রেখেই ড. শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন–‘পরিবর্তন জীবনের লক্ষণ; অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তির চাইতে পরিবর্তন সততই কাম্য। কিন্তু বিশ্বাস জিগির হয়ে দাঁড়ালে তার মুখ মস্কোর দিকেই হোক আর মক্কার দিকেই হোক ফল কবিতার অপমৃত্যু।… আমার ধারণা যেহেতু আল মাহমুদ হাড়ে মজ্জায় কবি, ধর্ম বিশ্বাস বা রাজনীতি তাঁকে জীর্ণ করতে পারবে না। যার রক্তের মধ্যে একটি সজনে গাছ ; ভ্রুর মধ্যে একটি পাখি, মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা হারালেও প্রতিটি রঙের মধ্যে অন্য রঙ না দেখে তাঁর উপায় নেই।… আমার সমকালে বাংলাভাষায় যে অল্প কয়েকজন খাঁটি কবি দেখা দিয়েছেন আল মাহমুদ তাঁদের ভিতরে একজন।….. আল মাহমুদ গল্প লেখেন, আত্মজীবনী লেখেন, একসময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন, সাম্প্রতিককালে তাঁর ধর্ম বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করে থাকেন, কিন্তু পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত তিনি একজন জলজ্যান্ত কবি। (একজন খাঁটি কবি/ শিবনারায়ণ রায়)
আল মাহমুদের কবিতায় তৃতীয় বাঁক পরিবর্তনটি ঘটে সম্ভবত তাঁর ‘একচক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯) কবিতাগ্রন্থ থেকে। কবিতাকে তিনি যে সবুজের গাঢ় গন্ধ যুক্ত বাকল পরিয়ে দিয়েছিলেন, আর ভাষার গভীরে স্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশের আবহমান নদীদের স্রোতের গতি। এবার তিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই অধ্যাত্মচেতনার অপার্থিব অনুভবকে তাঁর হাতের তালুতে তুলে নিলেন। ভাটি বাংলার মানুষের ধর্ম ও ভাবান্দোলনকে উন্মুল আধুনিকতার অগ্রসর পটভূমিতে স্থাপন করলেন। উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম পুরুহিতের আসনটিও আধিকার করলেন আল মাহমুদ। একটি পরিপূ কবিতাযুগের অধিশ্বর তিনি। তাই নিজেই ঘোষণা দিলেন ‘আমি সীমাহীন যেনবা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো’।