১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ’জলের নূপুর’। অর্কেষ্ট্রা প্রকাশনী, বগুড়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রকাশক ছিলেন ষাটের কবি রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৯৯৪ সালে। প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ছিলো বলতে গেলে অম্ল-মধুর। অনুভূতিও তাই। কারণ বইটি যেভাবে প্রকাশ করার কথা সেভাবে আমার মনঃপূত হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই,মনে হয়েছে আমার প্রথম সন্তানকে যেন অবহেলার সাথে ভূমিষ্ট হয়েছে। যার ফলে আমার অনুভূতিকে আপ্লুত করতে পারেনি। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরবর্তী বই যদি প্রকাশ করি আমার নিজের প্রকাশনা থেকে বই প্রকাশিত করবো। করেছিও তাই। আমার এ্যালবাম এবং টোঙ প্রকাশনী থেকে অধিকাংশ বই প্রকাশ করেছি।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
এ এক কঠিন প্রশ্ন। তবে যেহেতু আমি মধ্য সত্তর থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত, এবং সত্তর দশক তখন ছিলো দেশে অসম্ভব অস্থির পরিবেশ, একই সাথে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের যুগ ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাল, সঙ্গত ভাবেই সত্তরে দ্রোহ-চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। পরবর্তীতে আমার নিজস্ব মতামতকে প্রধান্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। এবং করে যাচ্ছি। কালকে সামনে রেখে নিজের মতামত প্রতিফলন ঘটানো যদি উত্তরাধিকার বলা হয়, তবে নিজের মতামতকেই বলি ।
৩. এ যাবৎ আপনার কতোটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি যা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি মনে করেন?
গত চার দশকের অধিককালে মাত্র দশটি কাব্যগ্রন্থ ও দুটি ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত হলো ’কবিতা সমগ্র’। ভাবলাম যদি না করতে পারি– সময়তো ঘনিয়ে আসছে। তো, করে ফেললাম। জানি না পাঠক কিভাবে গ্রহণ করবে। তবু নিজের প্রশান্তির জন্য, বলা যায় নিজের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ভেবেই ‘কবিতা সমগ্র’ করে নিজেকে হালকা লাগছে। সঙ্গত কাণেই আমার সদ্য প্রকাশিত ’কবিতা সমগ্র’কে আমার উল্লেখযোগ্য বই মনে করছি। কারণ কবিতা সমগ্রে আমার সবগুলো প্রকাশিত কবিতার বই রয়েছে। যা প্রিয় পাঠকগণ তাঁদের পছন্দ কবিতা বেছে নিতে এবং মূল্যায়ণ করতে পারবেন।
৪. আপনি নিজেকে কোন দশকের লেখক বা কবি বলেন? কেন?
আমাদের দেশে দশকওয়ারির চল চালু আছে শুরু থেকেই, সে হিসেবে আমি মধ্য সত্তর দশকের কবি হিসেবে নিজেকে ভাবতে স্বাছন্দ্য বোধ করি। কারণ আমরা যখন কবিতার অঙ্গনে আসি তখন সারা দেশে এক অস্থির সময় বিরাজ করছিলো। সঙ্গত কারণেই সেই অস্থির সময়কে কবিতায় ধরে রাখতে লিটল ম্যাগাজিনগুলো নিজেদের দ্রোহ ও অন্তর্যন্ত্রণা প্রকাশ করেন।
৫.আপনার সমকাল নিয়ে কিছু বলুন।
কোন এক প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা বলেছি– আমার বা আমাদের সমকাল ছিলো, বেশ উত্তাল, উত্তাল রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে। এই পরিবেশের মধ্যে আমরা যারা সাহিত্যে বিচরণ করেছি, স্বাভাবিকভাবেই সেইসব পরিবেশের উত্তাপ হাওয়া আমাদের সাহিত্যে প্রতিফলন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সময় বা সমকাল এর বাহিরে যাবে ভাবাও অবান্তর। তখনকার কবিতা বা লিটল ম্যাগাজিনগুলো চোখ বুলালে দেখা যাবে সেই অস্থির হাওয়ার প্রতিছবি। আমার সমকালের সব তরুণদের কবিতায় বা সাহিত্যে দ্রোহ বা বিদ্রোহের ঘটনা প্রবাহ লিখিত হয়ে আছে। আমি বলতে চাইছি সেই ভয়াবহ কালকে আমরা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি ভবিষ্যত প্রজন্মের কছে। কতোটুকু তুলে ধরতে পেরেছি, সময়ই একদিন তার মূল্যায়ণ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
৬.সাম্প্রতিককালে কারা ভালো কবিতা লিখছে বলে মনে করেন?
সাম্প্রতিককাল বড়ো এলোমেলো ধুয়াশায় আক্রান্ত। বলয়ে-বলয়ে বিভক্ত। প্রায় লেখক বা কবিরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পা-চাটা দলের এবং আর্থিক লাভের খতিয়ান নিয়ে ব্যস্ত। দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে ক্ষমতাসীনদের বন্দনায় বুদ হয়ে আছে। এর ভেতরে দু-একজন যে মূলধারার বা প্রকৃত সাহিত্যচর্চা করছেন না তা নয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সায়ীদ আবু বকর, রহমান হেনরী, রহমান ওয়াহিদ, হাসান আল জামী, ফজলুল হক তুহিন, মাহফুজুর রহমান আখন্দ, শহীদ ইকবাল, খালিদ আহসান, নাজীব ওয়াদুদ, মঈন সেখ, মনসুর আজিজ, আনোয়ার কামাল, মাহমুদ কামাল, কাজী মুস্তফা, সোহেল মাহবুব–এরকম আরো কিছু লেখক-কবি খুঁজে পাওয়া যাবে– যাঁরা প্রকৃত অর্থে সাহিত্যে নিবেদিত আছেন বা থাকতে চান।
৭. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
আমি বাংলাদেশের উত্তরের ছোট্ট জেলা শহর বগুড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। তার আগে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা ও চাকরির সুবাদে প্রায় চল্লিশ বছরের অধিক কাল ছিলাম। আমার স্ত্রী-ও সেখানে একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আমার একমাত্র মেয়ে মৌলীর জন্ম-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে [ইংরেজি সাহিতে অনার্সসহ এম.এ], তার বিয়ে সবকিছু রাজশাহী থেকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। দুজনেই চাকুরি থেকে অবসরের পর আমার আঁতুরভূমি বগুড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছি।
৮. স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্য কোন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে–হচ্ছে– বলে আপনি মনে করেন?
আমি মনে করি–স্বাধীনতা পূর্বের সাহিত্য ছিলো প্রায় ইসলামি মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে প্রবাহিত হতো। সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, মীর মোশাররফ হোসেন, ইসহাক খান, সিকান্দার আবু জাফর– এইসব স্বনামধন্য কবি-লেখকদের রচনা যদি আপনি পড়েন অবশ্যই আপনার অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্য বলেই মনে হবে। পরবর্তীতে আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, ফারুক সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান এঁদের সাহিত্য বা কবিতা কবিতায় স্বাধীনতার উত্তাল সময়ের শব্দ-তরঙ্গ লক্ষ্যনীয়। এমন কি রফিক আজাদ, মুহম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ সবাই কবিতা সাহিত্যে স্বাধীনতার বীজ বা ভিত্তি রোপন করেন। যা আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের জন্য সহায়ক বলে আমি মনে করি। কিন্তু আশি দশকের পর থেকে আমাদের কবিদের কবিতা ভাবনা বা কবিতা ভাষা পাল্টাতে থাকে। বর্তমান সময়ে কবিতার ভাষা তো এককেন্দ্রিক লক্ষ্য করা যায়। তারা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক খোলসে, বলতে গেলে ব্যক্তি বন্দনায় ঢুকে পড়েন। যা এখনো অব্যাহত আছে।
৯. আপনি কখনো কি কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
আমি বলতে গেলে ১৯৭৬ সাল থেকেই পত্রিকা সম্পাদনার সাথে জড়িত। বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিনের সাথে জড়িত। আমি ও অকাল প্রয়াত রায়হান রাহমান ছড়ার কাগজ ‘ইতিল বিতল’ দিয়ে শুরু করেছিলাম আমাদের সাহিত্যের যাত্রা। তারপর ছড়ার ভুবন থেকে বেরিয়ে কবিতার বৃহৎ অঙ্গনে ঢুকে পড়ি। সম্পাদনা করি গল্পের কাগজ অনড়, যুগল জানালা, [যৌথ সম্পাদনা] ১৯৭৮ সালে ষাটের কবি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাথে সম্পাদনা করি বগুড়ার প্রথম ১২জন কবির কবিতা সংকলন ’স্বনির্বাচিত’। ‘এ্যালবাম’ মূলত বগুড়া কবিতা সংসদের মূখপত্র ছিল। কবিতা সংসদ বিলুপ্ত হলে এর দায়িত্ব আমি এককভাবে গ্রহণ করি। ১৯৭৮ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেধাবী সত্তরের কবিদের সাতটি করে কবিতা নিয়ে সম্পাদনা করি ‘এ্যালবাম’ প্রেমের কবিতা সংখ্যা। ঢকিা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ–এর চৌদ্দজন কবির কবিতা এসংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শুরু হয় তখন থেকেই এ্যালবামের পদযাত্রা। মাঝে অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যৌথ সম্পাদনায় [ কবি জুলফিকার মতিন, শামসুল আলম সরদার, অনীক মাহমুদ,পূরবী যাফর ও আমি] বেশ কয়েকটি সংখ্যা ‘পাণ্ডব’ নামের একটি পত্রিকা বা ছোটকগজ সম্পাদনা করি। সেটিও বন্ধ হয়ে গেলে, কবি আরিফুল হক কুমার, শফিকুল আলম শফিক আর আমি সম্পাদনা করি ’টোঙ’। টোঙ কয়েক সংখ্যা বের হবার পর বন্ধ হয়ে গেলে আবার ফিরে আসি এ্যালবাম-এ। বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন যে, ‘অনড়’ ও ‘যুগল জানালা’ [ গল্পের ছোটকাগজ] ছাড়া সবগুলো পত্রিকায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক কাগজ ছিলো। ‘এ্যালবাম’ সম্পাদনা এখনো অব্যাহত আছে। এ্যালবামের বৈশিষ্ট হলো– প্রতিজন কবির পাঁচটি করে কবিতা ছাপানো। আমরা মনে করি একজন কবির একটি কবিতা ছেপে সেই কবিকে কবি হিসেবে মূল্যায়ণ সম্ভব নয়। পাঁচটি করে কবিতা ছাপা হলে সেই কবিকে কবি হিসেবে কিছুটা হলেও মূল্যায়ণ করা যেতে পারে। এক সাথে এ্যালবামে সেই সব কবিতা–গদ্য ছাপা হয়, যাকে আমরা মুক্তগদ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। অর্থ্যাৎ টিকা-টিপ্পনি বা তথ্যপঞ্জি ছাড়া গদ্য। আর একটি দিকে নজর দিয়ে আসছি– আমার সময়ের, অর্থ্যাৎ সত্তর দশকে যেসব কবি বন্ধুরা লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন, এখন লেখা থেকে দূরে চলে গেছেন, তাঁদেরকে খুঁজে বের করে পুনঃপুন তাগাদা দিয়ে পুনরায় কবিতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং সাথে এ প্রজন্মের অন্তত দশজন কবির কবিতা পত্রস্থ করা যাতে করে নতুনদের সাথে তাঁদের পরিচয় এবং সেতু বন্ধন তৈরি হয়। বলতে দ্বিধা নেই, এ প্রচেষ্টায় আমরা কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। এখন একে-অপরকে পড়তে এবং চিনতে পারছে তারা।
১০. লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজের সংজ্ঞা একেকজন কবি বা সাহিত্যিক তাঁদের মতো করে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমার মতে লিটল ম্যাগাজিন তারুণ্যের ক্রোধভাঙা উদগীরণ–মাতাল ঢেউ। দ্রোহ-বিদ্রোহ বিস্ফোরণের আগ মুহূর্তের তুমুল শিহরণের নাম লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন মূলতঃ পুরাতন –অচলায়তন ভেঙে প্রথাবিরোধীদের জানান দেয়া আমরা আসছি। এই আসাটাকে নিছক বুলি নয়, তারুণ্যের মনোভাব স্পষ্টতই প্রবীণদের চমকভাঙার নতুনত্বের দীপ্ত আগমন। রাগী তরুণগণ একক বা একত্রিত হয়ে প্রকাশ করেন তাঁদের সৃষ্টিশীল অল্পধাম। লিটল ম্যাগ্যাজিন হবে আদর্শগত এবং স্বার্থহীন মিছিল, যা স্বৈরাচারীর ভীতকে ধাক্কা দিতে পারে। এমন পথচলায় সামিল হন সারাদেশের সৃষ্টিশীল তরুণ। কী কবিতা, কী গল্পে, কী প্রবন্ধে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন লিটল ম্যাগাজিনে। আমার ভাবনা–এর বাইরে নয়। কারণ যে পথে চলা শুরু করেছি–এখনো যার যতিচিহ্ন পড়েনি, সেখান থেকে বের হই কিভাবে? আমি মনে করি বর্তমান প্রজন্ম আমাদের চলার পথকে আরো গতিশীল করুক। আমরা করতে গিয়েও করতে পারিনি, সেই অপূর্ণতা তাঁরা সিদ্ধহস্তে দ্বিধাহীনভাবে পুরুন করুক। সাথে কালকে তুলে আনুক নির্মোহভাবে তাঁদের প্রজন্মের জন্য।
১১. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়?
বর্তমান সময়ে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন বের হচ্ছে– সেগুলো সব কি লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে বা আদর্শে পড়ে? অন্তত আমি মনে করি না। কারণ বর্তমান সময়টা এ-যাবৎ কালে কঠিন সময় পার করছে। ক্ষমতাশীন দলের গুণগানে, লেজুর বৃত্তি করে উপার্জন করছে অঢেল বিত্ত। জেলায় জেলায় বসছে বিভিন্ন কবিতা সংগঠনের নামে লিটল ম্যাগাজিন মেলা, যেখানে প্রধান অতিথি বা অতিথি হয়ে আসন অলঙ্কৃত করছেন প্রশাসানের নানা স্তরের ব্যাক্তি যাঁরা আদৌ সাহিত্যের সাথে জড়িত নন। একারনেই আগামী দিনের সাহিত্য সম্পর্কে খুব আশাবাদী নই আমি। যদি না এই ধান্ধাবাজীর পরিবর্তন হয় এবং সহসায় এর পরিবর্তন হবে বলেও আমি আপাতত দেখছি না।