যারীন রাশেদা
১. ছড়া সমগ্র :
সহজ কথা সহজে বলা কঠিন। আবার অল্প কথায় বেশি বলা আরো কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন কাজটা যিনি সহজে করে ফেলেন তিনি ছড়াকার আতিক হেলাল।
সম্প্রতি আমি তার ” ছড়াসমগ্র ” বইটি পড়েছি।
কথিত রিভিউ নয় পড়ে ভালো লেগেছে বলে এই লেখা।
কিছু কিছু ছড়া একটু বেশীই ভালো লেগেছে।
সেরকম কিছু ছড়ার চুম্বক অংশ এখানে দিচ্ছি–
যেমন ” পাখি হবো ” তে
…”উড়ে চলে তবু তারা
মিলেমিশে থাকে
সুখে – দুখে একজন
অন্যকে ডাকে। “
…”পাখিদের মাঝে নেই
রেষারেষি , আড়ি
পাখিদের মতো হতে
আমরা কি পারি? “
তখন সত্যিই যেন মন পাখি হতে ইচ্ছে করে! মন বলে, একটু পাখি হতে দোষ কী?!
মেয়েদের নিয়ে চমৎকার সহজিয়া আশাবাদ যে ছড়ায় চাষাবাদ হয়েছে তা এভাবে,
“তোমাদের ঐ চোখের তারায় আলো
ঐ আলোতেই কাটবে আঁধার – কালো।
তোমরা অনেক ভালো
আজকে যেমন,থাকবে তেমন কালও।”
“নজরুল মিশে আছে” ছড়ায় নজরুলের অবদান যে সবখানে তা- ই উচ্চারিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে –
…”নজরুল মিশে আছে
কবিতা ও ছন্দতে
জীবনের বাঁকে বাঁকে
আছে ভালো – মন্দতে।
নজরুল মিশে আছে
সুখ কিবা দুঃখতে
সমানে সমানে আছে
কোমল ও রুক্ষতে। “
আবার প্রতিকূল পরিবেশে যেন নিজেকে শান্ত রাখতে হয় সে মেসেজটাই পাই আমরা “বায়না” ছড়ায়-
” আকাশটা চেয়ে বসে
একা এক ভাগিনা
তবু থাকি হাসিমুখে,
একটু ও রাগি না ।
সমুদ্র চেয়ে বসে
ভাতিজি ও ভাস্তে
বলে কথা চিল্লিয়ে
আমি বলি আস্তে। “
নিজ জেলা কুষ্টিয়া যাবার নীরব নিমন্ত্রণ রয়েছে ” ঢাকা টু কুষ্টিয়া ” ছড়ায়।
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাবার পুরোদস্তুর পথ বাৎলে দেয়া হয়েছে এখানে।
কেউ চাইলে ছড়া পড়েই সহজেই যেতে পারবেন!
“কাটছ কেমন” ছড়া খুব হালকাচালে লেখা। দারুণ ছন্দময়তা…।
…”কাটছে কেমন, সময় যেমন
সুর কেটে যায় তাল কেটে
দৌড়ের উপর কাটছে সবাই
শেভ করি, যায় গাল কেটে।”
আমাদের সবকিছুই শেষ হয় মৃত্যুতে। এই জমকালো জীবননদে আমরা বিচিত্র অনুভবে, আনন্দ – আড্ডায় অথবা দুঃখ শোকে হতাশায় থাকি৷
অথচ চোখ মুদলেই সব শেষ! কেউ মনে রাখে না!
” চলে যাওয়ার পংক্তিতে ” সেটারই সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে।
…” মন দেই, মন নেই
হৃদয়ের জন্যেই
আরো কত ঠাট্টা – ইয়ার্কি
জন্মের সাজা নিয়ে
কাউকেই না জানিয়ে
চুপচাপ মরে গেলে কার কী?”
শুভকামনা আতিক হেলালের “ছড়াসমগ্র” ‘র জন্য।
২.পাখি হবো
আমরা অল্প হলেও গল্প বলি, জীবনের গল্প। গল্প বলি ছড়া, কবিতা, গান, নাটক এবং উপন্যাসে। নিত্যদিনের আপন ঘরানায়। আর সেটা যদি মন থেকে, ভেতর থেকে স্বত:স্ফুর্তভাবে আসে তবে তা হয় সুন্দর আর আন্তরিকতাপূর্ণ।
যেকোন বৃহৎ বিষয়কে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার চমৎকার মাধ্যম হচ্ছে ছড়া।
সমকালীন এবং সর্বজনীন বিষয়কে সর্বোচ্চ সহজ ভাষায় লিখেও যে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া যায় তা বুঝতে পারি তার লেখা পড়লে।
তাই বলতে ইচ্ছে হয়-
ছড়ায় ছড়ায় যার জীবনটা লাল
প্রিয় ছড়াকার তিনি, আতিক হেলাল।
‘পাখি হবো’ ছড়াগ্রন্থের ‘ভালো লাগে’ ছড়ায় ছড়াকারের
অন্যকে আনন্দে রাখার ইচ্ছের প্রকাশ পেয়েছে। যেমন-
“আমার তো ভালো লাগে
শান্তিতে থাকতে
প্রিয় সব মানুষকে
আনন্দে রাখতে।”
‘এক থেকে দশ’ ছড়া সংখ্যানুক্রমিক ছড়া। ভালো লেগেছে, সহজবোধ্য। প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির পাঠ- উপযোগি।
” এক দুই তিন
গাছে – গাছে পাখি গান
গায় প্রতিদিন।
চার পাঁচ ছয়
বাগানের ফুল দেখে
মন ভালো হয়।
সাত আট নয়
সুন্দর ও শোভনের
হোক শুধু জয়।
দশ
ভালো কাজ করলেই
হবে নাম- যশ।”
” ঢাকা টু কুষ্টিয়া ছড়ায় বিভিন্ন ধরনের যানে অতি সহজে কুষ্টিয়া যাবার পথ বাৎলে দেওয়া হয়েছে। চাইলে যে কেউ এ ছড়া পড়েই কুষ্টিয়া ঘুরে আসতে পারবেন।
এ ছড়ার শেষাংশ,
” সুন্দর এবং শুদ্ধভাষা শুনতে যদি চান/একটিবারের জন্য হলেও কুষ্টিয়াতেই যান।”
সুন্দর এবং শুদ্ধ ভাষা শোনার জন্য হলেও মনে হচ্ছে একবার অন্তত কুষ্টিয়া যাওয়া দরকার!
আমরা আকাশকে সবসময় বড় -ই ভাবি, কিন্তু তারচেয়েও বড় কিছু যে ‘মহাশূন্য’এ বোধোদয় ঘটে ‘শূন্য চিন্তা’ পড়লে।
“আকাশকে বড় ভাবো,উদার আর পূণ্য
মহাকাশ কী তাহলে, সে কি মহাশূন্য?
মহাকাশে শূন্যতা, মহাকাশ শান্ত!
মানুষ আরো বড় হতো, যদি তাকে জানতো।”
আকাশ, মহাকাশ সব ছাড়িয়ে যিনি এসবের স্রষ্টা তিনিই যে সেরা বিজ্ঞানী, মূলদ্রষ্টা এ ছড়া পড়ে সে ভাবনায় আমাদের মন নতজানু হয় মহান আল্লাহর কাছে।
আবার, ঘুরেফিরে স্বদেশকে ভালোবাসলে যে নিজেকেই ভালোবাসা হয় তার রূপায়ণ ঘটেছে ‘স্বদেশকে ভালোবাসো যদি’ ছড়ায়।
পারিবারিক শিক্ষা যে বংশানুক্রমিক এ বিষয়টা উঠে এসেছে ‘দাদার শিক্ষা’ ছড়ায়।
” কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ
কোনটা কালো, শাদা
কোনটা পাপ আর পূণ্য কোথায়,
প্রথম শেখান দাদা।
সত্য কথা বলতে হবে,
মিথ্যা বিশাল পাপ
এই বিষয়ে দাদাই প্রথম
দিতেন কঠোর চাপ।
দাদার কাছে এসব শিখেই
আমায় শেখান পিতা
এখন এটার মূল্য বুঝি,
তোমরা বুঝবে কি তা?”
প্রথমে মনে হবে এ ছড়া শুধু দাদার জন্য লেখা, শেষাংশে বুঝা যায় আমাদের সব শিখন দাদা, বাবা, তারপর আমাদের উপর পর্যবসিত হয়।
বইয়ের নামকরণ “পাখি হবো” বেশ লেগেছে। নামের মধ্যে একটা কিছু হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আমাদের ইচ্ছেরা তো ডানা মেলে জীবনাকাশে ছড়িয়ে দিতে পারি!
পাখিদের মতো দলবেঁধে, সুখে – দুখে একের সাথে অন্য মিলেমিশে থাকতে পারি।
নামছড়ায়- “উড়ে চলে তবু তারা
মিলেমিশে থাকে
সুখে – দুখে একজন
অন্যকে ডাকে। “
ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে লিখিত ছড়ার মতো বলতে পারি,”
সবাই মিলে থাকবো মিশে
হরহামেশা যুদ্ধ কিসে? “
৪৮ পৃষ্ঠার এ বইটি লেখকের ৪ জন (১ হালি) বন্ধুকে উৎসর্গ করা হয়েছে। বইটি ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় ‘কণ্ঠস্বর’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।
শুভকামনা আতিক হেলালের ১৮তম বই ” পাখি হবো”র জন্য
…..
মৌলভী বাজার।