তৈমুর খান
কী আছে আমার কবিতায় ?
—————————–
কবিতায় কী থাকে তা কোনওদিনও ভাবিনি, অথচ কবিতা লিখি। অর্থের সম্পূর্ণতা নিয়ে তা ঠিক সিদ্ধিতে পৌঁছাল কিনা সে বিচারও করি না। মনের একটা গুন গুন টের পাই যখন, তখন তাকে শব্দের মাধ্যমে রূপ দেবার চেষ্টা করি। তাই কবিতাকে আমি বলি আত্মধ্বনি। কিন্তু কখনও কি এই আত্মধ্বনিটি আনন্দের বলে মনে হয়েছে?
.
না, তাও না ; বরং তা কষ্টেরই। প্রচণ্ড এক কষ্ট এসে যখন মনকে মোচড় দিয়েছে, তখনই গুন গুন বোধটি এসেছে। কী সেই কষ্ট তা বলতে পারব না। হয়তো তা বস্তুগত অভাব থেকে, হয়তো বা তা অপার্থিব কোনও শূন্যতা থেকে ; কিংবা কী থেকে তা না বলতে পারারও ভাষাহীন উপলব্ধি থেকে। প্রথম থেকে শেষ অবধি কোনও ভাবনার উপলব্ধির দৈর্ঘ্য মেপে আমি কখনও কবিতা লিখতে বসিনি।
.
একটা শব্দ এসে মনের দরজায় করাঘাত করেছে তা পার্থিব কোনও ঘটনা বা আচরণের অনুষঙ্গ হিসেবেই —তখন তাকেই লিখতে চেয়েছি। কবিতা কোনও সমাধান এনে দেয়নি, ধর্মসূত্র হতে চায়নি, বিদ্রোহ বা উদ্দেশ্য হয়েও ফেটে পড়েনি। তবু কবিতা যেন এক নীরব পথপ্রদর্শক বা শান্তশ্রী দিনান্তের আলোর মতো। জীবন প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যু-উদযাপন করে চলেছে। তার ক্লান্তিহীন উচ্ছ্বাস, নীরব অভিমুখ আমি কবিতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি। সে শূন্যতার গুহার দিকে যেতে যেতে এক একবার পিছন ফিরে চেয়ে দেখেছে। তা তো শূন্যতারই অভিঘাত।
…………………………….
কাকে চেয়ে দেখেছে ?
……………………………….
চেয়ে দেখেছে তমসাকে। ওর রূপ ও অরূপ। আছে, তবু নেই। ছোঁয়া যায়, তবু ধরা যায় না। কখনও কখনও তাকেই প্রেম বলে মনে হয়েছে। নারী-শরীরের চিকন প্রচ্ছদে তাকে কাব্য করে তুলতে চেয়েছি। আবার আকাশের বিস্তৃতিতে তাকে শুইয়ে রেখেছি। সমুদ্রের তরঙ্গে তরঙ্গে তাকে নাচতেও দেখেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য! এত অপূর্ব সবকিছু তবু নাথিংনেস্ প্রজ্ঞারই বিন্যাস সেগুলি । শব্দের মুঠি খুলে শুধুই আত্মধ্বনির প্রলাপ কথন। বাক্য ও চিত্রকল্পের সমাহার।
…………………………………….
কীভাবে কবিতার শব্দ এল ?
………………………………………….
কবিতার শব্দ নৈঃশব্দ্যেই এসেছে। জীবনের গতিময় বহুমুখী পর্যবেক্ষণ থেকে অনুজ্ঞাগুলি ধাবিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধি, যৌবন-উদ্গমের প্রাক্কালে যে মেয়েটির শরীরী পরিবর্তন একটা নদীর মতো প্রথম উপলব্ধিকে প্লাবিত করল, সেই উপলব্ধির মুকুলটিই মানবীয় প্রবৃত্তিরই নতুন ভাষা হয়ে এল। চোখ দেখল এক ইশারা। মন ভিজতে চাইল তার হিল্লোলে। জ্যোৎস্নার রঙে রঙিন তার শরীর। তখন প্রথম যে কবিতাটি উচ্চারিত হল :
নারকেল গাছের ছায়ায় জোরে চেঁচিয়ে ডাকি :
প্র-তি-মা প্র-তি-মা….
ঝোড়ো বাতাসে আমার শব্দগুলি মিশে যায়
আমার কথাগুলির নাক কান চোখ ঘুঁসি হাত পা ছুটে যায়
পথে প্রান্তরে
নিষ্ফল প্রত্যুত্তরে প্র-তি-মা প্র-তি-মা সারাক্ষণ প্রতিধ্বনি বাজে।
(নারকেল গাছের ছায়ায় : আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা)
কিন্তু এই ইচ্ছার প্রতিধ্বনি থেমে যায়। “প্র-তি-মা” শব্দটি প্লুতস্বর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আবেগের দীপ্ত আকাশে। প্রতিমা স্বয়ং দুর্গা হয়ে যায়। তার শরীরের চিকন বিশ্বাস আর উপলব্ধির উজ্জ্বল আলোয় প্রথম যৌবনের অযোগবাহ বর্ণগুলি ঘুরপাক খেতে থাকে আর তারা ব্যবহৃত হতে চায়। তার বইয়ের ভেতর গুঁজে দেওয়া লাজুক চিঠিতে তারা আবেদন জানায়। কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে। চিঠির উত্তর পাওয়ার প্রত্যাশাও জাগে। কিন্তু প্রত্যুত্তর আসে না। ওর জানালা সারাদিন বন্ধ থাকে। “পিপাসা” নামক শব্দটি তখন জেগে ওঠে তার নিষ্ফল কেরামতি নিয়ে :
যতদিন ভুল বোঝার হবে নাকো শেষ
ততদিন খুলবে না জানালা কপাট
কিছুফুল অবশিষ্ট আছে বারান্দায়
মরাগাছে বহুদিন দাওনিকো জল
কীভাবে যে কী হয় জানো নাকো কেউ
কোথায় চলেছি হেঁটে পথ চিনি নাকো
দুপুরের সেই ক্লান্তি মৃদু পাখা ঠাণ্ডা হাত
পিপাসা কাতর চোখ ব্যাকুল প্রশ্নের ধারা
তুমি শুধু তুমি হয়ে অদ্ভুত বৈশাখে
ঠিকানা দিতে অমৃত বারিধির
(ক্লান্ত করে আমাকে তোমাকে : আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা)
এই পিপাসা তো সমস্ত জীবন ধরেই অমৃত বারিধির ঠিকানা খুঁজেছে । হাহাকারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। শব্দ আর দীর্ঘশ্বাসগুলিকে পংক্তিতে পংক্তিতে প্রতিস্থাপন করা আর ইচ্ছাগুলিকে ঘিরে রাখা। মানব প্রবৃত্তির চিরন্তন আকুতি নিয়েই এই যাত্রাপথে আগমন। তাই কৈশোরের উত্তরণে যৌবনের সমাগমে বিরহ বন্দনার শূন্যতা থেকেই কবিতায় আশ্রয় রচনা। প্রতিমা মানস-প্রতিমার পর্যটনে বার বার জন্মান্তর পায় । তার সোনালি হাতখানা স্বর্ণালি বাঁশি হয়ে সুর তোলে । অমোঘ সেই আকর্ষণের নিরিবিলি আমাকে বোধিকেন্দ্রের অনন্ত প্রজ্ঞায় নিয়ে যায়। প্রেমের বিভাব থেকেই শূন্যতার অবিমিশ্র অনুধাবন আজও অক্লান্ত করে। শরীরী বিভঙ্গ সব তমসায় উত্তাল হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই শূন্যতাই বিরাজ করে।
………………………………………..
কী সেই শূন্যতার অভিক্ষেপ ?
………………………………………..
শূন্যতা বা এম্পটিনেস্এর ভেতর আত্মধ্বনিরই প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে । এ তো সেই হাহাকারই যা পরোক্ষভাবে আত্মক্ষরণের নির্বেদ অভিঘাত। শব্দ সেই শূন্যতার নামান্তর। আমেরিকান জ্যোতির্বিদ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও লেখক কার্ল সাগান ( Carl Sagan 1934 —1996)এর কথাটাই সত্য হয়ে উঠেছে : In all our searching, the only thing we’ve found that makes the emptiness bearable other. অর্থাৎ আমাদের সমস্ত অনুসন্ধানে আমরা কেবলমাত্র একটি জিনিসই খুঁজে পেয়েছি যা একে অপরের শূন্যতাকে বহনযোগ্য করে তুলেছে। যা নিজের অজান্তেই আমরা করে চলি। এই শূন্যতাই আমাদের প্রাপ্তি। শব্দ এসেছে, শব্দের অভিব্যক্তিও পাল্টে গেছে, কিন্তু শূন্যতা পাল্টায়নি। জীবন এক মহাশূন্যতারই আধার। কাব্যগ্রন্থের নামও দেওয়া হয়েছে “খা শূন্য আমাকে খা” ।সেখানেই তো শূন্যতার প্রথম ছায়া :
খা শূন্য, আমাকে খা
আছি বা নেই
দুই দিকে তোর হা
ঘুম ভাঙল এখানেই
জলের উপর উবুড় হয় ছায়া
ওপর দিকে পা
(খা শূন্য আমাকে খা)
এই নির্ঝর অবলম্বনহীন ছায়ামায়ার ভেতর আত্মযাপনের নিবিড় সন্ন্যাস-মগ্নতা আমার ক্রান্তীয় বিশ্বাসের ছলাচ্ছল অভিরূপ । বাইরে থেকে কবিতাকে অ্যাকাডেমিক আলোকপাতে ধরা যাবে না। বিষয় সেখানে উপলক্ষ মাত্র। জীবনই নিষিক্ত ইন্ধন — যার ধোঁয়া ও লিপি, চিত্র ও অভিজ্ঞান স্বরীয় স্তব্ধতা থেকে নিঃসৃত হয়ে মহাকালীয় বিভাজিকায় প্রকীর্ণ। এই শূন্যতা যে সর্বদা কিছুই নেই বা নাথিংনেস্-এরই পরিচয় তা কিন্তু নয়। এর মধ্যেই মহাপ্রাণসত্তার সঞ্চার ও স্পন্দনও গ্রাহ্য হয় বলেই তা অনন্তের আধারে পরিণত। পর্তুগিজ কবি ফারনান্দো পেসোয়া (Fernando Pessoa 1888—1935) এর মতোই বলতে পারি :
I am nothing.
I ‘ll never be anything,
I couldn’t want to be something,
Apart from that, I have in me all
the dreams in the world.
অর্থাৎ কিছুই হবে না, আমি কিছু হতেও চাই না। তাছাড়া আমার মধ্যেই তো পৃথিবীর সব স্বপ্ন আছে। এই স্বপ্নই যখন নাথিংনেস্ তখন তো এরকমই কবিতা লেখা যায় :
রিক্ত হাতের নীলাভ শিরা চাঁদের হাটে জ্বলছে বড়ো
ও মেঘ ও চাঁদের সাদা এ শূন্যতায় ঘুরছি একা
বাতাস খেয়ে
খা শূন্য, আমাকে তুই আমার স্বপ্ন অস্ফুট সব গোপনতা
(খা শূন্য আমাকে খা)
রিক্ত হাতের নীলাভ শিরা চাঁদের হাটে জ্বললেও তা যে প্রকৃতপক্ষে শূন্য তা বলাই বাহুল্য। বাতাস খেয়ে শূন্যের দরজায় নিজেকে সমর্পণই একমাত্র পথ আমার। এই শূন্যতাকেই লালন করে চলেছি আজীবন।
………………………………………………………….
বিকেলের অভিঘাত কেন ?
…………………………………………..
সময় নিরীক্ষীয় আর একটি শব্দ আমার খুবই প্রিয় “বিকেল”। দিনের কোলাহল ক্লান্ত হলে এই বিকেলের দেখা পাই। বাল্য-কৈশোরের ক্ষুধার্ত দিনগুলিতে এই বিকেলের জন্য অপেক্ষা করতে হত। বাবা মজুর খেটে ফিরবে। সঙ্গে নিয়ে আসবে চাল কিংবা আটা। আমাদের খাবারের আয়োজন হবে। মা সারাদিন খেজুর পাতার তালাই বোনে । কখনও ছেঁড়া কাপড় দিয়ে সেলাই করে কাঁথা। আমি তো গুন গুন। বাঁশের ডালে কাক ডাকে । উদাস করে দেয়। সূর্য রোদ গুটিয়ে অস্ত যাবার মুখে। বাবা ক্লান্তি মেখে ঘামসিক্ত শরীরে ফিরে আসে। পাতা ও খড়কুটো দিয়ে উনুন জ্বালায় মা।
উঠোনে লম্ফু জ্বেলে বসি । রান্নার ঘ্রাণ পেলে পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ে । গলার জোর বাড়ে। নিজেকে তখন মনে হয় অন্ধকারে আলোর মাছ। তারপর খাবার খেয়ে বসে বসে ঢুলতে ঢুলতে ঘুমিয়ে পড়া । উঠোনে তখনও বাবার আলিফলাইলা, অথবা হাতেমতাই, অথবা মহাভারত পাঠ চলছেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যুদ্ধের দৃশ্যগুলি পরখ করছি। আমার সব আয়োজনেই তাই বিকেলের ভূমিকা আনন্দময় ও অসীম। তারপর প্রেমও এল। বিকেল হলেই মেয়েটি আসত মাথায় ফুল ফুটিয়ে। তার ফ্রকেও ফুলের বাগান বসানো। হেসে উঠলে মুখও সেই রক্তিম গোলাপি ঠোঁটের পাপড়ি হয়ে যেত। জীবনের মহাসঙ্গমে আমরা দাঁড়াতাম। কবিতায়ও সেকথা লিখেছিলাম সেদিন :
একদিন ভালোবেসে মিথ্যে অভিনয়ে সময় গুলজার করেছি
পৃথিবীর এমনি খেলায় তুমিও ছিলে
তুমিও পথশ্রান্ত নেচেছিলে যাদুকরী মেলায়
একদিন স্বপ্ন থেকে স্বপ্নের ভিতর
সময়ের করতালি শুনেছিলে
চৈতন্যের প্রতিটি প্রবাহে
তখনও সূর্য আর রঙে প্রেমের পুজোয়
অনন্ত বিষাণে সুরের পালক
হৃদয়ের উৎসারিত নদীর ঠিকানায়
হেঁটেছিলে নিরুদ্দেশ নিরন্ত ভাসানে
আজ আমি এবং তুমি দু’আঙুলে সমস্ত বিকেল ধরে আছি
সত্যের পর্দা খুলে মিথ্যেরাও উঁকি দেয়
মিথ্যেরাও সত্য হয়ে স্বপ্ন হয়ে
তোমাকে আমাকে আবার
শেখাবে অভিনয়
এসো আমরাই আমাদের সমস্ত বিজয় করে নিই প্রত্যাহার
(মিথ্যেরাও সত্য হয়ে : খা শূন্য আমাকে খা)
প্রেম হল, প্রেম ভেঙেও গেল, কিন্তু বিকেল আর শেষ হল না। জীবন আজও সেই বিকেলের দিকে হেঁটে চলেছে। আমরা ঘুমানোর আয়োজন করছি। চেতনাকে বিশ্রাম দেবার স্বপ্ন দেখছি। হয়তো বাড়ি ফেরার তাড়া-ও আমাদের। পৃথিবী বিষাদময়। পৃথিবী ক্লান্তির ।পৃথিবী রাত্রির অন্ধকারেরও । আমাদের তাই বলতে হচ্ছে :
ব্যক্তিগত বিষাদে বিকেল গড়াই
কবিতা এই ব্যক্তিগত বৃত্তের কাছেই তার সমূহ আলো নিভিয়ে চুপচাপ স্তব্ধতার প্রহর গোনে আর চেয়ে দ্যাখে সেই মুখ :
তোর মুখ স্তব্ধ হয়ে সন্ধ্যার নীরব বাঁশি হয়ে জেগে আছে
যে মুখ জীবনের প্রথম সকালে দেখা দিয়েছিল, সেই মুখই জীবনের অন্তিম সময়েও জেগে আছে। দীর্ঘপথের প্রান্তে সেই শাশ্বত বিকেলই আমার মহাসন্ধিক্ষণের প্রাক্ মুহূর্ত। কবিতায় তা বার বার ফিরে আসে। তবু প্রতিটি বিকেলই মনে হয় কবি রবার্ট ফ্রস্ট (Robert Frost)-এর মতো :
The afternoon knows what the morning never suspected.
সকাল কেমন তাকে কখনওই সন্দেহ করে না এটা বিকেলও জানে। আমার সেই সকাল আর বিকেলের জংশন একটা সেতু গড়ে তোলার কাজই করে চলেছে কবিতাগুলি। যা শূন্যতার অভিক্ষেপ নিয়েই জেগে ওঠা শব্দের বহুমুখী সঞ্চার এবং অবশ্যই আত্মধ্বনির গুন গুন।