মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন
কাব্য আর মহাকাব্য লেখা এক জিনিস নয়। মহাকাব্য লেখা মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো মহাচ্যালেঞ্জময়। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় যেমন মহাকাব্য লেখা হয়েছে, তেমনি লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়ও। কালিদাস লিখেছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন, কায়কোবাদ লিখেছেন। আধুনিক কালে এসে যে মহাকাব্য লেখা যাবে, সে ব্যাপারে সিংহভাগ সাহিত্যিকের সংশয় ছিলো। কেননা এর পেছনে যে পঠনপাঠন, ধৈর্য ও সাহস দরকার, তেমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তাছাড়া সময়ও এমন প্রতিকূল – সবাই স্বল্প সময়ে ফসল তুলতে ব্যাকুল। তাই চারিদিকে চোখে পড়ে চড়ুই-মন, দেখা মেলে না বাবুইয়ের বুনন। কিন্তু বাংলা ভাষাপ্রেমিক সকলের সৌভাগ্য যে, সেই সংশয়কে সাহসে রূপান্তরিত করেছেন সায়ীদ আবুবকর। আর তাঁর মহাকাব্যের নাম ‘নবিনামা’। এটি কেবল মহাকাব্যই নয়, আধুনিক মহাকাব্য।
‘নবিনামা’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জ্যোতির্ময় জীবন নিয়ে লেখা একটি মহাকাব্য। মহানবী (সা.) সেই মহামানবের নাম, সারা সৃষ্টিকূলে যাঁর সুনাম ও সম্মান। পৃথিবীতে তাঁর জীবন নিয়ে রচিত হয়েছে যত বই, তেমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় আর নেই! শুধু তাঁর জীবনীই পায়নি ইতিহাসে ঠাঁই — পেয়েছেন তাঁর সৎ ও সুন্দর জীবনের সাথে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন সবাই। ইসলামের বিরোধীরাও এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন এবং বিস্মিত হয়েছেন! এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত জার্মান পন্ডিত ড. স্প্রেনগার-এর নাম উল্লেখ করা যায়। ড. স্প্রেনগার ১৮৫৪ সালে এবং পরবর্তীকালেও ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন। তাঁর দাবি মতে তিনিই প্রথম ইউরোপীয় লেখক, যিনি মূল আরবি গ্রন্থগুলোর সহায়তায় ‘লাইফ অব মুহাম্মদ’ লিখেছেন। এবং বিরোধিতা করেই লিখেছেন। তাঁর আমলে ও তাঁরই স্বকীয় প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে হাফেয ইবনে হাজারের ‘ইসাবা ফী আহওয়ালিস ছাহাবা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনিই ১৮৫৩-৬৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইসবার’ ইংরেজি ভাষায় লিখিত ভূমিকায় লিখেছেন, “দুনিয়ায় এমন কোনো জাতি দেখা যায়নি এবং আজো নেই, যারা মুসলমানদের মতো ‘আসমাউর রিজালের’ বিরাট তত্ত্বভান্ডার আবিষ্কার করেছে। আর এর বদৌলতে আজ পাঁচ লাখ লোকের বিবরণ জানা যেতে পারে।” এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যায় অক্সফোর্ডের আরবির অধ্যাপক ডি. এস. মারগুলিয়াথ (D. S. Marguliouth) লিখিত এবং ১৯০৫ সালে ‘হিরোজ অব দি নেশান্স’ সিরিজ কতৃক প্রকাশিত ইংরেজি বই ‘মুহাম্মদ’-এর কথা। এটি ছিলো রাসূল (স.)-এর জীবনী বিষয়ক একটি বিষাক্ত বই। বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত তথ্যে ভরা বইটির ভূমিকায় তিনি এই সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, “মুহাম্মদের জীবনীকারদের দীর্ঘ সিলসিলা শেষ হওয়া অসম্ভব, কিন্তু তাঁদের মধ্যে স্থান লাভ করা একটি বিরাট সম্মান।” তা যদি হয়, কেবল কাব্যে নয়, মহাকাব্যের মাধ্যমে, তা কেবল সম্মানেরই নয়, সৌভাগ্যেরও সমাচার। আর সেই কঠিন, কষ্টসাধ্য কাজটি সৃষ্টিশীল ও সুনিপুণ ভাষায় সম্পন্ন করে যিনি ইতিমধ্যে সকলের শ্রদ্ধার, শ্লাঘার ও শুভেচ্ছার পাত্র হয়েছেন, তিনি হলেন সায়ীদ আবুবকর। তিনি যেমনি প্রজ্ঞাবান, তেমনি প্রতিভাবান। তাই তো তাঁর কাছ থেকে পাই এত বড় কাজ, যাতে গর্বে বুক ভরে যায়।
কাজটি কঠিন ও কষ্টসাধ্য হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণও আছে। প্রথম কারণটি এই – কবিতা কর্মে সহজ বলতে কিছু নেই। এক সময় ছিলো, পুঁথির প্রতাপ ছিলো সর্বত্র। পুঁথিকেই কাব্য মনে করে প্রীত হতো পাঠক। কিন্তু সত্য তো এই — তাতে ইতিহাসের উপাদান যদিও নেয় দম, কিন্তু কাব্যের উপাদান কম। পাশাপাশি ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো/কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’ মার্কা পঙক্তি রচনাকে তখন কাব্য জ্ঞান করতো অনেকেই। কিন্তু সেখানে কবিতা কই? কবিতায় রস থাকা চাই, রহস্য থাকা চাই। রস ও রহস্যের রসায়নেই তো রসোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে কবিতা। কিন্তু এতো প্রভাত-প্রকৃতি, পুষ্প ও পাখির সহজ বর্ণনা বা নিউজ, যেখানে কবিতা ফিউজ। এসব কারণে, কেউ কেউ মনে করতো, কবিতা লেখা এমন কি কাজ — চাইলেই হওয়া যায় কবি-রাজ (নাকি কবিরাজ)! কিন্তু প্রকৃত অর্থে কবিতা লেখা বড় কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, যদি তাতে থাকে প্রকৃত কবিতার সাজ ও রাজ। তিরিশের কবি অরুণ মিত্র তো কবিতা লেখাকে ‘পাঁজর ভাঙা চাপ’ বলেছেন। তিনি তাঁর ‘কথামুখ’ কবিতায় লিখেছেন–
কবিতার তো অশেষ কথা, একটি গলা কতই-বা
বলতে পারে? খন্ড-সময়ের পাত্র উপচে এত
এত কথা উঠে আসে যা কিছুতে দুই ঠোঁটে
কুলোয় না অথচ পাঁজর ভাঙা চাপ চলে।
এবং কবিতা, কী বলব, জীবনের ভেতরে এমন
অচ্ছেদ্য জড়ানো, কে আছে যে তাকে তুলবে
ফুলের মতন, তোড়া বেঁধে রেখে দেবে, গুণের হিসেব
দেবে সমঝদার কানে? তা তো মোটেই হবার নয়।
এ এক গহন যাত্রা, এ এক মাতাল স্রোত,
এ এক শরীর পোড়ানো জ্বর কিম্বা সব শেষে
এ সেই মৃত্যুর শীতল যা আরও তাপ বুনে রাখে
অন্য রক্তে অন্য মাংসে, একটা জ্বলন্ত থেকে
হাজার আগুন উঠে যায়, রাত্তিরকে চিরে চিরে
অপরূপ মুখ দেখায়, তার দিকে কতবার যে
কবিতার বিহ্বল তাকানো আর তারপর
স্ফুট-অস্ফুটের ধ্বনি আমাদের কানে রাখা,
মাটিতে বাজানো রোদ্দুরের ধমকে কখন
রহস্য লুকায়, ক্ষিদে আর হাড়গোড়ের
সময় ঝংকার দিতে থাকে, লড়াই তুমুল বাজে
কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রৌদ্ররাত্রি-ধ্বনিত যে-ঘর
সে তো কবিতার, আমাদেরই আজন্ম মায়াবী ঘর।
কাব্যকর্ম করতে যদি ‘পাঁজর ভাঙা চাপ চলে’, মহাকাব্য রচনা কি তাহলে? মহাকাব্য রচনা হলো মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার মতো। কাব্যকর্ম বলতে যদি বোঝায় ব্যক্তির ভাবনাচিন্তার নান্দনিক বিবরণ, তাহলে মহাকাব্য রচনা হলো মহাসমুদ্র মন্থন। ইংরেজি Epic এর বাংলা প্রতিশব্দ মহাকাব্য। Epic শব্দটি এসেছে গ্রীক Epikos বা Epos থেকে। Epic হলো দীর্ঘ বীরগাথা এবং ঘটনাক্রমের বিস্তৃত বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পেশ করা। গাথাকাব্য ও কাহিনিকাব্যের মতো মহাকাব্যও আখ্যানকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। মহাকাব্যে কবির ব্যক্তিলোক প্রকাশের পরিবর্তে ব্যাপকতর সমাজ, গোষ্ঠী, জাতির ঐতিহ্য ও চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ এটি ব্যক্তি-নিষ্ঠ নয়, বন্তু-নিষ্ঠ। কবির অন্তর অনুভূতির প্রকাশ নয়, বস্তু প্রধান ঘটনা-বিন্যাসের প্রকাশ। এরিস্টটলের মতে, ‘মহাকাব্য হচ্ছে আদি, মধ্য ও অন্তসম্বলিত বর্ণাত্মক কাব্য যাতে বিশিষ্ট কোনো নায়কের জীবন কাহিনি অখণ্ডরূপে একই বীরোচিত ছন্দের সাহায্যে কীর্তিত হয়।’ আলোচ্য মহাকাব্যের যিনি নায়ক, তিনি সিনেমার কোনো নায়ক নন, কিংবা নন পুরাণের নায়ক ; তিনি হলেন ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ও সফল মানুষ, মহাকালের মহানায়ক, হযরত মুহাম্মদ (সা.)। কেন তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ও সফল মানুষ, তা বলতে গেলে জীবন ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু কথা শেষ হবে না। তবে অতি অল্পকথায় বলতে গেলে মাইকেল এইচ. হার্ট-এর বিশ্ববিখ্যাত বই ‘দি হান্ড্রেড’-এর প্রসঙ্গটি এসে যায়। বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের থেকে বাছাই কওে সেরা ১০০ ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি বইটি লিখেছেন এবং সেখানে সবার আগে স্থান দিয়েছেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে। কেন দিয়েছেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় যাঁর নাম সর্বাগ্রে স্থান পেতে পারে তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনিই হচ্ছেন ইতিহাসের সেই অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় ক্ষেত্রেই অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করেন। অতি সাধারণ অবস্থায় জীবন শুরু করে তিনি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসের প্রবর্তন করেন এবং অত্যন্ত সফল একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আজকে তাঁর মৃত্যুর তেরোশ’ বছর পরও তাঁর প্রভাব পৃথিবীতে ব্যাপক ও প্রবল।… হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাফল্যের মধ্যে জাগতিক ও ধর্মীয় উভয়বিধ প্রভাবের এক অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে। এজন্য সঙ্গতভাবেই তাঁকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ একক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।” ( শ্রেষ্ঠ ১০০, মাইকেল এইচ. হার্ট ; প্রথম প্রকাশ- বই মেলা ১৯৯৪, পরশ পাবলিশার্স, ১৫৫ ঢাকা নিউমার্কেট, ঢাকা-১২০৫, পৃ-১ ও ৫)। সায়ীদ আবুবকর তাঁকে নিয়েই রচনা করেছেন ‘নবিনামা’ নামের এই নান্দনিক ও নন্দিত মহাকাব্য।
কথায় আছে, সকাল দেখলেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। তেমনি আরম্ভ দেখেও অনুমান করা যাবে, পরের পাতাগুলো বা পুরোটা কেমন হবে। মহাকাব্যের মুখ বা ‘আবির্ভাব’-টা লিখেছেন তিনি এভাবে–
আমাকে ভিজিয়ে দাও ক্ষমার বর্ষণে;
তাঁর পুণ্য নাম মুখে আনার আগেই
এ-বুক বিদীর্ণ করে করো কাওসার ;
দু-ঠোঁটে বাজার আগে মহম্মদ-ধ্বনি,
এ-ঠোঁট বানিয়ে দাও বেহেস্তের বাঁশি;
কাব্যের লালিত্যে তাঁকে ছোঁয়ার আগেই
পুষ্পের বাগান করো আমার মস্তিষ্ক,
কেবলি যেখান থেকে উড়বে সৌরভ,
যে-সৌরভে স্বর্গমর্ত্য হবে সুরভিত!
আরম্ভটা এভাবে ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে, তারপর ঘটনার পরম্পরা বিশ্বস্ত ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে বলতে তিনি যান এগিয়ে। এ যেন তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে তুলে তীরের দিকে তীব্র বেগে এগিয়ে যাওয়া, কিংবা ঐশী প্রেমের প্রবল হাওয়া। যেন নেই যতি, শুধুই গতি। গতি মানেই তো প্রগতি। পৌত্তলিকতা, পশ্চাৎপদতা ও সকলরকম পাপ-পঙ্কিলতা যখন গ্রাস করেছিলো পুরো পৃথিবীকে, তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই পৃথিবীর মানুষকে সেসব পরিত্যাগ করে পরম প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বললেন, প্রগতির পথ দেখালেন। সেই প্রগতি কেবল কথার প্রগতি, কিংবা কাগুজে প্রগতি ছিলো না, ছিলো প্রকৃত প্রগতি । সেজন্য তিনি যেমন ছিলেন পরম প্রভুর প্রতিশ্রুত পয়গম্বর, তেমনি ছিলেন প্রগতিশীল পয়গম্বর। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বরও।
ইংরেজিতে সুপারস্টিশান বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ– “মিথ্যা উপাসনা বা ধর্ম, অতিপ্রাকৃত শক্তি, দৈববাণী, জাদুবিদ্যা প্রভৃতিতে অন্ধবিশ্বাস, জনসাধারণের মনে ব্যাপকভাবে বদ্ধমূল অযৌক্তিক বিশ্বাস।” অর্থাৎ বাংলা প্রতিশব্দ কুসংস্কার বোঝাতে সুপারস্টিশান শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। খ্রিস্টধর্মের বাহনরূপে সাম্রাজ্যবাদ তখন ছড়িয়ে পড়েছিলো বিভিন্ন উপনিবেশে। উপনিবেশিক দেশগুলোর উপাসনা, ঈশ্বরবন্দনা, ধর্ম, জীবনযাপনের ধারণা ও বিশ্বাসকে সুপারস্টিশান আখ্যায় চিহ্নিত করেছিলো খ্রিস্টধর্মের প্রেক্ষিতে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য দেশের বিশ্বাস এবং মিথগুলি উৎকৃষ্ট, কিন্তু ভারতীয়দের বিশ্বাস ও মিথগুলি নিকৃষ্ট। এককথায় যা কিছু অ-খৃস্টীয়, তাকে তারা অপকৃষ্ট বা নিম্ন রুচির মনে করতো। কিন্তু যে মিথকে তারা কুসংস্কার বলছে, সে ধরণের মিথ নিয়ে মাতামাতিতে তারাও তো কম মাতাল নয়। পৃথিবীতে যত মহাকাব্য এ পর্যন্ত লেখা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ নিয়ে মাতামাতি বা মাতলামি করতে দেখা গেছে। কিন্তু মিথ তো মিথ্যা বৈ কিছু নয়! মিথ্যা যদি কোনো কিছুর ভিত্তি হয়, তাহলে কিভাবে তা প্রগতি বা আলোকায়নের উদাহরণ হয়? সেদিক থেকে সায়ীদ আবুবকরের ‘নবিনামা’ এক নন্দিত ও নান্দনিক ব্যতিক্রম। কেননা, ইসলামে মিথ বলে কিছু নেই। সবকিছুই সত্যের আলোকে সমুজ্জ্বল। তাছাড়া যিনি এই মহাকাব্যর মূল-আদর্শে অতুল – তিনি তো কোনো পুরাণের চরিত্র নন, কোরআনের চরিত্র। আর যেটা কোরআন – তার অপর নাম তো ফোরকান। অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারি। তাছাড়া মহানবী (সা.) একটি ঐতিহাসিক চরিত্রও। মর্ত্যে তিনি এসেছিলেন মিথ্যার মূলোৎপাটনের জন্য এবং সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠার জন্য। তখন মানুষ তার মাবুদকে ছেড়ে মূর্তিপূজায় মগ্ন ছিলো। মূর্তিকে মনে করতো মাবুদ! মহানবী (সা.) মানুষকে সেই মূর্তিপূজা থেকে, মিথ্যে মাবুদ থেকে মুখ ফিরিয়ে সত্যের কাছে সমর্পিত হতে, সত্যের উপাসনায় উদ্বুদ্ধ করতে এসেছিলেন পৃথিবীতে। সত্য তো তা, যাকে আমরা বলি আল্লাহ। আল্লাহর অপর নাম ‘হক’,যার মানে সত্য। প্রিয় পয়গম্বরের (সা.) পৃথিবীতে পদার্পণের সময় প্রতিমা পড়ে যাওয়ার কাহিনিতেও মিথ্যের অবসান হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত মেলে। ঘটনাটি ছিলো এই- হযরত ওরওয়া সূত্রে ইবনে আসাকির বলেনঃ ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল, যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নাফায়েল, উবায়দুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ, উসমান ইবনে হুয়াইরিস প্রমুখ কুরায়েশ নেতা একরাতে জমায়েত হলেন তাদেও দেবমূর্তির কাছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, মূর্তিটি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ব্যাপরটিকে খারাপ মনে করে মূর্তিটিকে তারা সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই প্রতিমাটি পুনরায় সজোরে আছড়ে পড়ে যায় মাটিতে। আবার তারা সেটিকে সোজা কওে দেন। কিন্তু আবারও তা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। উসমান ইবনে হুয়াইরিস বললেনঃ “অবশ্যই কিছু একটা ঘটছে।” বস্তুত তা ছিলো ঐ রাত, যে রাতে মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ পর্যায়ে উসমান আক্ষেপ করে আবৃত্তি করেছিলেন একটি কবিতা, যার মর্ম ছিলো এমন-
হে প্রতিমা! দূর-দূরান্ত রথকে বড় বড় সরদারগণ
এসেছে তোমার কাছে, আর তুমি উল্টে পড়ে আছ!
একি খেলা তোমার!
আমাদেও কোনো কসুর বা অপরাধ হয়ে থাকলে
আমরা তা স্বীকার করি এবং তা থেকে বেঁচে থাকি।
আর যদি লুটিয়ে পড়ে গিয়ে থাক লাঞ্ছিত
ও পরাভূত হয়ে, তবে তুমি আর
প্রতিমাদের সরদার ও প্রভু নও।
(উদ্ধৃতি– রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনে আল্লাহর কুদরত ও রূহানিয়াত, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল গফুর হামিদী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় মুদ্রণ, জুন ২০১৬, পৃ-৩১)।
মিথ ও মূর্তি নিয়ে যখন মহাকাব্যসমূহে মাতামাতি, তখন সায়ীদ আবুবকর তা থেকে দিতে চাইলেন ইতি। পরম প্রভুর কাছে প্রার্থনা তাঁর – সুকল্যাণ, সন্তুষ্টি, মানবচিত্তের মহাশুদ্ধি, মুক্তি আর আনন্দআহার। রচিত পঙক্তিসমূহ থেকে পরিস্কার তাার পেছনে তাঁর লক্ষ্য কী। তাঁর ভাষায়–
তুমি হানো যদি কৃপাদৃষ্টি এ-অধমে,
আমার কবিতা হয় আনন্দসাগর,
আছড়ে আছড়ে পড়বে যার ঢেউ-উপঢেউ
মানবহৃদয়ে। দেব ও দেবীর স্তুতি
মহাকাব্যে এতকাল করেছে কবিরা
নতশিরে; আমার উন্নত শির, প্রভু,
জানে না প্রণত হতে, তোমার সত্তার
কাছে ছাড়া; রাত্রিদিন তোমার সিজদায়
পড়েছে হুমড়ি খেয়ে অস্তিত্ব আমার
মহাত্রাসে ; কী আছে অন্তরে তুমি জানো–
তুমি তা দিও না, নাথ, যদি তা অনিষ্ট
বয়ে আনে এ-জগতে, তোমার রশ্মিতে
বরং বিশুদ্ধ করে তাই তুমি দাও,
আছে যাতে সুকল্যাণ, তোমার সন্তুষ্টি
আর যুগ-যুগান্তরে মানবচিত্তের
মহাশুদ্ধি, মুক্তি আর আনন্দআহার।
তিনি যেহেতু বাংলা ভাষায় লিখেছেন এই মহাকাব্য, যার মূল চরিত্র মহাকালের মহানায়ক মহানবী (সা), এবং যেহেতু বিষয় ও বক্তব্যেও কাজটি ব্যতিক্রম, সেহেতু বলা যায়, নিঃসন্দেহে এটি একটি নতুন সংযোজন। সাথে সাথে সাহসী সংযোজনও। কেননা সত্য বলার জন্য কেবল সৎ হলেই চলে না, সাহসেরও প্রয়োজন হয়। অত্র মহাকাব্যে কেবল মহানবীর (সা) চিন্তা ও চরিত্রকেই তিনি মহিমান্বিত করেননি, তাঁর সাহাবাদেরকেও সঠিক, সুন্দর ও সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। সম্মানিত সাহাবাদের সাথে সাথে সমসাময়িক সময়ের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের, ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পণ্ডিতদের, সমাজপতিদের, ইসলাম বিরোধীদের এবং পূর্বের বিভিন্ন ধর্ম্গ্রন্থের ও পয়গম্বরদের উক্তি ও উদ্ধৃতি, বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার বিবরণ, যুদ্ধ ও শান্তির চিত্র, কোনোরকম পরিবর্তন না করে প্রকৃতভাবে পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে যে চিন্তা ও চরিত্র কিংবা চিত্র দরকার, তিনি তা একটুও করেননি বিকৃত। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রচিত মহাকাব্যগুলো যদি মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখা যাবে, বিকৃতি থেকে রক্ষা পায়নি কেউ। পুরানের কথা বাদ দিলাম, পূর্বের পবিত্র ধর্ম পুস্তকসমূহও যেখানে পরিবর্তন থেকে রেহাই পায়নি, সেখানে মহাকাব্যসমূহে তা বাঞ্ছনা করা বাতুলতাই। মাইকেলের মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য‘-এর যদি মূল্যায়ন করি, দেখবো বীর নায়ক হয়েছে রাবণ। কবির কারিশমা কিংবা কৃতিত্বই তার কারণ। ইসলামে যেহেতু পুরান নেই, কোরআন আছে ;আর কোরআন যেহেতু অসত্যকে অনুমোদন করে না, সেহেতু অত্র মহাকাব্যেও সেটাকে অনুসরণ করা হয়েছে অক্ষরে অক্ষরে এবং অত্যন্ত আন্তরকভাবে। মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠার এবং সত্যকে পরপারে পাঠাবার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।… উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে উভয়টা তিনি করেছেন ব্যাবহার – যাতে কারো না বোঝার অভিযোগ না থাকে । আরবিতে যেসব মুসলমান কমজোর তারা যেমন বুঝতে পারবে, আবার যারা অমুসলমান তারাও যেন না থাকে বোঝার বাইরে। অর্থাৎ কোরআন-হাদিস থেকে আরবি উদ্ধৃতিটাও দিয়েছেন, সাথে সাথে তার বাংলা কাব্যরূপটাও পেশ করেছেন। তাঁর ভাষা যেন চমৎকার ঝর্ণাধারা, আত্মহারা হয়ে ছুটে চলে সাগরপানে। একই সাথে যেখানে যে ভাষা প্রয়োগ দরকার, দরদ ও দক্ষতার সাথে তা তিনি ব্যবহার করেছেন । যুদ্ধের ক্ষেত্রে যুদ্ধের ভাষার প্রয়োগ – শান্তির ক্ষেত্রে শান্তিময় ভাষার যোগ। কোথাও জোর-জবরদস্তি নেই। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্ত, সহজ ও স্বাভাবিক।
শুধু ভাষার ব্যাবহারে কিংবা শব্দ চয়নে সতর্ক হলেই চলে না, আধুনিক হওয়াও চাই ভাষার ব্যবহার। ভাব যতই ভালো হোক, ভাষা আধুনিক না হলে, সবকিছু রসাতলে যায়। যেমন ধরা যাক, কেউ গেলো খেতে পাঁচতারকা হোটেলে, কিন্তু দেখতে পেল পরিবেসনের পেয়ালাগুলো পুরনো ও সেকেলে ; দেওয়া হয়েছে যা সেগুলোও যেন গাঁয়ের গলির কোনো ভাঙাচোরা হোটেলের বাসি খাবার; সে কি বেশি দাম দিয়ে আহার করবে এখানে? করবে না। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই – ভাষা আধুনিক হওয়া চাই। রন্ধন প্রণালী দেশীয় হলেও দোষ নেই, পরিবেষণের পেয়ালা আধুনিক হওয়া চাই। তা হলো ভাষা। আশা ও আনন্দের কথা, আলোচ্য মহাকাব্যের ভাষাও আধুনিকতার আলিঙ্গনে আন্তরিক। আধুনিকতার বাংলা ভাষার সাথে আরবি-ফারসি শব্দের যে ব্যাবহার, তা ঈর্ষণীয়। তবে তিনি যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন সেগুলো অপ্রচলিত শব্দ নয় কিংবা অপরিচিত, সেগুলো পরিচিত ও প্রচলিত। এসব শব্দ ব্যবহারের ফলে আরবীয় আবহকে আসলভাবে তুলে ধরা সহজ হয়েছে, অন্যভাবে তা সম্ভব হতোনা। কিংবা হলেও এতটা আকর্ষণীয় বা হৃদয়হরণকারী হতো না। রাসূলে আরবি (সা.)-কে, ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে গেলেও ঐ দুই ভাষার শব্দমালা এসে পড়ে। তাছাড়া ফারসি দীর্ঘকাল উপমহাদেশের রাজভাষা হওয়ার কারণে তার একটি প্রভাব বা আকর্ষণও রয়ে গেছে মানুষের মনে-মননে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রাূয় অনেক আগেই ব্যাপারটি বুঝেছিলেন এবং ‘পূর্ব বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক লেখায় আরবি-ফারসি থেকে তর্জমা করাকে ‘কর্তব্য’ মন্তব্য করে লিখেছেন, “এইভাবে আমাদের নিজেদের সাহিত্যগুলি সমৃদ্ধ হবে, অপরের সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমরা সচেতন হব এবং আমাদের দৃষ্টান্ত যদি তারাও অনুসরণ করে তা হলে আমাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ উভয় পক্ষকেই ঐশ্বর্যবান করবে।… মুসলমানকে এ দায়িত্ব আনন্দের সঙ্গে নিতে হবে। এর একটা সুফল হবে এই যে ইসলামী সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায় তা আলোর মতো স্পষ্ট হবে।… কতক লেখক যে ইসলাম থেকে প্রেরণা পাবেন এটা স্বাভাবিক। এই অনিশ্চয়তার যুগে ধর্ম যতখানি নিশ্চিতি যোগায় আর কোন জিনিস ততখানি নিশ্চিতি যোগাতে পারে! (দেশ, ২৫ বৈশাখ ১৩৬১, কলকাতা ; সম্পাদক- শ্রী বঙ্গিম চ›ন্দ্র দাশ, সহকারী সম্পাদক– সাগরময় ঘোষ)। এলিয়ট যদি খ্রিস্টান ধর্ম থেকে প্রেরণা পেতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ যদি হিন্দু ধর্ম থেকে প্রেরণা পেতে পারেন, তাহলে একজন মুসলিম হিসেবে সায়ীদ আবুবকরও যে ইসলাম থেকে প্রেরণা পাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। পেয়েছেনও। আর সেই প্রেরণার কেন্দ্র বা উৎস তো মহামানবতার মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মহৎ ও মহিমান্বিত জীবন। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন ‘নবিনামা’-এর মতো নান্দনিক ও নন্দিত মহাকাব্য। আরবি-ফারসির সাথে দেশীয় শব্দের মিশেলে তিনি এমন এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এই মহাকাব্যে, যা কেবল কাব্যিক গুণেই নয়, আধ্যাত্মিক আবহেও অনন্য। তিরিশের কবিরা একসময় ‘নিখিল নাস্তি’ নিয়ে যে নাচানাচি করেছিলেন, তার বিরুদ্ধেও ‘নবিনামা’ একটি নান্দনিক প্রতিবাদ। আল মাহমুদ তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন, “তাদের কবরের মতো নাস্তিক্যের নিস্তব্ধতায় আমি বয়ে দেবো প্রার্থনার ঘুর্ণিঝড়।” ‘নবিনামা’ যেন প্রার্থনার সেই ঘুর্ণিঝড় কিংবা বিজয়ের পতাকা। করোটির কবিতার বিরুদ্ধে এ যেন কলবের কালাম। কলবের কবিতা তো তাই, যা কলবে কলবে কানেকশন সৃষ্টি করে। প্রকৃত কবিতার প্রকৃতিও তো তাই, যা পাঠককে পড়তে প্ররোচিত করে, বাধ্য করে। সাধ্য কার, এড়িয়ে যাওয়ার! যদি কেউ একবার পাঠ শুরুকরে, উপায় নেই উঠার তা শেষ না করে। উপমার উপস্থাপনাও যে কতটা উজ্জ্বল ও উপভোগ্য তাও বোঝা যাবে উদ্ধৃতি দিলে। যেমন নবীজি (সা)-এর সুরক্ষার চিন্তায় হযরত আবুবকর (রা.)-এর সতর্ক চোখ কিভাবে ঘুরছিলো, কিংবা তাঁর অবস্থা কীরকম হয়েছিলো, তা বোঝাতে একজায়গায় তিনি লিখেছেন–
উটের সম্মুখভাগে বসে এক মনে
পবিত্র কোরান করছিল পাঠ নবি।
সেই ধ্বনি আছড়ে আছড়ে পড়ছিল
সাগরের নেচে ওঠা তরঙ্গের মতো
মরুর বাতাসে। পিছনে আবুবকর
দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো ছিলো তাঁকে ঘিরে ;
চোখ তার লাটিমের মতো ঘুরছিল
চারিদিকে, পাছে না শত্রুর ছোঁড়া তীর
বিদ্ধ করে এসে প্রাণাধিক প্রিয় তাঁর
সাথীর পঞ্জর। যেভাবে মুরগি পায়
টের আকাশে বাজের আনাগোনা আর
উদ্বিগ্ন হয়ে সে বাচ্চাদেও দেয় ডাক,
সেইভাবে পিছনে ফিরেই টের পেল
তটস্থ আবুবকর কেউ অশ্ব নিয়ে
ছুটতেছে পাছপাছ।…
(নবিনামা, পৃ. ২৪৩-৪৪)
‘নবিনামা’ নিয়ে লিখতে গিয়ে লক্ষ্য করি, আরো একটি বিষয় সামনে চলে আসে। বিষয়টি বিচ্ছিন্ন নয়, সংশ্লিষ্ট ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো বর্তমান সাহিত্য বিচার! সাহিত্য ক্ষেত্রে হোক, কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে, আধুনিকতার এই (অ)বিচার পশ্চিম প্রসূত। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাথে বাকি পৃথিবীর সম্পর্ক প্রভু ও ভৃত্যের। পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও প্রসারণের মাধ্যম হিসেবে আধুনিকতাকে প্রয়োগ করেছিলো পশ্চিমা শক্তি। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছিলো তারাই পৃথিবীতে প্রকৃষ্ট, বাকিরা নিকৃষ্ট ও অনুন্নত। উপনিবেশের উপর তারা তাদেও সেই চিন্তাকে চাপিয়ে দিলো। উপনিবেশের মানুষরাও তা মেনে নিতে বাধ্য হলো। মসনদকে তো না মেনে উপায় নেই, সবকিছু যে বাঁধা তাদের হাতে। বিশ্ব মানচিত্র কিংবা বিশ্ব ইতিহাসের ক্ষেত্রেও পশ্চিমের প্রভাব ও প্রাধান্য প্রবল। এ প্রসঙ্গে ড. আনিসুজ্জামান তাঁর লেখা এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “বিশ্ব মানচিত্রে যেমন নিজের এলাকা চলে আসে কেন্দ্রে, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমনি প্রাধান্য পায় নিজের কাল এবং পৃথিবীর অধিকাংশ ইতিহাস ইউরোপে প্রণীত বলে, তাতে প্রাধান্য পায় ইউরোপের কথা। কাছাকাছি সময় সম্পর্কে মানুষের মমত্ববোধ ও কৌতুহল স্বাভাবিক এবং নিজের ইতিহাসের উপর জোর দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে দেশকালের কীর্তির সমতা প্রত্যাশা করতে হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ ইতিহাস পড়ে মনে হয় যে, উন্নত সভ্যতার শুরু কিংবা ফিনিসীয়, পারসিক, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয় ও হিট্টিদের যে অবদান, তা বুঝি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারপর এলো ইতিহাসের অন্ধকার যুগ বা মধ্যযুগ। কিন্তু সে অন্ধকার তো শুধু ইউরোপের জন্য – তখন তো চীন, ভারত ও আরবের সমৃদ্ধির যুগ।” (মাটি, মে ১৯৯৩, ঢাকা ; সম্পাদকঃ গোলাম কিবরিয়া)। সাহিত্যের বিচারও হয় মসনদের মূল্যবোধ মোতাবেক, মহাকালের হস্তক্ষেপে নয়। মসনদের মূল্যবোধ মানে খ্রিস্টীয় তথা পশ্চিমা মূল্যবোধ। কিন্তু পশ্চিম মানে তো পুরো পৃথিবী নয়, পৃথিবীর অংশ মাত্র। ‘অংশ’ তো কখনো ‘সম্পূর্ণ’ নয়। সংগত কারণে ‘অংশের'(পশ্চিমের) সিদ্ধান্ত ‘সম্পূর্ণের’ ওপর চাপিয়ে দেওয়া তো অযৌক্তিক ও অন্যায্য। এখনো তারা তাই করছে। যেমন সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করেও তারা তাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞাসমূহ সারা পৃথিবীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর প্রজ্ঞাপ্রসূত প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যা বলেছেন তা এই পশ্চিমারা তাদের সমস্যাকে পৃথিবীর সমস্যা মনে করে, কিন্তু পৃথিবীর সমস্যাকে তারা তাদের সমস্যা মনে করে না।” সেজন্যই তাদের যে কোনো চিন্তা বা পর্যবেক্ষণ পক্ষপাতদুষ্ট। সাহিত্য ক্ষেত্রেও তাই, যেখানে সুবিচার নেই। এই যে প্রতিবছর করা নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়, সেখানেও কেবল তাদেরই জয়গান! পুরস্কারটিও প্রদান করা হয় পশ্চিমের পক্ষপাতমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সাহিত্য বিচারের মানদÐটা যেহেতু তাদেরই তৈরি, সেহেতু পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাদেরই যে প্রাধান্য থাকবে, তা পাগলও বোঝে। এক্ষেত্রে আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয় , তা হচ্ছে, পশ্চিমা সাহিত্য বিচারে মরালিটিকে মূলা দেখিয়ে মর্ডানিটিকে অধিক মূল্য দেওয়া হয়। কিন্তু মর্ডানিটি তো বাহ্যিক কাঠামো বা দেহ। মরালিটিই তো মূল বা প্রাণ। প্রাণই যদি না থাকে, দেহের কি দু’পয়সার দাম থাকে? ইংরেজিতে তো একটি কথাও আছে — What is the purpose of life if there is no soul that goes on. মরালিটি থাকলেই তো তবে, মহৎ চরিত্র সৃষ্টি হবে। মহাকালের মহানায়ক মহানবী (সা.)-কে চারিত্রিক সনদ প্রদান করেছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। মহানবী (সা) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “আর অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত।”(সুরা আল-কলম, আয়াতঃ ৪)। নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহানবী (সা.) এক হাদীসে বলেছেন, “মুমিনদের ঈমানের পূর্ণতা তখনি হতে পারে, যখন তারা নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে পূর্ণতা লাভ করতে পারবে। বস্তুত পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ মাত্রার নৈতিক চরিত্র সমপর্যায়ভুক্ত। যেখানে ঈমান পূর্ণ, সেখানে নৈতিক চরিত্রও পূর্ণ হতে হবে অবশ্যই। পক্ষান্তরে যেখানে নৈতিক চরিত্রের পতন, সেখানে ঈমানের পরিপক্বতার নিদারুণ অভাব।”(উদ্ধৃতি – জাহানে নও, সীরাত সংখ্যা ১৯৭৭, সম্পাদক- মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, পৃ-৭২)। মহানবী (সা.) ‘মহান চরিত্রের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত’ ছিলেন বলেই তাঁকে মর্ত্যের মানুষের জন্য ‘উত্তম আদর্শ’ বলে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহতালা। আল্লাহ পাক বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।”(আল কোরআন)। ‘উত্তম আদর্শ’ বলেই তো তিনি অনুসরণযোগ্য। সেজন্যই তো পৃথিবীতে তাঁকে পাঠানো হয়েছে ‘অতীব কল্যাণ’ হিসেবে। আল্লাহপাক বলেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহতালা অতীব কল্যাণ দান করিয়াছেন মুমিনদের প্রতি এইভাবে যে, তিনি তাহাদের মধ্যে তাহাদের নিজেদেরই মধ্য হইতে একজন রসূল পাঠাইয়াছেন। সে তাহাদের সম্মুখে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ বারবার উপস্থাপিত করে। তাহাদিগকে পরিচ্ছন্ন-পবিত্র প্রশিক্ষিত-সংস্কৃতিবান বানায় এবং তাহাদিগকে আল-কিতাব ও আল-হিকমাত শিক্ষা দেয় – যদিও এই লোকেরা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত ছিলো।” (সুরা- আল ইমরান, আয়াত-১৬৪)।” সায়ীদ আবুবকর ‘মহান চরিত্রের’ ও ‘উত্তম আদর্শের’ সেই মহামানবকেই মনোজ্ঞ ও মননশীল ভাষায় মূর্ত করেছেন আধুনিককালের পাঠকদের সামনে। ‘আবির্ভাব’ থেকে ‘মহাপ্রয়াণ’ পর্যন্ত ত্রয়োবিংশ সর্গে রচিত এই মহাকাব্যটি ভাবে, ভাষায় ও ভালোবাসার মেলবন্ধনে মূর্ত একটি মহান কাজ, শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ কাজ। কেবল প্রতিভা দিয়ে এমন মহাকাব্য রচনা করা যায় না, তার জন্য আল্লাহর মদদ ও অলৌকিক আশীর্বাদও লাগে। এমন একটি সুন্দর, সেরা ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মের জন্য সায়ীদ আবুবকরকে স্যালুট ও সালাম। আমার বিশ্বাস, মননশীল মানুেষরা মহাকাব্যটি পড়ে নিরাশ হবেন না মোটেও।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি । সম্পাদক : উপমা