আবু তাহের সরফরাজ
কবিতা কবির আত্মদর্শন। কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ ঘটে কবির আত্মবোধ, অন্তর্লীন অনুভূতির স্ফুরণ। কবিতার আঙ্গিক ও শব্দ-বুনন কৌশল কবির আন্তবোধকে শিল্পিত সুষমায় মণ্ডিত করে। কবিদের বোধের জগৎ বিচিত্র। তাই বিচিত্র নানা কারুকাজে নির্মিত হয় কবিতার অবয়ব। যে সময় ও সমাজ-বাস্তবতায় কবি জীবনকে যাপন করেন সেই সময়ের অভিঘাত এসে পড়ে কবির অন্তর্জগতে। সেই অভিজ্ঞতা আত্মগত করেই কবির ভেতর তৈরি হয় বোধের বুদ্বুদ। আশির দশকে কবিদের অন্তর্জগৎ তৈরিতে ওই সময়ের যে প্রভাব পড়েছিল, সেই প্রভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন রূপকল্প তৈরি হয়। ভাষার নান্দনিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে নির্মিত হয় আগের দশকের থেকে আলাদা রকমের কবিতা। আলাদা এই অর্থে যে, সত্তুরের দশকের ভাব ও আবেগ-তাড়িত শব্দপুঞ্জ আশির দশকের কবিতায় দেখা যায় না। এই দশকের কবিতার সার্বিক পাঠে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, কবিতার ভেতর দিয়ে কবিরা যেন দর্শনগত একটা যাত্রার উপায় খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছেন। এই যাত্রাপথ একেক কবির শিল্পযাত্রায় একেক রকম। বলতে কী, যে কোনো শিল্প নির্মাণের পেছনে শিল্পীর যে মূলশক্তি ক্রিয়াশীল থাকে তা হচ্ছে, নিজের সত্তাকে আবিষ্কার করা। মানে, নানাভাবে নানাদিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে চেনা, নিজের স্বরূপকে আত্ম-উপলব্ধির ভেতর নিয়ে আসা।
এখন কোথায় যাব, কোনদিকে আমার ঠিকানা?
চৈত্রের মাঠের মতো জিজ্ঞাসার মাটি নিয়ে কাঁধে
কালের রাখাল আমি, অন্তর্হিত পথ নেই জানা
স্বপ্নের জমিন বুঝি পুড়ে যাবে দারুণ বিবাদে?
গভীর সমুদ্রে আমি জনশূন্য ভাসমান দ্বীপ
প্রার্থনা, প্রার্থনা করো হাতে চাই মূল অন্তরীপ।
আশির দশকের কবি মুকুল চৌধুরী ‘জননীর প্রতি’ কবিতায় নিজের যাত্রাপথ খুঁজে ফিরছেন। নিজের স্বরূপকে চিনে নেয়ার তাড়না তার কাব্যযাত্রার সূচনাতেই আমরা দেখতে পাই। তার প্রথম বই ‘অস্পষ্ট বন্দর’এ রয়েছে এই কবিতা। বন্দর হচ্ছে জাহাজের গন্তব্য। জাহাজের মতো মানুষেরও একটা গন্তব্য মানে বন্দর দরকার। মরমী সত্য হচ্ছে, জগতের সবকিছুরই গন্তব্য দরকার। স্থিতি দরকার। লক্ষ্য দরকার। মহাবিশ্বে কোনো কিছুই লক্ষ্যহীন নয়। কাব্যযাত্রার প্রারম্ভিক পর্বেই মুকুল চৌধুরীর ভেতর এই উপলব্ধি ঘটে। এরই তাড়নায় তিনি গন্তব্যের খোঁজে উদ্গ্রীব। কিন্তু গন্তব্য যে বন্দরের মতোই অস্পষ্ট। মানুষের সমাজে নানা পথ ও মত। মুকুল জানেন, গন্তব্য অসংখ্য হয় না। গন্তব্য একটা। কিন্তু অসংখ্য পথের জটিল সমাজজীবনে সঠিক ওই একটি গন্তব্য মুকুল খুঁজে পাচ্ছেন না। তা’বলে তিনি হতাশ নন। নিজেকে তিনি কালের রাখাল মনে করেন। সময়ের অনন্ত প্রবাহে মানুষের জীবন চোখের পলকমাত্র। মানবীয় সত্তা নিয়ে সময়ের বিস্তীর্ণ চরাচরে তিনি জীবনকে চড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। মাঠে যেমন রাখাল চড়িয়ে বেড়ায় গরু। তিনি যেহেতু সময়ের রাখাল, সেহেতু খুঁজে পেতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন জীবনের সারসত্য। মানুষের জীবনের ওপর সময়ের কার্যকর প্রভাব রয়েছে। সেই অর্থে মানুষ ও সময় একটি আরেকটির অঙ্গাঙ্গী। সুতরাং, মুকুল চৌধুরী নিজেকে সময়ের রাখাল হিসেবে দাবি করলেও তিনি একইসঙ্গে জীবনেরও রাখাল। কেননা, সময়ের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তিনি জীবনকে চরিয়ে বেড়াচ্ছেন। জীবনকে চরাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু জীবনের অন্তর্নিহিত গূঢ় তাৎপর্য তিনি জানেন না। তাই খুঁজে চলেছেন জীবনের বাঁকে-বাঁকে। খুঁজে পাচ্ছেন না বলেই নিজেকে গভীর সমুদ্রে জনশূন্য দ্বীপ মনে করছেন। কিন্তু আমরা জানি, কোনো অবস্থাতেই জীবন মানে শূন্য নয়। পৃথিবীর বুকে মানুষের জীবনের গভীর মানে রয়েছে। জীবন চলার পথে এই সত্য উপলব্ধি করেছেন মুকুল। মূলত কৌতূহল থেকেই তার শৈশকে সত্য উপলব্ধির সূচনা ঘটে। ‘কবিতাসমগ্র’র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “আমার কৈশোরকালটি ছিল অন্যসব বৈচিত্র্যে ভরপুর। কোথায় কোন গাছের মগডালে পাখি বাসা বেঁধেছে, কোন গাছের ফলের স্বাদ কেমন, কার পুকুরে কত মাছ আছে, বাড়ির পাশের হাউরে মাছ ধরা পড়েছে কি-না, কোথায় কখন গানের আসর হবে, কোন গ্রামে কবে ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে— এসবের খোঁজ-খবরেই আমার সময় কেটে যেত। আর আমার বন্ধুরাও ছিল গ্রামের লেখাপড়া না-জানা, স্কুলের চৌকাঠ না-পেরোনো উদ্ধত-উচ্ছৃঙ্খল কিশোরের দল।”
এই যে শৈশব তিনি পেরিয়ে এসেছেন, ওই সময়েই তার ভেতর প্রকৃতির প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়। আর প্রকৃতি তো মানুষের জীবনের বাইরের কোনো প্রেক্ষাপট নয়। শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে জীবনের প্রতি তার কৌতূহলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে শুরু করে। সেই কৌতূহল নিবৃত্তির কোনো পথ তিনি খুঁজে পান না। এ কারণে তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি চূড়ান্ত বিনয় প্রকাশ করে প্রার্থনায় দুই হাত উত্তোলন করেছেন। কেননা, ততদিনে তিনি জেনে গেছেন, একমাত্র সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহেই মানুষ জীবনের মূল গন্তব্যের পথের সন্ধান পেতে পারে। এছাড়া আর যেসব পথ জীবনকে ঘিরে নানাদিকে চলে গেছে, সেসব পথ ভ্রান্তির। সূরা ফাতিহায় বলা আছে, “আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সেসব মানুষের পথ যাদের ওপর তুমি নিয়ামত দান করেছো। তাদের পথে নয় যাদের ওপর তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট।”
সৃষ্টিকর্তার প্রতি মুকুল চৌধুরী আত্মসমর্পণ করলেন। মানে, প্রকৃতপ্রস্তাবে তিনি মুসলিম হয়ে উঠলেন। কেননা, মুসলিম শব্দের অর্থ যে আল্লাহর আনুগত্যে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে। তার সময়ের আরসব কবিদের বেলায় আমরা দেখতে পাই, তাদের কেউ ডানপন্থি হয়ে ওঠেন, কেউ আবার বামপন্থি। সকল পন্থার মাঝামাঝি যে সরল পন্থা সেই পন্থায় জীবন ও জগতের স্বরূপ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা কেউ করেন না। মুকুল কিন্তু সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই তার কাব্যযাত্রায় পর্যটন করতে শুরু করেন। এই যাত্রাপথে যা-যা তিনি দেখলেন, উপলব্ধি করলেন, সেসবের নির্যাস ঢেলে দিলেন তার সাহিত্যকর্মে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০। কবিতার বই আটটি। এগুলো হলো: অস্পষ্ট বন্দর (১৯৯১), ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল (১৯৯৪), চা-বারান্দার মুখ (১৯৯৭), সোয়া শ’ কবর (২০০৩), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০১০), অপার্থিব সফরনামা (২০১১), মাটির ঘটনা এবং কবিতাসমগ্র। এসব বইয়ের কবিতাগুলো পাঠ করলে আমরা মুকুল চৌধুরীর দার্শনিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাই। এরই পাশাপাশি দেখি যে, তার প্রতিটি কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য আসলে আমাদের অন্তর্জগতের বহিঃপ্রকাশ। ‘অনন্তের সুর’ কবিতাটি পড়া যাক:
মাঝে মাঝে মর্মলোকে বেজে ওঠে কিসের আঘাত
সময়ের স্রোতবেগে ওঠে নামে কেমন অস্থির
নির্জনতা, নাকি কোনো পিছুটান যন্ত্রণা নিবিড়—
যা আমাকে নিয়ে যায় ভাবলোকে হানে— কষাঘাতে
কে এমন ডেকে যায় শূন্য থেকে থির থির স্বরে
ঊর্ধ্বলোকে কার বাস? অভিষিক্ত মহান প্রভুর
নাকি কোনো অভিশপ্ত মানুষের কুটিল-চতুর
মুখ ভিন্ন নামে ডাকে, ডেকে যায় ছদ্মবেশী স্বরে
আমি কি বিভ্রান্ত হবো মোহময় স্বরের অনলে
সমস্ত পুড়িয়ে দেব অধৈর্যের বেহিসেবি পাপে
নাকি কোনো অমরাত্মা বলে দেবে দৃষ্টির অতলে
যত্নহীন পড়ে আছি এই ভস্মে অন্য এক শাপে;
নিজেই নিজের নও কিভাবে হে থাকো সমকাল
জেগে উঠে চোখ মেলো— চেয়ে দেখো কেমন সকাল!
কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। প্রথমে রয়েছে আট মাত্রা, পরে দশ মাত্রা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সাথে যাদের সম্যক পরিচয় আছে তারা স্বীকার করবেন যে, গোটা কবিতার শরীরে কোত্থাও ছন্দের মাধুর্য সামান্য বিঘ্নিত হয়নি। সুললিত ধ্বনির ব্যঞ্জনায় শব্দগুলো সুশৃঙ্খল দাঁড়িয়ে আছে। শব্দের শৃঙ্খলায় কোথাও ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের চোখে পড়ে না। বলতে কী, কবিতা লিখতে গেলে ছন্দের জ্ঞান খুবই জরুরি। হোক না সেটা গদ্যকবিতা, এরপরও ছন্দজ্ঞান জরুরি। আলগাভাবে মনে হতে পারে, গদ্যের আঙ্গিকে কবিতা লিখবো তাতে আমার ছন্দের বাধ্যবাধকতা কেন? ছন্দ কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা নয়, ছন্দ শব্দের সুষমা। শব্দ উচ্চারণের গতিকে ছন্দ শ্রুতিমধুর করে। ফলে, গদ্য-আঙ্গিকে কবিতা লিখতে গেলেও শব্দের গতিকে লালিত্য দিতে হয়। তা না-হলে শব্দ-বুনন সৌন্দর্য হারায়। শব্দের উচ্চারণেও কর্কশ ধ্বনি ওঠে। ছন্দের এই গূঢ়তথ্য না জানায় অনেক কবির কবিতা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। কিন্তু মুকুল চৌধুরীর কবিতায় ছন্দ যেন স্বভাবসিদ্ধ উপায়েই প্রোথিত। শব্দের শ্রুতিকে মাধুর্য দিয়ে মুকুল পাঠককে আত্মার ভেতর ডুব দিতে উদ্বুদ্ধ করছেন। মাঝে মাঝে হৃদয়ের খুব গহনে কিসের যেন আঘাত এসে লাগে। আমরা টের পাই, কিন্তু ঠিকঠাক সেই আন্দোলিত অবস্থার স্বরূপকে উদ্ঘাটন করতে পারি না। জীবন চলার পথে সময়ের খণ্ড খণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়ে। সেই ঢেউয়ের আঘাতে আমরা অস্থির হয়ে উঠি। নির্জনতার কোনো অবসরে অস্থিরতা খানিকটা কমে এলে আমরা আত্মার ভেতর থেকে শুনতে পাই কারো যেন আহ্বান। কে ডাকে? কী বলে সে? আত্মা যে অনিত্য আর উর্ধ্বগামী, এ তো আমরা সকলেই জানি। কবি দ্বিধান্বিত যে, সেই আহ্বান মহান প্রভুর নাকি কোনো কুচক্রী মানুষের! ছদ্মবেশী স্বরে যে আমাদের গহন-প্রান্তরে আমাদেরকে আহ্বান করে চলেছে। সেই হিসাব মেলাতে কবি ধৈর্যধারণ করেন। কারণ তিনি জানেন, অধৈর্য হলেই তিনি বিভ্রান্ত হবেন। সত্যের গন্তব্যে তিনি পৌঁছতে পারবেন না। সত্যের গন্তব্যে পৌঁছতে আশির দশকের আর কোনো কবির কি এরকম আকুলতা আমাদের চোখে পড়ে? পড়লেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সে সংখ্যা খুবই কম। মুকুল চৌধুরী তারুণ্যের শুরুতেই উপলব্ধি করেছেন, জীবনে অধৈর্যই পাপ। ধৈর্যের ভেতর দিয়েই মানুষ পরম সত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারে। অন্তর্চক্ষু খোলে নিজের দিকে তাকাতে নিজেকেই প্ররোচিত করছেন মুকুল চৌধুরী। তবেই দেখা সম্ভব আত্মার স্বরূপকে। যাকে কবি সকালের সাথে তুলনা করছেন। কেননা, অসত্যের কালো মেঘে মানুষের জীবন নিকষ রাত্রির অন্ধকারে আচ্ছাদিত। সত্যই সেই অন্ধকার দূরীভূত করে নতুন সকাল উন্মোচিত করতে পারে। প্রথম বইয়ের ‘প্রাপ্তি’ কবিতায় মুকুল চৌধুরী লিখেছেন:
তোমার সন্ধান আমি আমাতেই পেয়েছি নিশ্চিত
প্রথম বয়সে প্রভু এই প্রাপ্তি অনিদ্র ভ্রমণ
সারাটি জীবন যেন টেনে যেতে পারি এই দাঁড়।
প্রথম বয়সেই কবির জীবনে সত্যের প্রাপ্তি ঘটেছে। মানে, তিনি পরম সত্তাকে আত্মার ভেতর উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এই বোধ তাকে দিয়েছে মানবীয় সুরক্ষা। তাই তো তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন, এই বিশ্বাস যেন তিনি আমৃত্যু বুকের ভেতর লালন করতে পারে। আধ্যাত্মিকতার এই স্ফূর্তি মুকুল চৌধুরীর কবিতাকে দিয়েছে আশির দশকের আরসব কবিদের কবিতা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য। মুকুল চৌধুরীকে আমরা বলতে পারি আধ্যাত্মিক ভাবনার শিল্পসাধক। আর তার কবিতা হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিকতার শৈল্পিক স্ফুরণ। তবে এখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে নেই তার কবিতা। আমরা জানি, মহাবিশ্বের অনন্ত বিস্তৃতির মতো কবিতার শিল্পভূমি। ফলে কবিতার কারিগর হিসেবে মুকুল চৌধুরী নানা বিষয় ও আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। তবে তার সেসব কবিতার প্রেরণা হিসেবে আমরা দেখতে পাই আধ্যাত্মিকতার শৈল্পিক কারুকাজ। মুকুলের কবিতার বিষয় বিচিত্রতার বর্ণে ও অনুষঙ্গে বিশিষ্ট। প্রকৃতির রূপরসগন্ধে যেমন তার কাব্যপুঞ্জ বিকশিত, তেমনই দেশের প্রতি গভীর মমত্ব প্রকাশ পায় তার কবিতায়। মানবতার মরমী সুর আমরা শুনতে পাই তার কবিতার গহন থেকে। আবার কখনো রাজনীতির সরল বয়ানে কবিতার মধ্য দিয়ে মুকুল চৌধুরী আবির্ভূত হন পাঠকের সমব্যথী হিসেবে। এতকিছুর পরও মূলত তিনি আধ্যাত্মিক ভাবধারার শিল্পসাধক হিসেবেই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। মনের অন্ধকার মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। সেই অন্ধকার দূর করার উপায় বাতলে দিচ্ছেন মুকুল চৌধুরী ‘এক আশ্চর্য ভোরে’ কবিতায়।
মাঝে মাঝে আশ্চর্য ভোর দেখি পলকে ঘুম ভেঙে গেলে।
মুছে যায় শরীরের সকল ক্লান্তি ও অবসাদ।
ক্লান্তিহীন ফুরফুরে মননে ও বোধে মনে হয় কত যুগ ঘুমিয়েছি
…………
এরকম আশ্চর্য ভোর কি দেখব পৃথিবীতে?
যার প্রতিচ্ছায়া আসবে মননে? যা দেখে মন ভালো যাবে।
মনের অন্ধকার যাবে মুছে।
যা দেখে ঐশী পুলক জাগবে মানুষের শিলপাটা অন্তরে।
খুব ভোরে কোনো দিন ঘুম ভেঙে গেলে ভোরের আশ্চর্য রঙে রাঙিয়ে যায় কবির হৃদয়। আর তখন আত্মার ভেতর তিনি প্রশান্তি অনুভব করেন। তার দেহের সকল ক্লান্তি ও অবসাদ ধুয়ে দ্যায় ভোরের আলো। কবি বলছেন, এই রকম আশ্চর্য ভোরে মনের অন্ধকার মুছে যায়। অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যখন মন আলোকিত হয়ে ওঠে তখন ঐশী আনন্দ শিহরণ তোলে অন্তরে। আর তখন পাষাণসম মানুষের হৃদয় স্রষ্টার করুণায় বিগলিত হয়ে ওঠে। আমরা তো প্রায়ই ভোরের এই রূপ প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু মুকুল চৌধুরীর মতো উপলব্ধি আমাদের ক’জনের ভেতর হয়েছে? জীবন ও জগতের পারম্পর্য এইভাবে মুকুল চৌধুরী নির্মাণ করে চলেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। তার কবিতা পাঠে পাঠকও তাড়িত হয় জীবনের মহৎ সত্যকে উপলব্ধি করতে। মুকুলের কবিতা তাই কেবল শিল্পই নয়, একইসঙ্গে তার দর্শনযাত্রাও। এই যাত্রায় তিনি জীবন থেকে শিখেছেন অনেক। জেনেছেন, যার জীবন যত সরল তার জীবনে তত বেশি শান্তি। তাই তো তিনি কবিদের ঠেলাঠেলি ও প্রতিযোগিতার হট্টগোল ছেড়ে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছেন সিলেটে। বলা চলে, কবি হিসেবে নিজের প্রকাশ নিয়ে তার কোনোই মাথাব্যথা নেই। বরং আত্মার শান্তিই তার কাছে পরম আরাধ্য। ‘চল্লিশ বসন্তের পর’ কবিতা থেকে কয়েক টুকরো পড়া যাক:
আমি এখন সমস্ত প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে। ঘরে-বাইরে এ মুহূর্তে
আমার কোনো প্রতিযোগী নেই। বন্ধুদের কাব্যহিংসা
সহকর্মীদের ছিদ্রান্বেষণ
থেকে দূরে এক মফস্বলবাসী। স্ত্রী-পুত্রের ভালোবাসাও যার এখন
সপ্তাহান্তের প্রতীক্ষা— সেখানে আমি কার সাথে ‘খরগোশ দৌড়’ দৌড়াবো?
অনেক দৌড়েছি। এবং দৌড়াতে দৌড়াতে চল্লিশ বসন্তের পর অনিশ্চয়তার
ক্লান্তি এখন আমার পথরোধ করে দেয়। জয়-পরাজয়ের আশঙ্কায়
দূর পথও অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট পথরেখায় দাঁড়িয়ে আমার যাত্রারম্ভের
কথাও মনে পড়ে। এক শুভ্র সকালের জ্বলজ্বলে স্মৃতি।
যাপিতজীবনে যে যত সফল, সে তত বেশি আত্মপ্রব ক। মানে, নিজের আত্মার শান্তি নষ্ট করেই তাকে সফল হতে হয়। সফলতা অর্জন করা মানেই তীব্র প্রতিযোগিতা। তাই মুকুল চৌধুরী সফলতার প্রথাবিরুদ্ধ একটি সংজ্ঞা আমাদেরকে দিচ্ছেন। তার কাছে, সফল সেই মানুষ যে আত্মার শান্তি রক্ষা করে চলে। মানে, যার জীবনে শান্তি রয়েছে। এই সংজ্ঞা নিশ্চয়ই তার আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সারাৎসার। আমরা জানি যে, প্রথাগত সফল হলেও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা মানুষকে সবসময় তাড়া করে ফেরে। প্রতিমুহূর্তে সফল মানুষকে তটস্থ থাকতে হয় তার সফলতা বজায় রাখতে। এ অবস্থায় তার হৃদয় অস্থির থাকে। সেখানে শান্তির সামান্য অংশও বজায় থাকে না। কিন্তু মুকুল তার আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে শান্তির কল্যাণময় বার্তা স্বীয় আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। এই শান্তিই মানুষের মোক্ষ।