রফি হক
আ আ চৌ আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না।
আমি যখন স্কুলে পড়ি, তিনি তখন কুষ্টিয়ার কোনো একটা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে দেখতাম মুসলিম স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়ারেস হোসেন, চাঁদ সুলতানা গালর্স হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আসমা আপা এবং দিনমণি স্কুলের আব্দুর রাজ্জাক -এর সঙ্গে। তাঁরা শুধু সহকর্মীই নন পরস্পরের ভালো বন্ধু, অথবা বন্ধুর অধিক ছিলেন। তাঁদের চারজনের এই চতুষ্কৌণিক সম্পর্ক জ্ঞানে রুচি আর নন্দন ভাবনায় নতুন একটি রূপ তৈরি করেছিলেন।
.
মোটকথা, আবুল আহসান চৌধুরীকে কুষ্টিয়ার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সারাক্ষণে পেতাম। তিনি হাঁটুর নিচে অবধি ঝুলে পাঞ্জাবি পড়তেন। নিজেও ছিলেন ছ’ফুটের কাছাকাছি । সাদা পায়জামার সঙ্গে পড়তেন। পরিপাটি করে চুল আচড়ানো, রবীন্দ্রনাথের মতো ঘাড় অবধি চুল নেমে আসা। কিন্তু তাঁর অবিন্যস্ত বাবরি ছিল না। তিনি খুবই গুছানো, পরিপাটি একজন উন্নত রুচির মানুষ ছিলেন। চোখে বড় ফ্রেমের পাওয়ার গ্লাস পরতেন। আর তাঁর লম্বাটে মুখের নাকের বারান্দায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো এক ফালি গোঁফ ছিল। তাতে তাঁকে রবীন্দ্র পরিবারের সদস্য মনে হতো।। কুষ্টিয়ার শিল্প-সাহিত্য, নিউজপেপার, মাস কমিউনেকশান এর উন্নতিতে চৌধুরী পরিবারের অবদান রয়েছে। ওয়ালিউল বারী চৌধুরী ছিলেন আ আ চৌ -এর বড় ভাই। পেশায় ছিলেন এ্যাডভোকেট এবং কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত প্রথম খবরের কাগজ “ইস্পাত” -এর প্রকাশক ও সম্পাদক। তাঁর আরেক ভাই রশীদ চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী, কুষ্টিয়া থেকে তখনও বোধহয় ঢাকায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আর্ট কলেজে পড়তে কেউ যাইনি। সেই হিসেবেও এই পরিবার থেকে কুষ্টিয়ার প্রথম চিত্রশিল্পী হয়েছিলেন রশীদ চৌধুরী। এ-ছাড়া তিনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক। তিনি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতেন সাপ্তাহিক “জাগরণী” পত্রিকা। আর আবুল আহসান চৌধুরী ছিলেন প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক, প্রাজ্ঞ গবেষক ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। অনেকটা ইটালির মেদেচি পরিবারের মতো, অথবা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতোই মনে হতো তাঁদের আমার কাছে।
.
আজ থেকে চুয়াল্লিশ বিয়াল্লিশ বৎসর আগে তাঁর কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে জেনেছি। লালনকে জেনেছি। কাঙ্গাল হরিনাথকে জেনেছি। মীর মোশাররফ হোসেনকে জেনেছি। তখন আমাদের বয়স বারো, তের, চৌদ্দ। তিনি হয়তো ত্রিশও ছিলেন না!
.
আজকের প্রজন্ম লালনকে জন্ম থেকেই জানছে। আমাদের সে উপায় ছিল না। আজকে লালনকে নিয়ে যা কিছু– যতটা কিছু– এ তাঁদের গবেষণা, নিষ্ঠা, একাগ্রতার ফসল। অধ্যাপক আনওয়ারুল করীম এবং আবুল আহসান চৌধুরী–এই দুই গবেষকের নিরন্তর গবেষণায় আমরা লালনের একটি আদল পেয়েছি। আমি সেদিনই অন্নদা শংকর রায়ের একটি প্রবন্ধে লালন বিষয়ে আবুল আহসানের নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার কথা পড়ছিলাম ।…
.
আমি আমার নিজের শৈশব, আমাদের সমসাময়িকদের শৈশবের কথা স্মরণ করতে পারি– আমরা আমাদের ছেলেবেলায় ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৭ সালেও কখনও ছেঁউড়িয়ামুখি হইনি। লালনের মাজারে যাইনি। যাবার সাহসই হয়নি।। পরে বুঝেছি, না যাবার পেছনে নানা ধরণের সামাজিক বিষয় আশয় ছিল। সেই ব্যাপারটি ১৯৮০ -এর দশক থেকে কাটতে থাকে। যা এখন কল্পনারও বাইরে।
.
বর্তমানে লালন এমনভাবে দখল করেছে আমাদের হৃদয় ! ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদা পারভীন– “ফরিদা পারভীন” হয়ে উঠছেন। যদি একটু ফিরে দেখি, স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কুষ্টিয়া সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল। পাড়ায় পাড়ায় নাটক হচ্ছে, রবীন্দ্র নজরুল, সুকান্ত জয়ন্তী হচ্ছে। লালনের গান হচ্ছে। কাঙ্গাল হরিনাথ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাঘা যতীন, মীর মোশাররফ নিয়ে আড্ডা হচ্ছে। শহরময় স্পোর্টসের নানা ধরণের ইভেন্ট হচ্ছে । কলেজ মাঠ, ইউনাইটেড স্কুলের মাঠ, মোহিনীমিল স্কুলের মাঠ, মুসলিম স্কুলের মাঠ– এটা ছিল কিন্তু। এখন আর দেখি না। বরং আগে ক্রিকেট আরও বেশি খেলা হতো মফস্বলে, এখন তো মাঠই নাই।
.
তো অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীকে নিয়ে কথা হচ্ছিল ।
আমি সরকারী কলেজে ভর্তি হলাম ১৯৮১ সালে। তখন আবুল আহসান চৌধুরী কি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে যোগ দিয়েছেন? আমি কুষ্টিয়া থেকে আর্ট কলেজে পড়তে এলাম- ১৯৮২ সালে। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে। ঢাকা এসে শুনেছিলাম সরকারি কলেজ থেকে আমার প্রিয় আবুল আহসান চৌধুরী যোগ দিয়েছেন। ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন আরও পরে।
.
কুষ্টিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম– ‘ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়’ কেন জানি না। এখানে কী ইসলামিক বিষয় আশয় পড়ানো হয় কি-না জানি না। আবুল আহসান চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–এটা খুব গৌরবের অন্তত ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। গত পরশু ১৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন ছিল, তাঁর জন্মদিনে আমার অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
.
ধন্যবাদ প্রিয় অগ্রজ ড. তপন বাগচী । ড. তপনের একটি লেখা পড়ে এই কথাগুলো মনে পড়লো। আবুল আহসান চৌধুরী হলো ড. তপন বাগচীর গুরু। তপন লিখেছেন : “…তিনি আমার গবেষণা গুরু। ফোকলোর গবেষণা শিখিয়েছেন। আমাকে পিএইডি উপাধি দিয়েছেন। এই মুহূর্তে তিনি দুই দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গবেষক, শ্রেষ্ঠ বক্তা”।
সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪
১ মাঘ ১৪৩০
রফি হক : শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এন্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।