ড. মাহবুব হাসান
সময় এখন তেল ফুরানো মাটির প্রদীপের মতোই নিঃস্ব।
শস্যদানার ভেতরে যে জীবন, তা আমরা দেখি না, তারা (শস্যরা) দেখে। মানুষ কি নির্মম ও হিংস্র কায়দায় সব গ্রাস করছে। গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে এটাই মনে হয় আজ আমার।
কেবলই ওই শস্যদানার কথা মনে হয় আমার। আমরা যে নির্মমতা নিয়ে যাপন করি নিজেদের জীবন, আর ক্ষুধার চেয়েও বেশি ব্যয় করি সেই নিয়ামত, তা একবারও ভাবি না। আমার কষ্ট এখানেই যে আমরা প্রাণ ও প্রাণীকে বুঝি না। কেবল ধ্বংস করতে ভালোবাসি। মানুষ আর মানবতা কোথায় গেছে ,ভাবলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একবার শ্বাস বন্ধ হলে তো জীবন শেষ। এই বোধটুকুও মানুষের নেই।
মানুষকে যে মরতে হবে, এই সত্য তারা জানে, কিন্তু মানে না।
এই বেদনা নিয়ে বেঁচে আছি।
২.
আমার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কবি জাহিদ হায়দার। বললো, কবি তো কল ধরছে না। কবি মানে জাহাঙ্গীর ফিরোজ। বললাম– সে তো মসজিদে। জাহিদ বললো, তোর মাথায়ও তো টুপি। বললাম– আমি ফিরছি সেখান থেকেই। জাহিদ বললো, কবিতা এখন নামাজ পড়ে। বললাম–হ্যা, পড়ে। জাহিদ একটি হাসি দিলো দাঁত বের করে। আমি সেই হাসির নাম দিলাম গুয়ামুড়ি হাসি। এই হাসি কি কিছুটা তাচ্ছিল্যের? মনে পড়ে না। তবে ওর হাসির বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে। এখন, মানে আজকাল অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। এটা কি বয়সের দোষ? মেমরি লস হচ্ছে এটা বুঝতে পারি । ডিমেনশিয়া! কী? হতে পারে। কিন্তু সেই নেংটাকালের অনেক কথাই তো দিব্বি মনে আছে। চলো যাই দেখে আসি সেই কিশোরকালের ছবি , যা এখনকার স্টান্ডার্ড কলোক্যাল বাংলা ভাষায় লিখছি। অনেক প্রজ্ঞাবান বলেন এই ভাষা নাকি প্রমিত বাংলা। এই প্রমিত শব্দের মানে আমি জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। যেমন আমি চেষ্টা করেও আজ আর আমার শিশুকাল কিশোরকালের ভাষা বলতে ও লিখতে পারবো না। নো যাইগ্যা বললে অনেকেই ধাক্কা খাবেন কেন না, নো বলতে আমি কি বোঝাতে চাইছি। যারা নো শব্দের অর্থ জানেন, তাদের ৯ ভাগই পড়তে বা লিখতে জানেন না। তাদের ছেলেমেয়েরাও আজ স্ট্যান্ডার্ড কলোক্যালের গরম তাপে আস্তে আস্তে অপ্রমিত বা গ্রামীণ বুলি থেকে সরে আসছে। খেয়াল করলে বোঝা যায় মানুষ কিছু শিখলে, সেটা ধ্বনি ও শব্দের অন্তরে ঢুকতে চায়। এটা তার প্রাকৃতিক বা সহেজাত প্রবণতা, যা নেচারাল।
জাহিদের কথায় আসি। ও যখন বললো কবিতা তো ফোন ধরছে না। আমি বুঝলাম কবিতা মানে জাহাঙ্গীর ফিরোজকে মিন করছে। আবার ফোন বলায় আমি বুঝলাম ওর ফোন বা সেলুলার থেকে কল করা বোঝাচ্ছে। ভাষার ভেতরে এই রকম ইঙ্গিতময়তা থাকে। আমরা পরিবেশ প্রতিবেশ ও সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রে সে সব কথার মানে বুঝে নিই। আমরা গোরু তাড়াবার বা আরো নানা কাজে ব্যবহারের বাঁশের তৈরি ছোটো টুকরো লাঠি বা কাঠি , যাকে আমরা বলতাম নড়ি, বা পাজন ইত্যাদি,বুঝতে পারি কিন্তু আজকালকার নগর শিশু কিশোররা তা বুঝবে না, চিনবেও না। চুকুরি নামের একটি ফল আছে, তা গ্রামের ছেলেরাও ভুলে বসে আছে, বোধহয়। পাংকিচুংকি নামের একটি ছোটো ফল আছে, বাড়ির পেছনে বা আড়ায় জন্মে,অনেকটা ব্লুবেরীর চেয়েও আকারে ছোটো, টক আর মিষ্টি মেশানো, সেই সব গাছ তো আজকালকার গ্রামের ছেলেরাও চিনবে কি না , সন্দেহ করি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বড় ঘরের গা লাগোয়া একটি ছিলো, জঙ্গলা গাছে, কিন্তু গরমের সময় পাকা কুচকুচে কালো হয়ে যেতো, কতো যে তুলে মুখে পুরেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না, পরিত্যক্ত, ঘরগুলোও নেই। নড়বড়ে, পরিত্যক্ত একটি দাাঁড়িয়ে আছে টিনের বেড়াগুলো নড়বড়ে দাঁতের মতোই অযত্নে আছে। আমাদের শরিকি ভাইয়ের ছেলেরা সংসার করে। তার ওয়াস রুমে হাই কমোড, লো ডাউন দুটেই দেখলাম। গ্রাম এখন নগরের সভ্যতায় আছে।
সেই দুরন্ত শিশুকাল আমার পিছু ছাড়ে না।
আমাদের বাড়ির পেছনে বেশ বড়সড় জঙ্গল ছিলো, আজ আর নেই। সেই জঙ্গলে ঝোপ-ঝাড় আর বেতের কয়েকটি গুচ্ছ ছিলো, ছিলো পাটিবেতের একটি এলাকা। আর একটি বেশ বড় ভূতুড়ে জারুল গাছে। ওই জারুল গাছে কতো যে পেত্নী থাকতো আজ আর মনে নেই। সেই জঙ্গলের পশ্চিম পাশে ছিলো একটি গাব গাছ। গাব গাছে ভূতেদের আড্ডাখানা। কিন্তু গাব পাকলে সেই আড্ডা ভেঙে আমরা গাছে চড়তাম পাকা গাব পাড়তে। ঠিক দুপুরবেলা, গাছ-পাকা গাবের রস খেতে কি যে মজা। আর বেতের গুচ্ছে ঝুলে থাকা বেতফলের গোছা আমরা কোটা দিয়ে টেনে এনে বেথুলের ঝোপা পারতাম। টক আর মিষ্টি মেশানো বেতফল (বেথুল) ঠিক দুপুরবেলা, জিভে জল এনে দেয় আজো। পেত্নী ঠাসা জারুলের পাশেই ছিলো আরেকটি গাছ। সেই গাছের নাম তো ভুলে বসে আছি। মনে হয় আমরা আঠা গাছ বলতাম। কিংবা লোকবাংলায় প্রচলিত নামই বলতাম। আজ ভুলে, গুলে খেয়ে বসে আছি। হায়রে মেমরি আমার!
চঙ বা ঘুড়ি বানানোর বাশপাতা কাগজে বংকুই গোটার মতো ফ্যাকাশে রঙের সেই আঠা দিয়ে কতো যে ঘুড়ি বাড়িয়েছি। মায়ের উঠোন ঝাড়ু দেবার শলাগুচ্ছ বা গোছা থেকে দুই/চারটি শালা চুরি করেছি ঘুড়ি বানাবার জন্য। তবে চঙ বানানোর জন্য খুব কষ্ট করতে হতো আমার। চঙয়ের খাচা বানানোর জন্য বাঁশের ঠুকরোকে ফালা ফালা করে নিয়ে সেগুলো ক্রমাগত চেঁছে সুযোগ বা চ্যাপ্টা করে নিয়ে তারপর চারকোনো খাচা বানাতাম। প্রথমে চারটি কাঠি বাধতাম। তারপর দুই কোণা থেকে দুটি কাঠি পূরণ চিহ্নের মতো,( ইংরেজি এক্সএর মতো করে চার কোণে বাধতাম। তারপাশে দিয়ে আরো সরু কাঠিগুলো ওই রকম করে বাধা শেষ হলে চঙ-এর মাথায় একটি পাতলা করে চাঁছা বাঁশের কাঠি বানাতাম। সেটা ঠিক মতো বেঁকে আমার চাহিদা মতো হয় কিনা, সেটা পরখ করতেই দিন উজাড় হয়ে যেতো। সেই কাঠি ঠিক হওয়ার পর আমি বা আমরা বেতের ঝোপ থেকে একটা পাকা বেত গাছই কেটে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনতাম। তারপর সেই বেত থেকে একটি অংশ পাতলা বের করে কেটে আনতাম। সেই অংশটি দা দিয়ে চেঁছে চেঁছে এমন পাতল করতাম যে তাতে ফু দিলেও সেই বেতের ফিতা রা রা করে বেজে উঠতো। তখন আমি বুঝতাম চঙয়ের মাথার ওই বাশের শিরটাতে বেতের পাতলা অংশ এমন কায়দায় বাঁধতাম যে তা গুলালের মতো বেঁকে এসে অন্য প্রান্তে ঠিক মতো বাধা যায়। এটা খুব কঠিন ছিলো আমার জন্য। তবে প্রতি বছরই এটা করতে করতে অভ্যাস দক্ষতায় পৌছে গেলো। চঙয়ের নিচের দিকে দুই হাত খানেক লম্বা বাঁশপাতার কোণাকুণি লেজ লাগাতাম আমরা। সেটা ঘুড়ির বেলায় কিন্তু এতো ছোটো হতো না। ঘুড়ির লেজ হতো আট/দশ হাত লম্বা আর চিকন। ঘুড়ির নিচে সেই সাপা লেজ লাগিয়ে দিতাম আমরা। সেই সময়টা ছিলো আগ্রহায়ন ও পৌষ মাস। তখন শীতের একটি ঠাণ্ডা আভা বাতাসে থাকতো। রোদ আর বাতাসের সেই তাপে আমাদের মনও চনমন করে উঠতো। আমরা ধান-কেটে নেয়া জমিতে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম। বাতাস কোন দিকে বইছে আমরা বুঝতাম। তার আগে দুটি কাজ করতাম। বাজারের বাইন্যার দোকান থেকে লম্বা সুতার পুটলি কিনে আনতাম। সেই সুতায় গাবের রস দিয়ে তা শুকাতাম। তাতে সুতা বেশ শক্ত হতো, সহজে ছিঁড়ে যেতো না। আর যদি ঘুড়ি বা চঙ কাটাকাটির প্রতিযোগিতার অফার পেতাম, তাহলে সুতায় মাঞ্জা দিতে হতো। ওই মাঞ্জা যে দোকানে পাওয়া যায় তা জানতাম না। প্রতিযোগিদের ঘুড়ি বা চঙ-এর সুতা কেটে দিতে পাররে যে বিজয়ী খুশি জাগতো আমাদের, তার তুলনা সারা জীবনে আর পাইনি। চিলা ও ফেসক্যা নামেরও দুটি ঘুড়ি বানাতাম আমরা। চিলের মতো দেখতে হতো চিলা। চিল উড়লে যে রকম দেখতে হয়, সেই আকৃতি হতো। আর ফেসক্যা যে আমাদের এখনকার চেনা ফিঙে, তা বহুকার পর জেনেছি। চঙ নামের ওই আকাশযাত্রী যে কোনো পাখির রূপ থেকে এসেছে, তা জানতাম না, আজো জানি না। মানুষের সৃজনী চেতনাই তার নির্মাতা, আজ বুঝি।
আমরা যারা কিশোর-যুবা ছিলাম, তারা ছোটো আকারের ঘুড়ি বা চিলা বা ফেসক্যা, চঙ বানাতাম। যারা যুবক তারা বানাতেন অনেক বড় চঙ। দুপুর ও বিকেলে মাঠে নিরানির কাজে বসার আগে সেই চঙ উড়িয়ে দিতেন তারা। একটা খোটা বা সুতার খুটি মাটিতে গেড়ে রেখে দেয়া হতো অথবা গরু খেদানোর নড়ি বা শক্তপোক্ত বাঁশের খুটিতে বেধে দিব্বি কাজে মন দিতো তারা। চঙয়ের মাথার সেই বেতের ফিতার রা রা শব্দে মুখর হয়ে উঠতো চারপাশ। বাড়ির ভেতরে বসেও ওই রা রা শুনতে পাওয়া যেতো। যারা মাঠে কাজ করতে করতে ওই চঙ-এর শব্দের সঙ্গীত শুনতেন, তারা মুগ্ধ হতেন। কাজের ভেতরে থেকেও উপভোগ করতেন সেই পরমানন্দ, যা প্রকৃতির মতোই ছিলো স্বাধীন।
ওই স্বাধীনতা আজ আর কোথাও দেখি না।
৩.
চৈত্র বৈশাখের রোদের দুপুরগুলোতে হাঁসফাঁস করতো মানুষ। নিরাক পড়েছে। মানে কোথাও বাতাস নেই। এমনই ঝিম-মারা দুপুরে ক্ষেতের কাজ রেখে তারা গাছের নিচে এসে জিরিয়ে নিতো। ঠিলা ( যাকে মাটির কলসি বলে চিনি আমরা) ভরতি পানি নিয়ে আসতো তারা মাঠে। সেই পানি পেটপুরে খেতো। তার পর ঘাসের কার্পেটে শুয়ে পড়তো। আমরা শিশু-কিশোররা আম গাছের নিচে বেতের পাটি বিছিয়ে শুয়ে গরম থেকে বাঁচতে চেষ্টা করতাম। নিরাক না পড়লে, গাছপালার মধ্যেই একটি মৃদু বাতাসের ধারা বইতো। আমি দুপুরের ভাত খেয়ে এসে ঘর থেকে বেতের পাটি বিছাতাম আমাদের কালাচারা কিংবা চিতল বা দরবারি আম গাছের নিচে। ছোটো ভাই ও বোনরাও পাটিতে শোতো। আর আমাদের পাশের গ্রাম একঢালায় ছিলো বড় খালার বাড়ি। সেই বাড়িতে ছিলো আমাদের অবাধ যাতায়াত। খালাদের ছিলো অনেক আম গাছ। দুই বা তিন একর জুড়ে আমের বাগান। আমরা কাচা আমের ভর্তা করে গাছের ছায়ায় বসে তা ভোগ করতাম। আহা সেই সব দিনের কোনো তুলনা কি হয়? হয় না।
৪.
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মনে পড়ছে টিনের তৈরি স্কুল ঘরটিকে। এল প্যাটার্নের সেই টিনের ঘরের পশ্চিম পাশের ক্লাশটি প্রাইমারির শেষ ধাপ, পঞ্চম শ্রেণির। সেই শ্রেণিতে পড়াতেন আমার বাবার বন্ধু ও এই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, আমার আব্বাও ছিলেন তাদের একজন, পড়াতেন ইংরেজি। আমি তাঁকে খুব ভয় পেতাম। তিনি পড়াতেন আর হাতে ধরা বেতটি নাচাতেন। তা দেখেই আত্মায় জল শুকিয়ে যেতো। তেষ্টায় বুককাঠ কাঠ ঠেকতো। গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চাইতো না। সৈয়দ নওয়াজেশ আলী প্রায় দিনই আমাকে টার্গেট করতেন। বন্ধুর পোলা কি লেখাপড়া করে সেটা যাচাই করাই ছিলো তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব, এটাই আমি বুঝেছিলাম অনেক পড়ে। বলতেন, খানের পোলা কৃষ্ণচূড়া বানান করো। আমি তার দেয়া পড়া ঠোঁটস্ত করে আসতাম, যে কোনো মূল্যে। আমি বানানটিকে বহুকষ্টে আয়ত্ব করেছিলাম। এবং হরহর করে সেই বানান আমি বলে দিতাম। তিনি খুব উচ্ছসিত হতেন। আর যেদিন পারতাম না, থতমত খেয়ে তুতলাতাম, সেদিন তিনি আমার কান ধরে মুচড়ে দিতেন আর তার সঙ্গে চলতো সেই নৃত্যময় বেতের চাটি। পিঠ লাল হয়ে যেতো। আর খানের পোলা কর কি, সারাদিন কর কি? ক্লাশের পড়ারও সময় হয় না? যেদিন পড়া পারতাম সেদিন আমার প্রশংসা করে কাছে এসে বেতের একটি চাটি দিতেন। বলতেন, তর বাবারে কমু, তুই ভালো করছিস।
তিনি তুই-তুকারি করতেন। শুধু তিনি নন, সব মাস্টারই শিশুদের তুই তুকারি করতেন। আমরা এর কোনো বিকল্প জানতাম না। এই যেমন আমাদের আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম ছাড়া পৃথিবীতে আরো গ্রাম/শহর আছে, এটাও জানতাম না। আরেকটু বড় হলে জানলাম আইসড়া গ্রামের কাছেই আছে একটি শহর, টাঙ্গাইল তার নাম। মাত্র ৫ কিমি দূরের ওই শহরে যেতে আমাদের পথে কতোবার যে জিরাতে হতো, পানি খেতে হতো। তারপরও রাস্তা ফুরাতো না। হাঁটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। আর রাস্তার ধারে টিউবওয়েল পেলেই, হাত-মুখ পা ধুয়ে নিতাম। কারণ, সড়কটিতে গরুর গাড়ি চলে ধুলার সাগর বানিয়ে ফেলেছিলো। আরো পরে, যখন আমরা কিশোরোত্তীর্ণ সদ্য যুবক হলাম তখন ওই সড়কটিতে ইট বিছানো শুরু হলো। একে নাকি বলে হেরিংবোন। তখন থেকেই টাঙ্গাইল শহর আমাকে টানতে শুরু করে।
আমি গ্রামের স্কুলের ছাত্র। ফাইভ থেকে সিক্স-এ উঠলাম। কি যে আনন্দ! সেই আনন্দের পেছনে ছিলো সৈয়দ নওয়াজেশ আলী স্যারের মার খাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দের সঙ্গে শঙ্কাও ছিলো। কালিহাতি থানার আমাদের গ্রামের কাছেরই রোয়াইল গ্রামের এক হিন্দু মাস্টার,আমাদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। জবরদস্ত স্বাস্থ্য তাঁর, তিনি ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট পরতেস। সেই শার্টের দুই পাশে ছিলো পকেট। অধিকাংশ মানুষই ওই ধরনের শার্ট পরতেন। সেটাই ছিলো গ্রামীন শিক্ষিতজনের পোশাকের ডিজাইন। আমার আব্বাও ওই রকম শার্ট পরতেন। তবে আব্বার ছিলো পাঞ্জাবি। পায়জামা আর মোকাসিন জুতো। তিনিও আব্বারই বন্ধু, সমসাময়িক, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, তিনি অংকের টিচার, ক্লাশ সিক্সে। হয়তো সেভেন, এইট পর্যন্ত তিনি অংকই কষাতেন। আমার মনে নেই ওপরের ক্লাশে অংক পড়াতেন কি না। অংক না পারলে তিনি তাঁর বড় বড় কিছুটা টলটলে টানা চোখ আর টানা ভ্রু নাচিয়ে বলতেন অংক ভালো না লাগলে তো তুই গোলায় যাবি, বলে তিনি তাঁর বা হাত দিয়ে আমার মাথা চেপে ধরে নিচু করতেন । তারপর ডান হাত মুঠি করা আঙুল দিয়ে কিল মারতেন। ধুম ধুম শব্দ হতো। তার সেই কিলের আওয়াজ আজো কানে বাজে।
এখানে আরো একটি ঘটনার কথা জানাই। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী স্যার মজার এক মানুষ ছিলেন। তিনি পড়তে ও শিখতে ভালোবাসতেন। তিনি প্রমোশন পাবেন যদি এমএ করে ফেলতে পারেন। আমার অগ্রজ ড. মাহবুব সাদিক তখন করটিয়ার সা’দত কলেজের বাংলার শিক্ষক। ভাইও ছিলেন কিশোরজীবনে বিশ্বনাথ স্যারের ছাত্র। তিনি যা পরামর্শ দেবার দিলেন। বিশ্বনাাথ স্যার এমএ ফার্স্ট পার্ট পাশ করে গেলেন। মনে হয় তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিংয়ে এসেছেন ঢাকা কলেজের পাশে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বা ইন্সটিটিশনে। তিনি খবর নিয়ে এসেছিলেন যে আমি মহসিন হলে থাকি। এবং কা্উকে দিয়ে খবর দিয়েছিলেন যে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। খবর পেয়েই গেলাম। তিনি ছিলেন নাটকের রিহার্সেলে। তিনি যে নাটক করতে ভালোবাসতেন তা আমি জানতাম না।
আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। তিনি আধা-ঘন্টা পর এলেন। আরে, তুই আইছিস। তিনি খুব খুশি। স্যার কেন ডেকেছেন, এই কথাটা জিজ্ঞেস করবার আগে তার কুশল জানলাম। তিনি যে ফাইনাল দেবেন সে কথাও জানালেন। বললেন ভাইজানের কথা। তিনি একটু দূরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে গেছেন। তাঁর এমএ ক্লাশের নোট দরকার। তিনি জানালেন কি কি দরকার। আমি সেগুলো টুকে নিয়ে গেলাম। তারপর আমার কাছে থাকা নোটগুলো দিয়ে এলাম তাঁকে একদিন পর। তারপর আর কোনো খবর নিইনি, নেবার সুযোগ পাইনি।
আমি সৈয়দ নওয়াজেশ স্যারের বেতের বাড়ি থেকে বেচে এসে পড়লাম আরেকজন বাঘের মামার কাছে। ভয় আর গেলো না। আমি বৃত্তির জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এইটের বৃত্তি পরীক্ষাও দিলাম, কিন্তু পেলাম না। অংকে ডাব্বা। অংক ভয় আমাকে ডুবিয়ে দিলো। তাই নাইনে রেজিস্ট্রেশন করার পর আমাদের বিএসসি আবুল কাশেম স্যারের কাছে তিন মাস প্রাইভেট পড়লাম। ওই তিন মাসে যা শিখলাম সরল অংক যে আদতেও সরল এবং গরলও, মানে প্যাচ মারা সেটা জেনে খুর খুশি হলাম। তিনি পরে, পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। তার শিখানোর জোরেই এসএসসিতে আমি লেটার মার্কস পািইনি। তিনি বলতেন সবার আগে সরল অংকটি রাফ করে নিয়ে শেষ করবে। এটা পরীক্ষার শেষ দিকে করতে গেলে ভুল হবার সমূহ আশঙ্কা। তাই এই পরামর্শ। আর সরলে সাক্কা ১০ মার্কস পেলে ঐকিক নিয়মে বা সুদকষায় নম্বর পাওয়া কঠিন না। বেশি নম্বরের অংকগুলো জানা থাকলে, আমরা বলতাম কমন পড়লে, সেগুলোই সব কিছুর আগে করতে হবে। জ্যামিতির বর্ণনা ঠিক মতো দিতে পারলেও ৮ এর মধ্যে ৪/৫ এর বেশি নম্বর দিতেন না পরীক্ষকগণ। মি এস্িসেসি তে ইতিহাসে ৬১ নম্বর পেয়ে লেটার্স মার্কসের অধিকারী হলাম। আমার সে খুশি কে দেখে?েআমাদের সময় রেজাল্ট দিতে সংবাদপত্রগুলোতে। রেজাল্টের খবর পেয়ে আমরা প্রথমে স্কুলে গেলাম। সেখানে পেলাম বাচ্চু স্যারকে। তিনি আমাদের আরবির শিক্ষক আবার তিনিই কেরানির কাজটি করতেন। আমি ক্লাশ নাইনে রেজিস্ট্রেশনের গেলে তিনি ভেটকি দিয়ে বলেছিলেন আসল বয়স লিখলে তুই সরকারি চাকরি বয়স পাবি? তিনি আরেকটি ফরম দিয়ে বললেন জন্ম ১৯৫৫ লেখ। আমি নাছোড় বান্দা, কিন্তু আব্বার কাছে বলে দেবেন, এই ভয়ে লিখে দিলাম। তাকে রেজাল্টের কথা বললাম। কে একজন বললো যশিহাটি কার কাছে নাকি নিউজ পেপার্ আছে। সেখানে রেজাল্টও আছে। শুনেই আমরা কয়েক বন্ধু দৌড়ালাম যশিহাটির দিকে। এবং পেলাম। সেটা ছিলো রেজাল্ট বেরুবার একদিন পরের ঘটনা। সেই লোকটির কাছে থেকে আমাদের স্কুলের রেজাল্ট অংশ নিয়ে এলাম। রোল নম্বর ছিলো ১৩৫৭ কিঙবা ১৩৭০। এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে আজো আমার তহবিলে ওই পরীক্ষার প্রবেশপত্র ইনট্যাক্ট আছে। আমার রোল নম্বরের পাশে একটি স্টার বসানো।
আমি কিন্তু কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। মাঝারি মানের ছাত্র। তবে অন্যদের চেয়ে আমার আইকিউ নাকি ভালো ছিলো। আমি কখনোই টের পাইনি। এখন কিছুটা টের পাই। আমার তৃতীয় নয়ন আছে, বুঝতে পারি।
এর পরের অংশ আমার টাঙ্গাইল শহরের জীবন।
০৪/২৪/২৪
জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো লিখুন, কবি।
সকলেরই ভালো লাগবে।