নির্ঝর আহমেদ প্লাবন
আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি। কবি হলেও কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান অনবদ্য। কথা সাহিত্যে কাব্যিকতা এনে কথাসাহিত্যকে নব ধারায় সাজিয়েছেন আল মাহমুদ। গদ্য ভাষায় ছন্দের ঝংকার সৃষ্টি করে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন বাংলা কথাসাহিত্যকে। বাংলাদেশের মানুষের মন ও মেজাজের ধরণ ধারণ করে তিনি মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছেন। সমাজ জীবন থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন অসাম্য। মানুষকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ভাষার উৎকর্ষে, বিষয়ের বিন্যাসে, সময়কে চিরকালের অমরায় বন্দি করার ক্ষেত্রে তিনি অমর কথাশিল্পী। কথার যাদুকর। একটি অনিন্দ্য মোহ জেগে থাকে তাঁর কথার ভেতর। তিনি সমাজ জীবনের একদম সাধারণ ভাষ্যকার। তবে সে সাধারণ বিষয়ের বর্ণনা অসাধারণত্বের মহিমা অর্জন করেছে। জনজীবনের আখ্যান রচনায় সিদ্ধহস্ত লেখক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ববহ ঘটনাগুলোকে চিত্রিত করেছেন শৈল্পিক ভাষায়। তিনি যখন কোনো কিছু বর্ণনা করেন, তখন সেখানে সাবলীলতা বিষয়টি একদম সহজ হয়ে ধরা পড়ে। তাঁর সাবলীল বর্ণনায় বর্ণিত বিষয়কে পাঠক দিব্যদৃষ্টি দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়। তাঁর বর্ণনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজের চিন্তার জগৎকে শাণিত করে নেয়া যায়। আল মাহমুদ এমন কবি যিনি যা দেখেছেন তা অবলীলায় লিখেছেন। সংকোচহীন ছিলেন লেখার ক্ষেত্রে। ধর্ম এবং নারীর যুগপৎ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার নির্মাণে তৎপর ছিলেন সব সময়। ধর্মের নারী এবং নারীর ধর্ম তাঁর বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রাণবন্ত হয়েছে বিন্যাসের ধারা। এ ধারার ধারাবাহিক ধারাপাত পাওয়া যাবে আলোচ্য গবেষণা গ্রন্থে। গ্রন্থটি লিখেছেন ড. ইয়াহইয়া মান্নান। আবেগের দোলার চেয়ে মস্তিষ্কের বস্তুনিষ্ঠতা অধিক দৃষ্টিগোচর হয় তাঁর গবেষণায়। গবেষণায় আবেগ থাকা একেবারে দোষের নয়। তবুও যথা সম্ভব আবেগ পরিহার করে বাংলা সাহিত্যে যুগান্ত সৃষ্টিকারি কবিকে নিয়ে ভুবনজয়ী গ্রন্থ রচনা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করেছেন ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান।
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবন ব্যবস্থা নিয়ে আল মাহমুদ কাজ করেছেন। জীবনের স্থূল থেকে সুক্ষ্ম অনুষঙ্গ তাঁর শিল্প ভাবনার উপকরণ হয়েছে। জগতের যাবতীয় বিষয়কে তিনি শিল্পের মাধ্যম হিসেবে চিত্রিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের একান্ত মাটিঘেঁষা সাহিত্যিক যারা, তাদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তি আল মাহমুদ। যিনি ষাটের দশকে আঙুল উঁচিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা, কলকাতা নয়। তাঁর বক্তব্য আজ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ হয়ে উঠেছেন। কবিতায় তো তিনি ভুবন জয় করে ফেলেছেন। বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে আল মাহমুদও ততদিন বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের প্রামাণ্য আখ্যান নির্মাণে তিনি বিশ্বস্ত ভাষ্যকার। কোনো একদিন হয়তো এমনও আসবে যখন আল মাহমুদের কবিতা দিয়ে বাংলাদেশকে চেনার চেষ্টা করবে অনুসন্ধিৎসু গবেষক ও যুব সমাজ। সেদিনওও খুব বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশের জমিনে বাংলার ফসল রোপন করে খাঁটি বাংলাদেশি ফসল উৎপাদন করেছেন আল মাহমুদ। তিরিশের কবিদের মতো ইউরোপের কাছ থেকে জমি বর্গা নিতে হয়নি তাঁকে। বাংলার উৎপাদনশীল জমিকে আরো ফলবান করেছেন এবং অনুৎপাদনশীল ভ‚মিকে উৎপাদনের উপযোগী করেছেন। অন্যের কাছে হাত পাততে হয়নি। তাই আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের মৌলিক ও স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। তাঁর স্বাতন্ত্র্যের দিকগুলো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়ার পাশাপাশি আল মাহমুদের জীবনীও রচনা করেছেন ড. ইয়াহইয়া মান্নান। আল মাহমুদের কবিতা ও কাব্যসত্তা নিয়ে গ্রন্থের শুরুতে কিছু আলোচনা করেছেন। সে আলোচনা ছোট হলেও প্রাণবন্ত। অল্প কথায় স্বল্প পরিসরে আল মাহমুদের কাব্যের মূল সুরকে তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন। এরপরই চলে গিয়েছেন কথাসাহিত্য আলোচনায়।
কবিতার বাইরে ছোটগল্প সৃজনেও অনন্য সফলতার পরিচয় দিয়েছেন সাহিত্যিক আল মাহমুদ। তাঁর ছোটগল্পের পরিধি অনেক দূর বিস্তৃত। ছোটগল্পেও তিনি নতুন ভাষা ও ভঙ্গি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটগল্পের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তিনি একের পর এক ছোটগল্পে লিখেছেন। কবি হওয়ার সুবাদে তাঁর ছোটগল্পও ভাবালুতা এবং কাব্যিক দ্যোতনা দ্বারা আক্রান্ত। এই আক্রান্ত ইতিবাচক হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠক মনে। পাঠক ছোটগল্পের ¯স্বাদ আস্বাদ করতে করতে হালকা কাব্যরসের সুধায়ও বিমোহিত হতে পারে। ছোটগল্পের পাশাপাশি উপন্যাস রচনায়ও তিনি মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। একজন জাত কবি চাইলে যে সাহিত্যের সকল শাখায় সফলভাবে বিচরণ করতে পারেন তার বাস্তব দৃষ্টান্ত আল মাহমুদ। আল মাহমুদের উপন্যাসও কাব্যিকতা দ্বারা আক্রান্ত। অতিকথনের কিছুটা প্রয়াস থাকলেও শিল্পের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। আল মাহমুদের উপন্যাস এতটাই জীবন্ত যে পড়ার সময় পাঠকের চোখে ঘটনাগুলো প্রামাণ্য চিত্রের মতো ভাসতে থাকে। গল্প উপস্থাপনের ভঙ্গি এবং ভাষার প্রাণবন্ত ব্যবহার পাঠককে টেনে নিয়ে যায় ঘটনার ভেতরে। ভেতরে প্রবেশ করে পাঠকও সেই ঘটনার অংশীদার হয়ে যায়। ড. ইয়াহইয়া মান্নানের এই গবেষণার মূল বিষয় যদিও উপন্যাস তবুও ছোটগল্প নিয়ে তিনি অসামান্য কথামালা রচনা করেছেন। আল মাহমুদের ছোটগল্প বিচারের রূপরেখা দেখিয়ে দিয়েছেন। কেন ছোটগল্পে আল মাহমুদ নতুন স্বর তার যথার্থ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। ছোটগল্প সৃজনে আল মাহমুদের মৌলিকত্বের জায়গাটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন ড. মান্নান।
সাধারণ পাঠকের কাছে একটি লেখা ভালো লাগাই যথেষ্ঠ। কিন্তু বোদ্ধা পাঠক ভালোলাগার কারণ উদঘাটন করতে চান। চান ভালো লাগার নেপথ্য সূত্র ধরে এগিয়ে যেতে। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে গত পঞ্চাশ বছরে কাব্যসভার প্রধান কবি হিসেবে সমাদৃত। কেন এমন মর্যাদায় তিনি অভিষিক্ত তার ব্যাকরণিক দিক জানলে নিজে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি আত্মপ্রত্যয়ও জাগ্রত হয়। কবির প্রতি ভালোবাসাও প্রগাঢ় হয়। আল মাহমুদের উপন্যাস নিয়ে জানতে হলে এবং সুন্দর তর্কে জড়াতে হলে আল মাহমুদ পড়ার পাশাপাশি আল মাহমুদ গবেষক ড. ইয়াহইয়া মান্নানের বইকেও পড়তে হবে।
আল মাহমুদের উপন্যাস কেন শ্রেষ্ঠ এবং বাংলা উপন্যাসের ধারায় সেটি কেন অমরত্মের আঙিনায় নিজ আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছে তার নান্দনিক যুক্তি জানতে হলে পড়তে হবে ড. ইয়াহইয়া মান্নানের ‘আল মাহমুদের উপন্যাস : বিষয় ও চিন্তা’ গ্রন্থটি। বহু সময় নিয়ে গবেষণার সকল ধারা অক্ষুন্ন রেখে তিনি এ অসামান্য কাজটি করেছেন। কাজটি করার ক্ষেত্রে বাইর থেকে কেউ গবেষককে তাড়া দিয়েছেন বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে একান্ত নিজ গরজে তিনি মনের মাধুরি মিশিয়ে এমন জটিল ও মহৎ গবেষণায় আত্মনিবেশ করেছেন। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার মধ্যে একটা ভাবালুতা অনায়াসে মনোগোচর হয়।
আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। কবি হবার তাগাদায় গিয়েছেন ঢাকা। ঢাকা যাওয়ার সময় হাতে টাকা না থাকলেও তিনি খালি হাতে যাননি। নিয়ে গিয়েছেন গ্রামীণ আবহ আর গ্রামীণ সংস্কৃতি। ড. ইয়াহইয়া মান্নানের ভাষায়- ‘মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি গ্রাম ছাড়েন, কিন্তু শূন্যহাতে তিনি গ্রাম থেকে শহরে আসেননি। নিয়ে এসেছেন নিবিড় গ্রাম্য প্রকৃতি, তিতাসের মতো ছোট-বড় অনেক নদ-নদী, খাল-বিল, খড়ের গম্বুজ, নর-নারী, নিসর্গ-প্রকৃতি যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে।’ ড. মান্নানের এ দেখার সঙ্গে আল মাহমুদের বর্ণনারও মিল পাওয়া যায়। আল মাহমুদ তাঁর মায়ের বরাত দিয়ে বলেছেন, তাঁর মা গ্রাম থেকে গাঁওয়া ঘি, খাঁটি শস্যের তেল আর বিশুদ্ধ অনুতাপময় কান্না নিয়ে শহরে আসতেন। আল মাহমুদের সাহিত্যে তাই গ্রামীণ শব্দের ব্যাপক প্রচলন। গ্রামীণ আবহকে শহুরে রূপে উপস্থাপনের সিদ্ধহস্ত শিল্পী তিনি।
গ্রামীণ মানুষের উপাখ্যান নির্মাণ করতে গিয়ে কোন উপন্যাসে কী কী ভাবে তিনি গ্রামকে উপস্থাপন করেছেন তার প্রামাণ্য দলিল একত্রিত করে উপস্থাপন করেছেন ড. মান্নান। আতেকা, সুফিয়া, জাহানারা, মোমেনাদের চরিত্র চিত্রণে নিজের সব আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে শব্দতুলিতে এঁকেছেন তাদের জীবনের আখ্যান। ডাহুকী উপন্যাসের গ্রামীণ চিত্রের সঙ্গে যেভাবে বেড়ে উঠি উপন্যাসের গ্রামীণ চিত্র ভিন্ন। কিন্তু কোথাও যেনো এক বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকটা উপন্যাসের মূল ঘটনা সংক্ষেপে উপস্থাপন করে তার শিল্পসফলতা কৌশলী শল্যবিদের মতো আবিষ্কার করেছেন গবেষক। আল মাহমুদের উপন্যাসের উৎকর্ষতা মূলত কোথায় সেটি দেখাতে গিয়ে তিনি বইটিকে পাঁচটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রত্যেকটি অধ্যায় যেমন অধ্যায় হিসেবে পূর্ণাঙ্গ তেমনি রয়েছে একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ। গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায় হলো যথাক্রমে—
১. আল মাহমুদ ও বাংলা উপন্যাস
২. নর-নারীর সম্পর্কের রূপায়ণ
৩. সমকাল
৪. বিবিধ প্রসঙ্গ
৫. উপসংহার
৬. গ্রন্থপঞ্জি
৭. পরিশিষ্ট
বাংলা উপন্যাসের ধারায় আল মাহমুদের অবস্থান নির্ণয়ের পাশাপাশি সমকালের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আল মাহমুদের বৈচিত্র্যও গবেষক নির্ণয় করেছেন। গবেষণার রীতি এবং ভাষার বিন্যাস বইটিকে বিশেষভাবে সফল করে তুলেছে। একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হিসেবে এটি আল মাহমুদ চর্চার একটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হবে। আল মাহমুদের উপন্যাস জানতে হলে ড. ইয়াহইয়া মান্নানের দোরগড়ায় করাঘাত করতে হবে। বইটি একটি বড় অভাব পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন গবেষকদের যে প্রত্যাশা ছিলো সে প্রত্যাশা অধিকাংশই পূরণ করতে পেরেছেন ড. মান্নান। তাঁর এ গবেষণা আল মাহমুদ অনুধাবনে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি তরুণদের আল মাহমুদ গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করবে। এমন কঠিন অথচ চমৎকার একটি গবেষণা জাতিকে উপহার দেয়ার জন্য ড. ইয়াহইয়া মান্নানের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
আল মাহমুদের উপন্যাস : বিষয় ও চিন্তা
ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান
প্রতিভা প্রকাশ, ঢাকা।
মূল্য : ৩২০ টাকা