নাজমুস সায়াদাত
আল মাহমুদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘সোনালি কাবিন’। এই একটি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিয়ে গেছে খ্যতির শীর্ষে। সেই সাথে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করেছেন এই ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ দ্বারা। ‘সোনালি কাবিন’ রচিত ও প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয়ের আগে অর্থাৎ সূচনালগ্নে। একটি দেশের অভ্যুদয়ের সাথে এই কাব্যগ্রন্থটির নিবির সম্পর্ক বিদ্যমান। উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ উল্লেখ করেছে যে :
‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদের সনেট জাতীয় কাব্য যা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ যে সকল সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে সোনালী কাবিন তাকে বেশি পরিচিতি প্রদান করেছে। এতে মোট ১৪টি সনেট রয়েছে এবং ৪১টি কবিতা রয়েছে।
আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত কবিতাগুলোর শিরোনাম হচ্ছে :
প্রকৃতি, বাতাসের ফেনা, দায়ভাগ, কবিতা এমন, আসে না আর, অবগাহনের শব্দ, এই সম্মোহনে, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা, পলাতক, স্বপ্নের সানুদেশ, তোমার হাতে, অন্তরভেদী অবলোকন, যার স্মরণে, নতুন অব্দে, আমিও রাস্তায়, পালক ভাঙ্গার প্রতিবাদে, খড়ের গম্বুজ, এক নদী, জাতিস্মর, আমার প্রাতরাশে, সোনালি কাবিন, আত্মীয়ের মুখ, তরঙ্গিত প্রলোভনে, তোমার আড়ালে, ভাগ্যরেখা, শোনিতে সৌরভ, সাহসের সমাচার, চোখ, উল্টানো চোখ, আভূমি আনত হয়ে, চোখ যখন অুীতাশ্রয়ী হয়, আমার চোখের তলদেশে, ক্যামোফ্লাজ, আমার অনুপস্থিতি, কেবল আমার পদতলে, নদী তুমি, সত্যেও দাপটে, আমি আর আসবো না বলে, অঘ্রাণ, স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে, বোধের উৎস কই, কোনদিকে?
আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ শিরোনামের চৌদ্দটি সনেট নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানি না বলে আর কোনে ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।
২
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তারও চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
মানে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি
আঁচল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেব আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী
জানত না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
৩
ঘুরিয়ে গলায় বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম,
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দেবে এই শব্দবিদ কোবিদের নাম।
কক্কার শব্দের শর আরণ্যক আত্মার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ–
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।
৪
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কতো অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বণ্য বালিকা
অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মতো এঁকে দেব হিঙ্গুলের টিকা
তোমার কপালে লাল, আর দীন-দরিদ্রের প্রেম।
সে- কোন গোত্রে মন্ত্রে বলো বধু তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেমে কবে নিয়েছিল ধর্ম কিম্বা সংঘের শরণ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।
৫
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাসের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছ বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনব না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?
প্রকৃতির ছদ্মবেশে যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে।
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,
চিরস্থায়ী লোকালয় কোনো যুগে হয়নি তো গড়া
পারেনি ইজিপ্ট, গ্রিস, সেরাসিন শিল্পীর আঙুল
কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর
কষ্টকর তার চেয়ে নয় মেয়ে কবির অধর।
৬
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাঁড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ’পরে।
পূর্বপুরুষেরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল– রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?
আরশি নগরে খোঁজা বাস করে পড়শি যে জন
আমার মাথায় আজ চুড়ো করে বেঁধে দাও চুল
তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন,
অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে এযাবৎ করেছি যে ভুল
সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কুজন।
৭
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা?
বাইরে দারুণ ঝড়ে নুয়ে পড়ে আনাজের ডাল,
তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা–
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল!
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।
ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ?
ভেঙো না হাতের চুড়ি, ভরে দেব কানের ছেঁদুর
এখনো আমার ঘরে পাওয়া যাবে চন্দনের শলা,
ধ্রæপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়
ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা।
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে, চঞ্চলা?
৮
অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখব কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ^র যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,
তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার।
কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,
কুন্তল এলিয়ে কন্যা শুরু করো রোদন পরম।
মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে
জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহারী যম,
বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে
নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।
৯
যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছ, মানিনী
একদা তারাই জেনো গড়েছিল পুণ্ড্রর নগর
মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জানিনি
কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।
আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্বপুরুষেরা ছিল পাট্রিকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সব কিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোত না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুন?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার
বর্গিরা লুটছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।
১০
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেব আন্তরিক রতির দরদ,
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকন্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।
১১
আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আঁতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?
কী করে মানিবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই
শীলভদ্র নিয়েছিল নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
অতীতকে বাদ দিয়ে আজ আর কোনো কিছু নেই
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস।
প্রস্তুরযুগের এই সর্বশেষ উল্লাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো, কোন ঝোপে লুকোবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে
যখন আড়াল থেকে ছুটে আসে পাথরের ফলা,
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
১২
নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার।
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস,
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত
আমরা ফিরাব সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস।
নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষান
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার;
ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার?
১৩
লোবানের গন্ধে লাল চোখ দুটি খোলো রূপবতী
আমার নিঃশ্বাসে কাঁপে নক্শাকাটা বস্ত্রের দুকুল?
শরমে আনত কবে হয়েছিল বনের কপোতী?
যেন বা কাঁপছ আজ ঝড়ে পাওয়া বেতসের মূল?
বাতাসে ভেঙেছে খোঁপা, মুখ তোলো হে দেখনহাসি
তোমার টিকলি হয়ে হৃৎপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু
মঙ্গলকুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রামবাসী
উঠোনে বিন্নির খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
শুভ এই ধানদুর্বা শিরোধার্য করে মহিয়সী
আব্রু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদিরা তোমার বয়সি
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।
১৪
বৃষ্টির দোহাই দিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদামের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে বাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বনরাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেব চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানত
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।
প্রথমে কলকাতা থেকে ‘সোনালি কাবিন’-এর ১৪টি সনেট নিয়ে একটি ছোট পকেট বই বের হয়। পরে ওই ১৪টি সনেট এবং আরও কিছু কবিতা দিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ নামেই আল মাহমুদের তৃতীয় বই বের হয় ১৯৭৩ সালে। বইটি প্রকাশ করেছিল নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। ‘সোনালি কাবিন’ রচনার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন :
‘সোনালি কাবিন’ সমাপ্ত করে আমি প্রথম ছুটে গিয়েছিলাম অধ্যাপক আবুল ফজলের কাছে। তিনি অসময়ে আমাকে আসতে দেখে বিস্মিত হলে আমি বললাম, আমি একটি সনেট সিকুয়েন্স আজই সমাপ্ত করেছি। এর অর্ধেক অংশ অর্থাৎ সাতটি কবিতা এর মধ্যে সমকালে দিয়ে এসেছি। আপনাকে না শুনিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আবুল ফজল মৃদু হাসলেন এবং আমাকে ভেতরে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে মুখোমুখি বসলেন।
পড়ো।
আমি থেমে থেমে ‘সোনালি কাবিনে’র চৌদ্দটি সনেটই তাকে শুনিয়ে দিলাম। তার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল তিনি ছন্দের দুলুনিতে মিল ও বক্তব্যের উপস্থাপনায় মাঝে মধ্যে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন। কবিতাগুলো শেষ হলে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, চা খাও।
… আমি যখন ঢাকায় এসে সমকালে কবিতাগুলো সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের হাতে তুলে দিই- এর আগে ওই সনেট সাতটি নিয়ে আমি সকালে শহীদ কাদরীর বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি তখনও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আমি তার মুখের কাপড় সরিয়ে বললাম, কয়েকটা সনেট লিখেছি। শোনো।
কাদরী চোখ খুলে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ‘সোনালি কাবিনে’র প্রথম সাতটি সনেট শুনে উঠে বসে পড়েছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ভালো হয়েছে।
আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক ১৪টি কবিতা নিয়ে পকেট সাইজ একটি সংকলন সম্পাদনা করেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এই সংকলনটিতে লেখা ছিল:
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মিনিবুক’। মাসমিডিয়ার প্রথম প্রতিদ্বন্দী। আত্মপ্রকাশ : ডিসেম্বর ১৫/৬৯। আল মাহমুদ-এর বাঙলাদেশ। সোনালী কাবিন। বাঙলাদেশের আল মাহমুদ।
আবহমান ইতিহাসচেতনা থেকে
বন্যবালিকা বাঙলাদেশের প্রতি আরণ্যক তক্ষকের ১৪টি নিশিডাক এই ১৪টি সনেট… বাঙলাদেশের জঙ্ঘা, বাঙলাদেশের কুন্তল, বাঙলাদেশের স্তন, বাঙলাদেশের নিতম্ব ও বাঙলাদেশের গ্রীবা- বিজয়ীর একের-পর-এক ট্রফির মত এই ভূতগ্রস্ত পঙ্তিমালায় তুলে দেখানো হয়েছে।
আল মাহমুদ। জন্ম : ১৯৩৬। ঢাকা বাঙলা আকাদেমি পুরস্কার : ১৯৬৮। প্রকাশিত গ্রন্থ : সোনালি কাবিন (মিনিবুক)। লোক-লোকান্তর। কালের কলস। শ্রেষ্ঠ কবিতা। সম্পাদক : দৈনিক গণকণ্ঠ।
মিনিবুক ৭ । গ্রন্থপ্রতি ৩০ পয়সা।
মিনিবুক মানে সবচেয়ে সস্তা বই। নতুন এবং অসংক্ষেপিত।
মিনিবুক ছাপা হয়েছে মোনোটাইপে। ছেপেছেন : সাধনা প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, ৭৬ বি.বি. গাঙ্গুলি স্ট্রীট, কলিকাতা ১২।
স্বীকার করুন এর চেয়ে ভালো ছাপা আগে দেখেন নি।
সোনালী কাবিনের টীকা
কাবিন : বিবাহের চুক্তিপত্র। দিনার : প্রাচীন মুদ্রা। দেনমোহর : বিবাহের পণ। পানোখী : কেউটে। কক্কা : তক্ষক। উগোল : সিঙি। জেয়র : অলঙ্কার। কানেট : কানপাশা। মেকুর : বেড়াল। সিকস্তী : তীরবর্তী। লোবান : ধূপ। সবক : পাঠ। না-পাক : অপবিত্র। নাদান : অবিশ্বস্ত। ছতরে : বুকে। লানৎ : অভিশাপ।
কীভাবে জন্ম হয় একটি কবিতার, আশ্চর্য সফল পঙক্তির? কবিতা জন্ম নেওয়ার সেই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে কবির অনুভবে খেলা করে কোন আলোছায়ার মগ্নতা? দৈনিক প্রথম আলো’র একটি লেখায় আল মাহমুদ তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:
একদা প্রেমের কবিতা লেখার ইচ্ছাতেই আমি ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুলো লিখে ফেলি। এ বছর এই সনেট ও সোনালি কাবিন নামের বইটির প্রকাশের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা স¤প্রতি একটি অনুষ্ঠান করেছেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারিনি। একটা বই ৪০ বছর ধরে সমাদৃত হচ্ছে, এর সনেটগুলো পড়ে আজও পাঠক আপ্লুত হচ্ছেন। একজন কবির জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! মাঝেমধ্যে বিষয়টি আমার নিজের কাছেও অবাক লাগে। ভাবি, এই বুঝি তবে কবির প্রাপ্তি! আমি কবি, আর কোনো পরিচয় নেই। কবিতার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি কত-না চরাচর, এঘাট-ওঘাট।
‘সোনালি কাবিন’ নামে সনেটগুলো যখন লিখি, তখন প্রবল এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। থাকতাম চট্টগ্রামের গোর্খা ডাক্তার লেনের একটি বাড়ির চারতলায়। একাই থাকতাম। আমার প্রতিবেশী ছিলেন বিখ্যাত গায়ক শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। আমার ডেরার পাশেই থাকত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা। তাদের কালচারটাই ছিল আলাদা। চলাফেরা, পোশাক-আশাক সবই আলাদা রকমের। নিজেদের বাইরে সাধারণত তারা কারও সঙ্গে মিশত না, কিন্তু আমার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করত, খাওয়াতে চেষ্টা করত এটা-সেটা। তারা ‘মাহমুদ’ উচ্চারণ করতে পারত না। তাই আমাকে ডাকত ‘মেহমুদ’ নামে। তারা বলত, ‘মেহমুদ ইজ অ্যা পয়েট গ্রেট পয়েট।’ এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা দেখা হলেই আমাকে বলত, ‘পোয়েট, ওহ পোয়েট!’ জবাবে আমি বলতাম, ‘ইয়েস মাদাম…।’ আসলে তারা আমাকে পছন্দ করত। আমিও যেতাম তাদের কাছে।
মনে আছে, প্রথমে এক টানে আমি সাতটি সনেট লিখে ফেলি। এরপর লিখি আরও সাত মোট ১৪টি। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও ‘সোনালি কাবিন’ সিরিজে এই ১৪টির বেশি সনেট লিখতে পারিনি। তখন আমার মনে হয়েছিল, এটা হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার। সে সময় চট্টগ্রামে যাঁরা আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন, তাঁদের ছিল বইয়ের ব্যবসা। ফলে আমার ঘরটি ছিল বইপত্রে ঠাসা। ঘরের একটু খালি জায়গায় ছিল একটা চেয়ার ও একটা টেবিল। সোনালি কাবিন ওখানে বসেই লিখতাম। ওই চেয়ার-টেবিলেই লিখেছিলাম সনেটগুলো।
একদিন হঠাৎই লিখে ফেললাম: ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি’ এক নম্বর সনেটটি। লেখার পর আমার সে কী উত্তেজনা! ঘরের ভেতরে পায়চারি শুরু করি, নিজের কবিতা নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ি! একেকটি সনেট লিখতাম আর ঘরের ভেতর পায়চারি করতাম। সেসব মুহূর্তের কথা বর্ণনা করা যাবে না। আর এখন তো বয়সের ভারে আমার স্মৃতি-বিস্মৃতি সবই একাকার। তাই অনেক কিছু এখন আর মনে করতে পারি না।
তবে সনেট আঙ্গিকে আমি প্রেমের কবিতাই লিখতে চেয়েছিলাম। এ জন্য আগেই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। প্রথমে আট, পরে ছয়লাইন; সনেটের এই যে ফর্ম, এক সময় ইতালিয়ান বেদেরা এভাবে গান গাইতেন। তাঁদের বলা হতো ত্রোবাদুর। তাঁরা যাযাবর ছিলেন। বেদেদের গানকে কবিতার ফর্মে প্রথম রূপ দিলেন পেত্রার্ক। এরপর অনেকেই এ ধারায় লিখছেন। কিটসও লিখেছেন এই ধারায়।
বাংলা ভাষায়ও অনেকে লিখেছেন, সার্থক হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেট ১৪ মাত্রার। এর অনেক পরে আমি লিখলাম ‘সোনালি কাবিন’। লেখার পরই মনে হয়েছিল, সনেটগুলো বাংলা সাহিত্যে আমাকে অমরতা এনে দেবে। আজ দেখি, আমার ধারণা বেঠিক নয়, আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছে সনেটগুলো! ‘সোনালি কাবিন’-এ তখন আমি খুব সাহসের সঙ্গে ‘কাবিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। আমার আগে বাংলা কাব্যে এ শব্দের ব্যবহার হয়নি। প্রথমে কলকাতা থেকে ‘সোনালি কাবিন’-এর ১৪টি সনেট নিয়ে একটি ছোট পকেট বই বের হয়। এটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। পরে ওই ১৪টি সনেট এবং আরও কিছু কবিতা দিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ নামেই আমার তৃতীয় বই বের হয় ১৯৭৩ সালে। বইটি প্রকাশ করেছিল নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। তবে সনেটগুলো প্রকাশ হওয়ার পরই যে আলোড়ন তুলেছিল তা নয়, কিছু দিন পর শুরু হলো আলোচনা। তখনকার সেরা পত্রপত্রিকায় এ সনেট নিয়ে আলোচনা হতে লাগল, পাঠকমহলে বিস্ময় সৃষ্টি করল, যা এই ৪০ বছর পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলছে।
মনে হয়, আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হলো ‘সোনালি কাবিন’। কাব্য সৃষ্টিই কবির কাজ। অবিরাম কবিতা লিখেছি, কিন্তু প্রকাশের ৪০ বছর পর সোনালি কাবিন-এর সনেটগুচ্ছ আমার দেশের মানুষ এখনো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এটা কয়জন কবির ভাগ্যে জোটে!
কীভাবে সোনালি কাবিন প্রকাশিত হয়েছিল তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় আল মাহমুদের আত্মজীবনীতে। তিনি এই বইয়ের প্রকাশনার ইতিহাস বলতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন:
… এবার ‘সোনালি কাবিন’ বইটির প্রকাশনার দিকে মনোযোগ দিলাম। তষনকার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দীন। তিনি সন্ধানী প্রকাশনা থেকে বইটি প্রকাশের জন্য আমার পাণ্ডুলিপিটি গ্রহণ করলেন। বইটি কাইয়ুম চৌধুরীর একটি অসাধারণ প্রচ্ছদ নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু বইটি বাজারে যাওয়ার আগে পঁচিশ মার্চের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আমি একটিমাত্র কপি হাতে ঢাকা থেকে সপরিবারে বেরিয়ে পড়েছিলাম এবং এই বইটি নিয়ে যাওয়ায় অনেক উপকার হয়েছিল আমার। যারা কলকাতায় আমার কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিল তারা এই বইয়ের কবিতাগুলো আস্বাদন করে আমাকে প্রশংসায় উদ্দীপিত করেছিল এবং কলকাতা থেকে অরুণা প্রকাশনী আল মাহমুদের কবিতা বলে আমার যে বইটি প্রকাশ করেছিলেন, এই বইটি না থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।
এ সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বইটি প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। তা না হলে বইটি বের হতো না। বইটির রয়্যালটি বাবদ নয়শত রুপি পেয়েছিলাম। এই টাকাটা না পেলে আমার অনেক অসুবিধাই হতো। কারণ আমি ঢাকা থেকে এক কাপড়ে আগরতলা ও গৌহাটি হয়ে কলকাতায় পৌছেছিলাম।…
বাংলাদেশে ‘সোনালি কাবিন’ বইটি প্রথম প্রকাশ করে নসাস। নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। প্রকাশনায় : ইফতেখার রসুল জর্জ। ৪৬ পিকে রায় রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৮৮। দ্বিতীয় মুদ্রণ : ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯২। তৃতীয় মুদ্রণ : ১ আগস্ট ১৯৯৮। চতুর্থ মুদ্রণ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০২। পঞ্চম মুদ্রণ : ১ জানুয়ারি ২০০৬। ষষ্ঠ সংস্করণ : ১ জানুয়ারি ২০১২। নবম মুদ্রণ : নভেম্বর ২০১৮। উৎসর্গ শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী ও আল মাহমুদের তিন প্রজন্ম।
প্রকাশনার ৪০ বছরে বাংলা-ইংরেজি একসঙ্গে আল মাহমুদের সোনালি কাবিন ২০১২ সালে প্রকাশ করে মহাকাল। এই বইটি ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সায়ীদ আবু বকর। সেখানে লেখা আছে- সোনালি কাবিনের কবিতাগুলোর রচনাকাল : ১৯৬৯-৭৩। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখা আছে :
শামসুর রাহমান
ফজল শাহাবুদ্দীন
শহীদ কাদরী
আমাদের এককালের সখ্য ও
কাব্যহিংসা অমর হোক।
বইটির একটি ‘প্রসঙ্গ কথা’ লিখেছেন আহমদ বাসির। তিনি উল্লেখ করেছেন :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাভাষার সবচেয়ে আলোচিত, সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ কবি আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশের চার দশক চলছে। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ভাস্বর এ গ্রন্থেও কবিতাবলী বহু-বিচিত্র আলোচনার আকর হয়ে উঠেছে। গত চার দশকে অজস্র প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও আলোচনা লেখা হয়েছে এ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে; বিশেষ করে এ গ্রন্থের ‘সোনালি কাবিন’ সিরিজের ১৪টি সনেট নিয়ে। বিশ্বেও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এ গ্রন্থের বহু কবিতা; বাংলাভাষীদেও হাতে যেমন, তেমনি বিদেশিদের হাতেও। ২০১০ সালে সোনালি কাবিনের পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের তরুণ কবি ও ইংরেচি সাহিত্যের শিক্ষক সায়ীদ আবুবকর কৃর্তক অনূদিত বইটি প্রকাশ করেছে I-Proclaim press. এরই মধ্যে The Golden Kabin নামে সোনালি কাবিনের ইংরেজি অনুবাদের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থাটি। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, বিদেশি পাঠকদের কাছেও সোনালি কাবিনের পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা বিস্তৃত হচ্ছে। ‘সোনালি কাবিন’ স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশের কাব্যজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল অর্জন।
কলকাতা থেকে ১৯৭১ সালে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক ১৪টি সনেট নিয়ে সাড়ে চার ইঞ্চি বাই সাড়ে তিন ইঞ্চি সাইজের মিনিবুক সিরিজে ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশিত হয়। মূল্য ছিলো ষাট পয়সা। সুমুদ্রিত ও পরিচ্ছন্ন এই পুস্তিকাটি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে সোনালি কাবিন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন আরিফ খান। প্রকাশ করেছে প্রগতি প্রকাশনী, ৪/৪ শাগবাগ বিপনী বিতান, ঢাকা-২। মুদ্রণ করেছে বুক প্রমোশন প্রেস, ২৮ টয়েনবি সার্কুলার রোড, ঢাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ড. নওয়াজেশ আহমদ ও কালাম মাহমুদ। ৭২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ছিলো সাড়ে পাঁচ টাকা। এরপর গত চার দশক ধরে বইটি অগণিত বার মুদ্রিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত The Golden Kabin সংগ্রহ করা বাংলাদেশী পাঠকদের জন্য যথেষ্ট ব্যায়সাপেক্ষ। বইটির দাম ১৫ ডলার, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করতে খরচ হয় ৭ ডলার। ফলে যথেষ্ট আগ্রহ থাকা সত্তে¡ও অনেক পাঠক বইটি সংগ্রহ করতে পারেননি। বাংলাদেশী পাঠকদের কথা বিবেচনায় রেখে ‘সোনালি কাবিন’ মূল বইয়ের সঙ্গে The Golden Kabinসংযুক্ত হয়ে এক মলাটে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রকাশের চারদশক উপলক্ষে ইংরেজি অনুবাদসহ সোনালি কাবিনের প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সোনালি কাবিনের স্থানিকতা, ঐতিহাসিকতা, নান্দনিকতা এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্য ও দ্যোতনা পাঠককে অবিরাম আকৃষ্ট করে চলেছে। এ আকর্ষণ এখন আর বাংলাভাষী পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হচ্ছে।
সোনালি কবিনের চার দশ উপলক্ষে অনূদিত The Golden Kabin সহ মূল বইটি এক মলাটে প্রকাশেক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মহাকাল। আশা করছি এ প্রকাশনা কবিতাপ্রেমীদের উদ্বুদ্ধ করবে।
আহমদ বাসির
ঢাকা
ডিসেম্বর ২০১২
সোনালি কাবিনের আরও একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১। প্রকাশক : আদর্শ ৩৮ পি কে রায় রোড, বাংলাবাজার (২য় তলা), ঢাকা ১১০০। এই বইটির ভূমিকা ও পর্যালোচনা : মোহাম্মদ আজম। বইটির উৎসর্গ সৈয়দা নাদিরা বেগম।
‘আল মাহমুদের সোনালী কাবিন’ শিরোনামে ফাইজুল ইসলাম একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটি মূলত সোনালি কাবিন গ্রন্থের কবিতাগুলোর অর্থ, টিকা-টিপ্পনি ও ব্যাখ্যা। বইটির প্রকাশক : নসাস। নওরোজ সাহিত্য সম্ভার’-র পক্ষে সুকোমল ইফতেষার কাঁকন ৪৬ বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০। প্রথম প্রকাশ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। প্রচ্ছদ : মোবারক হোসেন লিটন। উৎসর্গ : শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও আল মাহমুদেও তিন প্রজন্ম। বইটিতে ‘লেখকের দায়ভাগ’ শিরোনামে ফাইজুল ইসলাম লিখেছেন :
প্রেমের কোনো সংজ্ঞা হয় না। তবু প্রেমের সংজ্ঞা দেয়া চলে। কবিতার ব্যাখ্যাও তদ্রুপ। সার্থক কবিতার আসলে কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবু এর একটি ব্যাখ্যা দরকার। প্রকৃত কবিতার হয়তো ব্যাখ্যার কোনো শেষ নেই। যেমন আকাশের কোনো সীমানা নেই। অথচ আমাদের সবার মাথার ওপর একটি আকাশ আছে। আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিন। আধুনিক বাংলা কবিতার একটি মাইলফলক। আমাদের সামনে সেই সোনালি কাবিনের এক টুকরো আকাশ থাকলে মন্দ হয় না।
আল মাহমুদ কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি লোকায়ত বাংলার কবি। আমাদের সময়ের শক্তিমান কবি। সৃষ্টিশীলতায় এখনো তার প্রাণশক্তি অফুরন্ত। তার পিতা মীর আবদুর রব ছিলেন সুফী-সাধক মানুষ। আল মাহমুদ ষাট পেরিয়ে অবশেষে মোল্লাবাড়ির ঐতিহ্যেই আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তার মতে, ভুলেভরা মানুষের একটা ক্রন্দনের জায়গা থাকা দরকার। ধর্ম বা প্রার্থনাই হচ্ছে মানুষের সেই শেষ ঠিকানা। তবে তিনিও মানেন সাহিত্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয়। ইহা যেমন বিপ্লবের বাণী নির্ভর নয়, তেমনি নয় ধর্ম নির্ভরও।
আমার দেশ পত্রিকার জন্য ডিকটেশনের সূত্র ধরে আল মাহমুদের বাসায় কতবার গিয়েছি ইয়ত্তা নেই। প্রায় সময় সোনালি কাবিন গ্রন্থটি আমার হাতে থেকেছে। কাজী নজরুল ইসলাম তার গানে লিখেছেন আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু, ভালোবাসো মোর গান। বলতে দ্বিধা নেই যে, ব্যক্তি আল মাহমুদের চেয়ে তার অমর সৃষ্টি সোনালি কাবিন সম্পর্কেই আকর্ষণ ছিল বেশি। মাঝে মাঝে অবসর পেলেই তাতে সোনালি কাবিনের দু একটি করে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। তিনি আনন্দে এতই আত্মহারা হয়েছেন যে বারবার শুনতে চেয়েছেন। হয়তো একেই বলে ওল্ড ইজ গোল্ড। অর্থাৎ পুরাতন ভাল কিছু কখনো পুরানো হয় না। সোনালি কাবিন এখন ক্ল্যাসিকস। আল মাহমুদ ৩৫/৪০ বছ আগের লেখা কবিতা নতুন করে শুনে আবেগে কেঁদেছেন কখনো স্মৃতি হাতড়িয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। গ্রন্থটির নির্দিষ্ট কবিতার আশেপাশে এসবই আমি নোট নিয়েছি। কখনো জানতে চেয়েছি দুএকটি শব্দের অর্থ কিংবা কাবিতাটির মর্মার্থ। আল মাহমুদ সানন্দে এই বিরক্তিটা মেনে নিয়েছেন। এভাবে কয়েক বছর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পাÐুলিপি। প্রতিটি কবিতার অর্থ-টিকা-টিপ্পনী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, পুরাণ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিশেষ করে কবির জীবনী আত্মস্থ করতে হয়েছে। খোঁজ নিতে হয়েছে তার লেখালেখির। আল মাহমুদ নগন্য এই তরুণ সাহিত্যমোদীর জন্য যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তার ঋণ স্বীকার করা যায়। কিন্তু পরিশোধ করা যায় নাক। প্রিয় কবিকে অশেষ ধন্যবাদ।
কবিতা শুধু কবি কিংবা কোন সাহিত্য সম্পাদক বা অধ্যাপকদের জন্যই লিখা হয় এই মন্ত্রে আমি বিশ্বাস করি না। কবিতার প্রেমিক সাধারণ পাঠকও। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি সব শ্রেণীর পাঠকের সহজভাবে সোনালি কাবিন বুঝতে উপকারে আসতে পারে। তাছাড়া সোনালি কাবিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যও বটে। আমাদের জানা মতে, বাংলা সাহিত্যে কোনো কবির পুরো একটি কাব্যগ্রন্থের বিশ্লেষণধর্মী বই এই প্রথম। বইটি পড়ে কবিতার প্রতি কারো যদি নতুন করে ভালোবাসা জন্মে, তাহলে শ্রম সার্থক হয়েছে বলে বিবেচনা করবো। পরবর্তী সংস্করণের জন্য যে কোন পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে।
রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী যুগের সর্বাধিক পঠিত কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিন। প্রায় একই সময় শামসুর রহমান লিখেন বন্দী শিবির থেকে। তবে দুটি কাব্যগ্রন্থেরই মেজাজ আলাদা। একটি হল স্বাধীনতার দলিল, অন্যটি বিশুদ্ধ প্রেমের বন্দনা। সোনালি কাবিনের শুধু ক্যামোফ্লাজ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। তবু যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুন, বাংলা সাহিত্যে সোনালি কাবিনের কোনো তুলনা হয় না। এমন একটি বইয়ের সামান্য কাজে যুক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত। এই কৃতিত্বের দাবিদার নসাসের সত্ত¡াধিকারী ইফতেখার রসুল জর্জ ও তার ছেলে শাওনও। সবাইকে অকৃত্রিম ধন্যবাদ।
বিনীত
ফাইজুল ইসলাম
সম্পাদকীয় বিভাগ
দৈনিক ইত্তেফাক
৩০ অগ্রহায়ন ১৪১৩
বই সম্পর্কে আল মাহমুদের একটি মন্তব্য কবির হস্তাক্ষরসহ মুদ্রিত হয়েছে। সেখানে আল মাহমুদ বর্ণনা করেছেন :
স্নেহভাজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ফাইজুল ইসলাম আমার কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনের সহজ অর্থ, টিকা-টিপ্পনি ও ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার প্রয়াস করেছেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে কাব্যের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবুও তা পাঠ্য বিষয়ে পরিণত হলে এর একটি সহজ ব্যাখ্যা দরকার। কাজটি ফাইজুল নিখুঁতভাবে করেছেন। এতে আমার সম্মতি আছে। চমৎকার কাজ হয়েছে।
‘সোনালি কাবিন’ মূলত প্রেমের কবিতা। এর আবার ব্যাখ্যা কি? ফাইজুল অল্প বয়স্ক য্বুক, তার আগ্রহটিই হল বড় কথা। আমি খুশী এবং প্রীত।
আল মাহমুদ
১.২.০৬
গুলশান # ১
ঢাকা
সোনালি কাবিনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ফাইজুল ইসলাম ‘আল মাহমুদের সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে :
আল মাহমুদ যখন সোনালি কাবিন লিখেন, তখন তাঁর জীবনে দুঃসহ সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটটটা একটু বলা দরকার। ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক মিল্লাতের প্রুফ রিডারের কাজ ছেড়ে কাফেলা’য় যোগ দেন। এরপর ১৯৬৩ সালে কাফেলা ছেড়ে একই পদে ইত্তেফাকে যোগদান করেন। এখানে নিজের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার বলে তিনি মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। এভাবে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত গড়ায়। এরমধ্যে তিনি মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু ২৯৬৮ সালের এক পর্যায়ে হঠাৎ ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে যায় স্বৈরশাসক আইয়ুবের ইংগিতে। ফলে কবিও সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েন।
এই অবস্থায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বিশিষ্ট কবি ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আলী আহসান ও শিশু সাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ। তাদের মাধ্যমে কবি চট্টগ্রাম চলে যান এবং সেখানে প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’-এর প্রকাশনা অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি এই কাজে যুক্ত ছিলেন। এসময়টায় তিনি থাকতেন বন্দর নগরীর এক নির্জন কক্ষে। তার পাশেই থাকতেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। উল্লেখ্য, শ্যামসুন্দর সে সময় থেকেই শেফালি ঘোষের সাাথে গান গেয়ে নাম করেন। তার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। আল মাহমুদ তাকে ভাবী বলে ডাকতেন। এই বৈষ্ণবের কাছে গান শিখতে আসতো জেলেপাড়ার এক শ্যামলা তরুনী। দীর্ঘাঙ্গিনী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাকে কবির এতোই ভালো লাগত যে, তার উপস্থিতিতে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠতেন। সোনালি কাবিনের ১৪টি সনেট তারই উপস্থিতি ও অনুপ্রেরণারই ফসল বলে আল মাহমুদ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন। এছাড়া সেই মেয়েটিকে নিয়ে একটি চমৎকার রোমান্টিক গল্পও আছে যা একমাত্র তার জীবনীতেই উল্লেখ করা যায়। যাহোক, সেই সময়ে এবং চতুর্থ তলার সেই নির্জন কক্ষেই রচিত হয় সোনালি কাবিনের কালজয়ী সনেটগুচ্ছ। যেখান থেকে আকাশ, সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা পৃথিবীকে অনেক আপন বলেই মনে হয়েছে কবির। সনেটগুচ্ছ ছাড়া সোনালি কাবিনের অন্যান্য কবিতাগুলোর লেখার সময়কাল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে।
সোনালি কাবিন : অনিঃশেষ আবৃত্তির তৃষ্ণা শীর্ষক একটি রচনায় নাসিম আহমেদ লিখেছেন:
‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ আমি প্রথম পাঠ করি ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে। তখন আমি এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি মাত্র খুলনার ক্রিসেন্ট হাই স্কুল থেকে। পত্রিকায় এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রার কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনায় জেনেছিলাম ‘সোনালি কাবিন’ বেরিয়েছে কবি আল মাহমুদ। কিন্তু আমি আমার পাঠের আগ্রহ সংবরণ করেছিলাম আসন্ন পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। একটি কাব্য গ্রন্থের নাম ‘সোনালি কাবিন’ আমাকে একবারেই চমকে দিয়েছিল।…
…পরীক্ষা শেষে এক হেমন্ত সন্ধ্যায় কারেন্ট বুক স্টল থেকে বইটি কিনেছিলাম। সে সময়ে খুলনার অভিজাত বইয়ের দোকান ছিল এটি, পিকচার প্যালেস সিনেমা হলের কাছে। দাম সাড়ে পাঁচ টাকা- অনেক বেশি। ১৯৭৪ সালে একজন স্কুল ছাত্রের কাছে সাড়ে পাঁচ টাকা অনেক বেশি দাম বৈকি।…
…যখন সাড়ে পাঁচ টাকায় একটি পরিবার ভালভাবে একদিন চলতে পারতো তখন সোনালি কাবিনের দাম সাড়ে পাঁচ টাকা অন্যায় ছিল। সেই দুঃসময়ে অতীব কষ্ট করে সোনালি কাবিন কিনেছিলাম। গাঢ় হলুদ ও কালো বর্ণের প্রচ্ছদে জামদানী শাড়ির নকশা এবং অস্পষ্ট নারীর অবয়ব তার ওপর সাদা হরফে উল্লম্ব লিখন ‘সোনালি কাবিন/আল মাহমুদ’। বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে গাঢ় হলুদ রঙের ওপর কালো অক্ষরে ‘স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে’ কবিতার শেষ আট লাইন উৎকীর্ণ। প্রচ্ছদ শিল্পী ড. নওয়াজেস আহমদ ও কালাম মাহমুদ। প্রকাশক প্রগতি প্রকাশনী, ৪/৪ শাহবাগ বিপনী বিতান, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ১৯৭৩ সাল। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে তাঁর তিন কবিবন্ধু শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, শহীদ কাদরীকে। উৎসর্গপত্রে কবির সম্ভাষণটি চমক-প্রদ যেমন: আমাদের এককালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্যহিংসা অমর হোক। এই অভিব্যক্তির মাধ্যমে তিন কবি বন্ধুর প্রতি কাব্য প্রতিযোগিতার অনন্ত বাসনা জানিয়েছেন। ৭২ পাতায় বইটিতে ৫৭টি কবিতা অন্তর্ভূক্ত। বইটি আমি ৭৪ সাল থেকে সযতনে সংরক্ষণ করছি এবং এর ৫৭টি কবিতা বহুবার বহুভাবে আবৃত্তি করে চলেছি।…
…একদিন হাজির হলাম শিল্পকলা একাডেমিতে আল মাহমুদের সান্নিধ্যে। তারপর প্রায়ই আসা যাওয়া। ইতোমধ্যে সোনালি কাবিন নিয়ে আমার প্রেম তিনি জেনেছেন। জাতীয় চিত্রশালার একতলার বড় কক্ষটিতে তিনি আমার কণ্ঠে বহু আবৃত্তি শুনেছেন। তারপর লিপিকে সাথে নিয়ে যেতাম, তিনি ওকে আসল নামে শায়লা বলে ডাকতেন। ও আবৃত্তি করে গান গাইতে জানে শুনে তিনি খুবই উৎফুল্ল হতেন। খালি গলায় ওর নজরুল সঙ্গীত শুনতেন আর লিপি আল মাহমুদ থেকে আবৃত্তি করে শোনাতো ইচ্ছে মত কবিতা । তিনি চোখ বন্ধ করে শুনতেন। আমরা অনেকদিন পর গেলে তিনি অভিমানী অনুযোগ তুলতেন। আমরা তাঁর কাছে ঘনিষ্ট থেকে প্রিয়তর হলাম। আমাকে ভালবেসে তিনি নাম দিয়েছেন উচ্চারণ শিল্পী। বলেছেন তোমরা বিয়ে কর, বিয়ে করলে বরকত শুরু হয়। আমাদের বিয়ের পর তিনি সম্বোধন করতেন শায়লা-নাসিম উচ্চারণ দম্পতি বলে আমার কণ্ঠে ‘আমি আর আসবো না বলে’ কবিতার আবৃত্তি বারবার শুনতে চাইতেন ৮২-৮৩ সালে যখন তিনি সতেজ তখনো এবং এই বার্ধক্যে এসে যখন তিনি দেখতে পান অস্পষ্ট শুনতে পান স্বল্প এখনো তাঁর কাছে গেলেই বলেন আবৃত্তি শোনাও। অন্যান্য কবিতা শোনানোর পর নিজেই বলেন, ঐ কবিতাটি শোনাও আসবো না বলে। আমি অবশ্য ইচ্ছে করেই প্রথমে শোনাতাম না, অপেক্ষা করতাম তাঁর তাগিদের জন্য। তিনি বহুবার বলেছেন তোমার চেয়ে সোনালি কাবিনের কবিতা আর কেউ ভাল আবৃত্তি করে না। আশির দশকে শিল্পকলা একাডেমির অফিস ঘরে আবৃত্তি শেষে দেখতাম তিনি জানালার বাইরে তন্ময় তাকিয়ে আছেন। বাতাস ভারী করে দিয়ে প্রতিবার আমি ফিরে এসেছি মোহসীন হলে। তাঁর এই বার্ধক্যে আমাদের দু’জনের আবৃত্তি শুনে প্রতিবার চোখে তাঁর অশ্রু যারা দেখেছি।
সোনালি কাবিনের প্রেম আমাকে কখনো বিরহ-বিধুর করেনি বরং শরণ নিয়েছি তার। ১৯৮৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে আল মাহমুদ আবৃত্তি করে তথাকথিত প্রগতিবাদী দিয়ে তিরস্কৃত হয়েছি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পাঁচটি আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন করেছিল। কবিদের তালিকা থেকে আল মাহমুদকে বাদ দেয়ার একটা কৌশল তাদের ছিল। কিন্তু আমি বারবার প্রতিবাদ মুখর ছিলাম। ফলে আমাকেই বারবার আল মাহমুদ আবৃত্তি করতে হয়েছে। কৈশোরে একটি কাব্যগ্রন্থ ভালবাসার মধ্যদিয়ে আল মাহমুদের সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে সাড়ে পাঁচ টাকা দিয়ে কেনা সোনালি কাবিনের সেই বইটি আজো আমার সযত্নে সংরক্ষণে আছে। প্রচ্ছদ, পাতা সবই জীর্ণ এন্টিকের মত বিশেষ মর্যাদায় তা আগলে রেখেছি।…
সোনালি কাবিনের বিভিন্ন সংস্করণ নিয়ে ফাইজুল ইসলাম ‘আল মাহমুদের সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে লিখেছেন যে :
আল মাহমুদ বলেছেন, তার জানামতে সোনালি কাবিনের সব নিয়ে এ পর্যন্ত ১৪টি সংস্করণ বের হয়েছে। সোনালি কাবিনের কেবল ১৪টি সনেট নিয়ে সাড়ে ৪ ইঞ্চি বাই সাড়ে ৩ ইঞ্চি সাইজের একটি মিনিবুক বের হয় ১৯৭১ সালে। আল মাহমুদ তখন কলকাতায় অবস্থান করে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন। মিনিবুকটি বের করেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যিনি সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন। আল মাহমুদের ভাষায়, এই মিনিবুকটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাদের ব্লাউজের ভেতরে লুকিয়ে রাখতো। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদেরও ভালো লাগার দরুন মিনিবুকটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে প্রকাশকের কথাই শোনা যাক :
আমি উপরে উদ্ধৃত কবিতাসহ কবির ১৪টি সনেট নিয়ে একটি মিনিবুক অবিলম্বে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। এর পূর্বে সুনীল, শক্তি, প্রকাশ, উৎপল, মৃণাল সেন ও আমার ৬টি মিনিবুক বেরিয়েছে। সদামুক্ত মাতৃভূমিতে সে (আল মাহমুদ) ফিরে যাবার আগের দিন ওর হাতে বেশ কিছু কপি ধরিয়ে দিলাম। তখন আমার মিনিবুকগুলোর কোনো কোনোটা ১১০০০ কপিও ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের জনুক্ষণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশিত হলেও আল মাহমুদের মিনিবুক কিন্তু ২০০/৩০০-এর বেশি কপি স্টলে দেওয়া যায়নি। কারন, দপ্তরির ঘর থেকে বাকি কয়েক হাজার মিনিবুক চুরি হয়ে যায়। কে চোর জানলেও কোনো এফআইআর করিনি। কারণ, সে এ-ভাবে আমার প্রতি তার একটি নায্য প্রতিহিংসাই চরিতার্থ করেছিল। তবে আল মাহমুদের মিনিবুকের রিপ্রিন্ট বা ফটোকপি একাধিক স্থান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। লণ্ডনে প্রকাশ করেছিলেন উৎপলকুমার বসু। আল মাহমুদ নিজেই নাকি বলেছে, বাংলাদেশে তার মিনিবুক বিক্রি হয়েছে রেড বুকের মত। প্রতি মিনিবুকের পাতায় লেখা থাকত একটাই শ্লোগান “মাস মিডিয়ার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী’। ভেতরের পাতায় থাকত আমাদের কোনও কপিরাইট নেই’। এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠত মিনিবুক, মাসমিডিয়ার যেখানে-সেখানে থেকে যখন-তখন প্রকাশিত হয়ে। ঠিকই বলেছিল আল মাহমুদ – রেডবুকের মত। মিনিবুক ছিল প্রতিষ্ঠানের কুক্ষিগত শিল্প সাহিত্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শ্রেণী সংগ্রাম। মিনিবুকগুলির ফটোকপি আজও পুণমুদ্রিত হয়ে চলেছে। মিনিবুকে সোনালি কাবিন এখনও পাওয়া যায়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, গ্রহান্তরের মানুষ, কবিতা প্রতিমাসে, কলকাতা, জুলাই, ২০০৫।
মাসমিডিয়ার প্রথম প্রতিদ্ব হিসেবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মিনিবুক বের হওয়া শুরু করে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে। আল মাহমুদের মিনিবুকটি ছিল ৭ম মিনিবুক এবং বেরিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে। দাম ছিল ২ টাকা। প্রচ্ছদে কবিতা পাঠরত আল মাহমুদের ছবি ছাপা হয় এবং লেখা হয় ‘আল মাহমুদ-এর বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আল মাহমুদ। এছাড়াও এতে কিছু মজার মজার কথা ছিল, যেমন ‘মিনিবুক মানে সবচেয়ে সস্তা বই। নতুন এবং অসংক্ষেপিত…পড়ুন: চুরি করে। বা কেড়ে নিন।’ কিংবা ‘বিশ্বাস করুন, এর চেয়ে ভালো ছাপা আগে দেখেননি’ ইত্যাদি। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৬। এতে পর্যটনের একটি বিজ্ঞাপনও ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে পুরো সোনালি কাবিন গ্রন্থটি প্রথম বের হয় ১৯৭৩ সালে, আশ্বিন ১৩৮০। প্রকাশক ছিলেন আরিফ খান। প্রকাশনা সংস্থা—প্রগতি প্রকাশনী, ৪/৪, শাহবাগ বিপণী বিতান, ঢাকা-২। ছাপা হয়েছিল বুক প্রমোশন প্রেস, ২৮ টয়েনবি সার্কুলার রোড, ঢাকা থেকে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ড. নওয়াজেস আহমদ ও কালাম মাহমুদ। দাম ধরা হয়েছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ টাকা। পৃষ্ঠা ছিল ৭২। এর উৎসর্গ পত্রে বলা হয়েছিল শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, শহীদ কাদরী আমাদের এক কালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্য হিংসা অমর হোক।’
তবে আল মাহমুদ আমাকে বলেছেন, সোনালী কাবিন গ্রন্থ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেও ছাপা হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাজারজাত করা সম্ভব হয়নি। এর প্রকাশক ছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। যিনি পরে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কাব্যগ্রন্থটিও প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। তার প্রকাশনা সংস্থার নাম—সন্ধানী প্রকাশনী, ৪১, নয়াপল্টন, ঢাকা। মুদ্রিত হয়েছিল বাংলা একাডেমীর মুদ্রণ বিভাগ থেকে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
এরপর অরুণা প্রকাশনা, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা থেকে বের হয় ‘আল মাহমুদের কবিতা’। সেখানে ১৪টি সনেট অন্তর্ভুক্ত হয়। সর্বশেষ এবং এখন পর্যন্ত সোনালি কাবিন প্রকাশ করে আসছে নওরোজ সাহিত্য সম্ভার বা নসাস। নসাস প্রথম সোনালি কাবিন বের করে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে। এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন মামুন কায়সার। নসাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ বের হয় যথাক্রমে ১৯৯২ ও ১৯৯৮ সালে। চতুর্থবারের মতো বের হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। ৬০ পৃষ্ঠার এই সর্বশেষ সংস্করণের মূল্য ছিল চল্লিশ টাকা মাত্র। তবে ২০০৬ সালে পঞ্চম সংস্করণও বেরিয়েছে, যার বর্তমান মূল্য ৫০ টাকা।
আল মাহমুদের সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনের উৎসর্গপত্র নিয়ে কবি জাকির আবু জাফর চমৎকার লিখেছেন। তার ভাষায় :
শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরী- এই তিনজন ছিলেন আল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শহীদ কাদরী যদিও বয়সের তুলনায় তিনজনের চেয়ে কম, তবুও মানিয়ে গেছেন সফলভাবে। এ চারজনের পারস্পরিক এক ধরণের প্রতিযোগিতা ছিল। কে কার বৈশিষ্ট্য উঁচু করবে, নিজের অবস্থান পোক্ত করবে এমন সাধনা ছিল অবিরাম। কোনো নতুন কবিতা রচিত হলেই একজন অপরজনকে শোনানোর উচ্ছাসে অস্থির ছিল। কবিতা লেখা যেমন ছিল নিষ্ঠার। পাঠও ছিল খুবই আন্তরিক। শোনার ক্ষেত্রেও সামান্যতম কমতি ছিল না কারো। শুনে প্রশংসার মাল্যদান ছিল অকপট। সমালোচনার তীরও বর্ষাতেন স্বতঃস্ফূর্ততার স্বরে। এমনি ছিল চার কবির কাব্যানন্দের জগৎ। আল মাহমুদ অপেক্ষাকৃত বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন কবিতার শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়ে। মান নিয়ে ছিলেন আপোসহীন। কবিতার প্রতি তাঁর দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা এবং যত্ন ছিল নিখাঁদ প্রেমের। কবিতার প্রতি হৃদয়ভরা প্রেম আল মাহমুদ টইটম্বুর রেখেছেন আমৃত্যু। হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছেন কবিতা-কুমারীকে। তাই কবিতাও হয়ে উঠেছিল তার পক্ষের নান্দনিক বিতান। কবিতার ক্ষেত্রে পরস্পরের যে ঈর্ষা কাজ করত তার উদাহরণ বেশ প্রাচুর্যময়। এই ঈর্ষার তীর আল মাহমুদের দিকে ছিল নিত্য গতিমান- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আল মাহমুদের সব থেকে আলোচিত কাব্য সোনালি কাবিন। এ বইটি উৎসর্গ ছিল তাঁর এই তিন কবিবন্ধুর নামে। উৎসর্গ পাতায় উজ্জ্বল বাক্য এই:
শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরী
আমাদের কাব্যহিংসা অমর হোক
কাব্যহিংসার এই স্তুতিবাক্য সত্যিই অমর। সোনালি কাবিনের পৃষ্ঠায় এই তিনটি নাম যথার্থতার অনুষঙ্গে অমর। অমর তাদের পারস্পরিক কাব্যহিংসার মূল্যবান স্মৃৃতির গহন। সাহিত্য পাড়ায় এসব আলোচনা ছিল বেশ মুখরোচক। সমসাময়িক তো বটেই, পরে এবং আজো এসব আলোচনার সমাপ্তি নেই; বরং ডালপালা ছড়িয়ে সাহিত্যাঙ্গনে কাব্যিক বৃক্ষ হয়ে উঠেছে এসব ঘটনা-রটনার বৃত্তান্ত।
সোনালি কাবিনের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে কবি আল মাহমুদ তার এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে চমৎকার একটি বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যটি নিম্নে তুলে ধরা হলো :
মঞ্চে উপবিষ্ট শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গ এবং আমার সামনে উপস্থিত ভাই ও বোনেরা। আপনারা সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। আমি আপনাদের এই ভালোবাসার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এটা আমার কাছে অভাবনীয়। আকস্মিকও মনে হয়।
আমি সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্যে কিছু কাজ করেছি। যখন কাজ করেছিলাম ‘সোনালি কাবিন’ নিয়ে, লেখাটা আমার মনে পড়ে আমি চট্টগ্রামের ধীবরদের যে পাড়া, জেলে পাড়ার একটা চারতলা বিল্ডিংয়ে থাকতাম সেখানে। তো সেই বিল্ডিংয়ে আমার যারা প্রতিবেশি ছিল, তারা ছিল অ্যাংলো পরিবারের ছেলে মেয়ে। তাদের সাথে দেখা সাক্ষাত হলেও খুব একটা কথাবার্তা হতো না। কিন্তু যখন ওরা পরিচয় পেল যে, আই অ্যাম অলসো অ্যা পোয়েট। তখন তারা সিঁড়িতে নামতে উঠতে সালাম দিত। তো ওই পরিবেশেই ‘সোনালি কাবিনে’র পরিকল্পনা ঠিক বলবনা, ওখানে প্রথম সাতটা সনেট আমি লিখি। লিখে আমি অভিভ‚ত হয়ে যাই। নিজের লেখা, আশে পাশে কেউ নাই যে কবিতাগুলো পড়ে শোনাব। শেষ পর্যন্ত চৌদ্দটা সনেট লিখলাম। আমি ভেবেছিলাম যে পঁচিশটা সনেট লিখে একটা বই আমি করব। কিন্তু কাব্য যে একটা দৈব ব্যাপার সেটা উপলব্ধির সুযোগ হলো। আমি চৌদ্দটার পরে একটা লাইনও লিখতে পারিনি। কত চেষ্টা করলাম। আর হলো না। ওই চৌদ্দটাতে আটকালো। চৌদ্দটাকেই ‘সোনালি কাবিন’ নাম দিয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলো। এটা দৈব ব্যাপার বলেই আমার মনে হয়। দৈব আমাকে সাহায্য করেছে। আমিতো এসব দৈব টৈব জীবনে পাত্তা দিয়েছি এমন মনে হয় না। কিন্তু লিখতে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, সাহিত্য শিল্প কাব্যে এই যে মিল অন্তমিল দিই, ছন্দ গন্ধ এসব মিলিয়ে একটা দৈব ব্যাপার ঘটে যায়। তখন কাব্যটা সমাজস্থ হয়।
যাই হোক এই দুলুনিতে এই শিহরণে সৃজনশীলতার কম্পন, যখন আপনি সত্যিই কোনো ভালো জিনিস লিখে ফেলেন তখন আপনার শরীরে একটা কম্পন সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত লেখাটা শেষ না হয়। এই যে কম্পন এই কম্পন আমার মাঝে সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ‘সোনালি কাবিন’ লিখেছিলাম। তখন ভাবতে পারিনি এ কবিতা এতোদূর যাবে। কত যে মানুষ আমাকে টেলিফোন করে মুখস্ত লাইন বলত। সেটা আমার মনে আছে, তখনই আমি বুঝেছি। আমি পরাজিত হবনা। আমার বিজয় সূচিত হবে। যাই হোক বন্ধুগণ আপনাদের এই ‘সোনালি কাবিন’ নিয়ে চল্লিশ বছর পূর্তি হয়েছে এটাতো ভাবাই যায় না। সময় বয়ে যায়। সময়তো চলে যায়। আমারতো সময় চলে গেছে। বয়স হয়ে গেছে আশি। এরপর মানুষ কি বলবে। এরপর বেঁচে থাকলে কি বলে? বলে অশীতিপর বৃদ্ধ। তাইনা? অশীতিপর বৃদ্ধ বলবে। তো আল্লাহর রহমত যে হায়াত আমাকে তিনি দিয়েছেন এই হায়াতের প্রকৃতপক্ষে খুব বেশি অপব্যয় করিনি। আমি লিখেছি ভালো হোক বা মন্দ হোক। আমিতো লিখে গেছি। শুধু যে পদ্য লিখেছি কাব্য করেছি তা নয়। আমিও গদ্য লিখেছি। আপনারা যারা আমার গদ্য পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন যে আমি গদ্যেও সমানভাবে কাজ করতে পেরেছি। আমার কোমরে দুইটা তলোয়ার ছিল, গদ্য এবং পদ্য। কাজ করতে আমি দুটোকেই কাজে লাগিয়েছি।
আমি বলবনা যে আমি ক্লান্ত, তবে বয়সের কারণে চোখে দেখতে পাইনা। কানে শুনতে পাইনা, এসব। জীবনটা মনে হয়, যখন যুবক ছিলাম মনে করতাম পড়তে পড়তে কাটিয়ে দেব। কখনও সেটা হয়না। একদিন দেখা গেল চোখে দেখতে পাইনা। চোখে দেখতে পাইনা পাগল হয়ে যাবার অবস্থা। চোখে দেখতে পাইনা সারা দুনিয়া। এই পৃথিবীতে যতবড় শহর আছে লন্ডন নিউইয়র্ক প্যারিস কোনোটি কি আর বাদ রেখেছি। সব ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলে এসেছি। কিন্তু চোখ সম্বন্ধে এক মহিলা আমাকে বলেছিল যে, আমি কথাটা ভুলিনি। মহিলা বলেছিলেন, আমার দাদা বাঙালি ছিলেন। তোমার চোখ টোখ দেখে আমার মনে হয়েছে তোমার চোখতো আর ভালো হবেনা। তবে আমি তোমাকে একটা কথা বলি একটা আশার কথা শুনিয়ে দেই, যতটুকু তুমি দেখতে পাও এটুকু তুমি সব সময় দেখবে। এবং চোখের একটু যত্ন করবে। তারপরতো আমি চোখের ওপর যত্ন করি। কিন্তু ওই যাকে বলে যখন আমি পড়তে পারিনা অক্ষরটা ঠিকমতো দেখিনা। কত চশমা বদলালাম কোনো কাজ হয়না। তো এই ভাবে ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের হিউম্যান ইন্দ্রিয়গুলো আছে, সে ইন্দ্রিয় মানুষের বাসনা অপরিসীম। মানুষের যে কত আশা কত বাসনা কিন্তু তার দুর্বল ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়গুলো তার সঙ্গে সায় দেয়না। তারপরের এইতো আমার অবস্থা। আমার ইন্দ্রিয়গুলো আমার সঙ্গে সায় দিচ্ছেনা। আমিতো পড়তে চাই। অনেক লিখতে চাই অনেক। এখন কি করব। নাতি নাতকোর এগুলোকে ডেকে পাওয়া যায় না। খুব ভালো ভালো ছাত্র। দুনিয়ার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তাদের দিয়ে তো লেখানো যায়না। কতক্ষণ বসলে উঠে চলে যায়। এই অবস্থায় আমি কাজ করি। চোখে দেখিনা কানে শুনিনা। কিন্তু কবিতা হলো এমন এক শিল্প, আপনাকে চৈতন্যের মধ্যে থাকতে দিবেনা। সাংঘাতিক রকম এক অবস্থা সৃষ্টি করে। যাই হোক কবিতার তাড়না, জ্বালা, পেইন, এগনি যাই বলেন ঘরের বার হতেই হবে। আপনাকে লিখতে হবে কাত হয়ে পড়ে। যদি আপনি লিখতে না পারেন আপনি বলবেন কেউ লিখে নেবে। আমার মনে আছে একটি ইংরেজি ঘুম পাড়ানি গান-
Rest, rest on mother breast
Father will come to thee soon
Father will come to his
Babes in the rest
Silver sails, all out in the west
Come to thee soon,
While my little one’s
While my pretty one’s
Sleep.
একশ বছর পরে সে বেটার। পড়তামতো পড়তাম শিখতাম কিন্তু এখন মনে হয় গ্রো ওল্ড, বুড়ো হয়ে গেছি, বৃদ্ধও। মানুষ বুড়ো হলেও মানুষের যে শিল্প স্বভাব যে চৈতন্য যা দ্বারা সে চালিত হয়। লেখক হয়ে কাত হয়ে শুয়ে থাকি চোখ নানারকম দৃশ্য দেখি সারা দুনিয়াতো একসময় ঘুরে ছিলাম। ঘুরেছিলাম আমার মনে আছে। ইফেল টাওয়ারের পাশে মৃদু আলোয় ছোট, নদী নিচে বয়ে চলে এর ওপর আমি দাঁড়িয়েছিলান। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পানি যাচ্ছে। মনে হলো এরকম একটা নদীর পাড়েইতো আমার বাড়ি আমি জন্মেছিলাম একটা নদীর পাড়ে। যাকে বলে তিতাশ নদী। আমার মনে হয় আমার কথা ঠিক নাও হতে পারে। যারা নদীর পাড়ে জন্মায় তারা স্বপ্ন দেখে বেশি। ড্রিম স্বপ্ন কি ? স্বপ্নটা হলো ড্রিম। মানুষ শুধু বাস্তবতা নিয়ে বাঁচতে পারেনা। বাস্তবতা হলো কঠিন পাথর। কঠিন পাথরের ওপর পা ফেলে আপনি চলতে পারবেন না। সেই জন্য একটা পা ড্রিম বা স্বপ্নের মধ্যে রাখতে হবে। এই ভাবে আপনি এগিয়ে চলতে পারেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি কি করেন। আমি বলি আমি স্বপ্ন দেখাই। হা করে তাকিযে থাকে। হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি আমার জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছি, বই লিখেছি, গ্রন্থ লিখেছি। স্বপ্ন নির্মাণ করেছি, ছড়িয়ে দিয়েছি। এদেশের ভাষার সম্পদে আপনি যদি সামান্য কিছু যোগ করে থাকেন। তাহলে একেই বলে সার্থকতা। সেই সার্থক অবস্থায় পৌঁছেছি কিনা তা আমি জানিনা। কিন্তু আমি কাজ করেছি। একটা বই লিখেছিলাম, ছোট একটা বই। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। এই বইটা পড়ে একজন টেলিভিশনে আমাকে অপদস্ত করার জন্য বলেছিলেন, পঞ্চাশ ভাগ আপনি মিথ্যা লিখেছেন, পঞ্চাশ ভাগ সত্য লিখেছেন। আমি কি আর জবাব দেব, আমি বললাম যে দেখেন-আমিতো শুনেছি আপনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তো আমি যদি পঞ্চাশ ভাগ সত্য লিখে থাকি আর পঞ্চাশ ভাগ মিথ্যা হোক। আমিতো কবি। আমিতো সত্যবাদী বলে পরিচিত নই সমাজে। আমি ট্রুথফুল না।
আমি একজন কবি। স্বপ্ন দেখি সত্যমিথ্যা মিলিয়ে লিখি। তবে যত কবিই হই যখন রচনাটি তৈরি হয় সেটা একেবারে মাটিতে পা না রেখে দাঁড়াতে পারেনা। তার পা থাকতে হবে তার দেশের মাটিতে। আমি লিখে গেছি গদ্যে পদ্যে যা পারি। আমার যা আসছে আমি লিখে গেছি। আমি যা দেখেছি তা লিখেছি। আমি আবার গেøাব টটার ছিলাম। বোকা লোকেরা যা হয়ে থাকে আরকি। আমি ইচ্ছে করলাম যে সারা পৃথিবী ঘুরবো। আমি সারাটা পৃথিবী ঘুরেছি। পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় শহরের ফুটপাত ধরে আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। কখনো তুষার ঝড় দেখতে দেখতে চলে এসেছি। এই যে এই অভিজ্ঞতায় সবকিছু কি আমি লিখতে পেরেছি? কেউ পারেনা। তবুও আমি চেষ্টা করেছি। খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি। সাহিত্য ইচ্ছে করলাম আর সাহিত্য হয়ে গেল, এটাতো হয় না। রক্ত বিন্দু দিয়ে লিখতে হয় অদৃশ্য লেখা। বহু কষ্ট দুঃখ মাড়িয়ে আসতে হয়। জীবনকে, জীবনকে জানতে হয়। ভালোবাসতে হয় মানুষকে। এভাবে চলতে চলতে একদিন আমি বুঝতে পারলাম যখন শুনলাম যে একজন আরেক জনকে দেখিয়ে বলছে কবি কবি। সেদিনই আমি ভাবলাম যে আমি সার্থক হয়েছি। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
‘সোনালি কাবিনের কথা’ শিরোনামের একটি লেখায় আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের কবিতাগুলো নিয়ে সুন্দর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় ওমর বিশ্বাসের একটি রচনায়:
আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ এর বিশ্লেষণ নানাভাবে হতে পারে। ৪১টি কবিতা নিয়ে সোনালি কাবিন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে একটি কবিতা ‘সোনালি কাবিন’ এবং এই কাব্য শিরোনামে গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়। প্রকাশের পর গ্রন্থটি যত না আলোচনায় আসে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনায় স্থান দখল করে নেয় সোনালি কাবিন কবিতাটি। কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয়ে প্রকাশের অনেক আগেই বাংলা কাব্য সাহিত্যে আলোড়ন তোলে। সামগ্রিক বিচারে বাংলা কাব্য সাহিত্যে ‘সোনালি কাবিন’ নামটিই অধিক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। কবিতাটি ১৪টি সনেট দিয়ে সাজানো। কাজেই কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ‘সোনালি কাবিন’ ও ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ স্বতন্ত্র গুরুত্ব বহন করে। সনেট গুচ্ছের আকর্ষণ কাব্যপ্রেমীদের কাছে নানাভাবে অনস্বীকার্য। নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণও। সার্বিক দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটির আকর্ষণের পিছনে সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি।…
…‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রগতি প্রকাশন থেকে আশ্বিন ১৩৮০ সালে; ইংরেজির ১৯৭৩ সালে। দাম রাখা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ টাকা। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন যৌথভাবে ড. নওয়াজেস আহমদ ও কালাম মাহমুদ। উৎসর্গ করা হয়েছিল সমকালীন কাব্যহিংসার তিন কবি শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শহীদ কাদরীকে এবং তাদের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল, ‘আমাদের এক কালের সখ্য ও সা¤প্রতিক কাব্য হিংসা অমর হোক।’ পরবর্তীতে অবশ্য অন্য আরো প্রকশনী থেকে বিভিন্ন সংস্করণ বেরিয়েছে।
সন তারিখের হিসেবে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সোনালি কাবিন তার ৪০ বছর পূর্তি করে। আশ্বিন ১৩৮০ সালে প্রকাশ কাল হলে বাংলা সনের ‘আশ্বিন’ ইংরেজির ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। সেই হিসেবে ২০১৩ সালের ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের ৪০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই দীর্ঘ ৪০ বছরে সোনালি কাবিন নানাভাবে পঠিত হয়েছে। এর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এর কাব্যপ্রিয়তা অমর হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়।
১৯৬৭-৬৮ সাল ছিল আল মাহমুদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এই সময়টা তাকে নানা কারণে বিক্ষুব্ধ করে আবার অমর কাব্য সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধও করে। এই সময়টা কবির জীবনে নানা কারণে ঘটনা বহুল মনে হয় আমাদের কাছে। তার বিখ্যাত অনেক কবিতাই রচিত হয়েছে এই সময়গুলোতে। সোনালি কাবিনের ১৪টি সনেট ৬৮ সালেই লেখা। সনেটগুচ্ছ ছাড়া এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই রচিত হয়েছে ৬৭ সালে। আবার সোনালি কাবিনে গ্রন্থভুক্ত কবিতা ছাড়াও তার বেশ কিছু বিখ্যাত ছড়ারও রচনা কাল ৬৭-৬৮’র দিকে, যদিও এখানে অন্য বিষয়ে আলোকপাত করা হবে না। সোনালি কাবিন এর ১৪ সনেটের রচনা তারিখ ছিল :
সোনালি কাবিন ১ এর রচনাকাল ২৫.০৯.৬৮
সোনালি কাবিন ২ এর রচনাকাল ৪.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৩ এর রচনাকাল ৪.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৪ এর রচনাকাল ৫.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৫ এর রচনাকাল ৬.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৬ এর রচনাকাল ৭.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৭ এর রচনাকাল ৯.১০.৬৮
সোনালি কাবিন ৮ এর রচনাকাল ৫.১১.৬৮
সোনালি কাবিন ৯ এর রচনাকাল ৭.১১.৬৮
সোনালি কাবিন ১০ এর রচনাকাল ৮.১১.৬৮
সোনালি কাবিন ১১ এর রচনাকাল ১০.১১.৬৮
সোনালি কাবিন ১২ এর রচনাকাল ৩.১২.৬৮
সোনালি কাবিন ১৩ এর রচনাকাল ৫.১২.৬৮
সোনালি কাবিন ১৪ এর রচনাকাল ৬.১২.৬৮
তারিখগুলো আল মাহমুদ যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই দেয়া। প্রতিটি সনেটের শিরোনাম হিসেবে ‘সোনালি কাবিন’ লিখে সনেট সংখ্যাটি বৃত্তবন্দি করে লেখা হয়েছে। আর প্রতিটি তারিখের নিচে উল্লেখ করা হয়েছে রচনার স্থান ‘চট্টগ্রাম’।
সনেটগুচ্ছের রচনাকাল ছাড়াও ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতার রচনাকাল পাওয়া যায়। সে সব কবিতার রচনাকাল হলো :
বাতাসের ফেনা ২৫.১.৬৭
প্রত্যাবর্তনের লজ্জা ৩১.১.৬৭
অন্তরভেদী অবলোকন ৭.২.৬৭
দায়ভাগ ২৩.১২.৬৬
কবিতা এমন ২১.১২.৬৬
অবগাহনের শব্দ ৪.১.৬৭
ভাগ্যরেখা ১২.৬.৬৭
পলাতক ৩৭.৮.৬৭
এক নদী ৬.১০.৬৭
নতুন অব্দে ৬.১০.৬৭/৭.১০.৬৭;
(কবিতাটি ডায়েরির দুই দুই জায়গায় দুই তারিখ দিয়ে লেখা আছে। সম্ভবত ৬ তারিখে কবিতাটি প্রথম লেখা হয়। পরে ৭ তারিখে পুনরায় খসড়া থেকে ফাইনাল করা হয়। যদিও ৭ তারিখের অংশেও কাটাছেড়া দেখা যায়।)
স্বপ্নের সানুদেশ ৭.১১.৬৭
আমিও রাস্তায় ২৫.১.৬৮
পালক ভাঙার প্রতিবাদে ১৬.৮.৬৮
খড়ের গম্বুজ ৭.৯.৬৮
‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’ ও ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতা দুটির তারিখের নিচে ‘চট্টগ্রাম’ লেখা আছে।
বলা দরকার, আল মাহমুদ আল মাহমুদই। তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কাব্যিক বাছ-বিচারকে স্বতন্ত্র রেখেই বলা যায় একটি জনপ্রিয়, পাঠকপ্রিয় সোনালি কাবিন প্রকাশের আগেই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এর আগে তার ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৬ সালে। সোনালি কাবিন মিনিবুক হিসেবে পাঠকের হাতে আসে ১৯৭১ সালে। কলকাতা থেকে স›দ্বীপন চৌধুরীর প্রকাশনায় সপ্তম মিনিবুক হিসেবে প্রকাশ পায়। দাম ছিল দুই টাকা। এর আগে সোনালি কাবিনের সাতটি সনেট ‘সমকাল’ পত্রিকায় ছাড়া হয়। এর অনেক পরে ১৯৭৩ সালে পুরো কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
কাব্যের কোনো ব্যাখ্যা হয় না– আল মাহমুদ একথা মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন। তারপরও মানুষ ব্যাখ্যা করে। নানাভাবেই ব্যাখ্যা করে। নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে। নিজের মতো করেই করে। ভালো লাগা, মন্দ লাগা প্রকাশ করে। সে বিবেচনায় সোনালি কাবিন অবশ্যই একটি আলোচিত গ্রন্থ। সোনালি কাবিন আল মাহমুদের একটি বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। সোনালি কাবিন বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
আল মাহমুদ চেয়েছিলেন সনেটের মাধ্যমে প্রেমের কবিতা লিখতে। তার নিজেরও বিশ্বাস ছিল এটি তাকে বাংলা সাহিত্যে অমরতা দেবে। সোনালি কাবিন প্রেমের কবিতা হিসেবে খ্যাত। সেই প্রেমকে তিনি সাজিয়েছেন নানাভাবে নানা মোড়কে। করেছেন কাব্যটিকে কালোত্তীর্ণ।
সোনালি কাবিন সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য :
১.
‘সোনালি কাবিন’ কবিতাগুচ্ছে কবি উপমা-রূপকের অভির্চ্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে তিনি উম্মোচন করেছেন, যার ফলে গাঙের ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা পেয়েছে হৃদয়ের উদ্বেলতার, নদীর চরের প্রতি কিষাণের অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাক্সক্ষার, ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় ভাস্বর হয়েছে নর-নারীর আকর্ষণ। সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ (প্রবন্ধ)
২.
আল মাহমুদ শুধু শক্তিমান কবি নয়; এদিক থেকেও তাঁর কাব্য সাধনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। তাঁর উপজীব্য, বাক প্রতিমায় সংযুক্তিতে নাগরিকতা এবং আঞ্চলিকতার টানাপোড়েন অনেক সময় জামদানি শাড়ির কথা স্মরণে আনে। তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী; কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদলজ্জায় নিজেকে উদোম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তাঁর টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে, সেইকিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন। প্রফেসর শিবনারায়ণ রায়, একজন খাঁটি কবি
৩.
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলার’ সঙ্গে ‘সোনালি কাবিন’-এর পরিকল্পনার সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। জীবনানন্দ আল মাহমুদকে বহুভাবেই উদ্বেলিত করেছেন ভাষায়, ছন্দে, কবিতার গঠনে, চিত্রকল্পে এবং বহু ভাবনায়। কিন্তু তাঁর মনোগঠনে জীবনানন্দীয় প্রভাব খুব গভীরে কাজ করেনি। খানিকটা বৈপরীত্যই ছিলো বলা যায়। সংসার ও জনসমাজকে প্রবলভাবে ভালোবেসেও জীবনানন্দ তাঁর মনের নিঃসঙ্গ মুখ কখনই আড়াল করতে পারেননি। সমাজ-সংস্কার হয়নি তাঁর সুখের আশ্রয়। অপরপক্ষে আল মাহমুদ জনসমাজেই স্বচ্ছন্দ সেখানেই তাঁর শান্তি এবং তা দু’দত্তের নয়। জীবনানন্দের সংসার খুব সুখের ছিলো না এবং আল মাহমুদ তৃপ্ত পারিবারিক জীবনের অধিকারী এই ঘটনা দুটি একেবারে নিরর্থক নয় সম্ভবত। কাব্যগ্রন্থ দুটিরও সুর ও মেজাজ আলাদা। জীবনানন্দের প্রকৃতি সংবেদনা গাঢ়-স্নিগ্ধ, আবিষ্ট, নিবিড়। ‘সোনালি কাবিন’-এ প্রকৃতির সঙ্গে কবির সম্পর্ক শরীর ভোগের তীব্রতার। ‘রূপসী বাংলা’য় আগাগোড়াই মৃত্যুবোধস্পর্শী এক মন্থর বিষণœতা। আল মাহমুদের সনেটগুলি অতীত মহিমায় গর্বিত, বর্তমান দূর্ভাগ্যে ক্রুদ্ধ ও ভবিষ্যতের সংকল্পে উদ্দীপ্ত। দুই কবির নারী ভাবনা ও সম্পূর্ণ দু’রকম। বোধ হয় বলা যায়—’রূপসী বাংলা’ তার রূপ সত্তে¡ও বিষণ্ণভাবে না বাচক। ‘সোনালি কাবিন’ জোরালোভাবে হাঁ-বাচক। – সুমিতা চক্রবর্তী, আল মাহমুদের কবিতা : পার্থিব সংযোগ।
৪.
আমার বিবেচনায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম লেখক লেভ তলস্তয়ের কথাও স্মরণযোগ্য। লেখক হিসেবেও তিনি তীব্রতম। আল মাহমুদের মধ্যেও এই তীব্রতা উজ্জ্বল রেখায় দীপ্যমান চিরকালই। ‘সোনালি কাবিন’-এর কবির কথা মনে না-পড়া অসম্ভব। তখন আল মাহমুদ এইরকম জোরের সঙ্গেই শ্রেণীসাম্যের কথা বলতেন—এখন যেমন জোরের সঙ্গে তাঁর ধর্মবিশ্বাসের কথা রাষ্ট্র করেন। কিন্তু আল মাহমুদের কবিতা এসব বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে নয় অবশ্য কেন্দ্রে রেখেই অন্য জায়গায় উত্তীর্ণ হয়েছে। –আবদুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতা
৫.
বাংলাদেশের কবিতায় একমাত্র আল মাহমুদকেই ইয়েটসীয় জীবনানন্দীয় ধারার সার্থক প্রতিভু ভাবা চলে। গ্রাম-নিসর্গের অকৃত্রিম প্রেমী এই কবি তাঁর কবিতায় জীবনের হার্দা করুণ অনুভূতিসমূহের সরল কিন্তু গভীর প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সঙ্গে মিশিয়েছেন লোকজ ঐতিহ্যের বিবিধ উপাদান। আল মাহমুদের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যাকৃতি ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এবং অন্যান্য কবিতা। ‘সোনালি কাবিনে অবশ্য যুক্ত হয়েছে ভিন্ন একটি প্রবল ধারা যে ধারাটি অর্কসবাদী গণচেতনা ও ইতিহাস চেতনার। নিরাশা-নির্বেদ কণ্টকিত ইউরোপীয় কাব্যধারার সর্বপ্রচল ও প্রলোভক দিকটিকে শামসুর রাহমান তাঁর সাফল্যের নিধান ভেবে যাত্রারম্ভ করেছিলেন, অন্যদিকে আল মাহমুদ বেছে নিলেন সারল্য—গভীরতার কাব্যভাষা ও কৃৎ-কৌশল, তার সাথে মার্কসবাদী গণচেতনার মিশ্রণটি সুফলপ্রসু হয়েছিল সোনালি কাবিন’-এ। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, পশ্চিমের জানালা
৬.
লোকলোকান্তর, কালের কলস ও সোনালি কাবিনে এই যৌন মনষ্কতা ও কামনা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে আলাদা করা যায় না। সেই সূত্রে কখনো তিনি লোক পুরানের পাশাপাশি ভারতীয় মিথ ও গ্রীক-রোমান মিথিক চরিত্র ব্যবহার করেছেন। তবে লোক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো ছাপিয়ে তা প্রবীন হয়ে ওঠেনি। – মাহবুব হাসান, মিথের ব্যবহার : আল মাহমুদের কবিতায়
৭.
‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে পাশাপাশি দুটি স্তর রয়েছে। একদিকে প্রেমিক ও প্রেমিকা, অন্যদিকে বিস্তৃত প্রাকৃত পটভূমি। একদিকে সৌন্দর্য, আরেকদিকে তার বস্তুভিত্তি। যে বৃক্ষের সবুজে আমরা মুগ্ধ কিংবা যার ফুল ও ফসলে সৌন্দর্য ও প্রয়োজনে মেটে, তার শেকড় চ্যুত হলে সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে, তেমনি কবির ঐ রকম উচ্চারণ, তা যত বর্ণোজ্জ্বল ও চমৎকারই হোক শেষ পর্যন্ত আত্মহননেই প্ররোচিত হয়। সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছের কবি যখন তার বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্ন উচ্চারণ করেন, তখন তা তাঁর ঐ প্রবণতাকেই স্পষ্ট করে তোলে। যে নেতিবাচক লক্ষণসমূহ কবি নিজেই তাঁর সনেটগুচ্ছে শনাক্ত করেছেন সে সব যখন তাঁর ভিন্ন উচ্চারণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন আমরা আর বিস্মিত হইনা। কারণ, কবি নিজেও সেই বস্তুভিত্তি ও বাস্তবতার অধীন। আর সত্যিকার কবিতা এমন নির্মম যে সে তার স্রষ্টাকেও ক্ষমা করে না। – শান্তনু কায়সার, কালের অক্ষর: আল মাহমুদের সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ
৮.
ষাটের দশকে যে কবিতাগুলি লোকপ্রিয়তায় ধন্য হয়েছে, তার মধ্যে সোনালি কাবিন’ কবিতাগুচ্ছ আলোচনার দাবি রাখে। স্বদেশ ভাবনার পটভূমিতে প্রেমের এমন এক নিটোল চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে যে, ‘সোনলি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ পাঠকের পরিপূর্ণ আগ্রহ দাবি করে। কবির জন্য সার্থক চিত্রকল্প প্রার্থনীয় হয়ে ওঠে। কবিতার মর্মকথা ঐ চিত্রকল্পের মধ্যেই বাণীরূপ লাভ করে। পরিচ্ছন্ন পরিপুষ্ট চিত্রকল্প না হলে নিছক সনেটের আঙ্গিক এতো সফল কবিতার জন্ম দিতে পারে না। সফল চিত্রকল্প সৃষ্টি কবির জন্য আত্মআবিষ্কার, পাঠকের জন্য নতুন মানচিত্র লাভ। আল মাহমুদ আমাদের এমন একটি নতুন মানচিত্র দান করেছেন। -আবুল কাসেম, কাব্যের লোকপ্রিয়তা ও আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ সনেট চতুর্দশী
৯.
কিন্তু সোনালি কাবিনের পূর্বপর্যন্ত এই প্রাতিস্বিকতাকে ছুঁতে পারেননি এই কবি। সেক্ষেত্রে তখন আল মাহমুদের কবিতার প্রধান ভর ছিল কল্পনা প্রতিভা এবং অনন্য বাগভঙ্গির ওপর। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যখন যুক্ত হলো আঞ্চলিক ভাষারীতির ধরন, তখন তাঁর কবিতা শুধু অভিনব হয়ে ওঠেনি। বাংলা কবিতায় আধুনিকতাকে তিরিশের কবিতার পর অনেকটা প্রসারিত করে দিলেন তিনি।
ড. মাসুদুজ্জামান, আল মাহমুদ : তাঁর প্রাতিস্বিকতা
১০.
বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচক বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁর কবিতায় বাক প্রতিমা’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : সোনালি কাবিনের দৃশ্যচিত্রকল্পরূপময় প্রতিমাগুলি অবিরলভাবে আদি রসাশ্রিত’—এ মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ। যেমন ‘বাতাসের ফেনা’ কবিতায় যখন কবি বলেন, ‘উঠতি মেয়ের ঝাঁক একে একে কমে আসে ইলিশের মৌসুমের মতো’ কিংবা ‘এক নদী’ কবিতায় ‘পিঠার মতো হলুদ মাখা চাঁদ যেন নরম কলাপাতা মোড়া— এইসব চিত্ররূপময় প্রতিমা ব্যবহার আমাদের জন্য অনুভবের জগতে নিয়ে যায়। -সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়, কবির আত্মরক্ষা : আল মাহমুদের কবিতা।
১১.
আলোচনার সুবিধার জন্য ‘সোনালি কাবিনের’ কবিতাগুলোকে আমি এভাবে বিভক্ত করতে পারি। ১. জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির দর্শন—প্রকৃতি, অবগাহনের শব্দ, পলাতক, স্বপ্নের সানুদেশে অন্তরভেদী অবলোকন, জাতিস্মর, ভাগ্যরেখা, কেবল আমার পদতলে, চোখ, উল্টানো চোখ, আমার চোখের তলদেশে। ২. আত্মজীবনীমূলক – কবিতা এমন, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা, আভূমি আনত হয়ে। ৩. প্রেম এবং প্রকৃতি বিষয়ক এই সম্মোহনে, তোমার হাতে, যার স্মরণে, এক নদী, তোমার আড়াল শ্রেণিতে সৌরবে, দায়ভাগ, প্রকৃতি, বাতাসের ফেনা প্রভৃতি। ৪. গ্রাম এবং নগরের দ্বা›িদ্বক বাস্তবতার চিত্রপালক ভাঙার প্রতিবাদে, চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়, খড়ের গম্বুজ, আমার প্রাতরাশে এবং সনেট চতুর্দশ। ৫. আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তামূলক কবিতা— নতুন শব্দে, আত্মীয়ের মুখ, আমি ও রাস্তায় ও সনেট চতুর্দশ। আহমেদ মাওলা, আল মাহমুদের সোনালি কাবিন : কবি আত্মা ও কাব্যশিল্প, পূর্বাকাশ, চট্টগ্রাম ২০০৬।
১২.
‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠতম রচনাসমূহের মধ্যে অন্যতম। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় এই সৃজনশীল কবিতাই তার কাব্য হিংসার অন্যতম হাতিয়ার। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ তাঁর দুই দশকের কাব্য সাধনার পরিণত স্বরূপ হয়েছে। প্রেম ও রমনী দেহের প্রতি তার যে কাব্যময় অভিব্যক্তি তা এখানে অনুপমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কর্ষনের মাটি ও নারী একাকার হয়ে গেছে তার বর্ণনায়। কবি এখানে প্রাচীন বাংলার কীর্তি গাঁথাকে স্মরণ করে, বর্তমানের ব্যর্থতায় ও কর্তব্যে এবং ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। মাহবুবুর রহমান, সোনালি কাবিন সনেট গুচ্ছে আল মাহমুদ, পূবাকাশ, ২০০৬
সোনালি কাবিনের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ :
১. আল মাহমুদের কবিতা : সোনালি কাবিন, সৈয়দ আলী আহসান
২. আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০
৩. গ্রহান্তরের মানুষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কবিতা প্রতিমাসে, কলকাতা, জুলাই
৪. সোনালি কাবিন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ঐ
৫. কবির বিশ্বাসের তরু, মাহবুব হাসান। ঐ
৬. কালের অক্ষর: আল মাহমুদের সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ, শান্তনু কায়সার।
৭. কাব্যের লোকপ্রিয়তা ও আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’, আবুল কাসেম, উপমা, মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন সম্পাদিত, উত্তর পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, ১৯৯৪,
৮. কবিতার বিবর্তন, উত্তর বৃত্তের কবিতা ও নতুন অনুয়ের প্রেক্ষিত, এজাজ ইউসুফী, স্বল্প দৈর্ঘ্য, সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা-১, নামাজগড় ক্রসলেন, বগুড়া, ২০০১
৯. লোকজ বাস্তবে আল মাহমুদের কবিতা, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।
১০. কবিতায় রূপের ছন্দ : একটি উদাহরণ, ড. সনজীদা খাতুন।
১১. আল মাহমুদের কবিতায় মিথের প্রয়োগ, বেগম আক্তার কামাল।
১২. আল মাহমুদের কবিতা : গাঁয়ে ফেরার পিপাসা, ড. রাজীব হুমায়ুন।
১৩. শিল্পের চতুষ্কোণ (আল মাহমুদের কবিতায় নারী পুরাণ), ড. অনু হোসেন, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০০৫.
১৪. আল মাহমুদ ও অন্যান্য (আল মাহমুদের সোনালি কাবিন : পুনপাঠ), তৌফিক জহুর, স্বচ্ছন্দ প্রকাশন, গুলশান, ঢাকা ২০০৩,
১৫. আল মাহমুদের কবিতায় প্রসঙ্গ ও প্রকরণ, মুহিবুল আজিজ।
১৬. আল মাহমুদের সোনালি কাবিন : কবিতাত্মা ও কাব্যশিল্প, আহমেদ মাওলা, পুবাকাশ, পোয়েটিকস, চট্টগ্রাম, জুলাই ২০০৬,
১৭. সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে আল মাহমুদ, মাহবুবুর রহমান, পোয়েটিক্স, চট্টগ্রাম, জুলাই ২০০৬