রফি হক
“মানুষের কোনো বন্ধু নেই
…এমনকি মানুষ নিজেও নিজের বান্ধব নয়
…বুঝে গেছি আমি নিঃসঙ্গ বেদনায়
মানুষের কোনো বন্ধু নেই”….
[ইকবাল আজিজ / আমার কোনো বন্ধু নেই]
এত স্পষ্ট ভাবে বেদনার কথা বলা, ইকবাল আজিজের একাধিক কবিতায় আছে। তবে এটা তাঁর অভ্যেসে চলে এসেছিল। যেমন এই কবিতার আরো কয়েকটি পঙক্তি :
“…আমার বেদনা চেগুয়েভারার হাত থেকে খসে পড়া
ডাইরির মতো পড়ে আছে বলিভিয়ার অরণ্যে—
আমার সকল আশা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরোদের
কোনো অস্ফুট রাগিণী হয়ে আজো ডাক দিয়ে যায়…
….
তোমার সময় নেই
তুমি বুঝবে না আমার বেদনা…”
.
কবিতার মধ্যে এমন একটা কিছু থাকে, যা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ইকবাল আজিজকে আমি কখনও সরব দেখিনি। তিনি কবিতার পরিবেশের ভিতরে থেকেও চুপচাপ ছিলেন। আবার কবিতার পরিবেশ থেকে সরে গিয়েও মৃত্যু পর্যন্ত চুপচাপ ছিলেন।
.
ইকবাল আজিজ খুব অন্তর্গত বেদনাকে পুষে রাখতে ভালোবাসতেন। আমি তাঁকে আমার কৈশোরে ‘কবি’ হিসেবে চিনতাম। তখন আমি রাজু আহমেদ স্মৃতি সংসদে সক্রিয়। তিনি তখন ছাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তিনি কুষ্টিয়ার কোর্ট পাড়ার মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে তিনি কুষ্টিয়াতে আসতেন। রাজু আহমেদ স্মৃতি সংসদে আসতেন। সেখানে লালিম ভাই সহ তাঁর অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। তিনি আমার ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন—আমি তাঁকে ইকবাল ‘ভাই’ বলতাম।
.
অবাক হলাম যখন ঢাকাতে আমি আশির দশকের শুরুতে একটি ন্যাশনাল ডেইলি নিউজপেপারে পার্ট-টাইম করি—সেখানে তিনি সহ-সম্পাদক ছিলেন। অভিসার সিনেমা হলের বিপরীতে অফিস ছিল আমাদের। অভিসার থেকে আমরা কমলাপুর এলাম তখনও একসঙ্গে। কমলাপুর থেকে আমরা শান্তিনগরের মোড়ে এলাম সেখানেও ইকবাল ভাই এলেন। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছি নিউজপেপারে। আমি তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা ও সমীহ করতাম। আমরা আমাদের বড়ো ভাইদের বাঘের মতো ভয় পেতাম। তিনিও আমাকে ছোটোভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন।
.
নিউজপেপার অফিসে ইকবাল ভাইকে আমি উচ্ছ্বাস ও আনন্দ নিয়ে সহকমীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি, এমন নয় । হয়তো সেখানে ভিন্ন পরিবেশে তিনি কথা বলবার মতো কাউকে পাননি। সবার সঙ্গে তিনি মিশতেও পারতেন না। আমার ধারণা— তিনি কবি ও কবিতার পরিবেশে অন্য এক মানুষ ছিলেন। নিশ্চয়ই সেখানে তিনি উচ্ছ্বাস ও আনন্দ প্রকাশ করতেন।
.
আশির দশকের মধ্যভাগে একজন বিখ্যাত তুরস্কের গায়িকা এসেছিলেন ঢাকায়। সেই গায়িকা যেমন জাঁহাবাজ রূপবতী সুন্দরী ছিলেন তেমনি ছিলেন দুর্দান্ত গায়িকা। সম্ভবত গায়িকার নাম ছিলো লায়লা। লাস্ট নেম মনে নেই। ওসমানী মিলনায়তনে তিনি পারফরম করেছিলেন। নিউজপেপারে কাভার করবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইকবাল ভাই। কী মনে করে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। লায়লার গান ও সৌন্দর্য বিমোহিত করেছিলো ইকবাল ভাইকে। এতটাই বিমোহিত করেছিল যে তিনি গান শেষে তাঁর আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন পুরো শরীর নাচিয়ে চিৎকার করতে করতে। তখনও লায়লা মঞ্চে ছিলেন। ইকবাল ভাই একটি লাল গোলাপ হাতে করে ‘লায়লা ‘লায়লা’ করতে করতে মঞ্চে উঠে গেলেন।…
.
সেই বিষ্ময়কর মুহূর্তের দৃশ্যের স্মৃতিটি আমার চোখে লেগে আছে। এখন মনে হয় যে, তিনি লাল গোলাপটি কোথায় পেয়েছিলেন ? এমন ইকবাল ভাইকে আমি কোনোদিন দেখিনি আর। আমার কানে বাজছে ‘লায়লা’ ‘লায়লা’…
.
নব্বুইয়ের পরে ২০০০ সালে ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে আবার দেখা হলো “শৈলী’ পত্রিকায় । সোনারগাঁ হোটেলের উল্টো দিকে শৈলী-র অফিস ছিল। দেখা হলেই আমার বড় ভাইয়ের খোঁজ নিতেন। শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৪ সালে। আমাকে তিনি একদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানালেন ‘ব্রাক ইন’ রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে। সেই প্রথম ব্রাক ইনে চৌদ্দ তলায় শহরের দৃশ্য দেখতে দেখতে খেলাম। পরিচ্ছন্ন তারকামানের রেস্টুরেন্ট। শহরে এমন রেস্টুরেন্ট গুলশান এলাকায় আছে জানা ছিল না ! আমি অবাকই হচ্ছিলাম কেন তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন?
.
আমরা চাইনিজ ডিস্ খেতে খেতে কবিতা ও চিত্রকলা নিয়ে কথা বলছিলাম। খাওয়া শেষে আমাকে আরও অনেক অনেক গুণ অবাক করে দিয়ে তাঁর একটি সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘এক চাকরের সান্ধ্যগীতি’ নামের কাব্যে গ্রন্থের প্রচ্ছদে আমার শিল্পকর্ম ব্যবহার করেছেন !! ইকবাল ভাই তাঁর ছোটো ভাইসম অনুজ শিল্পীকে এমন করে সম্মান জানালেন যে আমি অবাক হলাম । আমার চোখে খুব জল আসে। চোখ ভিজে গেল কবির ভালোবাসায় । বললেন : আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার অন্তত. একটি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ হোক তোমার শিল্পকর্ম দিয়ে। আমরা কুষ্টিয়ার সন্তান”!!…. আমার গলায় বাষ্প জমল, কোনও কথা বলতে পারলাম না !
.
তাঁর একটি কবিতা আমার খুব প্রিয় । তিনি আসাদ চৌধুরীর টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘প্রচ্ছদ’-এ কবিতাটি পড়েছিলেন : “এ কোন্ জীবন আমি বেছে নিলাম” :
“পথের ওপাশে আর কোনো পথ দেখতে পাই না—আঁধারে
পথ হেঁটে মনে হয় পথ বহুদূর।
এ কোন্ জীবন আমি বেছে নিলাম, কৃষ্ণচূড়ায় হিমেল বাতাস,
রাজার সেনাদল—রুটমার্চ
আমার নাম আজো লেখানো হলো না প্রভু….”
.
.সার্ত্র লিখেছিলেন প্রত্যেক শব্দের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আছে, প্রত্যেক নীরবতারও। কবি জীবনের বেশ অনেকগুলো বছর নীরবই ছিলেন । কবিতার তুমুল পরিবেশের থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন কবি নিজেকে। তিনি নিজেই লিখেছেন :
.
“আমার মৃত্যুর স্মরণসভায় কাউকেই আসতে বলিনি
…..
রাত্রিশেষের ডাহুক এখনও প্রতীক্ষায় সকাল
হবে কখোন,
ঝিঁঝিঁ পোকারা ক্লান্ত,
বাঁশবনে ঘুরে ঘুরে তারা থেমে গেছে
নদীতে জ্যোছনার পাল তুলে চাঁদ সদাগরের নৌকা
ভাসে কি আজো সুদূরপারে?
.
ধীরে ধীরে সব শিথিল হয়ে মৃত্যু আসছে…”
.
আমি তখন কুষ্টিয়াতে, আমার প্রিয় শহরে। ইকবাল আজিজ ভাই ও আমার প্রিয় শহর কুষ্টিয়া। প্রিয় অনুজ রূপার [Rupa Mahmud] টেক্সট পেলাম : ইকবাল আজিজ ভাই নেই ! আমি ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছি—ওপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি জল ভরা চোখে, মাঠ ছাড়িয়ে কুয়াশাময় বহুদূরের আবছা গ্রাম। তারও ওপাশে পদ্মা। ‘আমার চোখের মধ্যে ছিল বেদনার বৃষ্টি’। পৃথিবীতে মৃত্যুর কাহিনী খুবই প্রাচীন।
……………………………………………………………….
কাব্যগ্রন্থ : এক চাকরের সান্ধ্যগীতি / ইকবাল আজিজ
প্রচ্ছদ : রফি হক
……
রফি হক : শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এণ্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।