মুসা আল হাফিজ
তিন.
আমরা সতেরো শতক থেকে প্রাচ্যবিদদের দেখছি একটি নির্ধারক ভূমিকায়। তারা তত্ত্বীয়ভাবে দিকনির্দেশক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্যের সবচে কার্য্কর বাহিনী হয়ে উঠছেন। তারা এমন নৈপুন্য ধারণ করেন, যা তাদেরকে বহুমুখী কাজের যোগ্য করে তুলে। সাম্রাজ্যের পলিসি এবং তাদের কাজ একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়। পশ্চিমা আধিপত্যকে তারা সকল উপায়ে জোগিয়ে চলে তথ্য, জ্ঞান ও শাসনের ব্যবস্থাপত্র। এ পথে চালিয়ে যায় ক্লান্তিহীন গবেষণা। অতএব অতএব একজন আর্নেস্ট রেনান (১৮২৩-১৮৯২) পশ্চিমা দখলদারীর চৈন্তিক উপাদান সরবরাহ করেন রচনাকর্মে। আবদুর রহমান বাদাবী (১৯১৭-২০০২) তাকে অভিহিত করেন, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রবক্তা হিসেবে। ফরাসী এ চিন্তাবিদ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বিশ্বময় পঠিত। সেসব অনুবাদের মধ্যে আছে Studies of Religious History and Criticism. (1864). Islam and Science: A lecture presented at La Sorbonne, ( 1883) Renan’s Letters from the Holy Land. (1904). History of the People of Israel. (1888–1895). Lectures on the Influence of the Institutions, Thought and Culture of Rome, on Christianity and the Development of the Catholic Church. (1885) My Sister Henrietta. (1895). An Essay on the Age and Antiquity of the Book of Nabathaean Agriculture (1862). ইত্যাদির মধ্যে প্রতিফলিত যে রেনান, সে শুধু একজন দ্রষ্টা ও দার্শনিক নয়, একজন শাসকও । তার পরিধি ছিলো বিশাল। কাব্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম্তত্ত্ব, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে তিনি কথা বলেছেন কর্তৃত্বের জায়গা থেকে। এস্ট্রোলজি গবেষণায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যা পরে প্রথায় পরিণত হয়। ১৮১২ থেকে ১৮৯২- প্রায় একশতকের জীবনপরিধিতে তিনি হয়ে উঠেন এক প্রণালী, যা দিয়ে একমহাদেশের সংস্কৃতি ও যুদ্ধজাহাজ আরেক মহাদেশে প্রবেশ করে। লেবাননে ছিলো তার বসবাস। তিনি পরিচালনা করেন পশ্চিমাদের গোয়েন্দাকর্ম্।
মুসলিম জাহানে গোয়েন্দাগীরির পশ্চিমা ধারাবাহিকতা আধুনিক রূপ লাভ করে যাদের হাতে, রেনান তাদের একজন নন, তাদের পুরোধা। তার উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এ কাজের সমন্বয় কীভাবে সম্ভব? যে রেনান অফিসিয়াল ডিসকোর্স্ রূপে প্রাচ্যতত্বের ভিত্তি রচনা করেছেন, এর অন্তর্দৃষ্টিসমূহকে দিয়েছেন পদ্ধতিগত স্থান ও শৃঙ্খলা, নির্মাণ করেছেন এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, তিনি ছিলেন সময়ের আর্কাইভ। ভাষ্য ও বিবৃতির এক রীতি। ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করা তার কাজ, দর্শন ও ভাষাতত্ত্ব তার বিশেষ এলাকা, ভাষাবিজ্ঞানে তার বিচরণ অবাধ; অনেকটা ফ্রেডরিখ নিটশে(১৮৪৪-১৯০০) বা আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) এর মতোই। লা অভেনির ডি লা সায়েন্স গ্রন্থে তিনি হয়ে উঠেন ভাষাতাত্ত্বিক আধুনিক মনের প্রতিষ্ঠাতা। ভাষাতত্ব্রের মতো সকল মানুষের বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা রেনান কাজ করলেন মুসলিম দেশে একজন গোয়েন্দা হিসেবে! কারণ তিনি যে শাখায় কাজ করতেন, তার মনে বৈরিতার এক ধর্ম বিরাজ করতো প্রভাবক হয়ে। নিজের কাল ও পরবর্তীকালের ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসকে প্লাবিত করা এ পুরুষ সকল পরিচয় নিয়েও মূলত সেখানে ছিলেন ক্রুসেডিয় মনের সন্তান!
এ ক্ষেত্রে তার সাথে তুলনীয় হতে পারেন লর্ড্ ক্রেমার। তার পরিধিও ব্যাপক। বৃটেনের তুখোড় এক রাজনীতিবীদ। ইসলামের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ভাষা ও শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে প্রতিপত্তিশীল কূটনীতিবীদ। মিসরে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। প্রশাসক। বাগ্মীতায় এক প্রবাধপুরুষ। প্রাচ্যে তিনি পাশ্চাত্যের নিযুক্ত এক ঋষী, শাসক ও গবেষক। কিন্তু এর আগে তিনি ছিলেন প্রধানত একজন গোয়েন্দা। মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি প্রভাবশালী মহলে তিনি বন্ধু তৈরীতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছেন যে কোনো তথ্য। যা জেনেছেন, পশ্চিমাদের সরবরাহ করেছেন। রচনা করেছেন এক ভেতরগত ভাষ্য। যাতে মুসলিমদের সমস্যা এবং তার মধ্যে নিহিত প্রাচ্যমানস অধরা না থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেনো তার মতো সময় বিনিয়োগ না করেও তারা যেন মুসলিম জাহানকে জানতে পারে তার মতোই। ১৯০৮ সালে বিখ্যাত মডার্ন্ ইজিপ্ট প্রকাশের দুই বছর পরে তিনি বিস্তৃত দার্শনিক আলোচনা করেন দ্য এনশিয়েন্ট এন্ড মডার্ন্ ইম্পেরিয়ালিজমে। ব্রিটিশ প্রভূত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রস্তাব করেন ক্রোমার। তিনি চাইতেন প্রাচ্যের মন ও সমাজে একটি অমোচনীয় ব্রিটিশ ছাপ। মহাপ্লাবী এক প্রভাব। তিনি আশা করতেন এর মধ্য দিয়েই প্রাচ্যজন অথবা মুসলিমরা নিজেদের বদলাতে পারবে। – ‘যার উপর দিয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তার তীব্র উত্তপ্ত পশ্চিমা নিশ্বাস একবার বয়ে গেছে এবং যেতে যেতে রেখে গেছে দীর্ঘজীবী ছাপ, সে কখনো আর আগের মতো হয়ে উঠবে না।’
শাসিতের উপর উত্ত্প্ত পশ্চিমা নিশ্বাস প্রয়োজন। তাকে উষ্ণ করার জন্য নয়, বদলে দেয়ার জন্য। যেন সে আর আগের মানুষ থাকে না। যেন তারা আর তারা না থাকে। এবং সে জন্যই তার প্রাচ্যচর্চা। প্রাচ্যবাদ তার কাছে একমাত্র ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে মুসলিমদের উপর বিজয়কে ধরে রাখা সম্ভব। ১৯০৯ সালের ২৭ সেটপ্টম্বর হাউস অব লর্ডসকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন -‘ প্রাচ্যের মানুষের ভাষার সাথে শুধু নয়, তাদের প্রথা, আচার , অনুভূতি, তাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ধর্মের উপর আমাদের বিজ্ঞতা, যাকে বলে প্রাচ্যের প্রতিভা, তা বুঝার ক্ষমতা হলো একমাত্র ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা বিজয়ী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবো। লর্ড্ ক্রেমারের ইসলাম গবেষণা ছিলো লর্ড কার্জনের মতোই।‘‘ সাম্রাজ্যের প্রয়োজনীয় আসবাবের অংশ।’’যার মূল প্রেরণা ছিলো তার উপনিবেশ , তার দেশপ্রেম।অতএব শাসক ভূমিকা, গোয়েন্দা ভূমিকা আর ইসলাম গবেষক ভূমিকা সবই ছিলো একই লক্ষ্যের সোপান। তার চিন্তা ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কর্মনীতির সমান্তরাল।
সিলভেস্ত্রো ডি সেসির নাম আমরা উল্লেখ করেছি। ১৭৫৭ সালে বিখ্যাত এক ইয়ানসেনিস্ত পরিবারে তার জন্ম। বিডিস্টাইন গির্জা শিশু সেসিকে আরবি শেখান। পরে শিখেন সিরিয়, হিব্রু, তুর্কি, কালাদিয় ইত্যাদি। ১৭৬৯ সালে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবাসিক প্রাচ্যবিদ হিসেবে। এ দায়িত্ব সেসির কাছে ছিলো পবিত্র ও মহান। গির্জা তাকে এভাবেই তৈরি করেছিলো। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন কোন বেতন গ্রহণ না করেই। মিশরে আক্রমনকারী গ্রান্ড আর্মির আরবী বুলেটিনের কাজ করেন তিনি। নেপোলিয়নের ১৮০৬ সালের মেনিফেস্টো আরবি করে দেন। ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখলের পরদখলদার ফরাসিদের ঘোষণাপত্র আরবি করে দেন তিনি ১৮২২ সালে হন সেখানকার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তাকে গ্রহণ করে উপদেষ্টা হিসেবে। ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইনস্ক্রিপশন একাডেমীর সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। হন রয়েল বিবলিওথিকের জন্য ইসলাম বিষয়ক পান্ডুলিপি সংগ্রহের কিউরেটর। তার হাতে পুনর্গঠিত হয় ফরাসি শিক্ষাব্যবস্থা। তিনি সংস্কার সাধন করেন ফরাসি সিলেবাস ও কারিকুলামের। ১৮৩২ সালে তিনি ঘোষিত হন ফ্রান্সের নতুন পিয়ের। তার রচনা কর্ম বিপুল। কালিলা দিমনার অনুবাদ (১৮১৬) হারিরির মাকামাতের বিস্তৃত আলোচনা (১৮২২) আলফিয়া সম্পাদনা (১৮৩৩) ইবনে রুশদ বিশ্লেষণ (১৮০৬) কিংবা মিসর-আরব আইন ও বিজ্ঞানগবেষণা (১৮০৫-১৮১৮) তার বিশাল কর্মপরিধির এক অংশ মাত্র। আরব শিলালিপি, মুদ্রা, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ও পরিমাপ পদ্ধতি থেকে নিয়ে অ্যারাবিক গ্রামার, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব এবং শিল্প ও বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তৃত ছিলো প্রজ্ঞা ও তার কাজ। তার অধিকাংশ সৃষ্টি সংকলনমূলক। বৃহৎ একটি দল বৃহৎ আয়োজনে যা করত, সেসি একা তা করেছেন। এবং ডেসিআর রিপোর্ট মতে সেসির শ্রেষ্ঠতম প্রবণতা হচ্ছে প্রাচ্য অধ্যয়নে তার অবদান। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ তিন খণ্ডের ত্রেস্তোমাথি এ্যারাবল; যা শুরু হয়েছে আরবি চরণ দিয়ে: কিতাবু আনিসিল মুফিদ লিত্তালিবিল মুস্তাফিদ ওয়া জামিউশ শুজুর মিন মানজুমিন ওয়া মানসুর, অধ্যবসায়ী ছাত্রের জন্য এক আনন্দময় ও লাভজনক গ্রন্থ। এটি ধারণ করে গদ্য-পদ্যের খন্ড সমূহ। তার তৈরি টেড লিউ ইস্তরিকের ভূমিকা হচ্ছে সকল মানবীয় জ্ঞানকে একত্রে স্থাপন করার প্রয়াস। এটি রচনা সম্ভব করে তুলেছিলো নেপোলিয়নের মিশর জয়। একজন ইউরোপীয় হিসেবে তিনি প্রাচ্যদেশীয় সকল অর্কাইভ তছনছ করে ফেলেন। এবং তা করেন ফ্রান্সে বসেই। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রাচ্যবিদ তৈরি। উনবিংশ শতকের সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ কোনো না কোনোভাবে তার সাথে সম্পর্কিত। ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও বিশেষ করে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এমন ছাত্র ছিলেন প্রচুর, যারা নিজেদের গঠন করেছেন তার পদতলে কিংবা তার সংকলন এর মাধ্যমে। সেসিকে আমরা কিভাবে বিচার করবো? তিনি যুদ্ধে, শিক্ষায়, গবেষণায়, অনুবাদে, ভাষাতত্ত্বে, কূটনীতিতে একটি মাত্রই কাজ করে চলেছিলেন। সেটা হচ্ছে, একটি অধীনস্থ মুসলিম বিশ্ব এবং একটি প্রভু হিসেবে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ীত্ব দান। সেক্ষেত্রে তিনি উদযাপন করেছেন পশ্চিমের ধর্মগুরু শিক্ষক অভিভাবক ও নির্দেশকের ভূমিকা। সেসির পূর্বসূরী ছিলেন জেস্তূল বুরখ হার্ট। বুরখ হার্টের পূর্বে এমন ভূমিকা উদযাপন করেন এডওয়ার্ড পুকোক। তার আগে ডি হারবেল্ট। এই যে ধারাবাহিকতা, এর সূচনা কোথায়?
চার.
আমরা মুসলিম স্পেনে প্রত্যক্ষ করি ইউরোপের ইসলামচর্চার সূচনা। ফ্রান্স হয়ে ইউরোপের গহীনে একে পৌছে দেয় স্পেনে আরবী ভাষার সংস্পর্শে জন্মলাভকারী মুযারিবদের ভাষা এবং বৃহr আকারে ল্যাতিন ভাষা। মুসলিম স্পেনে খ্রিস্টান বা ইহুদীর ইসলামচর্চা একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়। যদিও কোনো খ্রিস্টানের ইসলামচর্চার ধারা আরবেই শুরু হয়। এবং পশ্চিমা দুনিয়া বহন করেছে তার উত্তরাধিকার।সে ক্ষেত্রে তারা গুরু হিসেবে মেনেছেন যাকে, তিনি Seint John Damascene (৬৭৫-৭৪৯)। ক্রাইসেসাটোম বা সোনার অভিলাষী বলে পরিচিত এই পাদ্রীকে নিয়ে একধরণের ফ্যান্টাসি অনুভব করেন পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা। এন্টিয়কের এ পাদ্রী গ্রিক ভাষায় লেখালেখি করতেন, গ্রিক না হয়েও। কথা বলতেন সিরিয় বা আরামি ভাষায়। জানতেন আরবী ভাষাও। তার পিতামহ মনসুর ইবনে সারজুন ছিলেন দামেশকের অর্থ্ দপ্তরের প্রশাসক। মুসলিমরা যখন দামেশক জয় করেন, তিনি এ পদে ছিলেন। যখন মুসলিমদের জয় ঠেকানোর কোনো সম্ভাবনা ছিলো না, তিনি শহরকে মুসলিমদের হাতে সমর্পণের প্রশ্নে ছিলেন ইতিবাচক। যেমন ইতিবাচক ছিলেন দামেশকের বিশপ ও মুক্তিকামী জনগণ। বিজয়ী মুসলিমরা মনসুরকে তার পদে রেখে দেন। মনসুর অবসর নিলে জনের পিতা সারজুন ইবনে মনসুর একই পদে সমাসীন হন। তিনি লাভ করেন আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের প্রশাসনে তিনি হয়ে উঠেন প্রভাবশালী। মুসলিম খিলাফত খ্রিস্টান বা ইহুদীকে উচ্চপদে সমাসীন করতে অপ্রস্তুত ছিলো না। যোগ্যতা ও কাজের সক্ষমতা থাকলে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ্ পদসমূহে তাদের প্রতিষ্ঠা ছিলো নিয়মিত ব্যাপার। জনও লাভ করেন সরকারী পদ। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যান সেন্ট সাবায়, যা ছিলো জেরুসালেমের নিকটস্ত এক মঠ। সেখোনে সন্যাসসাধনায় জীবন কাটাতে তিনি সংকল্প করেন। তাদের পরিবার মুসলিম সাম্রাজ্যের উচ্চপদে সুযোগ লাভ করলেও নিজেদের পরাজয়ের বেদনা বহন করতো। ইসলামের হাতে শাসিত সিরিয়া তাদের মনে রক্তক্ষরণ ঘটাতো। কিন্তু তারা সচেতন ছিলেন যে, ইসলামের মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। উমাইয়া খেলাফত ভিন্ন ধর্মের অনুসারী পণ্ডিতদের আহবান করতো ইসলাম ও নিজ ধর্ম্ নিয়ে কথা বলার জন্য। সেন্ট জন খ্রিস্টানদের তরফে আগত পণ্ডিতদের বহু সংলাপ প্রত্যক্ষ করেন। তাদের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখেন। জ্ঞান ও যুক্তিতে তাদের হেরে যাওয়া দেখেন। যা তাকে বিচলিত করতো, পীড়া দিতো। তিনি মঠজীবনে নিজ ধর্মএক আরো নিবিড়ভাবে জানার চেষ্টা করলেন এবং অনুসন্ধান করলেন এমন প্রক্রিয়া, যা মুসলিমদের সাথে সংলাপে তার বিশ্বাসের বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। অতএব তিনি লিখলেন এক গ্রন্থ, যা শেখাবে, একজন খ্রিস্টান কীভাবে পরাজয় এড়িয়ে এক মুসলিমের সাথে বিতর্ক্ করবেন? খ্রিস্ট্রিীয় বিশ্বাস অনুযায়ী যিশুর ইশ্বরত্ব ও মানবীয় ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এ বইয়ে সংলাপ আকারে একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে একজন খ্রিস্টানের তর্ক্ বিবৃত। পি.কে. হিট্টি ঠিকই লিখেছেন, ‘এটি খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে মুসলিম বিরোধিতার পথপ্রদর্শ্ক সারগ্রন্থ।’
সেন্ট জনকে পশ্চিমা ইতিহাস যতোটা গুরুত্ব দিয়েছে, ততোটাই গুরুত্বহীন মনে করেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকরা। পশ্চিমা দুনিয়া বরাবরই তার থেকে প্রেরণা নিয়েছে এবং তাকে মহিমান্বিত করেছে। খ্রিস্টিয় ইতিহাসে তাকে প্রাচ্যের গ্রিক গীর্জার মহান ও শেষ ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে গণ্য করা হয়। পাদ্রীসাহিত্যে যেসব স্তোত্র তিনি রচনা করেন, সেগুলো গীর্জার সেরা সৌন্দর্য্। এসব স্তোত্র প্রায় হারিয়ে গেলেও এখনো প্রোটেস্টান্টদের ব্যবহারে তার অবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। বইজান্টোইন সঙ্গীতের জনক হিসেবে জনকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যা বাড়াবাড়ির মতো শুনালেও এর মূলে আছে তাকে মহিমান্বিত করার উদ্যম। গীর্জা তার গ্রন্থগুলোকে ইউরোপে পৌছে দেয়। কারণ সেখানেও মুসলিমসভ্যতা বিজয়ী হয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করছিলো। সেখানেও পাদ্রীদের মুখোমুখি হতে হতো ইসলামের সাথে। মুসলিম স্পেনে একটি মিশ্রসমাজ গড়ে উঠেছিলো। যেখানে সবধর্ম্ ও সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি সব ধর্ম্ ও সম্প্রদায়ের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের তুলনামূলক চর্চার সংস্কৃতি তৈরী হয়েছিলো। এ পরিস্থিতির দাবি ছিলো, একটি ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী বুদ্ধিজীবী অন্য ধর্ম্ সম্পর্কেও জ্ঞান রাখবেন। এর সাথে যুক্ত ছিলো আপন বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অভিপ্রায়ও। মূলত তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম স্পেনে। এর আগে ইসলামী দুনিয়ায় এর বহুমুখী চর্চা হলেও এর বৈজ্ঞানিক রূপায়ন ঘটে ইবনে হাযম উন্দুলুসীর ( আ. ৯৯৪-১০৬৪) হাতে। তার আল ফাসলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নিহাল গ্রন্থ সব ধর্ম্ ও মতবাদ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। এর ধারায় জরূরী হয়ে পড়ে ইহুদী ও খ্রিস্ট্রিয় প্রচেষ্টা। ইহুদী প্রচেষ্টা দেখা যায় yahuda Halevi (আনু. ১০৮৫-১১৪৩) এর রচনায়। আল খুযারী (প্রকাশ- ১১৪০) গ্রন্থে তিনি ইহুদীধর্মের জায়গা থেকে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সাথে কথা বলেন। খ্রিস্ট্রিয় প্রচেষ্টার প্রকাশ ঘটে নানা মাত্রায়। ইসলাম ও আরবীভাষা অধ্যয়নে স্পেনিশ খ্রিস্টানদের বড় একটি অংশ অনুপ্রাণিত ছিলো। এর মূলে প্রধানত ছিলো উন্নত সভ্যতার অনুগমন। তারা লিখতেন আরবীতে, পড়তেন আরবী সাহিত্য, অনুসরণ করতেন মুসলিম সংস্কৃতির। যদিও খ্রিস্টান পরিচয়ে ছিলেন স্বচ্ছন্দ। এ রকম খ্রিস্টানরা বিবেচিত হচ্ছিলেন অগ্রসর ও প্রগতিশীল হিসেবে। পাদ্রীরা তাদের নিয়ে আক্ষেপ করতেন। যার বিবৃতির জন্য দেখা যেতে পারে আর ডব্লিউ সাউদার্ন্ এর ওয়েস্টার্ন্ ভিউজ অব ইসলাম ইন দ্য মিডল এজস এর ভাষ্য। সাউদার্ন শুনাচ্ছেন আক্ষেপ – এসব খ্রিস্টান পছন্দ করতো আরবদের কাব্য ও প্রেমকাহিনী , পড়তো। তারা পাঠ করতো আরব ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের রচনা। এই পাঠ প্রত্যাখানের জন্য ছিলো না, ছিলো বিশুদ্ধ ও অগ্রসর আরবী জানার জন্য। পবিত্র গ্রন্থের ল্যাটিত ব্যাখ্যা পড়ুয়া সেই সাধারণ মানুষটি কোথায় হারালো?কোথায় সেই গবেষক, যার অনুসন্ধান গসপেল, পয়গাম্বর বা সহচরদের নিয়ে? হায়! কী আগ্রহ নিয়ে মেধাবী তরুণ খ্রিস্টানরা পাঠ করছে আরবদের বই, গবেষণা করছে আরবদের নিয়ে!
কিন্তু একটি অংশ আরবী ও ইসলাম অধ্যয়ন করে এর মুখোমুখি হবার আগ্রহে। তারা ছিলেন প্রবলভাবে ইসলামের প্রতিপক্ষ। তারা দেখতে রাজি ছিলেন না বিজয়ী ইসলামকে, যার হাতে খ্রিস্ট্রিয় সাম্রাজ্যসমূহ বিধ্বস্ত হয়েছে, খ্রিস্ট্রিয় গরিমা ম্লান হয়ে গেছে এবং যে ইসলাম মূলত শয়তানের কারসাজি। অতএব এর বাহকদের উচ্ছেদ করতে হবে, প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে গৌরবের মুত্যুকে বরণ করতে হবে। এ ধর্মের কেন্দ্রে যেহেতু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, অতএব তাকে চিত্রায়িত করতে হবে সর্বোচ্চ মন্দের সাথে। এ এক পূণ্যকর্ম্। ধর্মান্ধ ও বিবেচনারহিত মানুষদের এমন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ করা ছিলো সহজ এবং সেটাই হচ্ছিলো।
এসবের প্রতিক্রিয়া ছিলো বিপজ্জনক। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে পরেফেকটাস নামের এক মঙ্ক মুসলিম স্পেনের বাজারে প্রকাশ্যেই মহানবী সা. কে অশ্রাব্য গালাগালিতে লিপ্ত হয়। যেসব প্রচার তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেগুলোই সে বলে চলছিলো। তিনি ভণ্ড, বিকৃতকামী, যিশুর দুশমন ইত্যাদি। সামাজিক উত্তেজনা ও সহিংসতা ছিলো অবধারিত। পারফেক্টাসকে বন্দি করা হলো। কিন্তু অচিরেই তার অনুসরণে তৈরী হলো এক আন্দোলন। তাকে দেয়া হলো পথিকৃতের মর্যাদা। পল আ্যালভারো তাকে জাতীয় বীর হিসেবে চিত্রিত করলেন। চরমপন্থী খ্রিস্টান নারী-পুরুষরা জনতার ভিড়ে বা আদালতে এসে মহানবীকে নিকৃষ্ট ভাষায় আক্রমণ করে চললো। যা ছিলো রাষ্টীয় আইনের প্রতি দলবদ্ধ চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একে খ্রিষ্ট্রিয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে প্রচার করা হলো।
পারফেক্টাস কারাগারে কঠোর শাস্তি থেকে বেঁচে যান। কিন্তু অচিরেই তার ক্ষোভ বেসামাল হয় এবং আরো নোংরা এবং বিদ্বেষপূর্ণ্ আক্রমণ সে জারি রাখে মহানবীর বিরুদ্ধে। ফলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছাড়া কোনো পথ ছিলো না কাযীর সামনে। ক্যারেন আর্মস্ট্রং জানান, মঙ্ককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং খ্রিস্টসমাজের প্রান্তিক অবস্থানের একদল খ্রিস্টান তার মৃতদেহকে খণ্ড বিখণ্ড করে পবিত্র স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নিয়ে যায়। ক‘দিন পরে ইসহাক নামে এক মঙ্ক এবং এরপর মনেস্টারির দুই মঙ্ক প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য পেশ করা এবং মহানবীকে সা. ভয়াবহভাবে আক্রমণ করার জন্য আদালতকে বেছে নেয়। কাজীর সামনে এসে চূড়ান্ত হিংসাত্মকভাবে তারা ঘৃণ্য বক্তব্য রাখে। এটি ছিলো রাষ্ট্রের প্রতি সঙ্ঘবদ্ধ চ্যালেঞ্জ। কাজী তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনান। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলো ইউলোজি এবং পলএলভারো নামের দুই খ্রিস্টান নেতা। তারা এ্মন আত্মঘাতীদের ইশ্বরের সৈনিক বলে ঘোষণা করেন এবং এ প্রচেষ্টাকে পবিত্র যুদ্ধের অংশ বলে প্রচার করেন। কর্ডোভার বিশপ নতুন এই যুদ্ধপ্রচেষ্টার সমালোচনা করেন। কিন্তু সমাজের ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছিলো এই চরমপন্থা। লোকালয়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ, মুসলিম বিশ্বাসকে আক্রমণ, মহানবীর বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষী প্রচারের মাধ্যমে এমন এক সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চলে, যাতে অগণিত প্রিস্ট, পাদ্রী, পণ্ডিতসহ সাধারণ অনেকেই। শান্তিকামী মুসলিম ও খ্রিস্টানদের যৌথ প্রতিরোধে এ আন্দোলন স্থিমিত হয়।
[চলবে…]