কাওসার আলম ভূঁইয়া
স্কুল জীবনের ঈদ উৎসব ও রোজা-ই সম্ভবত: সবার জীবনে ভালতম উৎসব। এটা আমার ধারণা। এ পর্যন্ত যত লেখক-কবি বা সাহিত্যিকের লেখা পড়েছি অন্তত: তাই আমার মনে হয়েছে। পিছন ফিরে আমার বেলায়ও তো তাই মনে হয়। শুধু কি কবি সাহিত্যিক, টেলিভিশনেও যত স্মৃতিচারণ দেখি তাতেও তো সেলিব্রেটিরা এমনটি বলে থাকেন। তারা কি বানিয়ে বানিয়ে বলেন, মেকি বলেন? না তারা মেকি বলেন না। সত্যটি বলেন। কারণ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া শৈশব বা কৈশোর তাইতো বলে। ছোট বেলায় না বুঝে অনেক কিছু করা যায়, যা বড় বেলার জন্য যথেষ্টই হাস্যকর। এই যেমন আমার বড় ভাইয়ের লেখা ‘বরফে খেলাঘর’ বই থেকে জানলাম তাদের শৈশবের ঈদ। তা হলো ‘হাঁটা ঈদ’ বা ঈদের দিনের অর্থহীন হাঁটা। তিনি তার বইতে লিখেছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হতে কুমিল্লা পর্যন্ত হেঁটে আসা আবার ফেরৎ যাওয়া। সকাল ১০টা হতে বিকাল ৪টা/৫টা পর্যন্ত। শুধুই যেতে আর আসতে চলে যেত। ঈদের দিনের অর্থহীন হাঁটা বন্ধুদের নিয়ে। অথচ এখন কল্পনায়ও আনা যায় না যে কুমিল্লা ক্যান্টমেন্ট হতে কুমিল্লা শহরে হেঁটে আসা। তাও আবার বয়স তখোন কত? ১০ কি ১২ বা ১৩ বছর।
এখন এর অর্থ খুঁজতে যাওয়া মানে হাসির উদ্রেক কিন্তু তখন অর্থই খুঁজতে যাওয়া হতো না। আনন্দের সাথে হাঁটো, গল্প করো, রাস্তার দৃশ্যবলী দেখো, ঈদ করো।
ডিগ্রি কলেজ রোডের বাড়ী-ই হচ্ছে আমার জন্মের পর বুঝতে পেরে দেখা স্থায়ী বাসস্থান। জন্মের পর্বটা শুনেছি ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পাহাড়ের উপরের বাংলোতে হয়েছে। কিন্তু তা শুধুই শোনার বিষয়। যেদিন বুঝতে শিখেছি বা শিখতে শুরু করেছি তা হলো এই ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন বাড়ী।
মনে আছে রোজা এলে আমরা আনন্দে আহ্লাদিত হয়ে উঠতাম। রোজা রাখব, আর রোজার পরই আসবে ঈদ। আমরা পিঠাপিঠি ক’ভাই একসাথে ঘুমাতাম একই খাটে। এটাকে ভিতরের রুম বলা হতো। তারা বড়রা আমাদের ঘুম যাতে না ভাঙ্গে সেই প্রক্রিয়ায় দরজা বন্ধ রেখে এবং আলো যাতে না যায় সেজন্য কাপড় দিয়ে খাটকে ঢেকে রেখে রাত ২.৩০ মিনিটে খেতে উঠতেন সেহেরী। আমরা ছোট মানুষ রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ব এই ভয়ে আমাদেরকে ডাকতেন না। সম্ভবত: তখন চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমি আর ইফতেখার ভাই এক সাথেই পড়তাম। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত যা হতো দু’জনের জন্য একই। কে বড় বা ছোট সে বিষয় পরে আসবে। কাপড় চোপড় এর বেলায়ও তাই হতো। অন্যান্য বইপত্র কেনা বা যেকোন স্থানে যাওয়া বা ঘোরাঘুরি, ভিন্নভাবে চিন্তা করা হতো না, সুযোগও ছিল না। যেহেতু আমরা একই সাথে পড়ি, একই সাথে গোসল বা অন্যান্য খাবার দাবার।
আমরা দেখলাম, আমাদেরকে সুকৌশলে ঘুমে রেখে তারা সেহেরী খেয়ে নিচ্ছে। তারা মানে আব্বাজী থাকলে আব্বাজী সহ না হয় ভাই, মানে বড় ভাই, আমাদের গৃহ শিক্ষক মিজান স্যার, আম্মা ও মাহবুব ভাই। তারাই মূলত: তখন বড়। সারওয়ার ভাই মাদ্রাসায় পড়তেন বলে তিনি আবাসিক মাদ্রাসা মানে ছাতিপট্টিতে অবস্থান করছেন।
এভাবে বেশ ক’দিন যাওয়ার পর দেখলাম তারা সেহেরীতে যা খাচ্ছেন তারই অংশ বিশেষ আমাদের জন্য রাখা হয়েছে সকালের খাবার হিসাবে। অবশ্যই ভাল কিন্তু খুব ভাল অংশটুকু তারা ভক্ষণ করেছেন। আর পাতিলের তলানী আমাদের জন্য। আমরা বললাম, আমরা এভাবে চাই না। আমরা রোজা রাখতে চাই।
আম্মা বললেন, তোমরা তো রোজা রাখতে পারবে না। দিন বড়। তখন অনেক বড় দিন সন্ধ্যা ৬.৪৫ কি ৭ টায় ইফতার। আর সেহেরী খেতে হয় ভোররাত ৩.৩০ এর মধ্যে। কিন্তু আমরা নাছোর বান্দা। আমাদের আন্দোলন আমাদেরকে রোজা রাখতে দিতে হবে। দু’একদিন আমাদেরকে ডাক দেয়া হলো। কিন্তু সত্যিই আমরা বিকাল বেলা কাহিল হয়ে পরি। আমাদেরকে রোজা ভাঙ্গানোর জন্য পিরাপিরি করা হয়। কিন্তু আমরা রোজা ভাঙ্গি না। এভাবে শরীর খারাপ হবে ভেবে আমাদের ডাকা হয় না।
এবার আমরা অন্য বুদ্ধি নিলাম। আমি আর ইফতেখার ভাই বুদ্ধি করলাম কিভাবে উঠা যায়। আমরা মোটামুটি কান খাঁড়া করে শুয়ে থাকতাম। তার লাইট জ্বালালেই আমরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো দেখতে পেতাম। আমরা একে অপরকে কানে কানে বলতাম, উঠে গেছে। সুতরাং সেহেরী খেতে হবে। এভাবে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১০/১৫টি করে রোজা রাখতাম। কিন্তু ৭ম শ্রেণিতে উঠে যাওয়ার পর আমাদেরকে নিয়মিত ভাবে বড়দের মত সমীহ করে ডাকা হতো। আমরা আমাদের সম্মানিত স্থান ফিরে পেলাম। সবার সাথে উঠে হাত মুখ ধোয়ে রাতের আঁধারে সেহেরী খেয়ে নিতাম ও রোজা রাখতাম।
কিন্তু এখন মনে হয় ঐ রোজাগুলো অনেক কষ্ট হতো। তারপরও রোজা ভাঙ্গতাম না। একবার বাড়ীর পাশে থাকা জমিতে কাজ করতে গিয়ে ব্যাথা পেলাম। আম্মা অনেক অনুরোধ করলেন পানি খেতে। কিন্তু পানি খাইনি। অনেক কষ্ট করে রোজা রাখতাম। এই কষ্টের মাঝেও একটা আনন্দ ছিলো। কারণ বিভিন্ন জায়গায় শুনতাম রোজার প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহ এবং নিজ হাতে। এই বক্তব্যের কোন তুলনা হয় না। সত্যিইতো অনেক সহীহ হাদীস এ আছে রোজার প্রতিদান মানেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহই রোজদারদের জন্য হয়ে যান।
একটা ভাল সুবিধা ছিল সুরা তারাবীহ পড়া। আমাদের নামাজের জায়গা ছিল নজরুল ইসলাম হলের মসজিদ। মানে ‘নামাজ ঘর’। আমরা সেখানে নামাজ পড়তে যেতাম। এলাকায় কোন জুম্মা মসজিদ ছিলো না। এক হচ্ছে ধর্মপুর জামে মসজিদ অন্যদিকে দৌলতপুর মাঝে আর কোন মসজিদ নেই। খাঁন বাড়ীর ভিতরে একটি ছোট ‘নামাজ ঘর’ ছিলো। পুকুরের পাড়ে। ছোট অবস্থায় আমরা তা জানতেও পারিনি। পরে জেনেছি। তবে এতটাই ছোট যে ১৫ জনের বেশী দাঁড়ানো যেতো না। তবে খাঁন বাড়ীর পুকুরের পানি অনেক টলটলে ছিলো। অনেক ভাল ও সুন্দর পানি। এই পুকুরের পাড়েই ‘নামাজ ঘর’ বাড়ীর মানুষের জন্য। আমরা নজরুল ইসলাম হলে নামাজ পড়তে যেতাম। নজরুল ইসলাম হল তখন ছিল একতলা। তখনো এর নামকরণ ‘হল’ করা হয়নি। ছিলো নজরুল ইসলাম ছাত্রাবাস। লোকের মুখে মুখে ‘ডিগ্রি হোষ্টেল’। বর্তমানে এর নামকরণ হলো ‘হল’। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ‘হল’ এর আদলে নামকরণ হলেও তার সাথে তফাৎ অনেক। সামনের ‘ক’ ব্লক যেটা এখন ‘অতিথি শালা’ তা শুরু হতেই দোতলা ছিল। কিন্তু মেইন হোস্টেল ছিল একতলা। এই একতলার একটি রুমে নামাজ হতো। তবে হলের ভেতরটা এতই সুন্দর ছিলো যে বলার মতো না। চতুর্দিকে কক্ষগুলো মাঝে একটু ল্যান্ডস্ক্যাপ। এই ল্যান্ডস্ক্যাপে ছিল ছাত্রদের গোসলের জায়গা। পাশে অনেকগুলো ফুলের গাছ। রজনীগন্ধা ও শেফালী ফুলের গন্ধে মৌ-মৌ করত ভিতরটা। মাঝে মাঝে নামাজের সময় যখন বাতাস আসত ফুলের গন্ধে মন ভরে যেতো। বিমোহিত হয়ে হারিয়ে যেতাম। ভাল লাগত খুব। অনেক সময় খুব গরম পড়লে ‘নামাজ ঘরে’র বিছানা নিয়ে আমরা সবাই মিলে ছাদে উঠে যেতাম। রশীদ মাওলানা আমাদের নামাজ পড়াতেন। হুজুরের কথা আর এখন কি বলব। এত ভাল ইমাম, এত ভদ্র আর অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। আমাকে খুবই আদর করতেন। রোজার প্রতিটি দিনই তার জন্য আমরা ইফতার নিয়ে যেতাম। আজ জিজ্ঞাসা জাগে মনে, হলের এত ছাত্র ইফতার করত কিন্তু হুজুরকে ইফতার দেয়া হতো না কেন? আমি জানি না এর ব্যাখ্যা কি ছিল। আমাদের বাসা হতে ইফতার নিয়ে যাওয়া না হলে হুজুর পানি খেয়ে রোজা ভাঙ্গতেন। এমন দু’একদিনের কথা আম্মার কানে আসায় আম্মা ইফতারের মিনিট দশেক পূর্বে খুব অস্থির হয়ে বলতে থাকতেন হুজুরের ইফতার নিয়ে তাড়াতাড়ি যাও। আমি বা ইফতেখার ভাই আগে দৌঁড়ে গিয়ে হুজুরের ইফতার দিয়ে এসে ইফতার করতে বসতাম। পরে তারাবীহ পড়ার পর আসার সময় প্লেটগুলো নিয়ে আসতাম। হুজুর প্রতিটি নামাজে যাওয়ার সময় বিশেষ করে এশার নামাজে যাওয়ার সময় আমাদের বাসার সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজাতেন। আমরা বেলের আওয়াজে বুঝতাম নামাজের সময় হয়েছে এবং হুজুর এসেছেন। আম্মাকে বলে তাড়াতাড়ি আমরা এশা ও তারাবীর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চলে যেতাম। আম্মা বলতেন, অজু করতে যাওয়ার সময় চাউলগুলো ধুয়ে আনি যেনো। আমরা সবাই পুকুরে অজু করতাম। চালও পুকুরে ধুতাম। চাল ধোয়ার জন্য বিশেষ ছিদ্র যুক্ত পাতিল ছিলো। তাকে আমাদের পরিভাষায় ‘ঝাঞ্জুর’ বলত। আম্মা বলতেন, ‘ঝাঞ্জুর’ এ চাল দেয়া আছে। ধুয়ে রেখে যাও। আমরা তাই করতাম। এই চাল আম্মা গভীর রাতে রান্না করতেন। আম্মার অভ্যাস ছিলো ইফতারের পর সারা বিকালের কাজের কারণে বিশেষ করে সবার জন্য ইফতার বানিয়ে ও সন্ধ্যার খাবার তৈরী করে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তিনি ইফতারের পর একটু শুয়ে নিতেন। এই শুয়া হতে হালকা ঘুমিয়ে নিয়ে উঠতেন রাত ১১টায়। এই যে উঠা আর বাকী সারারাত তিনি এশা, তারাবীহ, তাহাজুদ ও কোরান তেলাওয়াৎ করে কাটিয়ে সবাইকে নিয়ে সেহেরী খেয়ে তারপর ফজর নামাজ পড়ে শুতে যেতেন। এই নামাজের ফাঁকে তিনি সেহেরীর ভাতটুকু রান্না করতেন। আমরা ভাইয়েরা সবাই একেবারে গরম ভাত খেতাম। আমরা গরম ভাত হাতে নিয়ে অবাক চোখে আম্মার দিকে তাকাতাম। পরে জানতাম, সারারাত আম্মা ঘুমাননি। রান্না হতো ‘হিটারে’। তখন গ্যাস আসেনি।
ইফতারের সময় আমাদের বড় ভাই (সাইফুল ভূঁইয়া) খুব তাড়াতাড়ি করে ঠিক ইফতারের পূর্ব মুহুর্তে কোল্ডষ্টোরে যেতেন বরফ আনার জন্য। ধর্মপুরে এটি ছিল সমবায় কোল্ডষ্টোর। এটিও ষাট এর দশকের সমবায় আন্দোলনের ফসল। এই আলোচনা আমি পূর্বে করেছি। এই সমবায় কোল্ডষ্টোর হতে ইফতারের পূর্ব মুহুর্তে জনসেবায় বরফ বিতরণ করত। যাদের প্রয়োজন তারা এসে নিয়ে যেতেন। ভাই কখনো কখনো আমাদেরকে নিয়ে আবার কখনো একাই সাইকেলে করে বরফের টুকরো নিয়ে আসতেন। তিনি এলেই তবে ইফতার শুরু। আসতেনও ঠিক আজানের ৫ মিনিট পূর্বে। আমরা বরফ জগে জগে বা কলসীতে দিয়ে দিতাম। তখন কোন ফ্রিজ ছিল না। কিন্তু আমরা ঠান্ডা পানি দিয়ে ইফতার করতাম। অনেকে মিলে একসাথে ইফতার করতাম। যা আইটেম হতো তা আনন্দের সাথে খেতাম। বড় ভাইয়ের অভ্যাস ছিলো ইফতার যাই হোক ইফতারের সথে সাথেই তাকে দু’মুঠো ভাত দিতে হবে। তবে তা যা দিয়েই হোক। এমনও হতো আম্মার মাগরিবের নামাজ শেষ না হতেই তিনি ভাতের জন্য রান্নাঘরের চকিতে উঠে বসে আছেন। তবে আম্মা নামাজ সারার পরই সন্ধ্যার খাবার পরিবেশন করতেন। আমরা প্রায় সবাই এই অভ্যাসে ঢুকে গেলাম। আজও ইফতারের পরপরই খেতে শুরু করি। তবে গত দু’বছর বয়সের কারণেই হয়তো আর ইফতারের পরপর মানে মাগরিবের নামাজের পর খেতে পারি না। খেতে হয় না। তখন রান্না ঘরের পাশে একটি বড় চকি ছিল। যাতে বসে আমরা খেতাম। এখনকার মতো ডাইনিং টেবিল ছিল না।
৮৫ কি ৮৬ সালের দিকে ভিসিআর এর প্রবণতা খুব বেড়ে গিয়েছিল। রোজার মাসেও বিভিন্ন জায়গায় ১৫/২০ টাকা করে নিয়ে বিভিন্ন ছবি দেখাত। ছবি ভেদে তা ৩০ টাকাও হতো। নব্বই দশকের মাঝামাঝি হতে তা বিদায় নিয়েছে। যখন হতে ডিস চালু হলো। তার আগে জায়গায় জায়গায় ক্যাসেট বিক্রি / ভাড়া হতো। অবাক হতাম এই রমজানে তা যেনো আরো বেড়ে যেতো। সিনেমার পোষ্টার এর মতো তারা ছবির নাম হাতে লিখে আমাদের হোষ্টেল (নজরুল হল আমরা বলি ডিগ্রি হোষ্টেল) থেকে শুরু করে পুরো রাস্তায় বিদ্যুতের পিলারে পিলারে লাগিয়ে যেত। যাতে মানুষ সকাল হলে তা দেখতে পারে। আমি আর ইফতেখার ভাই মিলে এই পোষ্টার গুলো সেহেরী খাওয়ার পর তুলে ফেলতাম। তারা এগুলো লাগাতো ঠিক ভোর রাতে। আমরা গিয়ে যখন তুলতাম তখন দেখতাম মাত্রই লাগিয়ে গেছে। আমরা তুলে আনন্দ করতাম আর বলতাম রমাজানের পবিত্রতার কাজ করছি। প্রায় এ মাথা থেকে ঐ মাথা দশটি পোষ্টার তুলতাম। আবার ভয়ও পেতাম যদি ওদের কেহ দেখে ফেলে বা বলে দেয়। কয়েক দিন পর দেখলাম তারা আর এগুলো লাগাতো না। খারাপ খারাপ ছবি তারা সেখানে দেখাত।
সেহেরী খেয়ে ফজর নামাজ পড়ার পর আমরা আরেকটি কাজ করতাম। এটা করতাম আম্মার অনুরোধে। তখন চোখে ঘুম লেগে থাকত। কথা শুনতে চাইতাম না। তারপরও আম্মা বলতেন পাশের জমি হতে ‘আন্তা’ গুলো এনে দাও। এইটা এই মধ্যরাতে খুবই বিরক্তির কারণ হতো। কারণ পানিতে নামতে হতো। আম্মা বলতেন, তুমি আন পূর্ব দিকেরটি আর ইফতেখার আনুক পশ্চিম দিকেরটি। আম্মা বলতেন, তুমি যদি এখন এগুলো না আন তাহলে সকালে উঠে দেখবে ‘আন্তা’ উদাও হয়ে গেছে। কারণ রোজার সময় ঘুম থেকে উঠতে উঠতে ৮টা বেজে যেত। ততক্ষণে রোদ উঠে যেত। আমরা ‘আন্তা’ এনে দিয়ে তারপর ঘুমাতে যেতাম। তারপরের কাজ আম্মা করতেন। হাসির কথা, ‘আন্তা’ রেখে দিয়ে শুধু ‘আন্তা’র ভেতরের মাছও অনেক সময় চুরি হতো। ‘আন্তা’ গিয়ে খালি পেতাম।
এভাবেই রোজার দিনগুলো কাটত। হাসি আনন্দ ভাগাভাগি করে।
রোজা শেষে আসত ঈদ। রোজার ৪টি – ৫টি যেতেই আম্মা আমাকে বলতেন, চলো ঈদের কেনা কাটা করে আনি পরে দাম বেড়ে যাবে। আমরা ভাই-বোন বেশী ছিলাম। অল্প টাকায় সবাইকে সন্তুষ্ট করতে হবে। আম্মা এসব নিয়ে খুব চিন্তিত থাকতেন। তখন চাহিদা যে খুব বেশী ছিল তা কিন্তু নয়। তারপরও দরিদ্র দেশ। অল্প বেতনে সবাইকে চলতে হতো। আর যদি সৎ থেকে চলার ইচ্ছা হয় তাহলে তো অনেক কষ্টইনা করতে হতো।
আমার মনে আছে কি কারণে জানি না, এসব কেনাকাটার জন্য আম্মা আমাকেই নির্বাচিত করতেন। পরপর বেশ অনেক বছর একই প্রক্রিয়ায় তিনি আমাকে সাথে নিয়ে একাজ সূচারু রূপে সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলতেন, পরে ভিড় বেড়ে যাবে, মহিলাদের জন্য বাজার করা সমস্যা। এই একবারই তিনি বের হতেন পুরো রমজানে। আর বের হতেন না। এরপরে কিছু লাগলে আমাদের কে দিয়ে সারিয়ে নিতেন।
কুমিল্লায় মার্কেট ছিলো একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। কাপড়ের মার্কেট শুধুমাত্র ‘গনি ভূঁইয়া ম্যানশন’। আর এদিকে ‘হকার্স মার্কেট’। যেটা এখন টাউন হল সুপার মার্কেট (বাহার মার্কেট)। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে কসমেটিক্স এর দোকান ছিল। অল্প স্বল্প অন্যান্য দোকান ছিল। যেটা এখন সিটি মার্কেট সেখানে ছিল বইয়ের ও অফিস ষ্টেশনারীর দোকান। নিউমার্কেট তো ছিলই কাঁচা বাজারও অন্যান্য মুদি বাজারের জন্য। কিন্তু কাপড়ের দোকানপাট শুধুমাত্র ‘গনি ভ‚ঁইয়া ম্যানশন’। যেখানে আগে ইসলামী ব্যাংক ছিল। ভাইদের জন্য একটা কিছু পছন্দ হলে দুই তিন ভাইয়ের জন্য একই রকম। আবার বোনদের জন্য একটা পছন্দ করলে দুই তিন বোনের জন্য একই রকম হতো। এতে করে সুবিধা যেমন ছিলো, অসুবিধাও ছিল বেশ। সবাইকে একই রকম দেখা যেতো। সুবিধা ছিলো একটি চ‚ড়ান্ত হওয়া মানে তিনজনের জন্য ঝামেলা শেষ। অন্যদিকে ভাইরা একজন অন্যজনের ভাল হয়েছে বলে ঝগড়া বাঁধাতে পারবে না। তারপরও আমার মনে আছে, সকাল ১০টায় বেরিয়ে ইফতারের খানিক আগে ফিরে আসতাম। এই ছোট বয়সেও আম্মা আমাকে বলতেন পছন্দ করতে। আমি পছন্দ করলে ইশারা দিয়ে বলত দামাদামি করতে। আমি কি এই ছোট বয়সে বুঝি কোনটির দাম কি?
তারপরও আম্মা বলতেন আমি নাকি ভাল কেনাকাটা করতে পারি। খুব তারিফ করতেন। প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে।
এই ভাবে সাত আট জনের জন্য কাপড় চোপড় কেনা হয়ে যেতো ৪/৫ রোজার সময়ই। জুতা আর সার্ট পেন্ট পেয়েতো আমরা যারপর নাই খুশী হতাম। আমাদের বোনেরা বিশেষ করে তখন তিনজন ছিলো রুমি, জেমি, আঁখি খুবই খুশী হতো। ‘আপা’ মানে বড় আপারই শুধু বিয়ে হয়েছে। আর কোন ভাই বা বোন বিয়ে করেনি। ভাইদের বিয়ে শুরু হয় ১৯৯০ সালে। তারপর ছোট বোনদের ও অন্যান্যদের।
ঈদের দু’দিন আগে আম্মা বসতেন কাপড় ধুতে। বাজারের তালিকায় থাকত ‘১৯৪৭’ এর বাংলা সাবান। দোকানিরা দুই নম্বরটি দিয়ে দিতো, ব্রান্ড ১৯৪১। আম্মা রাগ হয়ে বলতেন ‘১৯৪৭’ আনতে হবে। প্রতি গোল্লায় আধা কেজি করে ২ গোল্লা সাবান মানে এক কেজি সাবান আম্মা একদিনের কাপড় ধোয়ায় শেষ করতেন। আমরা সহযোগিতা করতাম। এখনকার মতো গুড়া সাবান তখন বের হয়নি। শুধু বের হয়েছিল ‘ঔবঃ’ গুড়া সাবান। এদিয়ে দু’চারটি ধুলেই শেষ। সুতরাং ভরসা বাংলা সাবান। আর একটি সাবান পাওয়া যেতো গোসলের জন্য তাহলো ‘কসকো’। তবে লাক্স সাবানও ছিলো সে সময়। গোসলের সাবান বলতে আমরা লাক্স সাবান কেই বুঝতাম। যেমন, মটর সাইকেল বলতেই ‘হোন্ডা’।
এ কথাগুলো গল্পের মতো মনে হলেও এই ছিল তখনকার জন্য বাস্তব ও আনন্দ বেদনার সাথী। আম্মার ঈদ উপলক্ষে এ কাজগুলো করার পাশাপাশি আমরা বড় ভাইসহ ঘরদোর পরিস্কারে লাগতাম। বছরের জমে থাকা ময়লা আবর্জনা সব সরিয়ে আসে আনন্দের ‘ঈদ’।
কাপড় ধোয়ার পরদিন আবার কাপড় ইস্ত্রি করার পালা। কোন লন্ড্রি দোকানে কাপড় দেয়া হতো না ইস্ত্রির জন্য। নিজেরাই দুইদিন লাগিয়ে শ্রেণিমত ইস্ত্রি করে নিতাম। আমি ইস্ত্রির কাজ ভাল জানতাম। তাই এ দায়িত্ব আমার উপর। সবাই ই কম বেশী কাজ করত। কাজ করতে করতে আবার আনন্দও হতো। ভাই (সাইফুল ভূঁইয়া) বলত কে বেশী ফাঁকি দিচ্ছে, বা কে বেশী করছে। এসব নিয়ে হাসাহাসি ও হাস্যরস লেগেই থাকত।
আব্বাজী এসব থেকে অনেকটা উধাও। উধাও এর কারণ তিনি হয় চাকুরীর জন্য দূরে কোথায়ও বা কুমিল্লায় থাকলেও অফিস নিয়ে ব্যস্ত। তবে ঈদ সহ যেকোন দিন আব্বাজী বাড়ীতে থাকলে প্রতিদিনের কাজ ছিল বহিরাঙ্গণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা। সোজা কথা ‘ঝাঁড়ু দেয়া’। এ কাজ আব্বাজী প্রায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গেছেন। বহিরাঙ্গণ পরিস্কার করা ছিল তার এক ধরণের শখ ও নিত্যদিনের ব্যায়াম।
আমরা ঈদের আগেই প্ল্যান করতাম কার কার বাসায় বেড়াতে যাওয়া যায় বা কাকে কাকে বলব বাসায় আসতে। সে মতে আম্মাকে জানাতাম। বন্ধুরাই বেশী আসত আমাদের এখানে। আম্মা কোন ক্লান্তি ভাব দেখাতেন না বরং খুবই খুশী হতেন। লোকজনকে বেড়ে খাওয়ানোতেই যেনো তার আনন্দ ও ঈদ। আসলেও তো তাই। ঈদের মূল বার্তাই হচ্ছে ত্যাগ।
ঈদের দিনের মূল আকর্ষণীয় দিক ছিলো ছবি তোলা। বড় ভাইয়ের ‘ণধংরশধ’ ক্যামেরা ছিল আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু। কখন সবাই কাপড় পরিধান করবে। নতুন নতুন জামা কাপড় পরে সবাই কেবলই বলতাম, আম্মা যে এখনো এলো না। আম্মা আব্বাজী না এলে ছবি তোলা হবে না। এদিকে আম্মা যে সবার জন্য সেমাই পায়েশ তৈরীতে মশগুল। একটু পরেই তো সবাইকে খেতে দিতে হবে। তারপরও আম্মার একটি চিন্তা থাকত যে কখন সবাই রেডি হয়ে যায়। তখনতো তাকেও রেডি হতে হবে।
আমরা এক ভাই অন্য ভাইকে পুকুরে গোসল করিয়ে দিতাম। আমি তোহাদকে করিয়ে দিতাম। তারাই সবচেয়ে ছোট। বোনেরাও একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করত। গোসল করা, কাপড় পরিধানে। ভাইরা আমরা একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করতাম। সমস্যা হতো জুতা নিয়ে। নতুন জুতা পড়লে পা কেটে যাবার ভয় থাকতো। অল্প হাঁটাহাঁটিতে নতুন জুতার কারণে পা কেটে যেতো।
সবাই একসাথে হয়ে বাসার উঠানে চেয়ার টুল দিয়ে বসে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হত। এখন মনেহয় এটিই ছিল ঈদের মূল আনন্দ। ছবি তোলা শেষ মানেই এবার খাওয়া দাওয়া শুরু। এর আগেই সবাই নামাজ পড়ে এসেছি মসজিদ থেকে। এলাকায় কোন ঈদগাঁহ ছিল না সুতরাং দৌলতপুর মসজিদেই হতো আমাদের সবার নামাজ। যা বর্তমানে হয়ে থাকে ডিগ্রি কলেজ মসজিদে।
আব্বাজী শুধু বলতে থাকতেন সবাই ঘরে খাবে। কেহই অন্যের বাড়ীতে মেহমান হবার আসায় কম খেতে পারবে না। দীর্ঘকাল তিনি একথা বলে গেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। হয়েছেও তাই। আমরা সবাই একসাথে পাটি বিছিয়ে বসে খেয়েছি। তারপর শুরু হতো অন্য কোন আনুষ্ঠানিকতা। অর্থাৎ কোন বাড়ীতে যাওয়া বা অন্য কিছু।
একটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়, আমরা তখন লাল-নীল পাতলা কাগজ দিয়ে ঘরও সাজাতাম। এখন অবশ্য তা আর চোখে পড়ে না। নিজেই কাগজ কেটে লিখতাম ঈদ মোবারক। আমার মনে আছে, লিটন যে কিনা এখন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছিল) রিপন, এহসান (বসুন্ধরায় চাকুরী করে) তারাও এমনটি করত। লিটন, রিপন, এহসান, ইডেন তারা আমাদের বাসায় আসত, আমরাও যেতাম। প্রত্যেক ভাই এর বন্ধুরা আসতো। শরীফ এর কিছু বন্ধু আসত। আমার আর ইফতেখার ভাইয়ের বন্ধু তো একই। কারণ আমরা একসাথেই পরতাম। স্কুল বন্ধুদের মধ্য হতে জিয়া, শাহীন, আতিক, হারুণরা আসত। এভাবেই হাসি আনন্দে ঈদ উৎসব হয়ে যেতো। ঈদের পরদিনই আমরা উদগ্রীব থাকতাম কখন নানার বাড়ী ‘বাকশীমুল’ এ যাব। মামাত ভাইরা আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকত। সেখানে কয়েকদিন বেরিয়ে তবেই না ঈদ শেষ হতো।