ড. ফজলুল হক তুহিন
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? –প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!
আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!
তাই সে এমন কেশে-কেশে
প্রলয় বয়েও আস্ছে হেসে–
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
কবিজীবনের প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা’র প্রথম কবিতা ‘প্রলয়োল্লাসে’ কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম নতুনের পতাকাবাহী, প্রথম উপনিবেশবিরোধী ও উত্তর-ঔপনিবেশিক বিপ্লবী, প্রথম রবীন্দ্র-দ্রোহী, প্রথম সুন্দরের ত্রাণকর্তারূপ কবিরূপে আবির্ভূত হন– আধুনিক বাংলা কবিতভুবনে। এই প্রথম হওয়ার পেছনে কাজ করেছে তাঁর স্বদেশী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, জনসাধারণের লাঞ্ছিত-বি ত পরাধীন জীবনের সীমাহীন দুর্ভোগের উপলব্ধি এবং মৌলিক দৃষ্টি ও সৃষ্টির সাহিত্যিক সক্ষমতা। স্বাধীন চিত্তের অধিকারী নজরুল তাই বাংলা কাব্য ও সংস্কৃতির জগতে উত্তর-ঔপনিবেশিক তরঙ্গ সৃষ্টি করেন স্বাভাবিক ছন্দে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যনিমার্ণের প্রথম কাজ উপনিবেশের উৎস-শক্তি-সৃষ্টির প্রত্যাখান। বাংলার লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা নজরুল তাই প্রথমেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীনভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন উপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের অপকর্ম ও অপতৎপরতা এবং গণমানুষের অধিকারব নার অধিকারকে; সঙ্গে সঙ্গে দায়ী করেছেন ভারতের জনদুর্ভোগের জন্য। কবির এই অসন্তোষ সাহিত্যাঙ্গনে অদ্বিতীয় ও অসাধারণ হিসেবে দেখা দেয়। অসন্তোষ থেকেই জন্ম নিয়েছে দ্রোহ ধ্বংস-বিনাশ-প্রলয়ের ইশতেহার। আত্মজাগরণের মাধ্যমে বিদ্রোহ। ভারতের নির্জীব, মরা-জরাগ্রস্ত ও হীনম্মন্য জনগণের অন্তরের-আত্মার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক বিদ্রোহ। বিদ্রোহ কবির পথ; পাথেয় আত্মোদ্বধন। লক্ষ্য অনেক বড় ও মহৎ। অসুন্দর ও অধীনতা ধ্বংসে তাই কবির কোনো দ্বিধা নেই, মায়া নেই, ভয় নেই; এক্ষেত্রে কবি বিপ্লবী। এই কাজে তাই অনুভূত হবেই প্রসববেদনা, যার অন্য নাম ‘কাল বৈশাখী’ বা গণবিপ্লব। কবি নতুনের কেতন উড়িয়ে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান স্বাধীন ও বন্ধনহীন জীবনের জোয়ার।
স্বাধীনতা– সমস্ত শৃঙ্খল-বন্ধন থেকে স্বাধীনতা– ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতা কবির পরবর্তী ধাপ। ‘ধূমকেতু’তে তাই কবি ঘোষণা করেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী; স্বয়ত্তশাসন নয়; কারণ ভারতের জনগণই অধিকার রাখে ভারত শাসনের; অন্য কেউ নয়। এখানে কবির মৌলিক ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়।
নজরুল ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন জাতিগত বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য দিয়ে কাক্সিক্ষত মুক্তি সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন দৃঢ় ঐক্য; জাতিগত ও রাজনৈতিক ঐক্য। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই উপনিবেশমুক্ত স্বধীন ভারত আসবে। তাই কবি হিন্দু-মুসলমানের মিলন চেয়েছেন। নিজে হিন্দু মেয়ে বিয়ে পর্যন্ত করেছেন। অসংখ্য কবিতা-গান-প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখায় এই মিলনের কথা জোরালো ও আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। ব্রিটিশের কূটচাল ডিভাইড এন্ড রুলকে কবি মর্মে মর্মে অনুভব করেন। ফলে একদিকে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের বীরগাঁথা; অন্যদিকে হিন্দু পুরানের বীর প্রতীকের পুনর্ব্যবহার করেছেন এই মিলনের প্রেরণায়; ইসলামী গান ও শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন উভয় জাতির শত বছরের সংস্কার, বন্ধনমুক্তি, ভক্তি ও উজ্জীবনের উদ্দেশ্যে। ‘নবযুগে’ কবির ভাষ্য: এস ভাই হিন্দু। এস ভাই মুসলমান। এস বৌদ্ধ। এস ক্রিশ্চিয়ান। আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না। তাই কবি একবৃন্তে দুটি কুসুম- হিন্দু ও মুসলমানের ছবি এঁকেছেন।
নজরুল শুধু জাতিভেদ, জাতিদ্ব›দ্ব, ধনী-গরিব ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিতে চাননি; তিনি সর্বাত্মকভাবে সাম্যবাদ চেয়েছেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েমের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। সকল মানুষ এক, সমান; উঁচু-নিচু, ধনি-গরিব, সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন, দেখার আহ্বান করেছেন; যেখানে সকল বাধা-ব্যবধান দূর হয়ে মানুষ মানুষের ভাই হয়ে উঠেছে, সবাই মানুষ। পশ্চিমের উপনিবেশের সম্পূর্ণ বিপরীতে কবির অবস্থান।
উত্তর-উপনিবেশবাদের লক্ষ্য– প্রথমত শৃঙ্খলমুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন; দ্বিতীয়ত স্বাধীন জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি-শিল্পের বিনির্মাণ; চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তি– গণমানুষের মুক্তি। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের প্রতিষ্ঠা। এককথায়, অসত্য-অন্যায়-অসুন্দর শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিপ্লবের মাধ্যমে সত্যের নির্মাণ, ন্যায়ের সৃষ্টি এবং সুন্দরের সৃজন।
বিদ্রোহ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরে যে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা সেখানে প্রেমের প্রসঙ্গ আসে। নজরুল তাই শুধু দ্রোহ ব্যক্ত করেননি; প্রেমের জয়গান গেয়েছেন, প্রেমের বর্ণিল রং ছড়িয়েছেন; প্রেমের স্তুতি ও নান্দিপাঠ করেছেন। তবে তা একান্ত ভারতীয় মন-মেজাজ-চরিত্র ও চিত্রকল্প-উপমা-রূপকের সাহায্যে; পশ্চিমের প্রেমরীতি ও রং সেখানে নেই।
বিশ শতকের ভারতবর্ষে উপনিবেশিক বাষ্ট্রে এইসব চিন্তা-চেতনা-ভাবনা যেমন নতুন; তেমনি বাংলা কবিতায় একদম মৌলিক ও আনকোরা। গণমানুষের সেই মুক্তির মন্ত্র সেই সমাজে নতুন জোয়ার সৃষ্টির পাশাপাশি সাহিত্যেও বিপ্লব সৃষ্টি করে। পলে পাঠক তীব্রভাবে তাকে গ্রহণ করে ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
বিউপনিবেশীকরণের কাজে নজরুলের ভূমিকা সকর্মক, প্রযোজক নয়। শুধু লেখায়, বক্তৃতায় বা নিদের্শনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি। কবি বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ ও আত্মোৎসর্গ করেন। নিজে পত্রিকা চালিয়েছেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছেন, রাজপথে-মে বিপ্লবের কবিতা পাঠ ও গান গেয়েছেন এবং এইসব করে জেল খেটেছেন, অনশন করেছেন, একটার পর একটা বই বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরও নিজ পথে-মতে অটল থেকেছেন; সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন সাহিত্য-সঙ্গীত রচনা করেছেন।
নজরুল বাংলা কবিতার ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভঙ্গিকেও পালটে দেন; পশ্চিমের সাহিত্যের প্রভাবে গড়ে ওঠা সাহিত্যের প্রকরণ ভেঙে দিয়ে। ফলে হয়ে ওঠেন রবীন্দ্র-দ্রোহী। নতুনের সাহিত্যসাধক। প্রথমেই তিনি উপার্জন করেন সম্পূর্ণ নিজস্ব এক কাব্যভাষা– মৌলিক কবির অপরিহার্য গুণ যা। নবযুগের নবমানুষের নবচেতনার পরিবাহী এক ভাষা আবিষ্কারের মাধ্যমে কবি রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে একজন মৌলিক ও শক্তিমান কবিরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন; স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেন নতুন বিপ্লবের ক্ষেত্র এবং ভারতীয় ও এশিয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরান থেকে। বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানের মুখের ভাষা, দৈনন্দিন ব্যবহার্য আরবি-ফারসি শব্দাবলী অসাধারণ দক্ষতায় কাব্যশিল্পে কাজে লাগান। নজরুল একাধারে আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি ভাষা জানতেন। ওমর খৈয়াম, হাফিজ ও আমপারার অনুবাদ এই জানারই ফসল। এইসব ভাষার সম্পদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে কবি এদের ছন্দ সম্পর্কে, অলঙ্কার সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন; পাশাপশি বাংলা কবিতায় সেগুলো ব্যবহার করেন নিজস্ব প্রকরণে। মনেই হয়নি এগুলো দূর প্রাচ্যের সম্পদ থেকে আহরণ করা। আত্মীকরণের বা স্বীকরণের অসামান্য যোগ্যতা নজরুলকে এই কাজে সাহায্য করেছে। বাংলা কবিতার ছন্দরীতি ভেঙে নজরুল নতুন ছন্দরীতি নির্মাণ করেন। বিশেষভাবে মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দ তাঁর একান্ত নিজের সৃষ্টি। চিত্রকল্প-প্রতীক-উপমা সৃষ্টিতে কবি ইন্দ্রিয়চেতনা উদ্রেককারি উপাদানের ব্যবহার করেন। নতুন রঙ-রূপ-রেখার কারুকাজ বয়নে নজরুলের হাত শিল্পির মতো কাজ করেছে। তিনি এই নতুন ছন্দ ও রূপরীতি নিমার্ণে পশ্চিমের কাছে একবারও যাননি। অথচ সেই সময় অবাধে চলছিলো ইউরোপের সাহিত্য থেকে আমদানি।
স্বাধীনচেতা ও ঐতিহ্যবাদী নজরুল বাংলা-ভারতবর্ষ-প্রাচ্যকে উপাদান সংগ্রহের জমিন বিবেচনা করেছেন। ফলে উত্তর-ঔপনিবেশিক কবি হয়ে উঠেছেন অনিবার্য ধ্বংস ও সৃজনের সমৃদ্ধ পথ ও পাথেয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে; চিরউন্নত শিরের জাতি ও জগৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে। নজরুলের পরে বা সমসাময়িক কবিদের মাঝে এই সৃষ্টির কাজ অনুভব করা যায় না। তিরিশোত্তর কবিরা জনগণের সাথে বন্ধন চায়ওনি। মূলত পশ্চিমের দোকান থেকে ধার করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কবিতার পসরা সাজিয়েছেন বাহারি রঙে; তার অবস্থা মাকাল ফলের মতো। জীবনানন্দ দাশ বাদে আর সকলের কবিতা উপনিবেশিত মনের সৃষ্টি। তাই নজরুলের উত্তরসূরি চল্লিশের দশকে একটু দেখা গেলেও পরবর্তীকালে আর দেখা যায়নি; সেই মনোভাব ও ভঙ্গির অভাবে। তাঁর উত্তরাধিকারের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।