নাসিম আহমেদ
দর্শক যখন কোন শিল্পকর্ম প্রত্যক্ষ করেন তখন তিনি একটি পরিশীলিত সুশৃঙ্খল রসঘন আবেগকেই আস্বাদন করেন এবং তার মনে চিন্তায় স্মৃতিতে পুলকের প্রস্রবণ ক্রিয়াশীল থাকে। মানব মনের এই আস্বাদন বিচিত্র রস ভাব অনুভাবে সঞ্জাত। শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু বিশ্বাসযোগ্য রূপে মানব মনের অন্তর্জগতে আনন্দ বেদনা বিরহ প্রেম উদ্দীপনা হাহাকারের অকারণ কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সে মোহিত হতে থাকে তাড়িত হতে থাকে। আমাদের দেখা-অদেখা ভুবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ কলাবিদেরা হাজির করেন মানুষের পরিতৃপ্তি বা ইন্দ্রিয় সুখের আশায়, সত্য-মিথ্যার মায়াময় দ্যুতি ছড়িয়ে। যে কোন শিল্পের এই যে উৎকৃষ্ট উপস্থাপন যা ভাবুক মনে একই সাথে পুলক বেদনা দ্রোহ এবং চিন্তার উন্মেষ ঘটায় তার পরিশীলিত রূপটিই শুধু দর্শক-শ্রোতা দেখে থাকেন মাত্র। কিন্তু নির্মাণ কৌশলের ইতিহাস, পরিশ্রমের নিষ্ঠার সন্ধান তারা করেন না বা করতে চান না। করা তাদের কাজও নয়, বার্তা গ্রহণ ও রস আস্বাদন করাই তাদের কাজ। শিল্পনির্মাণের দুর্গম ইতিহাস ও পরিশ্রমের দায়ভার একেবারেই শিল্পীর। শিল্পী কিভাবে তার শিল্পনির্মাণ করবেন? নির্মাণ কৌশলের বিবিধ সন্ধান কি? প্রস্তুতির নিয়োজন কেমন, অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো কি কি ? এমন অনেক জিজ্ঞাসা শিল্পীকে ভাবিত করে। যে শিল্পী তার শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ে যত বেশি চিন্তা করবেন তিনি ততবেশি নিপুণ সৃষ্টির স্বাক্ষর রাখতে পারবেন। শিল্পীর শিল্প জিজ্ঞাসাই শিল্প নির্মাণের সৃজন বেদনা ।
একটি প্রাত্যহিক উদাহরণ দেয়া যাক : আমরা খাবার টেবিলে সাজানো যে সব সুস্বাদু খাবার রসনাতৃপ্তির জন্য গ্রহণ করি তার পিছনের প্রক্রিয়াগত একটি বিশাল পটভূমি রয়েছে যা আস্বাদনকারীর চিন্তায় ও বিবেচনায় সবসময় ধরা দেয় না। এটি তাদের বিবেচনার বিষয়ও নয়। তারা শুধু এর রস-তৃপ্তি উপভোগ করেন মাত্র। খাবার সুন্দর হলে প্রশংসা করেন এবং মনঃপূত না হলে খারিজ করে দেন। এই যে রসনা তৃপ্তির সপ্রশংসিত উপভোগ এবং তাদের তৃপ্তিকর আবেগ রন্ধনশিল্পী প্রত্যক্ষ করেন তখন অধরা পুলকের প্রস্রবন রন্ধনশিল্পীকে অনাবিল আনন্দ দিয়ে যায়। রন্ধনশিল্পী পরিতৃপ্তি গ্রহণ করেন অনাস্বাদিত খাদ্য বস্তুর উদরপূর্তিহীন ঐশ্বরিক আনন্দ–তা সৃজনের আনন্দ। শিল্পের স্রষ্টা ছাড়া তা কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। একজনের রসনাতৃপ্তির আনন্দ-ভোগের আনন্দ আর নির্মাতার সৃজনের আনন্দ। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে শিল্পীর মুখ হাসে চোখ হাসে খুন হাসে রুদ্ধপ্রাণের পল্ললে বান ডেকে যায়, জোয়ারের কল্লোলে দুয়ার ভেঙ্গে যায়। আনন্দের সকল রং স্নায়ু ঘিরে ফেলে। সৃষ্টির ফসল তরীতে তুলে দিয়ে আনন্দ পুলকে শূণ্য নদী তীরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা। রন্ধনশিল্পীর বেলায় যা সত্য সকল শিল্পীর বেলায় একই ভাবে সত্য শাশ্বত এবং প্রযোজ্য।
আমার আলোচ্য বিষয় আবৃত্তিশিল্পীর নিয়োজন প্রক্রিয়া নিয়ে। অন্যান্য শিল্পীর প্রস্তুতি পর্বের মত আবৃত্তিশিল্পীরও একটি দীর্ঘ প্রস্তুতিসূচি রয়েছে। এই প্রস্তুতিসূচি মেনে আবৃত্তিশিল্পী প্রস্তুতি নিতে পারলে তার পরিবেশিত আবৃত্তিটি শিল্পোত্তীর্ণ হবে। আবৃত্তি যে শুধু কবিতারই হতে হবে এমন কথা নেই। যে কোন পাঠই আবৃত্তির বিষয় হতে পারে–কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, নাটক, সবকিছুই।
আবৃত্তি শিল্পের প্রধান উপাদান হলো উচ্চারণ। সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং উচ্চারণের বিবিধ কৌশল প্রয়োগের ফলে আবৃত্তির প্রত্যাশিত অর্থ রসব্যঞ্জনা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আবৃত্তি শিখতে গেলে প্রথমেই শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে হবে। আমাদের বাংলাদেশে অঞ্চল ভেদে অনেক আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষাই বাংলাভাষার মূল ভাষা। তবে এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে বোঝা কঠিন। সে কারণে সবার বোধগম্য করে আমরা একটি বাংলাভাষা চালু করে নিয়েছি যার নাম প্রমিত বাংলাভাষা। এই ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়, শিক্ষাদান করা হয়, অফিস-আদালতে ব্যবহৃত হয় রেডিও-টেলিভিশন প্রচার মাধ্যমে এই প্রমিত ভাষার একক আধিপত্য। প্রমিত বাংলাভাষাকে সুধি জনের ভাষা বলা চলে। তবে প্রমিত বাংলাভাষা যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের জীবনাচারের সাথে সম্পৃক্ত নয় সেহেতু তা কষ্ট করে শিখতে হয়। প্রমিত বাংলাভাষা লেখার ক্ষেত্রে সমস্যা তেমন নেই, সমস্যা হলো উচ্চারণগত দিকটি নিয়ে। ফলে এর বিশুদ্ধ উচ্চারণ চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। উচ্চারণ শেখা যতটা না গ্রন্থ নির্ভর তার চাইতে বেশি গুরু নির্ভর, অর্থাৎ শুরুমুখি বিদ্যা। উচ্চারণ শুনে শুনে শিখতে হয় উচ্চারণের ঝোঁক, ঘাত, অভিঘাত, গতি, ধ্বনি প্রক্ষেপণ সব কিছুই। উচ্চারণ অর্থ শুধু বিশুদ্ধ উচ্চারণই নয়, তার সাথে নমনীয় কণ্ঠস্বর মিষ্টিস্বর আদর্শ বাচনভঙ্গি স্বরভঙ্গি কথাবলার ঝোঁক গতি স্বরাঘাত এমনি বহু বিষয়ের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলা কথ্য ভাষার গতি মধ্যম প্রকৃতির। চীনা, জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষার মত দ্রুত গতির নয়। আরবি উর্দু হিন্দি ভাষার মত মধ্যম গতির এবং সুরেলা। মধ্যম গতি ও সুরেলা বাংলাভাষা দ্রুত গতি ও বেসুরা বলবার চেষ্টা করলে বাংলা কথ্য ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হবে। বাংলা শব্দ উচ্চারণে সৌন্দর্য মিষ্টতা স্নিগ্ধতা রয়েছে তার চর্চা করতে হবে। কথ্যভাষাকে সুন্দর স্নিগ্ধ সুরেলা কোলাহলমুক্ত করার গুরুদায়িত্ব অবশ্যই উচ্চারণ শিল্পীদের ওপর বর্তায়। উচ্চারণ শেখা একটি দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। আমরা লেখাকে গুরুত্ব দেই পড়াকে গুরুত্ব দেই না। এই অবহেলাও শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার অন্তরায়। নিজেকে ভেঙ্গে আবার গড়তে হবে চিরসুন্দরের আশায়।
যা আবৃত্তি করা হবে, কবিতা বা গদ্য তার মধ্যে রস আছে। রস শব্দটির ব্যাখ্যা হলো আস্বাদন করা। শিল্প সাহিত্যের প্রধান কাজ হলো পাঠক-শ্রোতা- দর্শকের মাঝে রস সৃষ্টি করা। সাহিত্যে রস হচ্ছে অনুভব করা। আমরা যে সাহিত্য পাঠ করি তা সাহিত্যিকের মনের ভাবের বহিঃপ্রকাশ। ভাবের বহিঃপ্রকাশ থেকে রসের উৎপত্তি। সাহিত্যিক সে রস সঞ্চার করেন পাঠকের মনে। আবৃত্তি শিল্পীর আবেগ সাধারণ পাঠকের আবেগের চাইতে নিগুঢ়। তার কাছে বিকিকিনির পণ্য মূলত আবেগ। কবিতা-গদ্যের আবেগ তিনি সন্ধান করবেন এবং তাতে মিশ্রণ ঘটাবেন শিল্পীর আমিত্বের আবেগ, চিন্তার আবেগ, ঘটনার নতুন দর্শনগত আবেগ। আবৃত্তিশিল্পীর নতুন আবেগের মিশ্রণে কবিতার নতুন ব্যাখ্যা হাজির হবে। এই ব্যাখ্যা কবির ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন, সাধারণ পাঠক থেকে ভিন্ন অনাস্বদিতপূর্ব আবেগ । আবৃত্তির কবিতা-গদ্য তার কাছে আশ্রয় মাত্র কিন্তু আবেগ তার প্রশ্রয়। এই প্রশ্রয় ঘিরে তিনি বিচিত্র ভাবে নিজেকেই প্রকাশ করবেন। নিজের চিন্তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শতরূপে শতভাবে প্রকাশ করবেন কবিতার কাঠামো ঘিরে। এই আবেগের তারতম্যের কারণে একই কবিতার আবৃত্তি এক এক শিল্পীর কাছে এক এক রকমের হয়ে যায়। একটি ঘটনা এক এক জন মানুষকে এক এক ভাবে আলোড়িত করে। আবৃত্তিশিল্পীর আলোড়ন আরো সু² ও গভীর। চিন্তা ও প্রেমের ওপর আবেগ নির্ভরশীল। বিষয়ের প্রতি মমতা, প্রেম ও চিন্তা যার যত বেশি তার আবেগ তত তীব্র। আর আবৃত্তিশিল্পীতো আবেগেরই সওদাগর। সুতরাং যে আবৃত্তিশিল্পীর কাছে আবেগের যত সওদা আছে তিনি ততবেশি বাণিজ্য করবেন এটি স্বাভাবিক। আবেগ এমনই বিষয় যা প্রেমের রং আনন্দের উচ্ছলতা দ্রোহের আগুনের মধ্যে প্রভেদ এনে দেয় বিষাদের কান্নায় কণ্ঠস্বর ভিজিয়ে রাখে। আবৃত্তিশিল্পী ধ্বনি প্রক্ষেপণে সে মান ও মাত্রা ঠিক করে চলবেন।
আবৃত্তি হতে পারে কবিতার, গল্পের, প্রবন্ধের, নাটকের, উপন্যাসের, চিঠিপত্রের এমনকি গানের বাণীর। অনেকের আবদার আবৃত্তি শুধু কবিতার হতে হবে। এই সীমাবদ্ধতার কোন কারণ নেই এবং আমার কাছে অর্থহীন কথাবার্তা। যাই আবৃত্তি করা হোক না কেন তার একটি ছন্দ আছে। কবিতায় যেমন গাণিতিক ছন্দ আছে আবার নেইও। কবিতা ছাড়া অন্যান্য রচনাতে প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার নেই, থাকবার সুযোগও নেই। তবে সব রচনাতে ছন্দের একটি অন্তর্গত দোলা ও বিভাজন বিদ্যমান। আবৃত্তিশিল্পীকে তা জানতে ও মানতে হবে। প্রচলিত বাংলা ছন্দের শ্রেণি বিভাগ, পরিচয় জেনে নেয়া খুবই দরকার। তাহলে শিল্পী ছন্দের কবিতা যেমন সুন্দর ভাবে আবৃত্তি করতে পারবে তেমনি গদ্য রচনার আবৃত্তিও সাবলীল ভাবে করতে পারবে। গদ্যের ভেতরেও ছন্দের অন্তর্লীন উন্মেষ সন্ধান করতে পারবে। কথারও ছন্দ আছে দোলা আছে চলনভঙ্গি আছে শ্রুতি মাধুর্য আছে, আবৃত্তিশিল্পী তা যেন লক্ষ্য করে এবং মেনে চলে। ছন্দ হলো ধ্বনির পরিমাপক। ধ্বনিকে মেপে ছন্দ সৃষ্টি করা হয়েছে। কথাকে ধ্বনি মধুরতা দিতে ধ্বনি প্রকাশের নিয়ম জেনে নিতে হবে। সংগীতের কিছু চর্চা থাকলে আবৃত্তিশিল্পীর উপকারে আসে, সুর-তাল-লয় মাত্রা জ্ঞান তৈরি হয়, কণ্ঠস্বর সুরেলা হয়, সুর সপ্তক উদারা-মুদারা-তারাতে অনায়াসে সুর তোলা যায়, প্রত্যেকটি সুরধ্বনি স্পষ্ট ভাবে কণ্ঠে প্রকাশ করা যায়। বেসুরা আবৃত্তি কে শুনতে চাইবে ? মানুষ সুরেলা কথা শোনা পছন্দ করে। কথাবলার সুর আছে আর সুর ছন্দ নির্ভর। অনেক মানুষ তা রপ্ত করে কথা বলেন। শ্রোতা তখন তাদের কথা শোনার মোহে পড়ে যান। তাহলে আবৃত্তিতে সুর থাকবেনা কেন, ছন্দ থাকবেনা কেন ? ছন্দবদ্ধ সুরেলা আবৃত্তি নিশ্চয়ই শ্রোতাকে মোহিত করবে।
কেমন করে আবৃত্তি করা হবে ? অর্থাৎ আবৃত্তির অভিব্যক্তি কেমন হবে। আবৃত্তির স্ক্রিপ্ট পড়ে শিল্পীর মনে কোন্ উপলব্ধি ধরা দিয়ে যায়। শিল্পী নিজে কি বুঝলেন এবং কি তিনি প্রকাশ করবেন। স্ক্রিপ্টের কি ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করাবেন এবং কণ্ঠে তা কেমন করে ফুটিয়ে তুলবেন। শিল্পীর অভিব্যক্তির পূর্বকথন হলো উপলব্ধি। সাহিত্যে কবি-লেখক কিছু বার্তা পৌঁছে দিতে চান পাঠকের কাছে। বার্তা পেশ করবার জন্য তিনি সহায়ক অনুষঙ্গের আশ্রয় নিয়ে থাকেন, যেমন : শব্দ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক, মিল, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস, ইত্যাদি। লেখক আবার কখনো কখনো কোন বার্তাই উপস্থাপন করতে চান না পাঠকের কাছে, উপস্থাপন করেন শুধু ধ্বনিব্যঞ্জনা, ধ্বনিসুষমা। সে সব ধ্বনিপুঞ্জের সম্মিলিত রূপ একটি বিমূর্ত বিষয় প্রকাশ করে ভাবুক পাঠকের চেতনায়। পাঠকের কাছে তখন ধ্বনি ঝঙ্কার ও আবেগের মিশ্রণই প্রধান হয়ে দাঁড়ায় নির্দিষ্ট কোন অর্থ নয়। পাঠক নিজ চেতনার আলোকে ধ্বনি ঝঙ্কারের অর্থ সন্ধান করতে থাকেন। তার চেতনায় পুলকের সঞ্চার ঘটতে থাকে। ভাবুক হৃদয় নিজের মত করে এ সবের ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন নিজের জীবন অনুভবের সাথে মিলিয়ে। সে সব অন্য বিষয় না বলা কথার ভীড়। সাহিত্যে বলা আর না বলা কথার ভীড় যাই থাক আবৃত্তিশিল্পীকে আবৃত্তির স্ক্রিপ্ট বারবার পড়ে অর্থ এবং অর্থের আঙ্গিনা খুঁজতে হবে। অর্থ এবং অনর্থকে ব্যাখ্যা করতে হবে। পুরাতন ব্যাখ্যা নয় চাই নতুন ব্যাখ্যা নিজস্ব ব্যাখ্যা। সে ব্যাখ্যা সাহিত্যিকের ব্যাখ্যা থেকে ভিন্নও হতে পারে। মনে রাখতে হবে আবৃত্তিশিল্পীর কাছে স্ক্রিপ্টটি কাঁচামাল হিসেবে গণ্য। তিনি তার বোধ, মেধা, মনন, পঠন-পাঠন, দর্শন দিয়ে কবিতা অথবা গদ্যটির পুনর্জন্ম দান করবেন। পুনর্জাত করাই আবৃত্তিশিল্পীর কাজ। এই পুনর্জাত হওয়াই আবৃত্তির শিল্প হয়ে ওঠার কারণ। সাহিত্যিকের কাছে তার রচনাটি উৎপাদিত পণ্য আর আবৃত্তিশিল্পীর কাছে তা কাঁচামাল। আবৃত্তিশিল্পীর কাছে আবৃত্তিই উৎপাদিত পণ্য। আবৃত্তিশিল্পী কখনোই কবি-সাহিত্যিকের ভারবাহী নন। তিনি স্বাধীন এবং নতুন রসস্রষ্টা এবং সে কারণেই তিনি শিল্পী। কবি-সাহিত্যিকের কাজ আর আবৃত্তিশিল্পীর কাজ ভিন্ন। দুটোর মধ্যে দেয়ালের মত প্রভেদ রয়েছে। আমি কবি-সাহিত্যিকদের নাকোচ করে দিচ্ছিনা, তাদের রচনা জীবন দর্শন বিবেচনায় রেখে আবৃত্তিশিল্পী একটি নতুন শিল্প নির্মাণ করবেন। গীতিকার আর সুরকার যেমন ভিন্ন কাজ করে থাকেন। আবৃত্তি হচ্ছে কবি-কবিতা ও আবৃত্তিশিল্পীর সম্মিলিত রসায়ন, শিল্প যার নাম।
আবৃত্তির অভিব্যক্তি প্রকাশিত হবে কণ্ঠস্বরে। কণ্ঠস্বর বাচিক শিল্পীর একমাত্র অবলম্বন। অন্যকোন ভাবেই নয়, অঙ্গভঙ্গিতেও নয় শুধু কণ্ঠ দিয়েই তিনি প্রকাশ করবেন বিষয়ের উপলব্ধি ও অভিব্যক্তি। মানুষের অনুভ‚তির বিভিন্ন ধরন আছে। অনুভ‚তির বৈচিত্র্য কণ্ঠস্বরে ফুটে ওঠে। আবৃত্তির কবিতাটি হৃদয়ঙ্গম করা না গেলে কণ্ঠে তার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সাহিত্য ও শ্রোতার মধ্যে অদৃশ্য যে সেতুবন্ধন অর্থাৎ সহৃদয় হৃদয় সংবেদীতার দায়িত্ব শিল্পীর। সাহিত্যিক সেখানে অনুপস্থিত সুতরাং বিষয়টি বুঝে বোধের গভীরে ধারণ করে শুদ্ধ উচ্চারণের মাধ্যমে কণ্ঠস্বরের মোহময়তার ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করাই হবে শিল্পীর যাদুকরী বৈশিষ্ট্য। সাহিত্য যখন আমরা মনে মনে পাঠ করি তখন দীর্ঘ কোন বক্তব্যে বিরক্ত হই না কিন্তু একজন শিল্পী যখন একটি নির্দিষ্ট স্বরভঙ্গিতে অনেকক্ষণ ধরে আবৃত্তি উপস্থাপন করেন তখন তা একঘেয়েমিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে জন্য শিল্পীকে কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রকাশক্ষম নতুন মনোভঙ্গিমা তৈরি করতে হয়। এ বিষয়টিকে আমরা বলতে পারি শিল্পীর মেধা মনন চিন্তন পরিশীলন ও অনুশীলনে নির্মিত শিল্প বিনির্মাণ। অনেকে বলেন আবৃত্তিশিল্পের জন্য একটি ভরাট মায়াবি আকর্ষণযোগ্য কণ্ঠের প্রয়োজন রয়েছে কারণ নিঃসন্দেহে কণ্ঠস্বর মানুষকে আকর্ষণ করে। কথাটি আংশিক সত্য তবে অনুশীলনকৃত সাধারণ মানের কণ্ঠস্বরেও ভাল আবৃত্তিশিল্পী হওয়া সম্ভব। নির্ভর করবে দীর্ঘ অনুশীলন- পরিশীলনের ওপর। কণ্ঠস্বরে যদি দ্যোতনা, অর্থবহতা সৃষ্টি করা যায় তবে তা সম্ভব। ভাব অনুযায়ী স্বরক্ষেপ করা চাই। কণ্ঠ যেন সঠিক ভাবটি প্রকাশ করতে পারে তাহলেই আবৃত্তিকার হওয়া সম্ভব। কণ্ঠস্বর তৈরির সাথে বাক্ যন্ত্রের ব্যবহার প্রক্রিয়াটি জড়িত। উচ্চারণ ভুল হবার কারণ বাকযন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক ব্যবহার কৌশল না জানা। কোন বর্ণ বাক্ প্রত্যঙ্গের কোন স্থান থেকে উচ্চারিত হবে তা জানা দরকার। বাকযন্ত্রের ভুল স্থান স্পর্শ করলে ভুল ধ্বনি উচ্চারিত হবে।
আমরা একটি কথা অনেকের কাছে শুনে থাকি তা হলো, ‘অমুক শিল্পীর কণ্ঠটি ভারি মিষ্টি’। তাহলে দেখা যাচ্ছে আবৃত্তির জন্য শুদ্ধধ্বনিই যথেষ্ট নয়, মধুস্বরও দরকার। মিষ্টি কণ্ঠ সুরেলা কণ্ঠ যাই বলি না কেন তা মূলত ধ্বনি সৌন্দর্য বা ধ্বনি সুষমা। ধ্বনি প্রক্ষেপণ কি ভাবে করলে মিষ্টি স্বর অর্থবহ স্বর বেরিয়ে আবৃত্তি মুগ্ধকর হবে তার কৌশলও রপ্ত করতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধি, শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা কণ্ঠস্বরের অন্তর্গত। দম বেশি থাকলে কণ্ঠস্বর পুষ্ট হবে, কম থাকলে দুর্বল স্বর বের হবে। আবৃত্তির স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করতে পারলে খুব ভাল হয় বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। মুখস্ত না হলে ক্ষতি নেই তবে মুখস্তের মত হওয়া চাই। আবৃত্তির সময় দর্শক-শ্রোতার রুচির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মঞ্চে দর্শকের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়। শ্রোতার মনস্তত্ত¡ বুঝে স্থান কাল পাত্র ভেদে আবৃত্তি করতে হবে। মঞ্চে শিল্পীর অঙ্গভঙ্গি, বেশি কথাবার্তা না বলাই ভাল। রুচিশীল উত্তম পোষাক পরে মঞ্চে যেতে হবে এবং একটি শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। মাইক্রোফোনের ব্যবহার খুব স্পর্শকাতর বিষয়। মাইক্রোফোনের যথাযথ ব্যবহার শিখতে হবে। শব্দযন্ত্রের ব্যবহার না জেনে ভাল আবৃত্তি করলেও শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর মনে হবে। রেডিওর আবৃত্তিতে ঝুঁকি কম। টেলিভিশনের আবৃত্তির স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করাই ভাল। বারবার স্ক্রিপ্টের দিকে তাকানো যাবে না। পোষাক রুচিশীল ব্যক্তিত্বপূর্ণ হতে হবে। শিল্পী শুধু কণ্ঠ দিয়েই নির্ণিত হন না, পোষাক, কথাবার্তা, মঞ্চে আসা যাওয়া, শিষ্টাচার, কবিতা নির্বাচন, উপস্থাপনের কৌশল সব কিছুর সমবায়ে প্রকৃত শিল্পীর মর্যাদা অর্জিত হয়। আবৃত্তির জন্য শিল্পীর মানসিক শারীরিক প্রস্তুতি ও স্বতঃস্ফূর্তি থাকা দরকার। আবৃত্তি হবে গভীর ব্যাপক ও মর্মস্পর্শী যা অবশ্যই দীর্ঘ মনন ও অনুশীলন সাপেক্ষ। গলা সাধা, শ্বাস-নিঃশ্বাসের অনুশীলন করা, স্বরের অনুরণন বৃদ্ধি করা, শারীরিক ব্যায়াম করা, কবিতা-গদ্য পাঠ করা, বারবার পাঠ করা, আপন অনুভবের সাথে মিশিয়ে পাঠ করা দৈনন্দিন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে।
সাহিত্য ও সাহিত্যিক সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা রাখা একজন শিল্পীর জন্য কল্যাণকর। সাহিত্যের সময়কাল, লেখার বৈশিষ্ট্য, শিল্পদর্শন, জীবনবোধ, উল্লেখযোগ্য রচনা সম্পর্কে ধারণা থাকলে রচনাশৈলীর ওপর আবৃত্তির স্বরভঙ্গি সূচারু হবে। যেমন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভিন্ন স্বরভঙ্গি দাবি করে। আবৃত্তিশিল্পীর মননে থাকতে হবে আবহমান বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস ।
নন্দনতত্ত্বের মূল বিষয় হলো সৌন্দর্যতত্ত্ব। জ্ঞান, বুদ্ধি ও রূপের সমন্বয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ হলো সুন্দরকে সঞ্চারিত করা। রূপের পথ ধরে অরূপের সন্ধানে যাওয়া। কথা বলার একটি সৌন্দর্য আছে। সুন্দর করে কথা বলতে হলে শিল্পিত ভাবে ধ্বনি উচ্চারণ করতে হবে। আবৃত্তির ধ্বনি সৌন্দর্য শুধু শ্রুতির বিষয় নয়। আবৃত্তি যখন শোনা ও উপভাগের বিষয় অতিক্রম করে চেতনা জাগ্রত করে এবং ধ্বনিপুঞ্জের অধরা মাধুরী হৃদয়ে মননে সঞ্চিত থাকে তখন তা নান্দনিক রূপ লাভ করে। কবিতার শব্দ কেমন করে বললে সবচেয়ে সুন্দর হবে, অভিজাত হবে, ভাল লাগার আবেশ শ্রোতার মনে জাগরুক থাকবে তাই হলো নন্দনতত্তে¡র বিষয়। বুদ্ধি বিবেচনা এবং সময় নিয়ে একটি কবিতা বারবার পড়লে কবিতার মায়াবী পর্দা উন্মোচিত হতে থাকে, অশেষ মাধুরীর সন্ধান মিলতে থাকে। মুখের কথা মধুময় মায়াময় করতে হলে কবিতার চরণে চরণে প্রাণের সাড়া জাগাতে হবে। কবিতা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উচ্চারণ করতে পারলে শ্রোতার মনে শিল্পীর আসন স্থায়ী হবে ।
আবৃত্তির নন্দনতত্ত্ব হলো ধ্বনিকে ভাবযুক্ত করে ছেড়ে দেয়া, শব্দের অর্থের সীমানা অতিক্রম করে ভাবলোকে ধাবিত করা। আবৃত্তিশিল্পী নিজেকে প্রাধান্য না দিয়ে শিল্পকে এগিয়ে নেবেন। সুন্দরের ধর্ম হলো আধো প্রকাশ্য, গোপনীয়তা এবং কৌতূহলোদ্দীপক। অসুন্দর সহজ প্রকাশ্য বলেই আকর্ষণহীন। আবৃত্তির ধ্বনিমাধুর্য দিয়ে শ্রোতার কানে নয় প্রাণে ঝংকার তোলার কৌশলটি আয়ত্ব করাই নন্দনতত্তে¡র বিষয়। আবৃত্তিতে লাবণ্যের প্রলেপ লাগাতে হবে। সংগীতে যেমন স্বরসপ্তকে সাতটি সুর আছে কিন্তু বড় শিল্পীর কণ্ঠে এই সাতটি সুর লক্ষ সুর রূপে ঝলক দিয়ে ওঠে। সুন্দরের রয়েছে আকর্ষণ করার শক্তি। সে মনকে সহজেই আপ্লুত করে রাখে, বলা যায় বস্তুর সাথে ভাবের সম্পর্ক। সৌন্দর্য ভোলায় এবং আকর্ষণ করে। হৃদয় মেলে গ্রহণ করে কণ্ঠসুধা। এ যেন রূপের অভিযাত্রায় অপরূপের অন্বেষণ। আজ আবৃত্তি করলাম শ্রোতা শুনলো এবং দুদিন পর তা ভুলে গেল তা নয়। যে শ্রোতা আবৃত্তিটি শুনবেন তিনি যেন চিরকাল মনে রাখেন কোন একটি সৌন্দর্য তাকে ছুঁয়েছিল কোন একদিন। একটি কবিতার কোথায় সৌন্দর্য আছে, কোথায় আনন্দ বিরহ বেদনা আছে, কোথায় স্পর্শকাতরতা অন্তক্ষরণ আছে, আত্মখনন আছে, কোথায় শ্রোতার সাথে কবির অনুভবের একাত্মতা আছে–সেসব আবিষ্কার করে কণ্ঠে ধারণ করাই আবৃত্তির নান্দনিকতা। সে জন্য একজন সেরা কবির সকল কবিতাই নান্দনিক বিবেচনায় আবৃত্তিযোগ্য কবিতা নয়। নান্দনিকতা এমন এক বিষয় যা বেদনাকেও আনন্দময় করে তোলে। আবৃত্তির নন্দনতত্ত্বের কারণে আবৃত্তিকার কবিরও নির্ভরতার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।