প্রবীর বিকাশ সরকার
প্রাচীনকালে ভারত ও জাপান সম্পর্ক ছিল কিনা তা গবেষণাসাপেক্ষ। জাপানের পূর্বপুরুষরা ভারতীয় বলে কোনো কোনো উৎস থেকে অবশ্য জানা যায়। অনেকেই মনে করেন বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে জাপানে এসেছে। সরাসরি বৌদ্ধধর্ম জাপানে আসেনি, চীন থেকে কোরিয়ায় যায়, কোরিয়া থেকে জাপানে আসে ষষ্ঠ শতকের দিকে। অধিকাংশ ভারতীয় ও জাপানি ইতিহাসবিদ, গবেষক ভারত-জাপান সম্পর্কের মূলসূত্র হিসেবে বৌদ্ধধর্মকেই গণ্য করে থাকেন।
বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে যে জাপানিরা ভারতবর্ষকে চিনেছেন, জেনেছেন এবং আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তা আর না বললেও চলে। সেই আগ্রহ আজও অটুট এবং ক্রমবর্ধমান এই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জয়জয়কারের যুগেও। প্রচুর জাপানি পর্যটক “ওশাকাসামা” তথা “শাক্যমুণি”র দেশ ভারতে যান প্রতি বছরই। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ভিক্ষু, পুরোহিত, পণ্ডিত ও গবেষক। বিগত শতবর্ষের পরিক্রমায় অনেক বিখ্যাত জাপানি বৌদ্ধ ভিক্ষু, পুরোহিত, পণ্ডিত ও গবেষক ভারতে গিয়েছেন সদ্ধর্মকে আরও জানা, বোঝা এবং গবেষণার জন্য। আধুনিককালে এই সদ্ধর্ম আবিষ্কারের সূচনা করেছিলেন পণ্ডিত, লেখক শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন ১৯০২ সালে ভারত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে।
তাঁর এই ভ্রমণের সময় ঘনিষ্ঠতা হয় স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে। ওকাকুরার সঙ্গে গিয়েছিলেন তরুণ এক বৌদ্ধভিক্ষু নাম শিতোকু হোরি, যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের প্রথম বিদেশি ছাত্র। সংস্কৃত ভাষা শেখা ছিল তার মূল লক্ষ্য।
ওকাকুরা তেনশিন ও রবীন্দ্রনাথ জাপান-ভারত ভাববিনিময় সম্পর্কের সূচনা করলেও পেছনে ছিল স্বামীজির আগ্রহ। কারণ তিনি ওকাকুরার আগে আধুনিক জাপানে এসেছিলেন আমেরিকায় যাওয়ার পথে ১৮৯৩ সালে। তিনি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন জাপানের উন্নতি, প্রগতি এবং আধুনিকায়ন প্রত্যক্ষ করে। সুতরাং জাপানের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক এটা তাঁর আরাধ্য ছিল বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। তিনিই তাঁর শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওকাকুরাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
কলকাতায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানে নিবেদিতা ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেন। এর আগে রবীন্দ্রনাথ এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ হিসেবে জাপানের নাম জানতেন সন্দেহ নেই, কিন্তু ওকাকুরার নাম জানতেন বলে মনে হয় না। স্বামীজি কী ভেবে ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়েছিলেন সে এক রহস্য বটে! কিন্তু এই সম্পর্ক যে পরবর্তীকালে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ ও জাপানের ক্ষেত্রে এটা কি স্বামীজি মনে মনে ভেবেছিলেন? গবেষণার বিষয়।
ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথ চিন্তা, দর্শন এবং সৃজনশীল জগতের দুই দিকপাল মনীষী হলেও তাঁরা আরেকটি জগত নিয়েও মেতেছিলেন আর সেটি হলো বৈশ্বিক রাজনীতি। দুজনের রাজনৈতিক চিন্তা ও বিচারবিশ্লেষণ যে কত গভীর ছিল তা তাদের রচিত গ্রন্থগুলোই উজ্জ্বল প্রমাণ। এবং আজও আলোচিত ও গবেষণাধীন।
বস্তুত, এই দুই মনীষীর গভীর মননশীল সম্পর্ক ক্রমশ রাজনীতির দিকেই ধাবিত হয়েছিল। ভারতে অবস্থানকালেই ওকাকুরা কর্তৃক তরুণ স্বদেশি আন্দোলনের কর্মী ও বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করা, উগ্র রাজনৈতিক গুপ্ত সংস্থা “অনুশীলন সমিতি” গঠনে উৎসাহিত করা ইত্যাদি রাজনৈতিক জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। বৈপ্লবিক তৎপরতা শুরুই হয়েছিল ঠাকুর পরিবার থেকে। এবং চৌকশ তরুণ বিপ্লবী রাসবিহারী বসু রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় সেজে জাপানে প্রবেশ করেন ১৯১৫ সালে। ওকাকুরার মৃত্যুর দুবছর পর। তারপর সে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিভিন্ন সময় আমি আমার বিভিন্ন লেখায় কিছু কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
এই রাসবিহারী বসু ভারতে থাকতে একরকম অপরিচিতই ছিলেন। তাঁকে জাপানে আশ্রয় দিলেন এমন একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও গণমুক্তি আন্দোলনের নেতা যাঁর কথার ওপর কথা বলার ক্ষমতা কারো ছিল না সেই সময়। তিনি গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু। উগ্র জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন ওকাকুরার মতোই প্যান-এশিয়ানিস্ট অর্থাৎ প্রাচ্যভ্রাতৃবাদী। অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক গুপ্ত সংগঠন “গেনয়োওশা”, “কোকুরিউকাই” প্রভৃতির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুই গড়ে তুলেছিলেন রাসবিহারী বসুকে একজন দুর্ধর্ষ, অকুতোভয় ও শক্তিধর বিপ্লবী হিসেবে, দুর্দান্ত ন্যাশনালিস্ট হিসেবে। রাসবিহারীর অপরিমেয় বুদ্ধিমত্তা, তৎপরতা ও কারিশমার কারণেই ভারতের স্বাধীনতা তরান্বিত হয়েছিল। যদিও তিনি সেই আরাধ্য স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারেননি গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুও। দুজনেই আগে পরে ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালে ইহলোকত্যাগ করেন।
এই যে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে জাপানে তার কিছুই ভারতীয়রা এবং বাঙালিরা জানে না বললেই চলে। ইতিহাস যেমন লেখা হয়নি, গবেষণাও হয়নি। কোথাও পড়ানোও হয় না। সুতরাং অজ্ঞতা ও অজানার মধ্যেই সুপ্ত হয়ে আছে এই ইতিহাস।
জাপানে আসার পর এইসব ইতিহাস ও ঘটনা বিভিন্ন জাপানি গ্রন্থ পাঠ করে ও প্রবীণ জাপানিদের কাছ থেকে জানার ফলে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয় আমার। তারপর তো অসংখ্য প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করেছি, গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এগুলো একাডেমিক গবেষণা নয়, একান্তই ব্যক্তিগত আগ্রহ তথা সৌখিন গবেষণা। হয়ত মূল্যবান, নয়ত নয়।
ক্রমে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ, রাসবিহারী বসু, নেতাজি, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল এং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চমাপের কয়েকজন ভক্তর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। তাঁদের মধ্যে গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর পৌত্র বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাবিদ তোওয়ামা ওকিসুকে অন্যতম। ২০০৩ সালে তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন আমার একজন জাপানি সাংবাদিক বন্ধু য়োশিজাওয়া মাকোতো। সেই থেকে গভীর ঘনিষ্ঠতা। তিনি “কুরেতাকেকাই; আজিয়া ফোরাম” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন দাদার আদর্শকে ভিত্তি করে। গোড়া থেকেই আমি এর সঙ্গে জড়িত। তাঁকে আমি একদিন প্রস্তাব দিলাম, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে সংগঠনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হোক দুই দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে স্মারক বক্তৃতা প্রদানের জন্য। ভারত ও জাপান যে পরীক্ষিত বন্ধু এটা এশিয়াবাসীকে জানানো জরুরি। কারণ চিন দ্রুত সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠছে, এশিয়ার শান্তি ও সংহতির জন্য হুমকিস্বরূপ। শান্তিবাদী দেশ তিব্বতকে দখল করে নিয়েছে, উইঘুর উপজাতিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করছে অনেক বছর ধরে, দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনামের সঙ্গে তার বিরোধ চলছে। থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে তার হাত রয়েছে। এশিয়ার প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে তার সীমান্ত, সমুদ্র এবং রাজক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। যা আদৌ শুভকর নয়।
ওকিসুকে স্যার আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগ নিলেন। ভারতীয় দূতাবাসে প্রতিনিধি পাঠিয়ে মাননীয় রাষ্ট্রদূত মণিলাল ত্রিপাঠীকে আবেদন জানালেন। এই ব্যাপারে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক আমার পরম শুভাকাক্সক্ষী ভারতপথিক দেশিকোত্তম অধ্যাপক কাজুও আজুমা সাড়া দিলেন, আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম। তিনি খুব আন্দোলিত হয়েছিলেন! বললেন, এটা খুব ভালো কাজ হবে। এর আগের রাষ্ট্রদূত আফতাব শেঠ বিভিন্ন সভা, সেমিনারে ভারত-জাপানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে বক্তৃতা করেছেন। তিনি জাপানের বিখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেইও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। আজুমা স্যারও বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রদূত মণিলাল ত্রিপাঠীর সঙ্গে আলাপ করলেন। তারপর রাষ্ট্রদূত রাজি হলেন।
২০০৬ সালের নভেম্বর মাসের এক রোববারে কুরেতাকেকাই এর সংবর্ধনা সভায় রাষ্ট্রদূত ত্রিপাঠী দেড়ঘণ্টা বক্তৃতা প্রদান করলেন। প্রচুর জাপানি নাগরিক সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন।
একটি ইতিহাস এভাবেই রচিত হলো।