তৈমুর খান
উপন্যাস যখন আত্মজীবনীর রসায়নে রসসিক্ত হয়ে ওঠে তখন তা আর উপন্যাস থাকে না, জীবনের রোদ-ছায়ায় আত্মজীবনীরই রূপ পায়। চার্লস ডিকেন্স ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এ লিখেছেন:
“আমি আমার নিজের জীবনের নায়ক হতে পারব কি-না, বা সেই স্টেশনটি অন্য কারও হাতে থাকবে, এই পৃষ্ঠাগুলি অবশ্যই দেখাবে।”
লেখক যখন নিজেই নায়ক হয়ে ওঠেন তখন পাঠকই বিচার করেন তিনি প্রকৃতই নায়ক হতে পেরেছেন কি-না। দীপংকর রায়ের ‘জলশ্যাওলার বিরহকথা’(কার্তিক ১৪৩০) উপন্যাসটি এক আত্মবৃত্তান্তেরই নিভৃত অভিমুখ, যা মগ্নচারী আত্মবিশ্লেষণেরই এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। জীবনের ভিতর-বাহিরের শূন্যতা, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস, নিস্তব্ধতা, ভাঙন, শিহরন, প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা এবং দৈনন্দিন কর্মময়তা সবই উঠে এসেছে। আত্মযাপনের নিবিড় মুহূর্তগুলিতে নানা সংকট ও বিপন্নতার সঙ্গে ভাবনাও বিস্তৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশ আর ভারত ভাগ হওয়ার পরও যারা দুই দেশকেই আপন করে নেওয়ার টানাপোড়েন থেকে বের হতে পারেননি—তাদেরই একজন এই উপন্যাসের নায়ক। কোথায় তার দেশ?জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতে পারেন না। উত্তর দেবার আগে একটু থেমে যান। দুই দেশেই তার যাতায়াত চলতে থাকে। পাসপোর্ট নিয়েই তিনি বৈধভাবে যাতায়াত করলেও তার সংবেদনশীল হৃদয়ে সর্বদা বিরাজ করে এক কষ্ট ও স্মৃতিকাতরতা। অতীতে যা ছিল, যা তিনি হারিয়েছেন তা প্রাকৃতিক ও মানবিক ঐশ্বর্য বলেই অন্তরটা সর্বদা ব্যথিত, শূন্যতায় হাহাকারময়। এই উপলব্ধির তীব্র মোচড় থেকেই যে ভাষা, যে শব্দ, যে বর্ণনা, যে আধ্যাত্মিক চেতনার জাগরণ ঘটে—সেখানে পাঠককে এনেও সামিল করেন। তাই দেশভাগের প্রথম পর্যায় থেকে আজ অবধি যে অন্তরায় ও ফাটলগুলি লালিত হয় তার সূক্ষ্ম মনশীল অভিব্যক্তি ঘটেছে এই উপন্যাসে।
নায়ক পথিকের বাংলাদেশে জন্ম না হলেও বাংলাদেশে লালিত পালিত হয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনদের একাংশ বাংলাদেশে, আরেক অংশ কলকাতায়। দীর্ঘদিন পর কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরে যাবার পথে তিনি দিনলিপি লিখতে লিখতে গেছেন। সাতষট্টিতে নেহাৎ বাল্য অবস্থায় চুরি করে বর্ডার পেরোনর অভিজ্ঞতা তার মনে পড়েছে। বরিশালগামী বাসে উঠে একে একে স্মৃতির বাঁকে কলম থেমে গেছে নায়কের। দিনলিপির পাতা থেকে মুখ তুলে বাস্তবে চেয়েছেন। তখন ‘এ এক মরা আলোর জ্বলে বেড়ানো নিঝুমতা’ বলে মনে হয়েছে। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে আত্মদ্বন্দ্বের মোকাবিলা করেছেন তাতে মনগড়া কাহিনি লিখে ‘লেখার দোকানদার’ হতে চাননি। জীবনকে খুঁড়েছেন, দুমরে মুচড়ে যে রস বের করেছেন তা-ই লিখতে চেয়েছেন।
ছেচল্লিশের নায়কের সঙ্গে খুড়তুতো শ্যালকের সতেরো-আঠেরোর যুবতী বউ ঊর্মির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। তারপর তার হাত ধরেই শহরের পূজামণ্ডপ পরিক্রমা। তখনই শরীরে শরীরে ঠোকাঠুকি, যৌনশিহরনে রমণগন্ধ টের পেয়েছেন। নায়ক একজন লেখক-কবি। প্রকৃতির সঙ্গে তার নিবিড় সংযোগ। একাকী নদী গাছপালা পশু পাখি মাঠ ও শস্যের সঙ্গে তার যেন কথোপকথন চলতে থাকে। যতদিন শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করেছেন এই সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। উর্মি এসে কখনো তার কোলে বসেছে। কখনো বাচ্চা ছেলের মতো খাবার খাইয়েও দিয়েছে। নায়কের বউ সাথী কলকাতা থেকে টেলিফোনে তার পাগলা স্বামীর দেখাশোনার জন্য তাকেই দায়িত্ব দিয়েছে। তাই রাতদিন এক করে চোখে চোখে তাকে রাখতে চেয়েছে ঊর্মিও। ঊর্মিও খুব নিঃসঙ্গ জীবন কাটায়। স্বামী গৌতম তাকে ঠিকমতো বুঝতে চায় না। তাই পথিকই তার আপনজন হয়ে ওঠে। বাড়ির অন্যরাও জেনে গেছে দুই পাগলের খেলা। নয়জন সদস্যের শ্বশুর বাড়ির যৌথপরিবার এবং তাদের সম্পর্কীয় আত্মীয়দের নিয়েও বহু মানুষজনের পরিচয় এই উপন্যাসে রয়েছে। পরিবারের নানা ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে বহু কিংবদন্তিরও ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে। প্রতিবেশী সুধীর ডাক্তারের ছোট মেয়ে গতির গান শুনে নায়ক মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষিতা হয়েও তার বিয়ে হয়নি। নায়কের ভাগ্নের বন্ধু জয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণেই।
নায়কের জীবন কাহিনিতে বহু দুঃখময় পরিস্থিতি উঠে এসেছে। প্রথম সন্তান দিব্যর জন্মবৃত্তান্ত, শ্বশুর বাড়ির সকলের উদাসীনতা তাকে ব্যথিত করেছে। ব্যবসা ছেড়ে আঠেরো বছর পর আবার কাপড় ফেরি করার ব্যবসা এবং সামান্য পুঁজি নিয়ে সোনারপুরে দোকান দেওয়া কত যন্ত্রণার ছিল তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাথীর কাকা প্রথমদিকে সঙ্গ দিলেও তিনিও কেটে পড়েছেন।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রতিটি স্মৃতিবিজড়িত স্থানকালপাত্র তার দিনলিপিতে উঠে আসে। শিকড়ছেঁড়া মানুষদের জীবনযাপনের কথা তিনি যেমন লিখতে ভোলেননি, তেমনি দার্শনিক চেতনায় নির্মোহ দৃষ্টিতে জীবনকেও দেখেছেন। তাই মনে হয়েছে ‘বড় অসহায় এই জীবনের সকল রসায়ন।’ ভাগ্যের পরিহাস বা দুর্বিপাক যা-ই হবে হোক নিজেই তার উত্তাপ মেপেছেন। তবু ঊর্মির ভালোবাসায় ‘বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানহীন জামাইবাবু’ হয়েও প্রাণের সাড়া দিয়েছেন। কলকাতার ‘দোকানদারির জীবনে’ পদার্পণ করে বুঝেছেন একলা চলার ব্রত। ঢাকা ঘুরে সবকিছু আরো স্পষ্ট হয়েছে—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষজনেরও কত পরিবর্তন। আন্তরিকতা উবে গিয়ে মানুষ হয়েছে স্বার্থপর হিসেবী আত্মকেন্দ্রিক। নগর জীবনের অসার ফাঁপা জায়গাটি মানুষকে গিলে নিয়েছে। তাই কোথাও প্রাণের প্রশান্তি নেই। যৌথপরিবারেও ভেতরে ফাটল দেখা দিয়েছে ‘হাঁড়ি এক থাকলেও হিসেব আর এক নেই।’ ভারত ভাগের সঙ্গে পরিবারও ভাগ হয়ে গেছে। একা একা রাত জেগে নায়কের ভাবনার বিস্তার ঘটেছে। আত্মবিশ্লেষণে নিমগ্ন হয়েছেন। তবুও চকিতে মনে পড়েছে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মেয়ে সোনালীর চামচে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা। সেই এঁঠো চামচে নিজেও খেয়েছে সে।পথিক যে তারও জামাইবাবু তা অকপটে স্বীকার করেছে। তেমনি ইদ্রিশ কাকা, চেতন ফকিরের ভাবনার কথাও মানবতার দেয়াল হিসেবেই উপন্যাসে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু সবার উপরে দেশভাগের কষ্ট, দুর্ভিক্ষ, কসাইবৃত্তি, ছিন্নমূল মানুষের দেশত্যাগ নায়কের অবচেতন মনেও ক্রিয়া করেছে। এই যন্ত্রণা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি।
সমগ্র উপন্যাসটিতে একটি ব্যক্তিজীবন, একটি পরিবার, একটি জাতির ইতিহাসের উপর এক অন্ধকারময় ভাঙনের প্রলাপকেই সংঘটিত করেছে। দেশপ্রেম কী, মানবপ্রেম কী, জাতিপ্রেম কী, প্রকৃতিপ্রেম কী এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি কতখানি আনুগত্য থাকলে এরকম বই লেখা যায় তা লেখক প্রমাণ করেছেন। চিরন্তন এক আবেগের কাছে আমাদের মানবজন্মের দায়বদ্ধতা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। চিরাচরিত প্লট নিয়ে তিনি রোমান্টিক গল্প শোনাতে চাননি। নিজ সত্তার ক্ষতবিক্ষত রূপ লৌকিক আত্মীয়তার জটিল সরণিতে প্রক্ষেপণ করেছেন। তাই চরিত্রগুলির অন্তরদেশে যেমন পৌঁছেছেন, তেমনি তাদের প্রকৃতি ও অভিব্যক্তি অকপটে প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতিও ভাষা পেয়েছে। প্রাণীরাও তাদের কষ্ট বুঝিয়েছে। কুড়ি দিনের ঢাকা সফরে মুগ্ধ হতে পারেননি। তার কেটে যাওয়া জীবনের বেসুরো উপলব্ধিই তার সঞ্চয়। তাই নামকরণেও ‘জলশ্যাওলার’ সঙ্গে ‘বিরহকথার’ এমন সংযোগ।
#
জলশ্যাওলার বিরহকথা: দীপংকর রায়, এবং কথা, ২৬ বাঁশদ্রোণী প্লেস, কলকাতা ৭০০০৭০, প্রচ্ছদ: লেখক, মূল্য ৩০০ টাকা।