১.
ওরা সাতজন
বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শোধ করেছি দাম
কি কিনেছি? কি কিনেছি?
এই যে দেখো বর্ণমালা,
বাংলা এনেছি
ভাষা শহিদ, বাংলা ভাষার যোদ্ধা সে, সালাম।
থমথমে ভোর গুমট শহর বক্ষে নীরব ভার
গর্জে ওঠে ভাষার শপথ
দুপুর রোদে হচ্ছে সরব
আস্তে-ধীরে পথ
ভাষার মিছিল, প্রাণ দিয়েছে নির্ভয়ে জব্বার।
রাজপথে লাল রক্তে আঁকা ভাষার দস্তখত
কে এঁকেছে ঢাকার বুকে?
প্রাণ দিয়েছে পশ্চিমাদের
ক্রুদ্ধ বন্দুকে
ভাষা শহিদ বাংলা ভাষার যোদ্ধা সে বরকত।
বাংলা ভাষার উঠলো দাবী কাঁপলো দিগ্বিদিক
মস্তকে কার লাগলো গুলি
বর্ণমালায় রক্তমাখা
উষ্ণ অঙ্গুলি
ভাষা শহিদ বাংলা ভাষার যোদ্ধা সে রফিক।
হে দুখিনী বর্ণমালা কোথায়, কতদূর?
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
ভাষার দাবী গর্জে ওঠে;
কাঁপছে চতুর্দিক
বুকের তাজা রক্ত দিলো শহিদ সফিউর।
রক্তে রাঙা পলাশ ফাগুন, ভাষার দাবী লাল
মিলিটারির ট্রাকের চাকায়
পিষ্ট হলো দিন-দুপুরে
ফেব্রুয়ারির রুদ্র ঢাকায়
ভাষা শহিদ রিক্সাচালক দরিদ্র আউয়াল।
যে শিশুটি আঁকতো ছবি তার কথা ভুল্লা?
তখনো তার বুক-পকেটে
ছবির পাতা, বর্ণমালা
তীব্র রোষে যাচ্ছে ফেটে
সে আমাদের ভাষাশহিদ বীর অহিউল্লা।
২.
অশ্রুযতিচিহ্ন
অহিউল্লার চিৎকার লিখবো বলে
হেঁটেছি শোকের সমান আয়ুপথে
খুঁজেছি উপযুক্ত শব্দ, যতিচিহ্ন
কোন ভাষা, কোন শব্দ,
কোন অক্ষর বেজে ওঠে আজো অহিউল্লার রক্তে
কোন যতিচিহ্নে এ রক্তপ্রবাহ থেমেছিল?
দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন?
না,
এর সবইতো ভিনদেশি
এইসব যতিচিহ্ন আমার নয়।
খরতপ্ত দুপুরে হন্তারক ফাগুন
কোন সুরে ডেকেছিল কিশোর অহিউল্লাকে?
মায়ের ক্রন্দন থেকে গর্জে ওঠে যে নদী
কোন তটরেখায় তা আছড়ে পড়ে মিছিলবিকেলে?
আমি খুব স্পষ্টতই দেখতে পাই
অহিউল্লার রক্তস্রোতে ভেসে গেছে ভিনদেশি কমা
উড়ে গেছে দাঁড়ির মিছিল
সেমিকোলনগুলো গলে গলে পড়ছে
আশ্চর্যবোধক কপালের ভাঁজ তলিয়ে গেছে
রক্তনদীর অতল গহনে
অহিউল্লার অজেয় রক্তস্রোত বালির বাঁধের মতো উড়িয়ে দিয়েছে
প্রশ্নবোধক চিহ্নের ঝাঁক।
অহিউল্লা, হে বীর, হে তরুণ ভাষাসৈনিক
তোমার বক্ষবিধৌত রক্তস্রোতবন্দনাশিল্পকাব্য
কোনো ধার করা যতিচিহ্নে থামানো যাবে না জানি
এই কবিতাটির জন্য তাই দরকার
বদ্বীপের মতো উজ্জ্বল বাংলা ভাষার নিজস্ব এক অশ্রুযতিচিহ্ন।
৩.
উদ্বিগ্ন রাতের কথা
উদ্বিগ্ন রাতের কথা বলতে এসেছি এত দূর
থেকে নগ্ন পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে সহস্র মাইল
বিক্ষত পায়ের রক্তে রাঙা গ্রাম্য পথের আইল
পীচঢালা শহর, শোকার্ত রমনা ও সূত্রাপুর।
সে-রাতে হায়েনা দিয়েছিল ঝাঁপ বাঙলা ভাষার
বুক লক্ষ্য করে। নখের আঁচড়ে করেছিল ক্ষত
মায়ের শরীর। কেঁদেছে মা সারারাত অবিরত।
দেখো কালসিটে, নখের আঁচড়, ঘৃণার পাহাড়।
ওরা নেমে এলো রাজপথে প্রতিবাদের অধিক
ভালোবাসা, ‘না, মানি না, মানবো না’ স্লোগানে মুখর।
স্বৈরশাহীর হুকুম, ‘চালাও গুলি, করে দাও স্তব্ধ।’
স্তব্ধ হয়েছিল বটে, বরকত, সালাম, রফিক,
জব্বার। রক্তের নদী প্রিয় মাটি, ঢাকার শহর
এভাবেই আমাদের হলো বাংলা ভাষা, প্রিয় শব্দ।
৪.
প্রভাতফেরী
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ কি হয়েছে বাবা?
কাকে বলে প্রভাতফেরী?
সাত-সকালে নগ্ন পায়ে কোথায় তুমি যাবা?
মা গো তখন বাংলাদেশের শাসক ছিল ভিন্ন
উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলাটা নিশ্চিহ্ন
এই মাটিতে তখন নাকি বাংলা ভাষার দিন না
এই ঘোষণা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের জিন্নাহ।
মায়ের ভাষা যাচ্ছে মুছে সে-তো হবার নয়
কেমন করে মানবে ওরা এমন পরাজয়?
প্রতিবাদে মুখর হলো ঢাকার সড়কগুলো
কিন্ত শাসক শুনলো না তা কর্ণে তাদের তুলো
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে উঠল দাবী শক্ত
ছাত্র যুবক ঢেলে দিলো বুকের তাজা রক্ত
রক্ত দিল বরকত এবং রফিক, সালাম, জব্বার
বাংলা ভাষা তাই হয়েছে বাংলাদেশের সব্বার
সালটা ছিল বাহান্ন আর ফেব্রুয়ারি মাস
একুশ তারিখ রক্তে লেখা ভাষার ইতিহাস।
তখন থেকে পবিত্র এই প্রাণের শহিদ মিনার
বিষণ্নতার সুর বাজে রোজ শোকের করুণ বীণার
সেই থেকে শোক বীর বাঙালীর মূল চেতনার শক্তি
ফুলে ফুলে আমরা জানাই ভালোবাসা, ভক্তি।
একুশ তারিখ সকালবেলা তাই করি না দেরি
ডাক দিয়েছে শহিদ মিনার ডাকছে প্রভাতফেরী…
৫.
এই ফাল্গুনে
আটই ফাল্গুন দিয়েছে “একুশ”
উপহার ব্রহ্মাণ্ডে
বসন্ত আজ ঘুমিয়ে পড়েছে
মৃত পলাশের কাণ্ডে।
শিমুলের ডালে কোকিল ডাকে না
কাকের দখলে পল্লব
সিরাজের আলখাল্লার নিচে
উঁমিচাদ রাজবল্লভ।
ভিনদেশি চিল, শকুন খাচ্ছে
মৃতদেহ গণতন্ত্রের
ক্ষমতার লোভে হার হয়ে গেছে
বিবেকের হৃৎযন্ত্রের।
বসন্ত শুধু ফুল ফোটাবার
ঋতু নয় এই বঙ্গে
রাঙা রাজপথে রক্তের ধারা
বরকত আছে সঙ্গে।
একুশের ভোর কেড়ে নেয় প্রাণ
রফিকেরা হলো ঝাঁঝরা
রক্তের দাগ মুছে দিয়ে আজ
রাজপথে দাঙাবাজরা।
বন্ধুর বেশে শত্রুকে চেনো
চিনে নাও প্রতিদ্বন্দ্বী
যখন ভ্রাতৃরক্তে খরিদ
গণতন্ত্রটা বন্দী।
এই ফাগুনের চেতনায় হোক
একুশের মূল মন্ত্র
স্বাধীন স্বদেশে চাই অধিকার
মানুষের গণতন্ত্র।
বাসন্তী শাড়ি ফুল গোঁজা চুল
দূরে থাক এই ফাগুনে
চাই উজ্জ্বল দাউ দাউ শিখা
স্বদেশপ্রেমের আগুনে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
৬.
একুশ ও বসন্ত
বাংলার বসন্ত কেন এতো লাল, এতোটা রঙিন?
একুশের রক্ত এসে মিশেছে এখানে, এই উদাসী ঋতুর মোহনায়;
ঢাকার উদ্দীপ্ত রাজপথ থেকে বরকতের পবিত্র রক্ত
নিয়ে আমাদের মেয়েরা কপালে পরে বসন্ত-সজ্জার লাল টিপ,
এখানে একুশ আর উজ্জ্বল ফাগুন মিলে নির্মাণ করেছে
নতুন মোহনা এক, চেতনার, প্রেম-বৈভবের।
অসাম্প্রদায়িকতার বৃষ্টি-স্নাত ততোধিক উজ্জ্বল নতুন এক জাতি
আত্মপ্রকাশ করেছে এই বঙ্গে, রক্তাভ ফাগুনে।
বসন্তের মুকুট আশ্চর্য দ্যুতি ছড়ায়, যখন
ঋতুচক্র-কুচকাওয়াজে রক্তের অক্ষর বেজে ওঠে,
বাজে একুশের তোপধ্বনি
বাংলার আকাশে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪