মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
কলকাতায় কিংবা কলকাতার বাইরে যে কোনো মফসসল শহরে বসেও বই পত্রপত্রিকার প্রকাশ এবং পরিবেশন আজ আর নতুন কোনো ঘটনা নয়।। তরুণ প্রকাশকেরা চোখ ঝলসানো স্মার্ট এক ফর্মার , পাতলা মলাট কবিতার বই প্রকাশ করে পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এরকম ঘটনা এখন সুবিদিত।
১৬ পাতার পাতলা মলাট পুস্তিকা বা পত্রপত্রিকার কথা বললে আমাদের মনে পড়ে পঞ্চাশের দশকের ‘শতভিষা’ সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার কথা, যেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল এক ফর্মা আকারে। এর সূচনা কখন থেকে? ‘শতভিষা’ ঘোষণা করেছিল সে পত্রিকা প্রকাশের পর থেকেই নাকি বাংলা ভাষায় একফর্মার কাগজ করার একটি প্রবণতা গড়ে ওঠে। এমন ঘোষণা থাকলেও আমরা দেখি ১৬ পাতার এক ফর্মার কবিতার বই বাংলা কবিতা পাঠকের হাতে প্রথম তুলে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেই তিরিশের দশকে। বাংলা কবিতাকে একটি সম্পন্ন মর্যাদায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সেই প্রণোদনা থেকেই ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রকাশ, ‘কবিতাভবন’ প্রতিষ্ঠা। এবং এই কবিতা ভবন থেকেই নানা সময়ে নানা ধরনের কবিতা প্রয়াস। এর আগে ১৯৩২ সালে ‘গ্রন্থকারমন্ডলী’ নামে একটি সমবায়িক প্রকাশনা গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। সেখান থেকে প্রথম পাতলা মলাট ১৬ পাতার এমনতর তন্বী কবিতা পুস্তিকার ধারণা।১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের আগে কবিতার স্থান ছিল সমকালীন অমনিবাসের পাতায় কোন গদ্যের নীচে,পাদপূরণ হিসেবে ।
কবিতাকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে শুধুমাত্র কবিতার জন্যই একটি পত্রিকা প্রকাশিত হল বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা। সেই প্রথম ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতা তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে একটি প্রচারক সত্তা ছিল। সমকালীন বাংলা কবিতার প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে একটি সম্পন্ন ভূমিকা তিনি প্রায় একাই গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কবিতাভবন থেকে শুধু কবিতা পত্রিকার প্রকাশ নয়, প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি কবিতার বই এবং সংকলন। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ অমিয় চক্রবর্তীর ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’, বুদ্ধদেব বসুর ‘দময়ন্তী’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ বুদ্ধদেব বসুর তত্ত্বাবধানেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর ছিল মার্জিত একটি রুচিবোধ। সমকালীন বাংলা কবিতার প্রকাশনাকে তিনি একটি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘কবিতা ভবন’
প্রকাশিত বই গুলির প্রত্যেকটি ছিল দৃষ্টিনন্দন শিল্প- শোভন প্রচ্ছদ সমৃদ্ধ রুচি স্নিগ্ধ প্রকাশনা।
বুদ্ধদেব বসু কবিতাকে তার প্রাপ্য মর্যাদায় যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তেমনি সব শ্রেণির পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। কবিতা বিষয়ে পাঠককে সচেতন করে তোলা এবং দীক্ষিত করে তোলা– এই উদ্দেশ্য এবং অভীপ্সা বুদ্ধদেব বসুর সামনে ছিল।
পাতলা মলাট ষোলপাতা একফর্মার কবিতার বইয়ের পরিকল্পনা ছিল এই অভীপ্সার অঙ্গ, ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ নামে।
এই নামের মধ্যেই ছিল একটা কৌতূহল আর অভিনবত্ব। দাম উল্লেখযোগ্য ভাবে কম রেখে কৌতূহলী পাঠকের হাতে কবিতাকে পৌঁছে দেওয়া ছিল এই সিরিজের প্রধান লক্ষ্য। সেই সঙ্গে ছিল ভাবনার অভিনবত্বে পাঠকের মধ্যে কবিতা বিষয়ে সচেতনতার একটি বোধ জাগ্রত করা।
যতদূর জানা যায় এই সিরিজের মোট ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ডিমাই সাইজের ষোলটি করে পৃষ্ঠা থাকতো প্রতিটি বইয়ে। প্রতি পৃষ্ঠার দাম এক পয়সা– এই হিসেবে ১৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দাম নির্ধারিত হয়েছিল চার আনা। সাধারণভাবে ১৬ পাতার প্রতি পৃষ্ঠায় থাকতো একটি করে কবিতা। এক পয়সায় একটি সিরিজে মোট ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত সেই বইগুলি র তালিকা টি দেখে নেওয়া যেতে পারে–
১.এক পয়সায় একটি : বুদ্ধদেব বসু ২. মাটির দেয়াল : অমিয় চক্রবর্তী ৩. সোনার কপাট : কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ৪. উড়কি ধানের মুড়কি: অন্নদাশঙ্কর রায় ৫. ২২শে শ্রাবণ: বুদ্ধদেব বসু ৬. ভানুমতীর মাঠ: অশোকবিজয় রাহা ৭.ওপারেতে কালোরং: সুধীরচন্দ্র কর ৮.মনপবন: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ৯. কয়েকটি নায়ক: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ১০. উলুখড়: বিমলচন্দ্র ঘোষ ১১. বনলতা সেন: জীবনানন্দ দাশ ১২. চন্দ্রকলা: বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৩.খোলা চিঠি: সমর সেন ১৪.কালো হরফ–অমল ঘোষ, ১৫. ভ্রমণ : হরপ্রসাদ মিত্র ১৬. রাজধানীর তন্দ্রা: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
১৭. ঘুমোও নগর: তড়িৎ কুমার সরকার, ১৮. গৈরিক : অনিলরঞ্জন বিশ্বাস।
আঠারো টি বইয়ের মধ্যে অন্তত চারটি বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। কোনো কোনো বইয়ের নতুন সংস্করণও হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনা থেকে। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কিংবা অশোকবিজয় রাহার ‘ভানুমতীর মাঠ’, অমিয় চক্রবর্তী র ‘মাটির দেয়াল’ কিংবা অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘উড়কি ধানের মুড়কি’-র স্মৃতি একালের পাঠক এখনো হয়তো ভুলে যায়নি।
বই প্রকাশের ব্যয়ভার সাধারণভাবে কবিরাই বহন করেছিলেন। সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রকাশনা এবং পরিবেশনার দায়িত্ব সামলাতেন বুদ্ধদেব বসু। কার বই প্রকাশিত হবে সেই নির্বাচনও ছিল বুদ্ধদেবের।
‘কবিতা’ পত্রিকার চৈত্র ১৩৪৮ সংখ্যায় কাদের বই প্রকাশিত হবে তার একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই তালিকার সবারই বই যে শেষ পর্যন্ত বেরিয়েছিল, তা অবশ্য নয়। যেমন তালিকায় নাম ছিল সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত,কান্তিচন্দ্র ঘোষ, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, হুমায়ুন কবীর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। শেষ পর্যন্ত এই তালিকা নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। এবং মূলত আর্থিক কারণে বেশি দিন এই সিরিজের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। তখন একফর্মার বই ছাপাতে খরচ পড়ত কুড়ি পঁচিশ টাকা। সে টাকাও অনেক কবির পক্ষেই যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। আবার কবিতাকে এত সুলভ করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা কবিদের কেউ কেউ তা পছন্দ করেননি। সুমিতা চক্রবর্তী অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে শুনেছিলেন বিষ্ণু দে কবিতা কে এমনতর সুলভ দেখতে চাননি। বুদ্ধদেব বসুর পরিকল্পনাকে টিপ্পনী কেটে বিষ্ণু দে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ বুদ্ধদেববাবুর তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। পাঠকেরা এক পয়সা দিয়ে নিয়ে যাবে এক একটি বই।’…
তবু মোটের উপর ‘এক পয়সায় একটি’ কবিতা সিরিজ সমকালীন কবিদের কাছে, সমালোচকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল অবশ্যই। ‘কবিতা’-র ১৩৪৮ চৈত্র সংখ্যায় এই পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বুদ্ধদেব বসু এই সিরিজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে লিখেছিলেন,
“… সম্প্রতি আমরা এই উদ্দেশ্য নিয়েই কবিতার একটি সুলভ গ্রন্থমালা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছি। এই গ্রন্থমালার নাম ‘এক পয়সায় একটি’। এই নামটিতে বেশকিছু বিদ্রূপ কিছু হয়তো ঔদ্ধত্য আছে। তা থাক। কিন্তু নামটির সার্থকতা এইখানে যে ১৬ পৃষ্ঠার এক একটি কবিতার বই সুন্দর মলাট দিয়ে চারআনা মূল্যে প্রকাশ করা হবে। একটি সম্পূর্ণ কবিতার বই চারআনা মূল্যে যে কোন শ্রেণীর পাঠকই অনায়াসে কিনতে পারবেন এ কথা মনে রেখেই আমাদের এই উদ্যম।”
বুদ্ধদেব বসুর এই পরিকল্পনার পিছনে কোনো প্রভাব কি কাজ করেছিল? বুদ্ধদেব বসুর লেখায় কোথাও তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘শনিবারের চিঠি’-র সম্পাদক অবশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর এই প্রয়াসের পিছনে পাশ্চাত্য প্রভাব। সেই সূত্র ধরে অনেকেই জেমস জয়েসের একটি কাজের সঙ্গে এ পরিকল্পনার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। ১৯২৭ এ প্রকাশিত হয়েছিল জেমস জয়েসের তেরোটি কবিতার সংকলন ‘পোমস পেনিইচ’ (POMES PENYeach) জয়েস খানিকটা বিদ্রূপ মিশিয়ে ‘poems’ এর পরিবর্তে লিখেছিলেন ‘pomes’। এবং ‘penny’ শব্দ টির সঙ্গে ‘each’ যুক্ত করে নিজস্ব বানানে লিখেছিলেন ‘PENYeach’.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বে সস্তা দামে যেমন বিকোচ্ছে সব কিছু। বুদ্ধদেবের পরিকল্পনাটিও ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত চল্লিশের দশকে। মানুষের জীবনযাপনের সব কিছুর সঙ্গেই কাগজ কলম কালিও যখন অগ্নিমূল্য।
এই সিরিজের প্রথম বই বুদ্ধদেব বসুর ‘এক পয়সায় একটি’ প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ এ। আর শেষ বই অনিলরঞ্জন বিশ্বাস এর ‘গৈরিক’ প্রকাশিত হয়েছিল জুন ১৯৪৪এ। এই বইটি ছিল এই সিরিজের আঠারো সংখ্যক বই এবং শেষ বই। এরপরে সিরিজটি বুদ্ধদেব আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। যদিও সিরিজটি যে বন্ধ করে দেওয়া হল এমন ঘোষণাও কোথাও করা হয়নি। শেষ অবধি সিরিজটি কবিতা প্রেমীদের কাছে যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সমকালীন পত্রপত্রিকায় অন্তত ২২টি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল, এই সিরিজের বিভিন্ন বই নিয়ে। এবং প্রায় সর্বত্রই কবিতা প্রয়াসটি প্রশংসিত হয়। সমালোচনাগুলি অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা’ পত্রিকার পাতায়। অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে ‘পরিচয়’,’চতুরঙ্গ’, ‘একক’, ‘শনিবারের চিঠি’। এসব কাগজে প্রকাশিত বইগুলির প্রশংসাই করা হয়েছিল। অবশ্য সজনীকান্ত দাস এক পয়সায় একটি কবিতার পরিকল্পনাকে বিদ্রূপই করেছিলেন আধুনিক কবিতাকে সস্তায় বিক্রি হতে দেখে। তাঁর ভাষায়,”আধুনিক কবিকুল যে দো দো পয়সা দামের সূঁচ মাথার কাঁটা অথবা হাতে মাটি সাবানের চাইতেও সস্তায় কবিতা ছাড়িতে পারিতেছেন সমাজের পক্ষে ইহা কম কল্যাণকর নয়।”অবশ্য সজনীকান্ত দাসের এই বিদ্রূপ সমকালীন কবিতা পাঠককে খুব যে প্রভাবিত করতে পেরেছিল তা বলা যায়না। বরং এই সিরিজ কবিতা পাঠকের কাছে যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন ‘চিনি দেশলাই জামাকাপড় ক্রমশ অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য হয়ে উঠছে’ এমন দুর্দিনেও বাঙালি যে কাব্যপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং পরপর এমন কবিতার সিরিজ প্রকাশ হওয়ার মতো ‘দুর্ঘটনা’ ঘটতে পারছে– তাকে দুহাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিলেন কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিতাপ্রেমী সমালোচকেরা।