অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
রোববার সন্ধ্যা: আমি কলকাতা হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছি। সত্যি বলতে কি, ১৮ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাদের বেয়নেট দিয়ে যে যজ্ঞ চালিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার পর পৃথিবীতে আমার অন্তিম ইচ্ছা এটাই ছিল যে, এই ঘৃণ্য নগরীতে আমি আর পা ফেলব না — এমন একটি সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সম্পাদকের ইচ্ছা যে, আমি মুজিবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ভূট্টো তাকে মুক্তি দেওয়ার পর আমার সম্পাদকের এই সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। তিনি কি ধরনের মানুষ? আমার সহকর্মীরা স্বীকৃতি দিলেন, তিনি মহান এক ব্যক্তি, সুপারম্যান। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দেশকে সমস্যামুক্ত করে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে পারেন।
আমার স্মরণ হলো ১৮ই ডিসেম্বর আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন লোকজন বলছিল, “মুজিব থাকলে সেই নির্মম, ভয়ঙ্কর ঘটনা কখনোই ঘটত না। মুজিব প্রত্যাবর্তন করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।” কিন্তু গতকাল মুক্তিবাহিনী কেন আরও ৫০ জন নিরীহ বিহারিকে হত্যা করেছে?” ‘টাইম’ ম্যাগাজিন কেন তাকে নিয়ে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে হেডলাইন করেছে? আমি বিস্মিত হয়েছি যে, এই ব্যক্তিটি ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক অ্যালডো শানতিনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার দেশে আমিই সবচেয়ে সাহসী এবং নির্ভীক মানুষ। আমি বাংলার বাঘ, দিকপাল — এখানে যুক্তির কোনো স্থান নেই —।” আমি বুঝে উঠতে পারিনি যে আমার কি ভাবা উচিত।
সোমবার বিকেল: আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এবং আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব দ্বিগুণেরও বেশি। ঘটনাটা হলো, আমি মুজিবকে দেখেছি। যদিও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে তাকে একনজর দেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু এই কয়েকটি মুহূর্তই আমার চিত্তকে দ্বিধা ও সংশয়ে পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, তখন কার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল? তিনি আর কেউ নন, মি. সরকার। আমার শেষবার ঢাকা অবস্থানকালে এই বাঙালি ভদ্রলোক আমার দোভাষী ছিলেন। তাকে দেখলাম রানওয়ের মাঝখানে। আমি ভাবিনি, কেন? সম্ভবত এর চেয়ে ভালো কিছু তার করার ছিল না।
আমাকে দেখামাত্র তিনি জানতে চাইলেন যে, আমার জন্য তিনি কিছু করতে পারেন কিনা। তাকে জানালাম, তিনি আমাকে মুজিবের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি আমাকে নিয়ে যাত্রা করলেন এবং পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা একটি গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। গেটে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানধারী সদস্যের কড়া প্রহরা। আমরা রান্নাঘরে প্রবেশ করে দেখলাম মুজিবের স্ত্রী খাচ্ছেন। সাথে খাচ্ছে তার ভাগনে ও মামাতো ভাইবোনেরা। একটি গামলায় ভাত-তরকারি মাখিয়ে আঙুল দিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে সবাই। এদেশে খাওয়ার পদ্ধতি এরকমই।
ঠিক তখনই মুজিব এলেন। সহসা রান্নাঘরের মুখে তার আবির্ভাব ঘটল। তার পরনের এক ধরনের সাদা পোষাক, যা দেখে তাকে আমার মনে হয়েছিল, যেন তিনি প্রাচীন আমলের একজন রোমান। পোষাকের কারণে তাকে দীর্ঘ ও ঋজু মনে হচ্ছিল। তার বয়স একান্ন বছর হলে তিনি সুপুরুষ। ককেশীয় ধরনের সুন্দর চেহারা। চশমা ও গোঁফে সে চেহারা হয়েছে আরও বুদ্ধিদীপ্ত। যে কারও মনে হবে, তিনি বিপুল জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
আমি সোজা তার কাছে গিয়ে পরিচয় পেশ করলাম এবং আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। মি. সরকার ভূমিতে পতিত হয়ে মুজিবের পদচুম্বন করলেন। আমি মুজিবের হাতটি আমার হাতে নিয়ে বললাম, “এই নগরীতে আপনি ফিরে এসেছেন দেখে আমি আনন্দিত, যে নগরী আশঙ্কা করছিল যে আপনি আর কোনোদিন এখানে ফিরবেন না।” তিনি আমার দিকে তাকালেন খানিকটা উষ্মার সঙ্গে। একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, “আমার সেক্রেটারির সাথে কথা বলো।”
আমার দ্বিধা ও সন্দেহের কারণ উপলব্ধি করা সহজ। মুজিবকে আমি জেনে এসেছি একজন গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী হিসেবে। যখন আমি দম নিচ্ছিলাম, একজন তরুণ আমার কাছে এসে বললেন যে, তিনি ভাইস সেক্রেটারি। বিনয়ের সঙ্গে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, বিকেল চারটার সময় আমি যদি ‘সরকারি বাসভবনে’ হাজির হতে পারি, তাহলে আমাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হবে। তার সঙ্গে যারা সাক্ষাৎ করতে চান, তাদের সঙ্গে তিনি সেখানেই কথা বলে নেন। বিকেল সাড়ে তিনটায় নগরী ক্লান্ত, নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত মধ্যাহ্নের বিশ্রাম নিচ্ছে। কাঁধে রাইফেল ঝোলানো মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে।
একমাসের বেশি সময় আগে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও তাদের হাতে অস্ত্র রয়ে গেছে। তারা দিনরাত টহল দেয়। এলোপাতারি গুলি ছোঁড়ে এবং মানুষ হত্যা করে। হত্যা না করলে তারা দোকানপাট লুট করে। কেউ তাদের থামাতে পারে না। এমনকি মুজিবও না। সম্ভবত তিনি তাদের থামাতে সক্ষম নন। তিনি এজন্য সন্তুষ্ট যে নগরীর প্রাচীরগুলো তার পোস্টার আকারের ছবিতে একাকার। মুজিবকে আমি আগে যেভাবে জেনেছিলাম, তার সঙ্গে আমার দেখা মুজিবকে মেলাতে পারছি না।
সোমবার সন্ধ্যা: আমি যে তার সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছি, এটাও ছিল এক দুর্বিপাক। তার মানসিক যোগ্যতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল। এমন কি হতে পারে যে, কারাগার এবং মৃত্যু সম্পর্কে তার ভীতি তার মস্তিস্ককে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে? তার ভারসাম্যহীনতাকে আমি আর কোনোভারেবই ব্যাখ্যা করতে পারি না। একই সাথে আমি একথাও বলতে চাই যে, কারাগার এবং মৃত্যুর ভয় ইত্যাদি —– সম্পর্কে কাহিনিগুলো আমার কাছে এখনও খুব স্পষ্ট নয়। এমন কি হতে পারে, যে রাতে তাকে গ্রেফতার করা হলো, সেই রাতে সকল পর্যায়ের লোকজনকে হত্যা করা হয়েছিল? কীভাবে এমন হতে পারে যে, তাকে কারাগারের একটি প্রকোষ্ঠ থেকে পলায়ন করতে দেওয়া হলো, যেটি তার সমাধি সৌধ হতে পারত? তিনি কি গোপনে ভূট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন? আমি যত তাকে পর্যবেক্ষণ করেছি, তত মনে হয়েছে, তিনি কিছু একটা আড়াল করছেন। এমনকি তার মধ্যে যে সার্বক্ষণিক আক্রমণাত্মক ভাব, সেটিকে আমার মনে হয়েছে তার আত্মরক্ষার কৌশল।
ঠিক চারটায় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ভাইস সেক্রেটারি আমাকে করিডোরে
বসতে বললেন, যেখানে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক ঠাসাঠাসি করে বসে ছিল। তিনি অফিসে প্রবেশ করে মুজিবকে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে জানালেন। আমি ভয়ঙ্কর একটি গর্জন শুনতে পেলাম এবং নিরীহ লোকটি কম্পিতভাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে আমাকে প্রতীক্ষা করতে বললেন। আমি প্রতীক্ষা করলাম — এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা, চার ঘন্টা — যখন রাত আটটা বাজলো, তখনও আমি সেই অপরিসর করিডোরে অপেক্ষমান। রাত সাড়ে আটটায় আমাকে প্রবেশ করতে বলা হলো। আমি বিশাল এক কক্ষে প্রবেশ করলাম। একটি সোফা ও দুটি চেয়ার ছিল সেই কক্ষে। মুজিব সোফার পুরোটায় নিজেকে বিস্তার করেছেন এবং দু’জন মোটা মন্ত্রী চেয়ার দখল করে বসে আছেন। কেউ দাঁড়ালেন না। কেউ আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন না। কেউ আমার উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করলেন না। মুজিব আমাকে বসতে বলার সৌজন্য প্রদর্শন না করা পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় সেখানে নীরবতা বিরাজ করছিল। আমি সোফার ক্ষুদ্র প্রান্তে বসে টেপ রেকর্ডার খুলে প্রথম প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আমার সে সময়টুকুও ছিল না। মুজিব চিৎকার শুরু করলেন: “হ্যারি আপ, কুইক! আন্ডারস্ট্যান্ড! নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার! — পাকিস্তানিরা ত্রিশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!?”
আমি বললাম, “মি. প্রাইম মিনিস্টার —?” মুজিব আবার চিৎকার শুরু করলেন: “ওরা আমার নারীদের তাদের স্বামী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করেছে। স্বামীদের হত্যা করেছে তাদের ছেলে ও স্ত্রীর সামনে। মা-বাপের সামনে ছেলেকে; ভাইবোনের সামনে ভাইবোনকে —।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার, — আমি বলতে চাই —।”
“তোমার কোনো কিছু চাওয়ার অধিকার নেই। ইজ দ্যাট রাইট!”
“আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো, একটি বিষয় সম্পর্কে আমি আরও কিছু জানতে চাই।” বিষয়টি আমি বুঝতে পারছিলাম না। “মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনাকে গ্রেফতারের সময় কি আপনার ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল?”
“নো ম্যাডাম, নো। তারা জানতো, ওতে কিছু হবে না। তারা আমার বৈশিষ্ট, আমার শক্তি, আমার সম্মান, আমার মূল্য, বীরত্ব সম্পর্কে জানতো। আন্ডারস্ট্যান্ড?’
“তা বুঝলাম। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেনযে তারা আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে? ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?”
“নো, নো ডেথ সেন্টেন্স।”
এই পর্যায়ে তাকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো এবং তিনি গল্প বলতে শুরু করলেন: “আমি এটা জানতাম। কারণ ১৫ই ডিসেম্বর ওরা আমাকে কবর দেওয়ার জন্য একটি গর্ত খনন করে।
“কোথায় খনন করা হয়েছিল সেটি?”
“আমার সেলের সামনে।”
“আমাকে কি বুঝে নিতে হবে যে, গর্তটা ছিল আপনার সেলের ভেতরে?”
“ইউ মিসআন্ডারস্ট্যান্ড।”
“আপনার প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে, মি. প্রাইম মিনিস্টার?”
“আমাকে একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল। এমনকি আমাকে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দেওয়া হতো না। সংবাদপত্র পাঠ করতে বা চিঠিপত্রও দেওয়া হতো না, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
“তাহলে আপনি কি করেছেন?”
“আমি অনেক চিন্তা করেছি। পড়াশোনা করেছি।”
“আপনি কি পড়েছেন?”
“বই এবং অন্যান্য জিনিস।”
“তাহলে আপনি কিছু পড়েছেন?”
“হ্যাঁ, কিছু পড়েছি।”
“কিন্তু আমার ধারণা হয়েছিল, আপনাকে কোনোকিছু পড়তে দেওয়া হয়নি।”
“ইউ মিসআন্ডারস্টুড।”
“তা বটে মি. প্রাইম মিনিস্টার। কিন্তু এটা কি করে হলো যে, শেষ পর্যন্ত ওরা আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলালো না.”
“জেলার আমাকে সেল থেকে পালাতে সহায়তা করেছেন এবং তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।”
“কেন, তিনি কি কোনো নির্দেশ পেয়েছিলেন?”
“আমি জানি না। এ ব্যাপারে আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলিনি এবং তিনিও আমার সঙ্গে কিছু বলেননি।”
“নীরবতা সত্ত্বেও কি আপনারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি আমাকে সাহায্য করতে চান।”
“তাহলে আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছেন?”
“হ্যাঁ, আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি।”
“আমি ভেবেছিলাম, আপনি কারও সঙ্গেই কথা বলেননি।”
“ইউ মিসআন্ডারস্টুড।”
“তা হবে মি. প্রাইম মিনিস্টার। যে লোকটি আপনার জীবন রক্ষা করলো, আপনি কি তার প্রিিত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন না?”
“এটা ছিল ভাগ্য। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি।”
এরপর তিনি ভূট্টো সম্পর্কে কথা বললেন। এ সময় তার কথায় কোনো স্ববিরোধিতা ছিল না। বেশ সতর্কতার সঙ্গেই বললেন তার সম্পর্কে। মুজিব আমাকে জানালেন, ২৬ ডিসেম্বর ভূট্টো তাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া। তার ভাষায়: “ভূট্টো একজন ভদ্রলোকের মতোই ব্যবহার করেছেন। তিনি সত্যিই একজন ভদ্রলোক।” ভূট্টো তাকে বলেছিলেন যে, একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য মুজিব ব্ল্যাক আউট ও যুদ্ধবিমানের গর্জন থেকে বরাবরই যুদ্ধ সম্পর্কে আঁচ করেছেন। ভূট্টো তার কাছে আরও ব্যাখ্যা করেন যে, এখন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং তার কাছে কিছু প্রস্তাব পেশ করতে চান।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “কি প্রস্তাব মি. প্রাইম মিনিস্টার?” তিনি উত্তর দিলেন, “হোয়াই শ্যুড আই টেল ইউ? এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রাইভেট অ্যাফেয়ার।”
“আমার কাছে বলার প্রয়োজন নেই, মি. প্রাইম মিনিস্টার। আপনি বলবেন ইতিহাসের কাছে।”
মুজিব বললেন, “আমিই ইতিহাস। আমি ভূট্টোকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে যদি মুক্তি না দেওয়া হয়, তাহলে আমি আলোচনা করবো না। ভূট্টো অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আপনি মুক্ত, যদিও আপনাকে শীঘ্র ছেড়ে দিচ্ছি না। আপনাকে আরও দুই বা তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে।’ এরপর ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তার পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করলেন। আমি অহঙ্কারের সঙ্গে তাকে জানালাম, আমি আমার দেশবাসীর সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি না।”
এই পর্যায়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “তাহলে তো কেউ বলতেই পারে যে, আপনাদের আলোচনা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে হয়েছিল?”
“তা তো অবশ্যই। আমরা একে অন্যকে ভালোভাবে জানি। আলোচনা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তা হয়েছিল আমার জানার আগে যে পাকিস্তানিরা আমার জনগণের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়েছে। আমি জানতাম না যে, তারা আমার মা-বোনকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছে।”
আমি তাকে থামিয়ে বললাম, “আমি জানি মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি জানি।”
তিনি গর্জে উঠলেন, “তুমি কিছুই জানো না। আমি জানতাম না যে তারা আমার স্থপতি, আইনবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিজ্ঞানি, আমার চাকরকে হত্যা করেছে এবং আমার বাড়ি, জমি, সম্পত্তি ধ্বংস করেছে, আমার —।”
তিনি যখন তার সম্পত্তির অংশে পৌছলেন, তার মধ্যে এমন একটি ভাব দেখা গেল, যা থেকে তাকে এই প্রশ্নটি করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম যে, তিনি সত্যিই একজন সমাজতন্ত্রী কিনা। তিনি উত্ত্র দিলেন, “হ্যাঁ ÑÑ।” তার কণ্ঠে দ্বিধা। তাকে আবারও বললাম যে, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি কি বোঝেন? তিনি উত্তর দিলেন, “সমাজতন্ত্র!” তাতে মনে হলো, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা নেই।
এরপর ১৮ই ডিসেম্বরের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি রাগে ফেটে পড়লেন।
নিচের অংশটুকু আমার টেপ রেকর্ডার থেকে নেয়া:
“ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?”
“ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি।”
“ঢাকা স্টেডিয়ামে কোনো ম্যাসাকার হয়নি। তুমি মিথ্যা বলছো।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরও সাংবাদিক এবং পনেরো হাজার লোকের সঙ্গে আমি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সেই ঘটনার ছবিও দেখাবো। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।”
“মিথ্যাবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার, দয়া করে ‘মিথ্যাবাদী’ শব্দটি আর উচ্চারণ করবেন না। ওরা মুক্তিবাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল।”
“তাহলে হয়তো ওরা রাজাকার ছিল, যারা প্রতিরোধের বিরোধিতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছে।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার কেউ প্রমাণ করেনি যে লোকগুলো রাজাকার ছিল এবং কেউই প্রতিরোধের বিরোধিতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। তাদের হাত-পা বাঁধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না।”
“মিথ্যাবাদী।”
“শেষবারের মতো বলছি, আমাকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলার অনুমতি আপনাকে দেব না।”
“আচ্ছা, সে অবস্থায় তুমি কি করতে?”
“আমি নিশ্চিত হতাম যে, ওরা রাজাকার ও অপরাধী। ফায়ারিং স্কোয়াডে দিতাম এবং এভাবেই এই ঘৃন্য হত্যাকান্ড এড়াতাম।”
“ওরা ওভাবে করেনি। হয়তো আমার লোকদের কাছে বুলেট ছিল না।”
“হ্যাঁ, তাদের কাছে বুলেট ছিল। প্রচুর বুলেট ছিল। এখনও তাদের কাছে প্রচুর বুলেট রয়েছে। তা দিয়ে তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলি ছোঁড়ে। ওরা গাছে, মেঘে, আকাশে, মানুষের প্রতি গুলি ছোঁড়ে শুধু আনন্দ করার জন্য।”
এরপর কি ঘটলো। যে দুই মোটা মন্ত্রী পুরো সাক্ষাৎকারের সময় ধরে ঘুমোচ্ছিলেন, তারা সহসা জেগে উঠলেন। আমি বুঝতে পারলাম না যে মুজিব কি বলে চিৎকার করছেন। কারণ কথাগুলো ছিল বাংলায়।
সোমবার রাত: গোটা ঢাকা নগরী জেনে গেছে যে, মুজিব এবং আমার মধ্যে কি ঘটেছে। শমসের ওয়াদুদ নামে একজন লোক ছাড়া আমার পক্ষে আর কেউ নেই। তিনি মুজিবের বড়ো বোনের ছেলে। এই যুবক নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন তার মামার কাছে। তার মতে মুজিব ক্ষমতালোভী এবং নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণকারী অহঙ্কারী ব্যক্তি। তার মামা খুব মেধা সম্পন্ন নন। বাইশ বছর বয়সে মুজিব হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছেন। তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতির সচিব হিসেবে। এছাড়া আর কিছু করেননি তিনি। কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারেনি যে মুজিব দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। শমসের ওয়াদুদের মতে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তার দুর্ব্যবহারের কারণ এটা নয়। আসলে একমাত্র ওয়াদুদের মাকেই মুজিব ভয় করেন। এই দু:খজনক আচরণের জন্য তিনি পারিবারিকভাবে প্রতিবাদ জানাবেন। তিনি আরও জানান যে, আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে কা তিনি তার মাকে জানাবেন, যাতে তিনি এ ব্যাপারে মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আমাকে আরও বলেন যে সরকারি দফতরে গিয়ে আমার এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানো উচিত এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলা উচিত। কারণ প্রেসিডেন্ট খাঁটি ভদ্রলোক।
মুজিব সম্পর্কে আমার সংগ্রহ করা তথ্যগুলো তার জন্য বিপর্যয়কর। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো ঢাকায় এসেছিলেন। ইয়াহিয়া খান যথাশীঘ্র ফিরে যান। কিন্তু ভূট্টো ঢাকায় রয়ে যান। তাকে রাখা হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তার রুম ছিল ৯১১-৯১৩।
ইন্টারকন্টিনেন্টালের সর্বোচ্চ তলায় তখন ভূট্টো ভূমিকা ছিল নিরোর মতো। নগরী যখন জ্বলছিল এবং এলোপাতারি গুলি চলছিল, ভূট্টো তখন মদ্যপান করছিলেন আর হাসছিলেন। পরদিন সকাল ৭টায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। আমি দেখেছি, যারা একসময় পাকিস্তানিদের ভয়ে ভীত ছিল, তারা এখন মুজিবকেই ভয় পায়। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচুর কথাবার্তা চলে এদেশে। কিন্তু সবসময়ই তা বলা হয় ফিসফিসিয়ে, ভয়ের সঙ্গে। লোকজন বলাবলি করে যে, এই সংঘাতে মুজিব খুব সামান্যই হারিয়েছেন। তিনি ধনাঢ্য ব্যক্তি। অত্যন্ত ধনবান। তার প্রত্যাবর্তনের দিন তিনি সাংবাদিকদের হেলিকপ্টার দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কি জানে, কেন? যাতে তারা নিজেরা গিয়ে মুজিবের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি অবলোকন করে আসতে পারে। এখনও তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেন। তিনি কি তার জমিজমা, বাড়ি, বিলাসবহুল ভিলা, মার্সিডিজ গাড়ি জাতীয়করণ করবেন?
ভূট্টোর সঙ্গে মুজিবের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৬৫ সালে, যখন তিনি ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তকে অরক্ষিত রাখার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার মূল্য ছিল খুবই কম। তার একমাত্র মেধা ছিল মূর্খ লোকজনকে উত্তেজিত করে তোলার ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন কথামালা ও মিথ্যাকথনের জাদুকর। কিছুদিন আগে এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেছিলেন, “করাচির রাস্তাগুলো সোনা দিয়ে মোড়ানো। করাচির রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।” অর্থনীতির কিছুই বুঝতেন না তিনি। কৃষি ছিল তার কাছে রহস্যের মতো। রাজনীতি ছিল প্রস্তুতিবিহীন। কেউ কি জানে যে ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি কেন বিজয়ী হয়েছিলেন? কারণ সব মাওবাদীরা তাকে ভোট দিয়েছিল। সাইক্লোনে মাওবাদীদের অফিস বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ভাসানী আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জনগণকে যদি পুনরায় ভোট দিতে বলা হয়, তাহলে মুজিবের অবস্থা ভিন্নতর হবে, যদি তিনি বন্দুকের সাহায্যে তার ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে না চান। সেজন্যই তিনি মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সমর্পনের নির্দেশ দিচ্ছেন না এবং আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, রক্তপিপাসু কশাই, যে ঢাকা স্টেডিয়ামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই আবদুল কাদের সিদ্দিকী মুজিবের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা। ভারতীয়রা তাকে গ্রেফতার করেছিল, কিন্তু মুজিব তাকে মুক্ত করেন।
এখন আমরা গণতন্ত্রের কথায় আসতে পারি। একজন মানুষ কি গণতন্ত্রী হতে পারেন, যদি তিনি বিরোধিতা সহ্য করতে না পারেন? কেউ যদি তার সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে তিনি তাকে ‘রাজাকার’ বলেন। বিরোধিতার ফল হতে পারে ভিন্নমত পোষণকারীকে কারাগারে প্রেরণ। মুজিবের চরিত্র একজন একনায়কের। অসহায় বাঙালিরা উত্তপ্ত কড়াই থেকে গনগনে অগ্নিকুন্ডে পতিত হয়েছে। বাঙালি রমণীদের প্রতি সম্মান জানিয়েই আমি বলছি, তাদের সম্পর্কে কথা না বলাই উত্তম। মুজিব নারীদের পাত্তাই দেন না।
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবার আমাকে মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সব ব্যবস্থা পাকা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যে প্রচেষ্টা করেছিলেন তা খুব একটা সফল হয়নি। তিনি এই বলে মুজিবের কাছে দুজন অফিসারকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার নির্দেশ পালন করা হয়। তারা মুজিবের কাছে একটি হুঙ্কার ছাড়া আর কিছু পায়নি। তবে এবার করিডোরের পরিবর্তে একটি কক্ষে অপেক্ষা করার অনুমতি পেয়েছিলাম। আমি বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। একজন বয় আমার চায়ের কাপ পূর্ণ করে দিচ্ছিল এবং এভাবে আমি আঠারো কাপ চা নি:শেষ করলাম। উনিশ কাপের সময় আমি চা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে হেঁটে বের হয়ে এলাম। আমাকে অনুসরণ করে হোটেলে এলেন মুজিবের সেক্রেটারি ও ভাইস সেক্রেটারি। তারা বললেন, মুজিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আগামীকাল সকাল সাড়ে সাতটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
পরদিন সকাল ঠিক সাতটায় আমি হাজির হলাম। সকাল সাড়ে সাতটায় মার্সিডিজযোগে মুজিবের আগমণ পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। একটি কথাও না বলে তিনি অফিসে প্রবেশ করলেন। আমিও অফিসে ঢুকলাম। আমার দিকে ফিরে তিনি উচ্চারণ করলেন, “গেট আউট!”
আমি রুম ত্যাগ করতে উদ্যত। তিনি বললেন, “গেট ইন হিয়ার!” আমি ফিরলাম এবং তখনই তিনজন লোক পোস্টার আকৃতির একটি ছবি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। ছবি দেখে মুজিব মন্তব্য করলেন, “চমৎকার!” এরপর তিনি বললেন, “এই মহিলা সাংবাদিককে দেখাও। আমিও ‘চমৎকার’ শব্দটি উচ্চারণ করলাম। এটি ছিল আমার মারাত্মক ভুল। তিনি বজ্রের মতো ফেটে পড়লেন। তিনি ক্ষিপ্ত। ছবিটি ফ্লোরে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “এটি চমৎকার নয়!” আমি কিছু না বুঝে চুপ থাকলাম।
আমি তার উত্তেজনা প্রশমনে সক্ষম হলাম। যেহেতু ভূট্টোর সঙ্গে তার সত্যিকার সম্পর্কটি খুঁজে পেতে চাই সেজন্য তাকে ভূট্টো সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। নামটি বলার মুহূর্তেই তিনি জ্বলে উঠলেন। বললেন যে, তিনি শুধু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিতে চান। আমি প্রশ্ন করলাম, “বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গকে যুক্ত করার সম্ভাবনা আছে কিনা।” খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে তিনি বললেন, “এ সময়ে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই।” তার এ বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধীকেও বিস্মিত হতে হবে যে, মুজিব কলকাতা করায়ত্ত করতে চান। আমি বললাম, “এর মানে আপনি বলতে চান অতীতে আপনার আগ্রহ ছিল এবং ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচেনা করার সম্ভাবনা রয়েছে।” ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন যে আমি তাকে একটি ফাঁদে ফেলতে চাইছি। নিজের ভুল সংশোধন করার পরিবর্তে তিনি টেবিলে মুষ্টাঘাত করে বলতে শুরু করলেন যে, আমি কোনো সাংবাদিক নই; বরং সরকারি মন্ত্রী। আমি তাকে প্রশ্ন করছি না, দোষারূপ করছি।আমাকে এখনই বের হয়ে যেতে হবে এবং পুনরায় আমি যাতে এদেশে পা না রাখি।
এই পর্যায়ে আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম এবং আমার মাঝে উত্তেজনার যে স্তুপ গড়ে উঠেছিল তা বিস্ফোরিত হলো। আমি বললাম যে, তার সবকিছু মেকি, ভূঁয়া। তার পরিণতি হবে খুব ভয়াবহ। যখন তিনি মুখ ব্যাদান করে দাঁড়ালেন, আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম এবং রাস্তায় প্রথম রিকশাটায় চাপলাম। হোটেলে গিয়ে বিল পরিশোধ করলাম। স্যুটকেস হাতে নিয়ে যখন বের হতে যাচ্ছি, তখন দেখলাম মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা একথা বলতে বলতে আমার কাছে এলো যে, আমি দেশের পিতাকে অপমান করেছি এবং সেজন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হবে। তাদের এই গোলযোগের মধ্যে পাঁচজন অস্ট্রেলিয়ানের সাহায্যে আমি পালাতে সক্ষম হলাম। তারা এয়ারপোর্ট থেকে এসে হোটেলে প্রবেশ করছিলেন। এয়ারপোর্টে দুজন ভারতীয় অফিসার আমাকে বিমানে উঠিয়ে নিলেন। আমি নিরাপদ হলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯৭২
(ওরিয়ানা ফালাচি ইটালির বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন। বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তিনি খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। তার নেয়া সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন “ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি” জনপ্রিয় একটি গ্রন্থ। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফালাচি নিউইয়র্কে মারা যান।)