spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধঔপনিবেশিক শিক্ষাদর্শের বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ

লিখেছেন : মোরশেদ শফিউল হাসান

ঔপনিবেশিক শিক্ষাদর্শের বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ

মোরশেদ শফিউল হাসান 

***

“সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে  মুক্তিদান করে। এতদিন আমরা ইস্কুল-কলেজে যে শিক্ষা লাভ করিতেছিলাম তাহাতে আমাদিগকে পরাস্ত করিয়াছে। আমরা তাহা মুখস্থ করিয়াছি, আবৃত্তি করিয়াছি, শিক্ষালব্ধ বাঁধি বচনগুলিকে নিঃসংশয়ে চূড়ান্ত সত্য বলিয়া প্রচার করিতেছি। যে ইতিহাস ইংরেজি কেতাবে পড়িয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র ইতিহাসের বিদ্যা, যে পোলিটিক্যাল ইকনমি মুখস্থ করিয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র পোলিটিক্যাল ইকনমি। যাহা-কিছু পড়িয়াছি তাহা আমাদিগকে ভূতের মতো পাইয়া বসিয়াছে : সেই পড়া বিদ্যা আমাদের মুখ দিয়া কথা বলাইতেছে, বাহির হইতে মনে হইতেছে যেন আমরাই কথা বলিতেছি। আমরা মনে করিতেছি, পোলিটিক্যাল সভ্যতা ছাড়া সভ্যতার আর কোনো আকার হইতেই পারে না। আমরা স্থির করিয়াছি, য়ুরোপীয় ইতিহাসের মধ্য দিয়া যে পরিণাম প্রকাশ পাইয়াছে জাতিমাত্রেরই সেই একমাত্র সঙ্গতি। যাহা অন্য দেশের শাস্ত্রসম্মত তাহাকেই আমরা হিত বলিয়া জানি এবং আগাগোড়া অন্য দেশের প্রণালী অনুসরণ করিয়া আমরা স্বদেশের হিতসাধন করিতে ব্যগ্র।” রবীন্দ্রনাথ কথাগুলো লিখেছেন তাঁর ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রবন্ধে। ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ কলকাতা টাউন হলের এক সভায় পঠিত এবং ওই বছরই ‘বঙ্গদর্শন’-এর ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত অভিভাষণটিতে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “শিক্ষা আমাদিগকে পরাভূত করিয়া ফেলিয়াছে”। ‘অস্থিমজ্জার মধ্যে দাসখত বহন করে জন্মগ্রহণ করা’, ‘পরের দ্বারা তাড়িত না হয়ে’ কিছু করতে অক্ষম,  ‘শিক্ষার নিচে চাপা পড়া’ এ-অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তা ও আপন শক্তির চরম বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তিনি। জোর দিয়েছিলেন ‘পাণ্ডিত্যের বিদেশী বেড়ি ভেঙে ফেলে পরিণত জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া’র আবশ্যকতার ওপর। এ-ও বলেছিলেন, “পাঠ্যপুস্তকটির সঙ্গে আমাদের যে কথাটি না মিলিবে তাহার জন্য আমরা যেন লজ্জিত না হই। এমন-কি আমরা ভুল করিতেও সংকোচ বোধ করিব না। কারণ ভুল করিবার অধিকার যাহার নাই সত্যকে আবিস্কার করিবার অধিকারও সে পায় নাই। পরের শত শত ভুল জড়ভাবে মুখস্থ করিয়া রাখার চেয়ে সচেষ্টভাবে নিজে ভুল করা অনেক ভালো।” জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে অভিনন্দিত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “শিক্ষার দ্বারা আমরা যে পূর্ণপরিণত আমরাই হইব, আমরা যে ইংরেজি লেকচারের ফোনোগ্রাফ, বিলিতি অধ্যাপকের শিকল-বাঁধা দাঁড়ের পাখি হইব না, এই একান্ত আশ্বাস হৃদয়ে লইয়া আমি আমাদের নূতনপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যামন্দিরকে আজ প্রণাম করি।” এভাবে, সরাসরি ‘উপনিবেশ’ শব্দটি ব্যবহার না করেও, আমাদের মনোজগতে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং তা সৃষ্টিতে শিক্ষার মুখ্য ভূমিকা শনাক্ত ও তার সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিভিন্ন রচনায় বিশেষ করে শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলির ছত্রে ছত্রে যে-সচেতনতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা যথাসম্ভব তাঁর নিজ জবানীতেই তাঁর শিক্ষাচিন্তার অপেক্ষাকৃত স্বল্প-আলোচিত এই পরিচয়টি তুলে ধরতে চেষ্টা করব। 

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার একটি মূলকথা হল, শিশুবয়স থেকেই শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের যোগ থাকতে হবে। আনন্দহীন শিক্ষা শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের অনুকূল নয়। তাঁর মতে অত্যাবশ্যক শিক্ষার সঙ্গে স্বাধীন পাঠ না মিশালে ছেলে ছেলেই থেকে যায়, মানুষ হতে পারে না। আর আনন্দের সঙ্গে পড়তে পড়তে পড়বার শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পায়। (‘শিক্ষার হেরফের’, ১২৯৯) চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তি জীবনযাত্রা নির্বাহের পক্ষে এ-দুটিকে অত্যাবশ্যক গণ্য ক’রে তিনি বলেছেন, শিশু বয়সেই শিক্ষার্থীদের ওপর বিদেশী ভাষার বোঝা চাপানোর ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সত্যরাজ্যে প্রবেশ করবার অবকাশ থাকে না, সাহিত্যের কল্পনারাজ্যে প্রবেশের দ্বারও তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। (ঐ) তাঁর মতে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ‘স্মরণশক্তির ওপর সমস্ত ভর’ দিতে গিয়ে ‘চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর’ সৃষ্টির কর্তব্যটি উপেক্ষিত হচ্ছে। আর তার ফল যা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,  “স্তূপ উঁচা করিতেছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ করিতেছি না। … মাল-মশলা যাহা জড়ো হইতেছে তাহা প্রচুর …। মানসিক অট্টালিকা নির্মাণের উপযুক্ত এত ইঁট-পাটকেল পূর্বে আমাদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল না। কিন্তু সংগ্রহ করিতে শিখিলেই যে নির্মাণ করিতে শেখা হইল ধরিয়া লওয়া হয়, সেইটেই একটা মস্ত ভুল।” (ঐ) আমাদের প্রচলিত মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষার বাহন’(১৩২২) প্রবন্ধে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি  মন্তব্য করেছেন : “যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল?” মুখস্থ করে পাস করাকে চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “যারা বই মুখস্থ করিয়া পাস করে তারা অসভ্যরকমে চুরি করে, সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই?” বস্তুত আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই এই নকলনবিশির দৌরাত্ম্য রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন

    এক সময় আয়ারল্যাণ্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইউরোপে আদর্শস্থানীয় গণ্য করা হত। নানা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আয়ারল্যাণ্ডে  আসত পড়াশুনা করতে। সপ্তম থেকে মোটামুটি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই অবস্থাটা চালু ছিল। সে-সময় আয়ারল্যাণ্ডের বিদ্যালয়গুলোতে গ্রিক, লাতিন, হিব্রু প্রভৃতি ক্লাসিকাল ভাষাও শেখানো হতো। কিন্তু শেখানোর ভাষাটা অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যম ছিল আইরিস। বিষয়টির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষাসংস্কার’ (১৩১২)  প্রবন্ধে লিখেছেন, “গণিতজ্যোতিষ, ফলিতজ্যোতিষ এবং তখনকার কালে যে-সকল বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল তাহা আইরিশ ভাষা দ্বারাই শেখানো হইত, সুতরাং এ ভাষায় পারিভাষিক শব্দের দৈন্য হইত না।” পরে যখন সেখানে ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেয়া হল তখন তার ফল দাঁড়াল এই যে, “মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল, আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া।” রবীন্দ্রনাথের কাছে এই পরিণামটিকে মনে হয়েছে খুবই স্বাভাবিক, কারণ, “নিজে চিন্তা করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করিবার প্রণালী এক; আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজের জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ।” আয়ারল্যাণ্ডের ওই শিক্ষাসংকটের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার ‘একটা গভীর জায়গায় মিল’ খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মিলটা হল “বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে না, আমাদেরও শিক্ষাপ্রণালীতে কলের অংশ বেশি।” এই শিক্ষাপ্রণালীর বৈশিষ্ট্য বা সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করে একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন : 

এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমাদের উদ্ভাবনা শক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না। আমাদের ধারণাশক্তির বলিষ্ঠতা নাই। আমাদের ভাবাচিন্তা, আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র-অবস্থার ক্ষীণতাই বরাবর থাকিযা যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি তাহা হয় কোনো-না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার।

    সমাজের ভেতর থেকে তার নিজস্ব তাগিদে উঠে আসা পরিবেশানুকূল শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে স্রেফ পরানুকৃতি বা তার যান্ত্রিক প্রয়োগ, এর সমালোচনা রবীন্দ্রনাথ অন্যত্রও, যেমন তাঁর ‘শিক্ষাসমস্যা’ (১৩১৩) প্রবন্ধেও  করেছেন : 

ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল্। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন : ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়।

    আর এই মার্কামারা শিক্ষার ‘সুবিধা’ ও অসুবিধার দিক উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : 

কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে, ঠিক ফর্মাশ-দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায় : এক-কলের সঙ্গে আর-এক-কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়। 

   কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত। এমন-কি, একই মানুষের এক দিনের সঙ্গে আর-এক দিনের ইতর-বিশেষ ঘটে।

   তবু, মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। …

       … বিদ্যাশিক্ষার কারখানা-ঘরে জগৎকে আমরা একটা যন্ত্র বলিয়াই শিখিতে পারি।

অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও অসহযোগ বা বর্জননীতিকে সমর্থন করতে না পারলেও, ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পশ্চাত-উদ্দেশ্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো সংশয় ছিল না। স্পষ্টভাবেই তিনি লিখেছেন, “আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার যখন প্রথম পত্তন হইয়াছিল তখন তাহার লক্ষ্য ছিল এই যে, ব্রিটিশ ভারতের রাজ্যশাসন ও বাণিজ্যচালনের জন্য ইংরেজি-জানা দেশি কর্মচারী গড়িয়া তোলা।” (‘অসন্তোষের কারণ’, ১৩২৬) ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা তাদের নিজস্ব স্বার্থে প্রবর্তিত সেই শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকারই আমরা অদ্যাবধি বহন করে চলেছি। রবীন্দ্রনাথের ভাষা অনুসরণ করেই বলা যায়, “গোড়ায় যাঁরা এ দেশে তাঁদের রাজতক্তের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন করেছিলেন, দেখতে পাই, তাঁদেরও উত্তরাধিকারীরা বাইরের আসবাব এবং ইঁট-কাঠ-চুন-সুরকির প্যাটার্ন দেখিয়ে আমাদের ও নিজেদের ভোলোতে আনন্দ বোধ করেন।” (‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’. ১৩৪২) রবীন্দ্রনাথের মতে, “সকল পরাশ্রয়তার চেয়ে ভয়াবহ শিক্ষায় পরধর্ম।” (ঐ) আর তাই হয়তো শিক্ষাসমস্যাকেই তাঁর কাছে আমাদের ‘সর্বপ্রধান সমস্যা’ বলে মনে হয়েছে।” (‘শিক্ষার মিলন’, ১৩২৮)

    যে-কথাটা রবীন্দ্রনাথ বারবারই বলেছেন তা হল, ইংরেজি আমাদের জন্য বিদেশি বা পর ভাষা। আর ‘পরের ভাষায় গ্রহণ করাও শক্ত, প্রকাশ করাও কঠিন’ (‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, ১৩১২)। তা ‘আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা’ হতে পারে, ‘ভাবের ভাষা নয়’ (শি.হে.) আর দেশের শিক্ষাবিস্তারের পথেও একে, অর্থাৎ ইংরেজিকে এই মাধ্যম বা বাহন করাটাকেই তিনি ‘সর্বপ্রধান’ বাধা হিসেবে দেখেছেন। এ-বিষয়ে ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্য : “বিদ্যাবিস্তারের কথাটাকে যখন ঠিকমত মন দিয়া দেখি তখন তার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে তার বাহনটা ইংরেজি।” বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, “বিদেশী মাল জাহাজে করিয়া শহরের ঘাট পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিতে পারে, কিন্তু সেই জাহাজটাতে করিয়াই দেশের হাটে হাটে আমদানি রফতানি করাইবার দুরাশা মিথ্যা। যদি বিলিতি জাহাজটাকেই কায়মনে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাই তবে ব্যবসা শহরেই আটকাইয়া পড়িয়া থাকিবে।” এ-প্রসঙ্গে ‘মুখে যাই বলি, মনের মধ্যে’ শহরকেই আমাদের ‘দেশ বলে ধরে’ নেবার প্রবণতারও তিনি সমালোচনা করেছেন। (ঐ) শিক্ষায় ‘মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধে’র সঙ্গে তুলনা করেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হননি। দেশের ‘মনকে মানুষ’ করার ক্ষেত্রেও তাকে অপরিহার্য বিবেচনা করেছেন। বলেছেন পরের ভাষায় তা ‘কোনোমতেই সম্ভবপর নয়’। (ঐ) এ-প্রসঙ্গে তাঁর আরও মন্তব্য : “আমরা লাভ করিব, কিন্তু সে লাভ আমাদের ভাষাকে পূর্ণ করিবে না; আমরা চিন্তা করিব, কিন্তু সে চিন্তার বাহিরে আমাদের ভাষা পড়িয়া থাকিবে; আমাদের মন বাড়িয়া চলিবে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষা বাড়িতে থাকিবে না ─ সমস্ত শিক্ষাকে অকৃতার্থ করিবার এমন উপায় আর কী হইতে পারে!” (ঐ) তাঁর মতে ‘সকলের চেয়ে অনর্থকর কৃপণতা’ হল ‘বিদ্যাকে বিদেশী ভাষার অন্তরালে দূরত্ব দান করা।’ তিনি এর তুলনা করেছেন ‘ফসলের বড়োমাঠকে বাইরে শুকিয়ে রেখে টবের গাছকে আঙিনায় এনে জলসেচন করা’র সঙ্গে। (‘ছাত্রসম্ভাষণ’) বিদ্যাকে, উচ্চশিক্ষাকে ‘দেশের ভাষায় দেশের জিনিস’ করে নেবার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানের উদাহরণ দিয়েছেন, “পশ্চিম হইতে যা-কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল তার প্রধান কারণ, সেই শিক্ষাকে তারা দেশি ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে।” (শি.বা.) যদিও, তিনি বলেছেন, “জাপানি ভাষার ধারণাশক্তি আমাদের ভাষার চেয়ে বেশি নয়। নূতন কথা সৃষ্টি করিবার শক্তি আমাদের ভাষার অপরিসীম।” (ঐ) বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা সম্ভব নয়, এ রকম বক্তব্যকেও তিনি ‘অক্ষমের, ভীরুর ওজর’ বলে বাতিল করে দিয়েছেন। (ঐ) স্বীকার করেছেন যে কাজটা কঠিন, আর তার জন্য ‘কঠোর সংকল্প চাই’। (ঐ) ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধেই বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন : 

ক. মাতৃভাষা বাংলা বলিয়াই কি বাঙালিকে দণ্ড দিতেই হইবে? এই অজ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য সে চিরকাল অজ্ঞান হইয়াই থাক্, সমস্ত বাঙালির প্রতি কয়জন শিক্ষিত বাঙালির এই রায়ই কি বহাল রহিল? … মাতৃভাষা হইতে ইংরেজি ভাষার মধ্যে জন্ম লইয়া তবেই আমরা দ্বিজ হই?

খ. … অধিকাংশ বাঙালি ইংরেজি শিখিবে না। সেই লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষীদের জন্য বিদ্যার অনশন কিম্বা অর্ধাশনই ব্যবস্থা, এ কথা কোন্ মুখে বলা যায়?

গ. … যারা বাংলা জানে, ইংরেজি জানে না, বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় কি তাদের মুখে তাকাইবে না? এত বড়ো অস্বাভাবিক নির্মমতা ভারতবর্ষের বাহিরে আর কোথাও আছে?

ঘ. ভালোমত ইংরেজি শিখিতে পারিল না এমন ঢের ঢের ভালো ছেলে বাংলাদেশে আছে। তাদের শিখিবার আকাক্সক্ষা ও উদ্যমকে একেবারে গোড়ার দিকেই আটক করিয়া দিয়া দেশের শক্তির কি প্রভূত অপচয় করা হইতেছে না?

   মৃত্যুর চার বছর আগেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদবি বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এ দেশে অনেক কাল জানিয়ে আসতে হয়েছে যে, পরভাষার মধ্য দিয়ে পরিস্রুত শিক্ষায় বিদ্যার প্রাণীন পদার্থ নষ্ট হয়ে যায়।” একে তিনি ‘দুর্ভাগ্যদিনের সকলের চেয়ে দুঃসহ লক্ষণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন, যখন কিনা ‘স্বতঃস্বীকার্য সত্যকেও বিরোধের কণ্ঠে জানাতে হয়’। তিনি বলেছিলেন, “ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই শিক্ষার ভাষা ও শিক্ষার্থীর ভাষার মধ্যে আত্মীয়-বিচ্ছেদের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না। … বর্তমান কালে চীন জাপান পারস্য আরব তুরস্কে প্রাচ্যজাতীয়দের মধ্যে সর্বত্র এই ব্যর্থতাজনক আত্মবিচ্ছিন্নতার প্রতিকার হয়েছে, হয় নি কেবলমাত্র আমাদেরই দেশে।” (‘ছাত্রসম্ভাষণ’, ১৩৪৩)। বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রশ্নে যে (ক) উপযুক্ত অর্থাৎ মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক এবং (খ) প্রয়োজনীয় পরিভাষার অভাবের অজুহাত তোলা হয় তাকে নাকচ করে দিয়ে ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য : (ক) “শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রন্থ হয় কী উপায়ে? … শিক্ষাকে যদি শিক্ষাগ্রন্থের জন্য বসিয়া থাকিতে হয় তবে পাতার যোগাড় আগে হওয়া চাই তার পরে গাছের পালা, এবং কূলের পথ চাহিয়া নদীতে মাথায় হাত দিয়া পড়িতে হইবে।” এবং (খ) “দেশে এই পরিভাষা-তৈরির তাগিদ কোথায়? ইহার ব্যবহারের প্রয়োজন বা সুযোগ কই? দেশে টাকা চলিবে না অথচ টাঁকশাল চলিতেই থাকিবে, এমন আবদার করি কোন্ লজ্জায়?” 

   আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষা এদেশে বিদ্যার সঙ্গে জীবনের যথার্থ যোগ ঘটাতে পারেনি। কিন্তু যাঁরা মনে করেন এর একমাত্র কারণ বিদ্যাটা বিদেশী, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে একমত নন। স্পষ্টভাবেই তিনি বলেছেন, “এ কথা মানি না। যা সত্য তার জিয়োগ্রাফি নাই। … বস্তুত, যদি এমন কোনো ভালো থাকে যা একমাত্র ভারতবর্ষেরই ভালো তবে তা ভালোই নয়, এ কথা জোর করিয়া বলিব।” (শি.বা.) ‘আসল কথা’, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমাদের ‘আধুনিক শিক্ষা তার বাহন পায়নি।’ (শি.বা.) ভাবের সঙ্গে ভাষার, শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সংযোগ বা সামঞ্জস্য ঘটাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। (শি.হে.) আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান ত্রুটি, রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করেছেন, “বস্তুর সহিত বহির সহিত আমরা মিলাইয়া শিখিবার অবকাশ পাই না। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষা যে-সকল দৃষ্টান্ত আশ্রয় করে তাহা আমাদের দৃষ্টিগোচর নহে।” যেখানে “জ্ঞানশিক্ষা নিকট হইতে দূরে, পরিচিত হইতে অপরিচিতের দিকে গেলেই তাহার ভিত্তি পাকা হইতে পারে। যে বস্তু চতুর্দিকে বিস্তৃত নাই, যে বস্তু সম্মুখে উপস্থিত নাই, আমাদের জ্ঞানের চর্চা যদি প্রধানত তাহাকে অবলম্বন করিয়াই হইতে থাকে তবে সে জ্ঞান দুর্বল হইবেই।” এবং “আইডিয়া যত বড়োই হউক, তাহাকে উপলব্ধি করিতে হইলে একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ জায়গায় প্রথম হস্তক্ষেপ করিতে হইবে।” (ছা.প্র.স.)

    আধুনিক শিক্ষার নামে যে-ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য শিক্ষপদ্ধতির অনুকরণ এদেশে করা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে তা কাঠামো বা খোলসের নকল মাত্র। আর নকল কেবল বহিরঙ্গেরই হতে পারে, অন্তর্বস্তুর হয় না। পাশ্চাত্য শিক্ষার ভালো দিকগুলোও যে-কারণে আমাদের জীবনে ফলবতী হতে পারে না, আমাদের ভেতরের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারে না। উপরন্তু তা আমাদের ভারগ্রস্ত করে তোলে। এ-প্রসঙ্গে ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : “আমাদের বিলাতি বিদ্যাটা কেমন ইস্কুলের জিনিস হইয়া সাইনবোর্ডে টাঙানো থাকে, আমাদের জীবনের ভিতরের সামগ্রী হইয়া যায় না। তাই পশ্চিমের শিক্ষায় যে ভালো জিনিস আছে, তার অনেকখানি আমাদের নোট্বুকেই আছে; সে কি চিন্তায়, কি কাজে ফলিয়া উঠিতে চায় না।” ‘শিক্ষাসমস্যা’  প্রবন্ধেও তিনি লিখেছেন :

 … য়ুরোপের বিদ্যালয়ের অবিকল বাহ্য নকল করিলেই আমরা যে সেই একই জিনিস পাইব এমন নহে। এই নকলে সেই বেঞ্চি, সেই টেবিল, সেই প্রকার কার্যপ্রণালী সমস্তই ঠিক মিলাইয়া পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা আমাদের পক্ষে বোঝা হইয়া উঠে।

    আর এর অনিবার্য পরিণতি : “অধিকার লাভ করিতে গেলেই আমরা পরের কাছে হাত পাতি এবং গড়িয়া তুলিতে গেলেই আমরা নকল করিতে বসিয়া যাই – নিজের শক্তি এবং নিজের মনের দিকে, দেশের প্রকৃতি ও দেশের যথার্থ প্রয়োজনের দিকে তাকাই না, তাকাইতে সাহসই হয় না।” (ঐ)

    রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই আসলে বিদেশের ছাঁচে তৈরি। আর ডিগ্রি হলো মানুষের ‘নামের ওপর মার্কা মারার’ একটা সীলমোহর। ‘মানুষকে তৈরি করা নয়, মানুষকে চিহ্নিত করা তার কাজ’। (শি.বা.) তিনি লিখেছেন, “আমরা বিদ্যা পাই বা না পাই বিদ্যালয়ের একটা ছাঁচ পাইয়াছি।” (ঐ) বাঙালির একটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য উলে¬খ করে তিনি বলেছেন, “আমাদের মুশকিল এই যে আমরা চিরদিন ছাঁচের উপাসক। … এই ছাঁচ-দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি আমাদের মজ্জাগত।” (ঐ) ফলে, তিনি মনে করেছেন ‘গোড়া হতে ছাঁচ বদল করা সহজ কাজ নয়’। এ-অবস্থায় ‘সংস্কারের একটিমাত্র উপায়ে’র কথা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন; আর তা হল “এই ছাঁচের পাশে একটা সজীব জিনিসকে অল্প একটু স্থান দেওয়া।”(ঐ) বস্তুত শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পেছনে রবীন্দ্রনাথের এই উদ্দেশ্যই কাজ করেছিল।

শিক্ষার আয়োজন বা ব্যবস্থাপনার নামে তার বাহ্যিক আড়ম্বর অর্থাৎ সভা-সমিতি-প্রস্তাব, ভবন ও আসবাবপত্রকে বড় করে না তুলে, শিক্ষাদানের বিষয় এবং শিক্ষার্থীর মানস-আকর্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ-প্রসঙ্গে ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্য :

 ক. একটা বিজ্ঞান-সভা স্থাপন করা এক, আর দেশের লোকের চিত্তকে বিজ্ঞানশিক্ষায নিবিষ্ট করা আর। সভা ফাঁদিলেই তাহার পরে দেশের লোক বিজ্ঞানী হইয়া উঠিবে, এরূপ মনে করা ঘোর কলিযুগের কল-নিষ্ঠার পরিচয়।

… কী শিখাইব তাহা ভাবিবার বটে, কিন্তু যাহাকে শিখাইব তাহার সমস্ত মনটা কী করিয়া পাওয়া যাইতে পারে সেও কম কথা নয়।

খ. অনাবশ্যককে যে পরিমাণে অত্যাবশ্যক করিয়া তুলিব সেই পরিমাণে আমাদের শক্তির অপব্যয ঘটিবে। … ধনী য়ুরোপের মতো আমাদের সম্বল নাই; তাহার পক্ষে যাহা সহজ আমাদের পক্ষে তাহা ভার। কোনো একটা সৎকর্মের অনুষ্ঠান করিতে গেলেই গোড়াতে ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্রের হিসাব খতাইয়া চক্ষে অন্ধকার দেখিতে হয়। এই হিসাবের মধ্যে অনাবশ্যকের দৌরাত্ম্য বারো-আনা। … কিন্তু যে দেশে শক্তির সীমা নাই, যে দেশে ধন কানায় কানায় ভরিয়া উপচিয়া পড়িতেছে, সেই দেশের আদর্শে সমস্ত কাজের পত্তন না করিলে আমাদের লজ্জা দূর হয় না, আমাদের কল্পনা তৃপ্ত হয় না। ইহাতে আমাদের ক্ষুদ্র শক্তির অধিকাংশই আয়োজনে নিঃশেষিত হইয়া যায়, আসল জিনিসকে খোরাক জোগাইতে পারি না।

গ. এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, যেখানে মুষলধারায় চাঁদার টাকা আসিয়া পড়ে সেইখানেই যে শিক্ষা বেশি করিযা জমা হইতে থাকে তাহা নহে, মনুষ্যত্ব টাকায় কেনা যায় না; যেখানে কমিটির নিয়মধারা অহরহ বর্ষিত হয় সেইখানেই যে শিক্ষাকল্পলতা তাড়াতাড়ি বাড়িয়া উঠে তাহাও নহে – শুদ্ধমাত্র নিয়মাবলী অতি উত্তম হইলেও তাহা মানুষের মনকে খাদ্য দান করে না।

    আমাদের জীবনযাত্রা যেখানে গরিবের সেখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ‘বাহ্যাড়ম্বরে’র তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘টাকা ফুঁকে দিয়ে টাকার থলি’ তৈরি করার সঙ্গে। (শি.বা.) তাঁর মতে ‘মেদ যেখানে প্রচুর, মজ্জা সেখানে দুর্বল’। (ঐ) ইউরোপ-আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সহায়তায় শিক্ষা যেখানে প্রায় অবৈতনিক সেখানে ভারতবর্ষে শিক্ষার ব্যয়বাহুল্যের সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “পশ্চিমের পোষ্যপুত্র তার বিলিতি বাপকেও ছাড়াইয়া চলে।” (ঐ) 

    প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগের কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পেছনে এটাই প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বলে আমরা জানি। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় তাঁর রচনা ও ভাষণে একথা বলেছেন। তো সেই তপোবন শিক্ষার ব্যাপারটা কেমন ছিল? রবীন্দ্রনাথ এ-সম্পর্কে লিখেছেন : “এক দিন তপোবনে ভারতবর্ষের গুরুগৃহ ছিল, এইরূপ একটা পুরাণকথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। অবশ্য তপোবনের যে একটা পরিষ্কার ছবি আমাদের মনে আছে তাহা নহে এবং তাহা অনেক অলৌকিকতার কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে।” (‘শিক্ষাসমস্যা’) তাহলেও ধারণা হিসেবে তপোবন শিক্ষার যে-দিকটি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে তা হল, সেখানে ‘সাধনা ও শিক্ষা একত্র মিলিত হয়েছিল’ (‘ধর্মশিক্ষা’, ১৩১৮), সেখানে বিদ্যাদানের কাজটি করতেন গুরু, শিক্ষক নয় – মানুষ, কল নয় (“শিক্ষক কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেই জোটে, কিন্তু গুরু তো ফর্মাশ দিলেই পাওয়া যায় না।” ‘শিক্ষাসমস্যা’)। এবং “সেখানে জীবনযাত্রা নিতান্ত সাদাসিধা; বৈষয়িকতা বিলাসিতা মনকে টানাছেঁড়া করিতে পারে না, সুতরাং শিক্ষাটা একেবারে স্বভাবের সঙ্গে মিল খাইবার সময় ও সুবিধা পায়।” (ঐ) যদিও রবীন্দ্রনাথ সচেতন যে, “তখন আমাদের শিক্ষার বিষয় এত বিচিত্র ও বিস্তৃত ছিল না এবং তখন আমাদের সমাজে-প্রচলিত ভাব ও মতের সঙ্গে পুঁথির শিক্ষার কোনো বিরোধ ছিল না। ঠিক সে দিনকে আজ ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিলে সে একটা নকল হইবে মাত্র, তাহার বাহ্য আয়োজন বোঝা হইয়া উঠিবে, কোনো কাজেই লাগিবে না।” (ঐ) আসলে রবীন্দ্রনাথ যা চেয়েছেন তা হল ‘যাতে পাঠ্য বিষয়ের বিচিত্রতার সঙ্গে অধ্যাপনার সজীবতা মিশতে পারে’ এবং বিদ্যালয় ‘যাতে পুঁথির শিক্ষাদান এবং হৃদয়মনকে গড়িয়া তোলা দুই ভারই’ গ্রহণ করে। (ঐ) এদিক থেকে তাঁর কাছে ‘বিলেতের নজির একেবারে’ই পরিত্যাজ্য বলে মনে হয়েছে। যেহেতু ‘বিলাতের ইতিহাস, বিলাতের সমাজ আমাদের নয়’। (ঐ) আর এ-সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে, রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লক্ষ করেছেন, “আমরা ন্যাশনাল পতাকাটাকে উচ্চে তুলিয়া যখন স্বাধীন চেষ্টায় কাজ করিব বলিয়া কোমর বাঁধিয়া বসি তখনও বিলাতের বেড়ি কোমরবন্ধ হইয়া আমাদিগকে বাঁধিয়া ফেলে, আমাদিগকে নজিরের বাহিরে নড়িতে দেয় না।” (ঐ) শিক্ষার্থীর জন্য ব্রহ্মচর্য পালনের আবশ্যকতার কথাও যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে-ও বলা বাহুল্য বৈরাগ্য-সাধনার প্রতি তাঁর কোনো অনুরাগ থেকে নয়, কারণ ‘বৈরাগ্যের নামে শূন্য ঝুলি’ তিনি সমর্থন করেন না (শিক্ষার মিলন, ১৩২৮); এজন্য যে তাঁর মনে হয়েছে, “জীবনের আরম্ভকালে বিকৃতির সমস্ত কৃত্রিম কারণ হইতে স্বভাবকে প্রকৃতিস্থ রাখা নিতান্তই আবশ্যক।” (‘শিক্ষাসমস্যা’) আর তাঁর মতে ব্রহ্মচর্য পালন ‘প্রবৃত্তির অকাল-বোধন ও বিলাসিতার উগ্র উত্তেজনা থেকে মনুষ্যত্বের নবোদ্গমের অবস্থাকে স্নিগ্ধ করে রাখে’। (ঐ) শিক্ষার্থীকে কেবল উপদেশ দিয়ে বা নীতিকথা শুনিয়ে সে উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়। স্পষ্ট করেই বলেছেন, “জীবনের আরম্ভে মনকে চরিত্রকে গড়িয়া তুলিবার সময়, উপদেশ নহে, অনুকূল অবস্থা ও অনুকূল নিয়মই সকলের চেয়ে বেশি আবশ্যক।” (ঐ) বস্তুত বিদ্যালয়কে যাঁরা নীতিশিক্ষাদানের স্থান হিসেবে গণ্য করেন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে একমত নন। এ-প্রসঙ্গে ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে প্রায় ব্যঙ্গ করেই বলেছেন, “আজকাল নীতিপাঠের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। যে-কোনো উপলক্ষে ছাত্রদিগকে নীতি-উপদেশ দিতে হইবে, দেশের অভিভাবকদের এইরূপ অভিপ্রায়।” এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য আমরা এখানে প্রবন্ধটি থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি : 

নীতি-উপদেশ জিনিসটা একটা বিরোধ। ইহা কোনোমতেই মনোরম হইতে পারে না। যাহাকে উপদেশ দেওয়া হয় তাহাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। উপদেশ হয় তাহার মাথা ডিঙাইয়া চলিয়া যায় নয় তাহাকে আঘাত করে। ইহাতে যে কেবল চেষ্টা ব্যর্থ হয তাহা নয়, অনেক সময় অনিষ্ট করে। সৎ কথাকে বিরস ও বিফল করিয়া তোলা মনুষ্যসমাজের যেমন ক্ষতিকর এমন আর-কিছুই নয় – অথচ অনেক লোক এই কাজে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন, ইহা দেখিয়া মনে আশঙ্কা হয়।  

    সংসারে কৃত্রিম জীবনযাত্রায় হাজার রকমের অসত্য ও বিকৃতি যেখানে প্রতি মুহূর্তে রুচি নষ্ট করিয়া দিতেছে সেখানে ইস্কুলে দশটা-চারটের মধ্যে কতক পুঁথির বচনে সমস্ত সংশোধন করিয়া দিবে ইহা আশা করা যায় না। ইহাতে কেবল ভুরি ভুরি ভানের সৃষ্টি হয় এবং নৈতিক জ্যাঠামি, যাহা সকল জ্যাঠামির অধম, তাহা সুবুদ্ধির স্বাভাবিকতা ও সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া দেয়। 

   শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষকের ভূমিকাকেই রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে সে শিক্ষক বলতে তিনি, বলা বাহুল্য, আমাদের আজকের প্রচলিত অর্থে শিক্ষককে বোঝাননি। তিনি এ-প্রসঙ্গে ‘গুরু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন; ‘শিক্ষাবিধি’ (১৩১৯) প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সেই গুরু খুঁজিতেছি যিনি আমাদের চিত্তের গতিপথকে বাধামুক্ত করিবেন।” শিক্ষক যেন ‘শিক্ষার ছাঁচ’ বা ‘নোটের বোঝার বাহন’ হয়ে না হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে শিশুশিক্ষার বেলায় এই সজীবতার প্রয়োজনটা রবীন্দ্রনাথ অধিক অনুভব করেছেন। যেহেতু, “শিশুবয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নাই, তাহা মনকে যতটা দেয় তাহার চেয়ে পিষিয়া বাহির করে অনেক বেশি।” (ঐ) এবং “মরা মন নিয়েও পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর ঊর্ধ্বশিখরে ওঠা যায়, আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই। দেখা যায় অতি ভালো কলেজি ছেলেরা পদবী অধিকার করে, বিশ্ব অধিকার করে না।” (‘আশ্রমের শিক্ষা’) 

মনুষ্যত্ব বিকাশের পক্ষে চিন্তার স্বাধীনতা, যুক্তি-বিচার ও পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের দ্বারা সবকিছুকে যাচাই করে নেবার ক্ষমতা এমনকি ভুল করবার সাহসকেও রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য বলে মনে করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে (১৩১৯) তাঁর বক্তব্য :

মানুষ যেখানে কোনো জিনিসকেই পরখ করিয়া লইতে দেয় না, ছোটো বড়ো সকল জিনিসকেই বাঁধা বিশ্বাসের সহিত গ্রহণ করিতে ও বাঁধা নিয়মের দ্বারা ব্যবহার করিতে বলে, সেখানে অবস্থা যতই অনুকূল হউক-না কেন মনুষ্যত্বকে শীর্ণ হইতেই হইবে। …মানবপ্রকৃতির উপর ভরসা নাই বলিয়া এ কথা একেবারে ভুলিয়া বসিয়াছি যে, মানুষকে ভুল করিতে না দিলে মানুষকে শিক্ষা করিতে দেওয়া হয় না। মানুষকে সাহস করিয়া ভালো হইয়া উঠিবার প্রশস্ত অধিকার দিব না, তাহাকে সনাতন নিয়মে সকল দিকেই খর্ব করিয়া ভালো-মানুষির জেলখানায় চিরজীবন কারাদণ্ড বিধান করিয়া রাখিব, এমনতরো যাহাদের ব্যবস্থা তাহারা যতক্ষণ নিজের বেড়ি নিজে খুলিয়া না ফেলিবে এবং বেড়িটাকেই নিজের হাত-পায়ের চেয়ে পবিত্র ও পরমধন বলিয়া পূজা করা পরিত্যাগ না করিবে ততক্ষণ ভাগ্যবিধাতার কোনো বদান্যতায় তাহাদের কোনো স্থায়ী উপকার হইতে পারিবে না।

   শিক্ষার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মনুষ্যত্বের অন্যতম প্রধান অভিব্যক্তি, মানুষ প্রশ্ন করে, বিদ্রোহ করে। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য। এ-প্রসঙ্গে ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :

জন্তুরা আহার পায় বাঁচে, আঘাত পায় মরে, যেটাকে পায় সেটাকেই বিনা তর্কে মেনে নেয়। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড়ো স্বভাব হচ্ছে মেনে না নেওয়া। জন্তুরা বিদ্রোহী নয়, মানুষ বিদ্রোহী। বাইরে থেকে যা ঘটে, যাতে তার নিজের কোনো হাত নেই, কোনো সায় নেই, সেই ঘটনাকে মানুষ একেবারে চূড়ান্ত বলে স্বীকার করে নি বলেই জীবের ইতিহাসে সে আজ এত বড়ো গৌরবের পদ দখল করে বসেছে। আসল কথা, মানুষ একেবারেই ভালোমানুষ নয়। ইতিহাসের আদিকাল থেকে মানুষ বলেছে, বিশ্বঘটনার উপরে সে কর্তৃত্ব করবে। কেমন করে করবে? না, ঘটনার পিছনে যে প্রেরণা আছে, যার থেকে ঘটনাগুলো বেরিয়ে এসেছে, তারই সঙ্গে কোনোমতে যদি রফা করতে বা তাকে বাধ্য করতে পারে তা হলেই সে আর ঘটনার দলে থাকবে না, ঘটয়িতার দলে গিয়ে ভর্তি হবে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তা বৈষম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং একই সঙ্গে তা বৈষম্য সৃষ্টির সহায়কও। মানুষে মানুষে মিল বা ঐক্য ঘটাবার পরিবর্তে তা বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে, কিংবা যে-বিভেদটি আছে তাকে পাকাপোক্ত করে তোলে। যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতে ‘জ্ঞান মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো ঐক্য’ এবং ‘আলোতে মানুষ মেলে, অন্ধকারে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়’। (শি.বা.) ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ধনীর ছেলে এবং দরিদ্রের ছেলে কোনো প্রভেদ লইয়া আসে না। জন্মের পরদিন হইতে মানুষ সেই প্রভেদ নিজের হাতে তৈরি করিয়া তুলিতে থাকে।” এভাবে ধনীর সন্তানটি “সম্পূর্ণরূপে মানবসন্তান হইতে শিখিবার পূর্বেই ধনীর সন্তান হইয়া উঠে।” আর পিতামাতা বা অভিভাবকদের মতো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এক্ষেত্রে সহায়ক এমনকি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এদেশের ধনীর সন্তানদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : “জগতে এত বড়ো বন্দী, এত বড়ো পঙ্গু আর কেহ নাই।” (ঐ) তাঁর মতে “অনায়াসে-প্রয়োজন-জোগানোর দ্বারা ছেলেদের মনটাকে আদুরে করে তোলা তাদের নষ্ট করা।” (‘আশ্রমের শিক্ষা’, ১৩৪৩) আর সেই কাজটিই এদেশে করা হয়,  “বাল্যকাল থেকেই ব্যবহারসামগ্রী সুনিয়ন্ত্রিত করবার আত্মশক্তিমূলক শিক্ষা আমাদের দেশে অত্যন্ত উপেক্ষিত হয়।” (ঐ) 

    রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধটি ১৩২২ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যা ‘সবুজপত্র’-এ প্রকাশিত হয়। তখন তাতে তিনি লিখেছিলেন, “বিদ্যাশিক্ষার উপায় ভারতবর্ষে কিছু কিছু হইয়াছে, কিন্তু বিদ্যাবিস্তারের বাধা এখানে মস্ত বেশি।” প্রসঙ্গত ব্রিটিশ-ভারতে মহাত্মা গোপালকৃষ্ণ গোখলের (১৮৬৬-১৯১৫) উদ্যোগে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের যে-একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তার ব্যর্থতার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : “যে সর্বজনীন শিক্ষা দেশের উচ্চশিক্ষার শিকড়ে রস জোগাইবে কোথাও তার সাড়া পাওয়া গেল না”। আর এ ব্যাপারে বাঙলা দেশেই যে ‘সব চেয়ে বাধা’র সম্মুখীন হতে হয়েছিল সে-কথাটাও রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক প্রবন্ধে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :

বাংলাদেশে শুভবুদ্ধির ক্ষেত্রে আজকাল হঠাৎ সকল দিক হইতেই একটা অদ্ভুত মহামারীর হাওয়া বহিয়াছে। ভূতের পা পিছন দিকে, বাংলাদেশে সামাজিক সকল চেষ্টারই পা পিছনে ফিরিয়াছে। আমরা ঠিক করিয়াছি, সংসারে চলিবার পথে আমরা পিছন মুখে চলিব, কেবল রাষ্ট্রীয় সাধনার আকাশে উড়িবার পথে আমরা সামনের দিকে উড়িব;  আমাদের পা যে দিকে আমাদের ডানা ঠিক তার উল্টা দিকে গজাইবে।

   এ বিষয়ে এদেশীয় মানস-প্রবণতার সমালোচনা ক’রে একই প্রবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন :

দেশের অন্ন, দেশের বিদ্যা, দেশের স্বাস্থ্য আমরা তেমন করিয়া চাই নাই। পরের কাছে চাহিয়াছি, নিজের কাছে নহে। ওজর করিয়া বলি, আমাদের সাধ্য কম : কিন্তু আমাদের সাধনা তার চেয়েও অনেক কম। 

… শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই। শিক্ষাবিস্তারে আমাদের গা নাই। তার মানে শিক্ষার ভোজে নিজেরা বসিয়া যাইব, পাতের প্রসাদটুকু পর্যন্ত আর-কোনো ক্ষুধিত পায় বা না পায় সে দিকে খেয়ালই নাই। … ‘জনসাধারণকে লেখাপড়া শেখাইলে আমাদের চাকর জুটিবে না’ এ কথা যদি সত্য হয় তবে আমরা লেখাপড়া শিখিলে আমাদেরও দাস্যভাবের ব্যাঘাত হইবে এ আশঙ্কাও মিথ্যা নহে। 

    বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রশ্নেও দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাব বা প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করে ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

আমাদের দেশে মাতৃভাষায় একদা যখন শিক্ষার আসন প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রস্তাব ওঠে তখন অধিকাংশ ইংরেজি জানা বিদ্বান আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। সমস্ত দেশের সামান্য যে-কয়জন লোক ইংরেজি ভাষাটাকে কোনোমতে ব্যবহার করবার সুযোগ পাচ্ছে তাদের ভাগে উক্ত ভাষার অধিকারে পাছে লেশমাত্র কমতি ঘটে এই ছিল তাদের ভয়। হায় রে, দরিদ্রের আকাঙ্ক্ষা দরিদ্র! 

    এমনকি পরাধীন ভারতবর্ষে তিনি যে লিখেছিলেন ‘এমন মানুষ আজও দেশে আছে যারা মনে করে শিক্ষাকে বাংলাভাষার আসনে বসালে তার মূল্য যাবে কমে’ (‘শিক্ষার বিকিরণ’, ১৯৩৩), আমাদের আজকের প্রেক্ষাপটেও তা বেশি বৈ কম সত্যি নয়। 

    শিক্ষা যদি না তা শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় গৌরববোধ, আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করতে পারে, তাদেরকে সত্যিকার মনুষ্যত্ব সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে, বরং তা যদি তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতার জন্ম দেয়, তবে তার চূড়ান্ত ফল এই হতে পারে যে দেশে ভুরিভুরি শিক্ষিত এমনকি জ্ঞানী-গুণি-পণ্ডিত লোক জন্ম নেবেন কিন্তু জাতীয় মনীষা সৃষ্টিতে তারা কোনো সমষ্টিগত অবদান রাখতে পারবেন না। উপনিবেশ-উত্তর আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বাস্তবতা ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির এই কুফলকেই তুলে ধরছে। দেশে মননচর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় ব্যর্থতার দিকটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন :

যে দেশে জলাশয় নাই সে দেশে আকাশের বৃষ্টিপাত ব্যর্থ হইয়া যায়। জল ধরিবার স্থান না থাকিলে বৃষ্টিধারার অধিকাংশ ব্যবহার নষ্ট হইতে থাকে। আমাদের দেশে যে জ্ঞানী, গুণী, ক্ষমতাসম্পন্ন লোক জন্মগ্রহণ করেন না তাহা নহে; কিন্তু তাঁহাদের জ্ঞান গুণ ও ক্ষমতা ধরিয়া রাখিবার কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নাই। তাঁহারা চাকরি করেন, ব্যবসা করেন, রোজগার করেন, পরের হুকুম মানিয়া চলেন, তাহার পরে পেন্সন লইয়া ভাবিয়া পান না কেমন করিয়া দিন কাটিবে। 

   শিক্ষা প্রসঙ্গে জাতীয় গন্তব্য বা লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয়টিকেও রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ (১৩১৯) প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্য : “আমরা কী হইব এবং আমরা কী শিখিব এই দুটা কথা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন। পাত্র যত বড়ো জল তাহার চেয়ে বেশি ধরে না।” এবং “আশা করিবার ক্ষেত্র বড়ো হইলেই মানুষের শক্তিও বড়ো হইয়া বাড়িয়া ওঠে। শক্তি তখন স্পষ্ট করিয়া পথ দেখিতে পায় এবং জোর করিয়া পা ফেলিয়া চলে।” রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘কোনো সমাজ সকলের চেয়ে বড় জিনিস যা মানুষকে দিতে পারে’ তা হল ‘সকলের চেয়ে বড় আশা’। (ঐ) এ-প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “যাহার বিশেষ কোনো একটা বন্দর নাই তাহার অতীতই বা কী আর ভবিষ্যতই বা কী?” জনসংখ্যাকে আমরা শক্তি বা সম্পদ হিসেবে গণ্য করে থাকি। আপ্তবাক্যের মতো প্রায়শ কথাটা আওড়াই। কিন্তু কখন জনসংখ্যা সম্পদ? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “লোকসংখ্যার কোনো মূল্য নাই; কিন্তু সমাজে যতগুলি লোক আছে তাহাদের অধিকাংশের যথাসম্ভব শক্তি-সম্পদ কাজে খাটিতেছে, মাটিতে পোঁতা নাই, ইহাই সমৃদ্ধি। শক্তি যেখানে গতিশীল হইয়া আছে সেইখানেই মঙ্গল, ধন যেখানে সজীব হইয়া খাটিতেছে সেইখানেই ঐশ্বর্য।” (ঐ)

   রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও/বা সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরবশ্যতা বা পরনির্ভরতার নীতি আমাদের মধ্যে যে মানসিক দৌর্বল্য বা হীনম্মন্যতার জন্ম দেয় তার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : “যাহারা আমাদের খাঁচার দরজা এক মুহূর্তের জন্য খুলিয়া দেয় না তাহারাই রাত্রিদিন বলে ‘তোমাদের উড়িবার শক্তি নাই’। পাখির ছানা তো বি.এ. পাশ করিয়া উড়িতে শেখে ন; উড়িতে পায় বলিয়াই উড়িতে শেখে। … উড়িতে পারা যে সম্ভব এ সম্বন্ধে কোনোদিন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়া তাহাকে দুর্বল করিয়া দেয় না। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, অপরে আমাদের শক্তি সম্বন্ধে সর্বদা সন্দেহ প্রকাশ করে বলিয়াই এবং সেই সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করিবার কোনো ক্ষেত্র পাই না বলিয়াই অন্তরে অন্তরে নিজের সম্বন্ধে একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়া যায়।” (ঐ) জাতীয় জীবনে যেমন তেমনি ব্যক্তি-মানুষের বেলায়ও এই হীনম্মন্যতার অবসান ঘটিয়ে তার মধ্যে আত্মশক্তিতে আস্থা ও উচ্চাকাক্সক্ষা সৃষ্টিকে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হিসেবে নির্দেশ করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধেই তাঁর বক্তব্য :

‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডেপুটি মুন্সেফের চেয়ে বড়ো, তুমি যাহা কিছু শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে’ এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা এই কথাটা আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে।

    আর রবীন্দ্রনাথের মতে, “এইটে বুঝিতে না পারার মূঢ়তাই আমাদের সকলের চেয়ে বড় মূঢ়তা। আমাদের সমাজ একথা আমাদিগকে বোঝায় না, আমাদের ইস্কুলেও এ শিক্ষা নাই।” এবং “আমরা যে কী হইতে পারি, কতদূর আশা করিতে পারি, তাহা মোটা লাইনে বড়ো রেখায় দেশের কোথাও আঁকা নাই।” পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে-কোনো পরিবর্তনের গোড়ার কথা, রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, “আমরা কোথায় আছি, কোন দিকে চলিতেছি তাহা সুস্পষ্ট করিয়া জানা চাই।” কারণ “জীবনের কোনো লক্ষ্য নাই অথচ শিক্ষা আছে, ইহার কোনো অর্থই নাই।” (ঐ) 

    উপরে যে জাতিগত দৌর্বল্য বা হীনম্মন্যতার কথা বলা হল তার সবটাই আরোপিত বা পরাধীনতার ফল রবীন্দ্রনাথ এমনও মনে করেন না। তাঁর মতে এটি ‘ভিতরকারই ব্যাধি’। লিখেছেন, “দোষ বাহিরের নহে, তাহার রক্ত দূষিত হইয়াছে ; নহিলে এমন সাংঘাতিক দুর্বলতা, এমন মোহাবিষ্ট জড়তা মানুষকে এত দীর্ঘকাল এমন করিয়া সকল বিষয়ে পরাভূত করিয়া রাখিতে পারে না।” (ঐ)

    রবীন্দ্রনাথের মতে আমরা শিক্ষাকে জীবনের বাহন ক’রে না তুলে বিদেশের নকল করা শিক্ষার ভার বহন ক’রে চলেছি। আর তার পরিণতি, ‘অসন্তোষের কারণ’ (১৩২৬) প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ভয়ে ভয়ে ইংরেজের ডাক্তার ছাত্র পুঁথি মিলাইয়া ডাক্তারি করিয়া চলিল, কিন্তু শারীরবিদ্যায় বা চিকিৎসাশাস্ত্রে একটা-কোনো নূতন তত্ত্ব বা তথ্য যোগ করিল না। ইংরেজের এঞ্জিনিয়ার ছাত্র সতর্কতার সহিত পুঁথি মিলাইয়া এঞ্জিনিয়ারি করিয়া পেন্সন লইতেছে, কিন্তু যন্ত্রতত্ত্বে বা যন্ত্র-উদ্ভাবনায় মনে রাখিবার মতো কিছুই করিতেছে না।” ‘শিক্ষাপ্রণালীটাই যে আমাদের ব্যর্থতা’র, ‘শিক্ষার এই শক্তিহীনতা’র কারণ, রবীন্দ্রনাথের মতে, “অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না।” (ঐ) ফলে “প্রণালী বদল করিবার কথা মনেই আসে না ; … নূতনের ঢালাই করিতেছি সেই পুরাতনের ছাঁচে।” বলেছেন, “অনেক কাল এমনি করিয়া কাটিল, আর সময় নষ্ট করা চলিবে না।” এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রায় শত বছরের ব্যবধানে এবং দু-দুবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পরও, সেই প্রণালী, পুরাতনের ছাঁচ বদলের পথে আমরা কতটা অগ্রসর হয়েছি? জ্ঞান-বিদ্যার কোনো ক্ষেত্রেই আমরা যে বিশেষ মৌলিকত্ব প্রদর্শন করতে পারিনি, রবীন্দ্রনাথের মতে তারও কারণ, বিদেশ থেকে পাওয়া বিদ্যাটাকে ‘নিজের বিচার খাটিয়ে ও তেজের সঙ্গে’ ব্যবহারের ভরসা আমরা পাই না। আর এই না-পারার কারণ, ‘বিদ্যার যাচাই’ (১৩২৬) প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “বিদ্যাটাও যেখান হইতে ধার করিয়া লইতেছি বুদ্ধিটাও সেখান হইতে ধার-করা।” এ-প্রসঙ্গে তাঁর আরও মন্তব্য : “আদালতটাই আমাদের এখানে নাই, কাজেই বিদেশের বিচারের নকল আনাইয়া আমাদিগকে বড়ো সাবধানে কাজ চালাইতে হয়।” আর রবীন্দ্রনাথের মতে, “নিজের বুদ্ধিবিভাগে যে লোক কর্তাভজা পোলিটিক্যাল বিভাগেও কর্তাভজা হওয়া ছাড়া তার আর গতি নেই।” (শি.মি.)

৭ 

শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারটি অনেককাল ধরেই আমাদের কাছে এক প্রধান উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার বিষয়। তো প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রদের দ্বারা ইংরেজ অধ্যাপক ওটেনের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটিতে (যাকে কেন্দ্র করে সুভাষচন্দ্র বসুকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল) আপন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লেখা তাঁর ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ (১৩২২) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত যুক্তিবাদী ও ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টিকে বিবেচনা করেছেন। এ-রচনাটিতেও তাঁর ঔপনিবেশিকতা বিরোধী মনোভাব খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর মতে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বটি কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, এ ব্যাপারে শিক্ষকদেরও দায়িত্ব আছে। ছাত্রদের ‘জেলের কয়েদি বা ফৌজের সিপাই’ মনে না ক’রে তাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কর্তব্যটির ওপর জোর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া’ তাদের কোনোমতেই ছাত্রদের মানুষ করার দায়িত্ব নেওয়া উচিত নয়। একইভাবে সম্মান ব্যাপারটিও তাঁর মতে একতরফা নয়। তিনি লিখেছেন, “ছাত্রদিগকে যারা স্বভাবতই শ্রদ্ধা করিতে না পারে ছাত্রদের নিকট হইতে ভক্তি তারা সহজে পাইতে পারিবে না।” এবং “শ্রদ্ধার সঙ্গে দান করিলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা সম্ভব হয়। যেখানে সেই শ্রদ্ধার সম্পর্ক নাই সেখানে আদানপ্রদানের সম্বন্ধ কলুষিত হইয়া উঠে। জেলখানার কয়েদিরা হাতে বেড়ি পরিয়া যে অন্ন খাইতে বসে তাকে যজ্ঞের ভোজ বলা বিদ্রূপ করা। জ্ঞানের ভোজ আনন্দের ভোজ।” সনাতনী নীতিবাদী দৃষ্টিকোণ কিংবা, অন্যভাবে বললে, ‘প্রবীণ পরম-পাকা’দের অবস্থান থেকে তরুণদের আচরণকে বিচারের প্রবণতারও তিনি সমালোচনা করেছেন। এ-প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সুবুদ্ধির কথা চিরকাল খাটে না; মানবপ্রকৃতি সুবুদ্ধির পাকা ভিতের উপরে পাথরে গাঁথিয়া তৈরি হয় নাই। তাকে বাড়িতে হইবে, এইজন্যই সে কাঁচা। এইজন্যই কৃত্রিম ঘেরটাকে সে খানিকটা দূর পর্যন্ত  সহ্য করে;  তার পরে প্রাণের বাড় আর আপনাকে ধরিয়া রাখিতে পারে না, একদিন হঠাৎ বেড়া ফাটিয়া ভাঙিয়া পড়ে। যে প্রাণ কচি তাহারই জয় হয়, যে বাঁধন পাকা সে টেঁকে না।” বয়ঃসন্ধিকালে, যখন শিক্ষার্থীরা ‘শাসনের সীমানা থেকে স্বাধীনতার এলাকায় প্রথম পা বাড়ায়’, তখন তাদের পক্ষে সহজে এমনকি অনেক সময় অকারণেও উত্তেজনা প্রকাশ স্বাভাবিক গণ্য করে রবীন্দ্রনাথের অভিমত : “যেখানে ছাত্রদের সঙ্গে অধ্যাপকের সম্বন্ধ স্বাভাবিক সেখানে এই-সকল উৎপাতকে জোয়ারের জলের জঞ্জালের মতো ভাসিয়া যাইতে দেওয়া হয়”।  এ-প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, “এই বয়ঃসন্ধিকালটিই বেদনাকাতরতায় ভরা। এই সময়েই অল্পমাত্র অপমান মর্মে গিয়া বিঁধিয়া থাকে এবং আভাসমাত্র প্রীতি জীবনকে সুধাময় করিয়া তোলে।” এবং “এই বয়সে ছাত্রগণ শিক্ষার উদ্যোগপর্ব শেষ করিয়া মনুষ্যত্বের সার জিনিসগুলিকে আত্মসাৎ করিবার পালা আরম্ভ করে ; … চিবাইয়া খাইবার বয়স আসিলে বেশ একটু জানান দিয়া দাঁত ওঠে, তেমনি মনুষ্যত্বলাভের যখন বয়স আসে তখন আত্মসম্মানবোধটা একটু ঘটা করিয়াই দেখা দেয়।” এ-প্রসঙ্গে পৃথিবীর অন্য (স্বাধীন) দেশ বা সেখানকার অবস্থার সঙ্গে (পরাধীন) ভারতবর্ষ বা বাঙলার অবস্থা ও এ দেশের ছাত্রদের আচরণের তুলনাকে তিনি সঙ্গত মনে করেননি। বলেছেন, “বাংলাদেশের ছাত্রদের মনস্তত্ব যে বিধাতার একটা খাপছাড়া খেয়াল একথা মানি না।” এবং “আমাদের দেশ ইংলনড নয়, ইটালি নয়, আমেরিকা নয় : সেখানকার মাপে কোনোমতেই আমাদের ইতিহাসকে ছাঁটা চলিবে না।” শিক্ষক পদে আসীন থেকে বা তার সুযোগ নিয়ে কেউ উপনিবেশবাদী মনোবৃত্তির পরিচয় দেবেন, সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমান বা অন্ধ জাতিবিদ্বেষ প্রচার করবেন, অথচ ছাত্রদের সে অপমান মুখ বুঁজে সহ্য করে যেতে হবে, আর এভাবেই তাদেরকে তাদের গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে, রবীন্দ্রনাথের কাছে একে মোটেও সমর্থনযোগ্য মনে হয়নি। এ সম্পর্কে ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধেই তিনি বেশ তীব্র ভাষায়ই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন :

 … আমার কথা এই, ছেলেরা যা খুশি তাই কখনো করিবে না। তারা ঠিক পথেই চলিবে, যদি তাহাদের সঙ্গে ঠিকমত ব্যবহার করা হয়। যদি তাহাদিগকে অপমান কর, তাহাদের জাতি বা ধর্ম বা আচারকে গালি দাও, যদি দেখে তাহাদের পক্ষে সুবিচার পাইবার আশা নাই, যদি অনুভব করে যোগ্যতাসত্ত্বেও তাহাদের স্বদেশীয় অধ্যাপকেরা অযোগ্যের কাছে মাথা হেঁট করিতে বাধ্য, তবে ক্ষণে ক্ষণে তারা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করিবেই; যদি না করে তবে আমরা সেটাকে লজ্জা এবং দুঃখের বিষয় বলিয়া মনে করিব।

    এবং

… আজ আমাদের ছাত্রেরা কেবলমাত্র ইংরেজি কেতাবের ইংরেজি নোট কুড়ানোর উঞ্ছবৃত্তিতেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করিবে না, আজ তারা আত্মসম্মানকে বজায় রাখিতে চাহিবেই; আজ তারা নিজেকে কলের পুতুল বলিয়া ভুল করিতে পারিবে না; আজ তারা জেলের দারোগাকে নিজের গুরু বলিয়া মানিয়া শাসনের চোটে তাকে গুরুভক্তি দেখাইতে রাজি হইবে না।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিদেশি ছাঁচের নকলের তিনি যেমন বিরোধিতা করেছেন, একই রকম দৃঢ়তা নিয়ে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে যে-কোনো রকম সঙ্কীর্ণতা বা একদেশদর্শিতার বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন। জোর দিয়েছেন বিদ্যাসমবায়ের ওপর। এ-প্রসঙ্গে ‘বিদ্যাসমবায়’ (১৩২৬) প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্য : “জাতিগত বিদ্যাস্বাতন্ত্র্যকে একান্তভাবে লালন করিবার দিন আজ আর নাই। আজ বিদ্যাসমবায়ের যুগ আসিয়াছে। সেই সমবায়ে যে বিদ্যা যোগ দিবে না, সে বিদ্যা কৌলীন্যের অভিমানে অনূঢ়া হইয়া থাকিবে। সে নিস্ফল হইয়া মরিবে।” তিনি লিখেছেন, “দীর্ঘকাল আমাদের বিদ্যাকে আমরা একঘরে করিয়া রাখিয়াছিলাম। দুই রকম করিয়া একঘরে করা যায় ─ এক অবজ্ঞার দ্বারা, আর-এক অতিসম্মানের দ্বারা।” রবীন্দ্রনাথের মতে “দুইয়েরই ফল এক। দুইয়েতেই তেজ নষ্ট করে।” আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘আমাদের নিজ দেশের বিদ্যার স্থান নেই, অথবা তার স্থান সব-পিছনে’, এটা যেমন তাঁর কাছে ক্ষতিকর মনে হয়েছে, তেমনি বিদ্যাস্বাতন্ত্র্যকেও তিনি মূঢ়তার পরিচায়ক বলে মনে করেছেন। প্রথম বিচ্ছেদটিকে তিনি বলেছেন ‘অজ্ঞানের, সুতরাং মার্জনীয়’ কিন্তু পরবর্তী বিচ্ছেদটি তাঁর মতে ‘শিক্ষিত মূঢ়তার, সুতরাং হাস্যকর ও ততোধিক অনিষ্টকর’। এ-অবস্থায় বিদ্যাসমবায়ের এমন একটি বড় ক্ষেত্রের প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছেন ‘যেখানে বিদ্যার আদান প্রদান ও তুলনা হবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রেখে বিচার’ করা হবে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা বলা বাহুল্য সে আকাক্সক্ষা বা তাগিদ থেকেই। এ-প্রসঙ্গে পলিটিকাল ঐক্যের চেয়ে ‘গভীরতর উচ্চতর মহত্তর যে ঐক্য চিত্তের ঐক্য আত্মার ঐক্য তাকে বড় বলে জানা’র প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি। (ঐ) পশ্চিমের বিদ্যার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে তার সঙ্গে শয়তানিও আছে সত্যি। তাই বলে “পশ্চিমের লোকে যে বিদ্যার জোরে বিশ্ব জয় করেছে সেই বিদ্যাকে গাল পাড়তে থাকলে দুঃখ কমবে না, কেবল অপরাধ বাড়বে।” (‘শিক্ষার মিলন’)। কারণ বিদ্যা সত্য, শয়তানি সত্য নয়। (ঐ) অন্ধবিশ্বাস ও নিয়তিনির্ভরতা থেকে মানুষের মনকে মুক্ত করার শিক্ষাটা কিন্তু আমরা পাশ্চাত্যের কাছ থেকেই পেয়েছি। আর “মানুষের বুদ্ধিকে ভূতের উপদ্রব এবং অদ্ভুতের শাসন থেকে মুক্তি দেবার ভার যে পেয়েছে তার বাসাটা পূর্বেই হোক আর পশ্চিমেই হোক তাকে ওস্তাদ বলে কবুল করতে হবে।” (ঐ) এ-প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন : “এখনো যারা বিশ্বব্যাপারে জাদুকে অস্বীকার করতে ভয় পায় এবং দায়ে ঠেকলে জাদুর শরণাপন্ন হবার জন্যে যাদের মন ঝোঁকে, বাইরের বিশ্বে তারা সকল দিকেই মার খেয়ে মরছে, তারা আর কর্তৃত্ব পেল না।” এবং “বিশ্বব্যাপারে যে মানুষ আকস্মিতাকে মানে সে নিজেকে মানতে সাহস করে না, সে যখন-তখন যাকে-তাকে মেনে বসে; শরণাগত হবার জন্যে সে একেবারে ব্যাকুল।” (ঐ) তবে পশ্চিমের শয়তানি রূপটা সম্পর্কেও সচেতনতার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছেন। বলেছেন, ‘ওই শয়তানির যোগেই তাদের মরণ’। (ঐ) পশ্চিমের শক্তিরূপ তাঁকে তৃপ্তি দেয়নি। বরং যে-সাতমাস তিনি আমেরিকার, তাঁর ভাষায়, ‘ঐশ্বর্যের দানবপুরীতে’ ছিলেন সেখানে ভোগের চেহারা দেখেছেন, আনন্দের নয়। (ঐ) তুলনায় প্রাচীন জাপানের রূপ তাঁকে ‘গভীর তৃপ্তি’ দিয়েছে। সেখানে যে-জিনিসটি তিনি লক্ষ করেছেন তা হল পূর্ণত; ‘অর্থহীন বহুলতা তার বাহন নয়’। (ঐ) আর তাঁর মতে ‘একান্ত রিক্ততাও নিরর্থক, একান্ত বহুলতাও তেমনি’। (ঐ)

     রবীন্দ্রনাথের মতে এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির সম্বন্ধ ‘অনুকরণ-অনুসরণের নয়, আদান প্রদানে’র (‘তপোবন’)। জবরদস্তির দ্বারা অন্যের আদর্শের অনুগত হওয়ার প্রয়াস এক্ষেত্রে কেবল বিকৃতিরই জন্ম দিতে পারে। (ঐ) ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “শিক্ষার বিষয়কে আমরা অন্য জায়গা হইতে লইতে পারি, কিন্তু মেজাজটাকে সুদ্ধ লইতে হইবে সে যে বিষম জুলুম।” ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে “শিক্ষা-দোকানদারির নীচতা হইতে দেশের শিক্ষাকে ও ছাত্রগণকে আমরা কি রক্ষা করিব না?” বলে যে-আর্তি তিনি সেদিন প্রকাশ করেছিলেন তা যেমন, তেমনি ‘শিক্ষাসংস্কার’ প্রবন্ধে তাঁর “আমরা বিদ্যালয়ের সাহায্যে এ দেশে তাঁবেদারির চিরস্থায়ী ভিত্তিপত্তন করিতে কিছুতেই রাজি হইতে পারি না” কথাটাও শতাব্দীকাল পরে ভিন্ন রাষ্ট্রনৈতিক প্রেক্ষাপটেও আজ আমাদের কাছে বেশি বৈ কম গুরুত্ব বা তাৎপর্য বহন করে না।  

২০০৯

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা