শিমুল আজাদ
‘কবিতা জীবনের সমালোচনা’। ‘কবিতা সাদা কাগজের ওপর এই তিনটে অক্ষর ফুটে উঠল যখন, মনে হল যেন চমকে উঠল বিদ্যুৎ। চেতনাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে জেগে উঠল সম্ভাবনা। বোধের হাওয়া আর হয়ে উঠার ভাষার মধ্যে গিয়ে। এই ভাষা দৈনন্দিন অভ্যাসের; কিন্তু কবিতার বাচন তা হয় যখন, আমূল রূপান্তরিত হয়ে যায় তার বিধি বিন্যাস ও তাৎপর্য। বিবরণের ভাব সরে যায় ক্রমশ, ইশারার প্রবণতা বড়ো হয়ে ওঠে। অতএব কবিতা যতখানি ভাষার তার বেয়ে বেশী পরভাষার। যতখানি অভিজ্ঞতার, ইস্তাহারের বিজ্ঞাপনের তার চেয়ে অনেক বেশী উপলব্ধির, দ্যোতনার, উন্মোচনের। আপেক্ষিক মিথ্যার জগতে বাধ্যতামূলক পরিক্রমা করেও যিনি কেবলই সত্যের নতুন নতুন জন্মমুহূর্ত ও প্রকাশ পদ্ধতি সন্ধান করে চলেন তিনি কবি। প্রতিটি বাস্তবতায় তিনি খোঁজেন সম্ভাব্য রূপকের বাস্তবতা। উচ্চাররিত শব্দকে ঘিরে থাকা নিরুচ্চার বার্তা ও নৈঃশব্দের অর্থবহ বলয় তার অনুভবে ধরা পড়ে। প্রতিটি মুহূর্তই তখন হয়ে ওঠে কবিতার মুহূর্ত। –তপোধীর ভট্টাচার্য।
অনেক প্রতিকূলতার ভেতর কবিতার জন্য কবিকে তৈরী থাকতে হয়। সজাগ, সতর্কচোখে কবিতার মুহূর্ত আবিষ্কার করতে হয়। কবির সামগ্রিক চিন্তা-চেতনা কবিতাকে ঘিরে। যতটা জীবনের ঘনিষ্ঠতায় তারও চেয়ে বেশী কবিতার নিবিড়ে। পরিবেশ, পরিস্থিতি সামলে কবিতার পৃথিবী। কাব্য সৃষ্টি তত্ত্বের মূলে, ‘রূপের দ্বারাই অরূপকে প্রকাশ করা, অরূপের দ্বারা রূপকে আচ্ছন্ন করে দেখা’। মানুষের যেমন বিভিন্ন প্রকার কবিতাও তেমনি নানা রকমের। কোনো বিশেষ ধারায়, সংজ্ঞায়, রূপে তাকে ধরতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র। স্থান, কাল পাত্র-ভেদে কবিতার উদ্দেশ্য, গতি, প্রকৃতি অনুভব বিষয় পরিবর্তিত। পরিবেশ, পরিস্থিতি, সময় কবির মানসিক অবস্থানে গড়া কাঠামো, আকৃতি পায় কবিতায়। পাঠককে কবিতার মর্মে পৌঁছাতে এই সব অবস্থানে ঢুঁ মারতে হয়। এসব পরিস্থিতি বুঝে নিতে হয়। না বুঝতে পারলে তার সামগ্রিক স্বাদ হারিয়ে যায়–কবিতার দুর্বোধ্য ধারণা আসে। কি নেই, কবিতায়!– যদি চিন্তারশ্মি বাড়ে। তখন অন্বেষণর মাত্রা ডালপালা ছড়ায়। মানবের অশান্ত মুহূর্ত, ইচ্ছের, তৃষ্ণার, রাজনীতির, অর্থনীতির, সমাজনীতির, ধর্ম, জীবন-পৃথিবীর সমগ্রে যা আছে, আবিষ্কৃত হয়েছে যা অনাবিষ্কৃত রয়েছে সবই কবিতায় বিচ্ছুরিত। সংঘবদ্ধ ধারণায়, মৌলিক কাঠামোয় পরিব্যপ্ত। মহাবিশ্বের বিস্ময়েরা, কবিতার অক্ষরে, গন্ধে, ছন্দে দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। মানুষের সমৃদ্ধির যতটা দাবী বৈজ্ঞানিক, প্রাযুক্তিক আবিষ্কারকে ঘিরে তার থেকে বেশী সত্য কবিতার সত্যকে ঘিরে। মূলত সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু। জীবন ম্রিয়মাণ ধ্বংস্তুপে দাঁড়িয়ে। এই সভ্যতা, অগ্রগতি মানুষের কোনো কাজে লাগছে না আরাম-আয়েশ হাতের মুঠোয় বিশ্ব, চাকচিক্য, যুদ্ধ, ধবংস, আধিপত্য, বাজার অর্থনীতি আর বার্ধক্যগ্রস্ত, অসুস্থ কিছু মানুষকে বাঁচানোর হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। এ সবের চেয়ে সামগ্রিক মৃতবৎ মানুষের প্রাণ সৃষ্টিতে সত্যিকার শান্তিময় জীবনে ফিরিয়ে আনা, মনুষত্যে উন্নীত করা, জীবনের স্বাভাবিকতায় জাগ্রত করাই জরুরি। সমগ্র মানুষের উত্থান, ধ্বংসের বিপর্যয় তলিয়ে যাওয়ার থেকে অমানবিক নিষ্ঠুর প্রতিরূপ থেকে ফিরিয়ে আনার কাজটি কবিতাই করতে পারে। কবিতাই পারে এই দুঃসময়ে যুদ্ধবাজ এই বিশ্বে শান্তি ও শৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে। মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়-প্রকৃত স্বরূপেরা মুখোমুখি দাঁড় করাতে কবিতাই প্রধান শক্তি, ঘোর আচ্ছন্নতা। কবিতা ধূসর থেকে সবুজে পৌঁছানোর পথ। অজ্ঞান থেকে সজ্ঞানে যাবার শিক্ষা। স্থবিরতা ভেঙে সরব হবার, ক্লেদ ও পংকিলতা থেকে স্বচ্ছতায় পৌঁছানো পবিত্রতা। অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস। শোষনের হাতকে গুড়িয়ে দেবার হাতিয়ার। অপ্রেমে-প্রবাহিত, প্রেমস্রোত। আকাশকে হাতের মুঠিতে পাবার সাধ ও সাধ্যের কৌশল। অবচেতনকে-চেতনে, অদেখাকে দেখার; অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে, মিথ্যাকে-সত্যের সান্নিধ্যে উন্নীত করার শপথ, অসুন্দরকে-সুন্দরের বিকশিত করার প্রেরণা।
‘সর্বহারা মানুষের চূড়ান্ত আশ্রয়স্থল কবিতা। কবিতাই আদিম ও আধুনিক মানুষের যাবতীয় জিজ্ঞাসা এবং অন্তর্ঘাতের, শিক্ষিত ও ভুল শিক্ষিত মানুষের চেতনা ও অবচেতনার যাবতীয় সংঘাতলুপ্তির একমাত্র উপায়। কবিতা আলটিমেট সিন্থেসিস’। –প্রদীপ চৌধুরী।
কবিতাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। কবিতার পাঠক সব সময় কম। অনেকের ধারণা কাব্যচর্চা একটি বিলাসিত মাত্র। কবিতা বর্তমান সময় থেকে বাস্তব অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ এসব বিষয়ে জীবন বেশী মাত্রায় প্রবিষ্ট হয়। ব্যক্তি ও সমাজ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসরতায় বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু কবিতা সম্পর্কে উপর্যুক্ত চিন্তার কোনো সত্যতা নেই বর মেধা ও মননের স্পর্শে কবিতা যেমন স্পর্শ করে তেমনি জীবনের সমৃদ্ধি রূপ, রস, রঙ গন্ধকে বাড়িয়ে তুলতে বিশেষ ক্ষমতা রাখে। এই সক্ষমতাকে অস্বীকারে পৌঁছায়ে ব্যক্তি সমাজ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত। কবিতার আঙ্গিক, কৌশল পরিবর্তিত হয়েছে। জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তন, সমস্যা, বিপদ-সংকুলতার ভিতর সে একটি মাত্রা সংযোজন করে। প্রকৃত ও শাশ্বত অবস্থানে পৌঁছে দেয়। জীবনের সাধ্য ও সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে। কবিতার দুরূহতা আধুনিক যুগ মানসের প্রতিবিম্ব। বহির্জগত যতই আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা হারিয়ে নিষ্ফল মরুর রূপ ধারণ করেছে কবিও ততই তার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে এক অন্তর্লীন ধ্যানরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। বহির্জগতের চেতনা অন্তরের পটে ফোটাবার জন্য বা বহির্জগৎ থেকে পলায়ন করবার জন্য যে কারণেই হোক না কেন! তিনি তখন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন এবং সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেন ততই তিনি বিশেষ ভাষা, শৈলী ও প্রতীক ব্যবহার করেন। পাঠক গোষ্ঠীর কাছে তা অনিবার্যভাবে নতুন ঠেকে তথা দুরূহ। মানুষের কান্না, আদর, ভালবাসা, হতাশার প্রকাশ প্রায় সমপর্যায়ের, কিন্তু মনের চিন্তা দুরধিগম্য। বিশেষ করে এ সময়ের কবিরা চান পাঠক সাধারণকে তাঁদের জটিল অভিজ্ঞতার অংশীদার করতে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কবিদের কৈশোর এবং জীবন বিভিন্ন চিন্তাধারার ঘাত-প্রতিঘাতে আন্দোলিত। লক্ষ্য ও পন্থা নিয়ে দেশব্যাপী অনিশ্চয়তা তাঁদের অনুভূতিপ্রবণ মনকে বিভ্রান্ত করেছে। ধনতন্ত্রের নাগপাশে পৃথিবী বাঁধা। তার এক প্রান্তের সামান্য অনিশ্চয়তা বা সংশয় অন্য প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মানবের জীবনের দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
‘যে সমাজে কবির নিঃসরণ তার পটভূমি থেকে কবিতাকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়’ –কডওয়েল।
কবিতা নিয়ে কথা বা আলোচনায় প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টা তাড়িত করে তা সময়-সভ্যতা। এরপর একে একে আসে জাতির স্বভাব, অবস্থান, রুচি, চিন্তা, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়। সভ্যতার উন্নতি বা সীমানা নির্দ্ধারণের জন্য সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর আলোকপাত করা হয়। জীবনের রুচি, অর্থ, কর্ম, পরিবেশকে পরিবর্তিত বা উন্নীত করতে-এ সমস্ত বিষয় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে–এখনও রাখছে। কাজেই আমরা অবস্থানগত সত্য স্বীকারের পাশাপাশি ভূমিকার উপকরণগুলির স্মরণ ও চর্চার দিকেই থাকতেই চাই। সাহিত্যকে, কবিতাকে পরিবর্তনের বাঁক হিসাবে আদি, মধ্য এবং অন্তে ভাবতে ও দেখতে চাই। এবং এই সত্যে জীবন, সময়, পরিবেশ ও জাতিকে চাই উচ্চারিত করতে। বর্তমান বাংলাদেশের জাতিগত অবস্থান যে পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে একে ফেরাতে না পারলে জাতীয় অগ্রগতি-জীবনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। প্রত্যেকে ব্যক্তি স্বার্থে, ব্যক্তিগত সাধের পরিতৃপ্তির দিকে ছুটছে। জীবনের মহত্তম বোধ, আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পরিবেশ, পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে। এর কারণ রাজনীতিকে আমরা জীবনের চরম লক্ষ্য অবস্থানের সুযোগ হিসেবে দেখছি। আমরা চালিত হচ্ছি মিথ্যে চাকচিক্যের দিকে। অন্তর্গত সত্য, যুক্তির একনিষ্ঠতা, বিচারবোধ এসব বিষয়গুলি ঠিকমতো কাজ করছে না। আমরা সংস্কৃতিগত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। বিলাসী দ্রব্য, আমদানীকৃত কসমেটিকস পোশাক বিভ্রমে চোখ নাচাচ্ছি। স্ব-ভূমির ভৌগলিক জ্ঞান, অবস্থান থেকে ক্রমশ বিচ্যুত ঘটছে আমাদের । আমাদের আচার-আচরণ, চাওয়া-পাওয়া সদকর্মের হাত সংকুচিত। শঠতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, মিথ্যাকর্ম, সমস্ত অনৈতিকতার মধ্যে জাতি। গ্রামীণ সমাজ কাঠামো ভেঙে শাহরিক, নাগরিক, রঙচঙে চমকে মোড়াতে চাচ্ছি সব। এ মেকি সময়-সভ্যতার ভেতর দিয়ে কবিতার, সাহিত্যের মূল অবস্থান তৈরী করা-কবি, সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মীর পক্ষে বেশ দুরূহ ব্যাপার। স্যাটেলাইট টিভির মাধ্যমে আমদানীকৃত রঙিন নষ্ট সময়-সভ্যতা, ক্লেদ-জীবনের স্বাভাবিক অবস্থানকে অস্বীকার করছে। পরিবেশের উপর চেপে বসছে সবুজের নির্মল জলের দেশে এসে পড়ছে অন্তসারশূন্য জীবনের দ্বন্দ্ব, সংঘাত নষ্টামি। এই মনোগত, দেহগত দেয়াল ভেঙে কবিতাকে এগোতে হচ্ছে। কবিতাকে জাগানো এখন কঠিন কাজ। আরও কঠিন কবিতা চর্চা। এই অবস্থানকে মেনে নিয়ে কবিতার দিকে জীবনকে, জাতিকে ফেরাতে হবে। রাজনীতির কলুষতা, বাজার সংস্কৃতির উপর পালটা আঘাত করে কবিতাকে মৌলিক স্বরূপে, চিন্তনের, গবেষণার আনন্দের ব্যথা উপষমের উপযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কবিতার সত্য, জীবন সত্যে অনিবার্য করে তোলাই আমাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা।
‘আর্ট মাত্রেই ব্যক্তি মনীষার প্রকাশ বৈ নয়। বাইরের সমাজ সংসারের সঙ্গে তার যোগযোগ সামান্য। কিন্তু কবিতা তো আর যাই হোক ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত নয়, তার প্রকাশ ভাষার মাধ্যমে এবং ভাষা, কবি যত বিশিষ্ট ও মৌলিকই হোন না কেন-কারো একার সম্পত্তি নয়, গোটা সমাজেরই তাতে অবাধ ও সাধারণ অধিকার। ঐ ভাষার পথ ধরেই সমাজ আসে, যুগ আসে, এসে কবিতায় প্রবেশ করে। যতই নিরাসক্ত হোন না কেন, কবিতা তিনি পথে চলতে যেয়েই লিখুন কি ঘরে বসেই লিখুন, কবি সমাজেই বাস করেন, সমাজের আর পাঁচজনের জন্যই কবিতা লেখেন –দার্শনিক ক্রোচে।
জাতিগত উত্থান, অবস্থান সংস্কৃতিগত পরিবেশ, স্ব-সময়, সমাজ, ব্যক্তি মনোবৃত্তি, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, জাগরণ, প্রকৃতি এ সমস্ত বিষয় কবিকে প্রভাবিত করে। ব্যক্তি কবি এ সমস্ত বিষয় দ্বারা সর্বত্র আপ্লুত, জাগরিত হন। মননভূমির-চিন্তাভূমির অনবরত কর্ষণের ভিতর দিয়ে কবিতার উন্মোচন ঘটে। কবি কবিতা লেখেন। সম-সাময়িক সমস্ত কবিকর্মী কবিতা লিখছেন, তাঁদের চিন্তা-চেতনা সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এসেছে জীবন। এসেছে স্ব-সমাজের বাস্তবতা, আত্মার ক্ষয়, নির্যাস, সম্পর্কের ভেঙে যাওয়া, দারিদ্রতা, অসুস্থতা, মানবিক স্পর্শের আকুতি। বাংলাদেশের কবিতা মুক্তির পথে, উত্তরণের পথে। স্বাধীনতা উত্তর কবিদের কবিতায় বিজয় এসেছে। এসেছে স্ব-ভূমির-প্রতি, স্ব- সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির চিন্তা, সামাজিক সমস্যার দিকগুলি অনুুভূত হয়ে উঠেছে। নব্বই-এর পরবর্তী সময়ে জীবন যাত্রার যে বাস্তবতা, দেশ-বিদেশ, আন্তর্জাতিক সীমা পরিসীমা, তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে বিশ্ব-বাজার, বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতিগত যে উত্থান, পতন, জোয়ার-ভাটা, তার ছায়া-প্রচ্ছায়া, প্রতিফলিত হয়েছে লেখায়। জীবনের প্রকৃত ছবিটি আবিষ্কারের এবং তাকে চিত্রিত করে তোলার প্রচেষ্টাটি কখনো এসেছে সরাসরি, কখনো তা নীরব, নিঃশব্দে। প্রতীকি ব্যঞ্জনায়।
এখন কবিতায় অন্তর্মুখিন প্রবণতা খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকতা, মানবিক অধিকার, ব্যক্তির অবস্থানগত সত্য, সীমা-অসীমার দ্বন্দ্ব, নির্যাতিত, নিষ্পেসিত, বন্দিত্ব, হতাশা, দুঃশাসন, রোগ-ব্যাধি, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসণ, সব কিছুই সরাসরি, কবিতায় এসেছে। কবি বিরোধিতা করেছেন অন্যান্য সামাজিক দশজন মানুষের মতো। তাকে বাঁচতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতো। কিন্তু বক্তব্য উপস্থাপনে, চিন্তা-চেতনায়, কর্মে তাকে ছুঁতে হচ্ছে, তাড়িত হতে হচ্ছে, ভিন্ন যাত্রায়, ভিন্ন ভাবনায়, ভিন্ন পরিবেশ নিয়ে। কবির সামাজিক জীবন ধারণ সব সময়– এই বিরুদ্ধ পরিবেশে ঘটে। সামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি সমগ্র পরিবেশের প্রভাব কবির থাকে। কবি অস্বীকার করতে পারেন না। স্বাভাবিক পরিবেশ রচনা এবং সেই পরিবেশ নির্মাণের প্রচেষ্টা অনবরত কবিকে প্রলুব্ধ করে। হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ ঘটিয়ে কবি ও কবিতার যাত্রা নিরন্তর প্রবাহিত হয়। জীবনের স্বাভাবিক সঞ্চালন বাংলাদেশে প্রতিটি মুহূর্তেই বিঘ্নিত। কারণ অন্বেষণের পদক্ষেপ খুবই কম। সামাজিক পট পরিবর্তনের প্রধান দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত সেই নীতি নির্ধারকরা কোনোভাবেই পারছেন না সুস্থ সমাধান দিতে। পারছেন না পরিবেশের গঠনগত রূপ নির্মাণের। দিন দিন সব কিছুর পরিবর্তন ঘটছে। জাতিগত বিভাজন, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, মূল্যবোধ, সামাজিক কমিটমেন্ট, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের, রাজনীতির নোংরা অবস্থান, হিংসা-বিদ্বেষ; ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ ও জাতি। সহজ, সুন্দর, সুস্থ পরিবেশ এখন অস্বাভাবিকতার। সবকিছুই এখন নঞার্থক। জীবনের নঞার্থক বিষয়গুলির সত্য উন্মোচনে কবিতা জাগ্রত। কবির চোখ জ্বলে ওঠে। কবিতা হতাশার কথা বলে, অসুস্থতার কথা বলে। ক্লান্তির, বিমর্ষতার ছাপ প্রকট করে তোলে।