কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা : ভবিষ্যৎ কবিতার অজানা সড়ক
মতিন বৈরাগী
এখনতো আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ
ইথারের ওভেনে সেদ্ধ হয় বাতাসের ডিম
রাত্রির বাগানে ফোটে ছোট ছোট দীর্ঘাশ্বাস
অন্ধকারের ফরাশ বিছিয়ে বসেন-ই পীর
সময়ের এই প্রস্থে মানুষের ভাবনায় যে নতুন অনুষঙ্গ উপস্থিত; মানুষের যে ভাবনা বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার দৃশ্যগুলোতে প্রবেশ করছে তা দেখতে পাচ্ছেন কবি ‘আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ’ কবিতার মধ্য দিয়ে। সভ্যতার নতুন যাত্রায় টেকনোলজির যে উৎকর্ষতা মানুষকে নিয়ে চলেছে তার জ্ঞাত জগৎ থেকে, তার চারপাশ থেকে, আরেক জগতে, যা মানুষের মনের জগতের হ্যালুসিনেশনের মতো বাস্তব ও অবাস্তবের সংকট, আর তাতে ভাবনার গতি দ্বিধা ও দ্বিরুক্তির ভেতরে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে এলোমেলো এক কল্পনায় যা সত্য নয় তবু যেনো এমন এক প্রকাশ যে সত্য হলে হতেও পারে। ডিজিটাল নারদ, মিথের নারদের চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলোকে ইলেক্ট্রণ জগতে এনে তার সমতাকরণ আর অলিক ভোঁজবাজির মতো একটা মনের সংকট নানা প্রতীকে বিস্তারিত যার অস্তিত্ব আছে বস্তুজগতে বস্তুর মতো এবং ভাবনায় আছে, পরিমিতিহীনতায় আছে, অপরিমিতির মধ্যে আছে একটা অভাবিত প্রকল্পে; তখনি কেবল ‘ইথারের ওভেনে সেদ্ধ হয় বাতাসের ডিম’। এই পঙক্তি কাব্যিক হয়ে ওঠে জীবনযাপন প্রণালীর মধ্যে এবং ‘রাত্রির বাগানে’ তখন ‘ফোটে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস’ আর ‘অন্ধকারের ফরাশ বিছিয়ে বসেন ই-পীর’। এই কল্পণায় বাস্তবের অগ্রগতি এবং মনোজগত এই দুইয়ের একটা বিধান রয়েছে। তিনিই একালের মোড়ল, নিয়ন্ত্রক, তিনিই বহুজাতিক কোম্পানী, নানা চেহারায় আবির্ভূত। তার কেরামতিতে আমরা দেখি ‘দুধভরা ওলান ঝুলিয়ে হাঁটে বরফের গাই, মুখ দেয় সেল্যুলার ঘাসে’ তারপর ‘কষ্টের টুথব্রাশে দাঁত মেজে’ আমরা ‘স্নেহের ঝাপটা দিই চোখে-মুখে’। ‘সারাদিন পার করি স্বপ্নের জামায় বোতাম লাগাতে লাগাতে’। ‘রৌদ্রের ঠোঙায় করে’ তখন ‘সিঙারা কিনে আনে মেঘের ছেলেরা’ আর ‘বিকেলটাকে ল্যাঙ মেরে সন্ধ্যাবাবু ধুতি গুটিয়ে বসেন চিন্তার ছাদে’। ‘উরু ফাঁক করে’ তখন ‘শুয়ে পড়ে রাত্রি’, অসহায় অথবা বারবনিতা, এক বাধ্যবাধকতার নিয়মে আবদ্ধ।
যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কি হলো? কবিতা কি এমন? এর কি অর্থ হয়? কবিতা কি অর্থহীন প্রলাপ? কিন্তু যদি নিবিষ্ট হয়ে আমরা পাঠে বসি এবং এই বয়ানগুলো আমাদের চলমান চেতনায় নিয়ে মিলিয়ে দেখি তা হলে দেখবো যে বলার ভঙ্গিতে রয়েছে এক জাদুকরী মোহমায়া, যা ছড়িযে রয়েছে বাস্তবেও। এটাই কি জাদুবাস্তবতা নয়? এই কবিতা আমাদের হাতছানি দেয়, নানা ভাবে প্রলোভনে ফেলে এবং আমাদের লুট করে; আমরা কষ্টের ‘টুথব্রাশে দাঁত মাজি’ ‘স্নেহের ঝাপটা দিই চোখে-মুখে’ আর স্বপ্ন দেখি, ‘সন্ধ্যাবাবু ধুতি গুটিয়ে বসেন চিন্তার ছাদে’। দিন ফুরায়। ‘উরু ফাঁক করে শুয়ে পড়ে রাত্রি’। এসব নানা দৃশ্যহীনতার ভেতর এক দৃশ্য যা আমরা বুঝি না কিন্তু বুঝি, যা তৈরী করে এক ঘোরের জগত।
কবিরা আগামীর কবিতা কেমন লিখবেন এর একটা আন্দাজ আমরা ‘আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ’ কবিতাটি থেকে অনুমান করে নিতে পারি। এই কবিতাটি নানা ভাবনা দিশা বিদিশার সাথে আমাদের যুক্ত করে। কাজী জহিরুল ইসলাম হয়ত নিজের অজান্তেই নির্মাণ করেছেন ভবিষ্যৎ কবিতার অজানা সড়ক।
দেখো ভিনিয়াস, দেখো লিথুনিয়া
দেখো প্রিয় জন্মভূমির অনুর্বর ধুলিকণা
শীতল উপত্যকা এবং আধুনিক মস্কো
দেখো জেনারেল উইন্টারের দেশ
তোমাদের পাথরের চোখগুলো মেলে ধরো
দেখো কী বিভৎস দাঁতাল শুয়োরের দল
আমার গলায় বসিয়েছে ইস্পাতের দাঁত
অথচ মুখে ওদের ভুবন ভুলানো হাসি
গণতন্ত্রের ব্যাপক আস্ফালনে
প্রিয় পিত্রিভূমির গলায় ওরা ঝুলিয়ে ভিক্ষার বেশাতি…
হে দেশবাসী তোমরা আবার কমরেড হও
এবার সত্যিকিারের কমরেড..[ লেনিনের ভাষণ ]
এই কবিতাটি ১৯৯৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পার্টির মুখপত্র ‘একতা’য় বিশেষ ভাবে ছাপা হয়। গদ্যের লিরিকে বলিষ্ঠ এক বক্তব্য যার আবেগগুলো পরিমিতির মধ্যে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে আর কবিতা হয়ে উঠছে এক কমরেডের বিদায় ভাষণ যার প্রান্তগুলো একই কেন্দ্রমূখি এবং যখন বলেন ‘বিদায় আজারবাইজানের উষ্ণ মরুভূমি/বিদায় সাইবেরিয়ার দুর্ধর্ষ জেনারেল/ওয়াশিংটনের পায়ে মস্তক নোয়ানো অতি সভ্য মস্কো তোমাকেও বিদায়’। এই ভাষণভাবকবিতায় যে আবেগ তা যেনো সমপুষ্টি নিয়ে বসে গেছে কবিতাটির গায়ে, নির্মাণের বিশেষ গুণে। এখানেও সেই এক ঈশ্বর ‘আনন্দ উৎসবে মেতেছে হোয়াইট হাউজ’ দ্বারা স্পষ্টতই তার ভূমিকা এবং বিজয়ের বিষয়টি আর আলগা থাকেনি। কবি যা অনুভব করেছেন তা অনুভব করতে পারেননি আমাদের প্রগতিবাদীগণ পতনের আওয়াজে ছাতাটা বুজিয়ে খুঁজছেন ঈশ্বর, মানে ধনী, প্রভু, রাজা, স্বামী, অধিপতি যিনি অপরকে অধীন করেন । ‘মঙ্গলময় ঈশ্বর’ এ তিনি বলেন’ ‘মানুষগণ, তোমরা শোনো এবং বিশ্বাস করো’ এখানেও বিবৃতিগুলো আবেগদীপ্ত এবং সম্মোহনপূর্ণ। এখানে ঈশ্বর বসবাস করেন মাটির ঘরে, তিনি কোনো দৈববাণী পাঠান না এই যে ‘এই মাটির ঘরে/মৃত্তিকা বেষ্টিত এই পরিপাটি ঘরেই তার বসবাস’ এবং তিনি এই ঈশ্বরকেই নিজের ঈশ্বর বলে মানছেন এবং বলছেন ‘আমার ঈশ্বর প্রেরণ করে না কোনো দৈববাণী/ ক্রোধের লা’নত ছুড়ে পোড়ায় না অবিশ্বাসীদের ফসলের মাঠ’ এই অভিজ্ঞতা তার কর্ম-উপলক্ষ ভ্রমণ থেকে কুড়াণো অভিজ্ঞতা যা তিনি দেখেছেন বসনিয়ায়, কসোভোতে, দেখেছেন অফ্রিকায়, এশিয়ার নানা দেশে। আর কবিতাটি শেষ হয়েছে ‘আমার ঈশ্বর হাসে, নিষ্পাপ নির্মল হাসি’র মতো নিটোল পঙক্তিতে।
‘আমাদের বুকে পা রেখে মঞ্চে ওঠেন মহান ঈশ্বর
আমরা ঈশ্বরের পায়ে চুমু খেয়ে
প্রার্থনার সংগীতে মগ্ন হই
ঈশ্বর তুমিও তৈরি থেকো
একদিন আমরাও মঞ্চে উঠব
মানুষের ভার তোমাকেও বুক পেতে সইতে হবে’
[পারিবর্তন]
কিংবা
শাসকেরা মিথ্যার বেশাতি ফেরি করে প্রতিদিন।
আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি তবু ব্যালটের বাক্সে
গণতন্ত্র গণতন্ত্র তসবিহ জপি সারাক্ষণ
স্বপ্নের স্বদেশ! প্রত্যাশার আলো ক্রমশই ক্ষীণ
মরে যেতে যেতে বলি স্বপ্ন একটুকরো থাক সে
হৃদয়ের খুব কাছে তবু, সুখের অনুরণন।
[হতাশা নগর ]
এই যে প্রতিদিনের মৃত্যু, প্রতিদিনের এক প্রবঞ্চনার মধ্যে জীবন যাপন, এ যেনো এক নিয়তি যাকে বহন করে চলেছে একদল মানুষ। তারা প্রতারিত, প্রবঞ্চিত এক দাস্যজীবনের বোঝা টানছে।
ভাল কবিতার জন্য দরকার অভিজ্ঞতা, বিশ্বকে জানা, নিজের মধ্যে তার মগ্নতার অধিষ্ঠান তৈরি করা, প্রকাশে উপযুক্ত ভাষাকে বাহন করা, তা হলেই ভাষা আভিধানিক অর্থ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন অর্থের দ্যোতনা দেয় পাঠকের মনে। সেরকম অনেক কবিতা রয়েছে কাজী জহিরুল ইসলামের । নানা অভিজ্ঞতার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে তার কবিতায়, রয়েছে গম্ভীর বাক্যবিন্যাস, চমৎকার সব উপমার ব্যবহার এবং মাপা ছন্দের কাজ। কাজী জহিরুল ইসলাম মানবিকতার পক্ষের কবি, মানুষই তার কাছে হয়ে উঠেছে দীপ্তিমান ঈশ্বর আর তা একারণে যে বহুজাতিক অর্থনীতি, এককেন্দ্রিক বিশ্বপরিকল্পনা যে ঈশ্বরের ভূমিকা নিয়েছে তা রুখতে মানব ঈশ্বরের জাগরণ অনিবার্য। এই বাণীই ব্যপ্ত হয়েছে কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায়। বহু বছর আগে তার সম্পর্কে কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবি-তারুণ্যকে আমি প্রবাসে দেখতে পাচ্ছি’। পঞ্চাশের আরেক প্রধান কবি শহীদ কাদরীকেও দেখি কবি কাজী জহিরুল ইসলাম সম্পর্কে ‘বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবির উন্মেষ’ বলে উচ্ছসিত হতে।
রামপুরা, ঢাকা। আগস্ট ২০১৪।
কাজী জহিরুল ইসলামের “কবিতাসমগ্র”
হাসান ফেরদৌস
[কবিতা সমগ্র, কাজী জহিরুল ইসলাম, পৃষ্টা ৩৫১, মূল্য ৫০০ টাকা, বাংলাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫।]
কাজী জহিরুল ইসলাম লেখক হিসাবে পরিণত। কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী ও কলাম সংকলন মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা ৩১ টি। শুধু কবিতা গ্রন্থের সংখ্যাই ১০টি। এর মধ্যে প্রথম আটটি, সাথে কিছু অনূদিত কবিতা, নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার “কবিতাসমগ্র”।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত প্রথম যৌথকাব্যগ্রন্থ, জলের মিছিল, ও ২০০৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ, দ্বিতীয়বার অন্ধ হওয়ার আগে, সব মিলিয়ে গত পনেরো বছরে এই কবির নিরলস পদচারণার প্রমাণবহ এই আঁকর গ্রন্থে একদিকে কাজী জহিরুল ইসলামের কাব্য ভাবনার নানা দিক যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি ধরা পড়ে একজন কবির ক্রমশ কবি হয়ে ওঠার বিবরণ।
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার মুখ্য বিষয় প্রেম, যদিও শুধু নারী-পুরুষের প্রেমে তাকে আটকে রাখা অযৌক্তিক হবে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের “বন্দি,” নামক কবিতা থেকে শেষ কাব্যগন্থের “সুবাস,” সর্বত্রই নারী নামক এই রহস্যের গ্রন্থি উদ্ধারে কবির নিরন্তর অন্বেষণ। নারীর কাছে কবি গেছেন প্রেমের বুভুক্ষা নিয়ে, ফিরে এসেছেন কৃতজ্ঞতার অঞ্জলি নিয়ে। ফলে এই গ্রন্থে প্রেমের আবিষ্কার ঘটেছে ইতিবাচক আত্মবীক্ষায়, আয়ুহীন নিস্ফল রক্তক্ষরণে নয়।
প্রেম থেকেই কবি খুঁজে পান জাতপাতের বিভেদ সূত্র, সমরায়োজনের গোপন মন্ত্রণা, ঘৃণার ধিক ধিক আগুনের লেলিহান শিখা। উদাহরণ হিসাবে ২০০৩ সালে লেখা “লাল স্কার্ট” কবিতাটির কথা ভাবা যাক। এ এমন এক সময়ের কবিতা যখন বলকান পুড়ছে জাতিগত আত্মহননে। একটি সার্ব বালিকা ও একটি আলবেনিয় যুবক যেই বিভেদকে অস্বীকার করে একে অপরকে ভালবাসে। দুটি দেহ, দুটি আত্মা নিকটবর্তি হয়, কিন্তু ঘৃণার আগুনে পুড়ছে যে দেশ, জাতপাতের বিভেদই তার কাছে একমাত্র সত্য। যাদের প্রেম জন্মেই মৃত, জহির তাদের আখ্যানটি নির্মাণ করেছেন প্যারাবলের ভাষায়। তার কিছুটা গল্প, কিছূটা ইতিহাস পাঠ, আর দুই মিলিয়ে ভীষণ নির্জন, ভীষণ বেদনার একটি কাব্যচিত্র। জাতিভেদের কারণে যুবকটির মৃত্যু হয়, কিন্তু বেঁচে থাকে প্রেম। কবি দেখেছেন ক্রুশবিদ্ধ যেই যুবকের রক্ত, যা মেঘ হয়ে উড়ে যায় আকাশের কাছে।
“আর বিরহী সার্ব-সুন্দরীর লাল স্কার্ট
প্রেমিকের রক্ত মেখে ক্রমশ আরো লাল হয়ে
ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত বলকান আকাশে
সেই থেকে বলকানে আগুন, যুদ্ধ ও রক্তের খেলা”
কবির – শুধু কবি কেন, যে কোন শিল্পীর প্রধান লক্ষণ, সহমর্মিতা। যে কবির রচনায় এই সহমর্মিতার অনুরণন শোনা যায়, তার কবিতা একান্ত ব্যক্তিগত হওয়া সত্বেও তা হয়ে ওঠে আমাদের নিকটবর্তি, তার সমিপ্যধ্বনিতে শুনি সংহতির উচ্চারণ। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য এই সহমর্মিতা, যা অনায়াসে দেশ ও জাতির বিভাজন রেখা অতিক্রম করে যায়। এই গ্রন্থের কাব্য নির্মাণক্রম অনুসরণ করলে স্পষ্ট হয় যে কবি এই বোধটি অর্জন করেছেন ক্রমান্বয়ে। শুরুতে যা ছিল একটি অনুচ্চ চিন্তা, ক্রমশ তা হয়ে ওঠে তার চিন্তা জগতের কেন্দ্রবিন্দু। এর একটি কারণ, তিনি একাধিক মানব সভ্যতা নিকট থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান এবং তা থেকে এই স্থির-বিশ্বাসে উপনীত হন, অন্তর্গতভাবে মানুষ সর্বত্রই অভিন্ন। তার এই অভিজ্ঞতার প্রমাণ এই পংক্তিসমূহঃ
তোমাকে চিনতে হবে মানুষের ভেতরের মানুষগুলো
বৃক্ষের ভেতরের বৃক্ষগুলো
অরণ্যের ভেতরের অরণ্যগুলো
নদীর ভেতরের নদীগুলো
ছায়ার ভেতরের ছায়াগুলো
এরপর বৃত্ত ভাঙতে হবে।
[একটি বৃত্তের গল্প]
জহিরের প্রথম দিকের কবিতায় একটি উচ্চকিত রাজনৈতিক স্বর শোনা যায়, যা কখনো কখনো অনুচ্চ ভাষণে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালে রচিত “লেনিনের ভাষণ” কবিতার কথা ভাবা যাক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ছে, অন্য অনেকের মত তাতে তিনিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গোপন অঙ্গুলির হদিশ পান। এই ভাঙ্গন যে বস্তুত একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা, এই ইতিহাস বোধ তার মধ্যে অনুপস্থিত। ফলে, তিনি সেকথাই বলেন যা একজন বাঙালি তরুণ কবি বলতে পারেন। তিনি এই স্বপ্নে অনুবর্তি হন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো এক সময়ে আবার তার সাম্যবাদী শেকড়ে প্রত্যাবর্তন করবে।
আমার উত্তোলিত হাত তোমাদের করছে আশীর্বাদ
হে প্রিয় দেশবাসী তোমরা আবার কমরেড হও
এবার সত্যিকারের কমরেড।
[লেনিনের ভাষণ]
জহির পয়ারে কবিতা লেখায় অভিজ্ঞ, ছন্দোবদ্ধ কিছু প্রেম বিষয়ক কবিতায় তিনি সেই রকম কাব্যিক দুলুনি অর্জন করেন যা পাঠককে আবিষ্ট করে। এই বইতে সে রকম কবিতার কমতি নেই, আর কবি হিসাবে তার আত্মপরিচয়ের সেটি একটি প্রকাশও বটে।
অন্তর্গতভাবে প্রেমিক এই কবি তার প্রবজ্যার অন্বেষণের ভেতর দিয়েই ক্রমান্বয়ে অর্জন করেছেন একটি নিজস্ব কন্ঠস্বর। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, কাব্যভাষার সাথে ইতিমধ্যে পরিচিত এই কবি আগামীতে প্রোদ্ভিন্ন বহু বিচিত্র ও বর্ণিল অভিজ্ঞতার নৈকটিক বিবরণ জানাবেন। সেই প্রতিশ্রুতি তার এই কবিতা সমগ্র-তে রয়েছে।[1]
৩১ মে ২০১৫। নিউইয়র্ক
[1] লেখক হাসান ফেরদৌস ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাময়িকীতে এই রিভিউটি লিখেন ২০১৫ সালে।
কাজী জহিরুল ইসলামের ভ্রমণগ্রন্থ : কসোভোর পথে-প্রান্তরে
কাজী রোজী
আলোর গতি কিংবা শব্দের গতি কিংবা বাতাসের গতির চেয়ে মনের গতি অনেক বেশী দ্রুতগামী। মুহূর্তে মন ছুটে যেতে পাড়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে। মনের এ নিঃশব্দ চলাচলের নাম মনন-ভ্রমণ। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কসোভোর পথে-প্রান্তরে পড়তে পড়তে আমার তেমনি মনন-ভ্রমণ হয়ে গেল। স্থল পথে জল পথে কিংবা আকাশ পথে নয় – মনের দৃষ্টি মেলে কসোভোতে হারিয়ে গেলাম আমি। নীরবে নিভৃতে মুহূর্তে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আমার মন আশ্রয় নিল কসোভোর মানুষ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক ঘটনাবহুল নান্দনিকতার অবস্থানে। সাথে ছিলেন ঘুরে ফিরে সেই অদৃশ্য মানুষ যার নাম কাজী জহিরুল ইসলাম।
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি, আলোচনাও করেছি, সেখানে অনেক স্বাচ্ছন্দবোধ করেছি। কিন্তু গদ্য – এ যে ভীষণ অন্য জগত! তার ওপর এখানে-সেখানে নিকট ও দূরের খবরাখবর মিশ্রিত গদ্য। “কসোভোর পথে প্রান্তরে” কোনো উপন্যাস নয়, ছোট গল্প কিংবা প্রবন্ধ নয়। বিদেশে থাকার, বেড়াবার অভিজ্ঞতা। জীবনের কিছুটা সময় বাংলাদেশে না থেকে কসোভোতে থাকার অভিজ্ঞতা। কম বেশী তিন বছরকাল কাজী জহিরুল ইসলাম চাকরির সুবাদে কসোভোতে ছিলেন। সেই সব দিন যাপন, চাকরীর পরিবেশ, সাথে সাথে বিচিত্র মানুষের শৈল্পিক সান্নিধ্য তাকে কতটা ভারাক্রান্ত কিংবা আশ্বস্ত করেছে সে সব বর্ণনাই এ বইটিতে পাওয়া যায়। “কসোভোর পথে প্রান্তরে” বইটিকে আমি নিছক ভ্রমণকাহিনী বলবো না। পর্যটক ভ্রমণ করেন – দেখেন – শোনেন, তারপর বর্ণনার আশ্রয়ে নিজেকে সমর্পণ করেন। অর্থাৎ নিছক মনের পিপাসা মেটানোর তাগিদ থাকে সেখানে। কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম শুধু মনের নয়, জ্ঞানের পিপাসা অধিক পরিমাণে নিবৃত্ত করেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন কৌতূহলী পাঠকের জানার আগ্রহকে। বইটির ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘অস্বাভাবিক ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাব কসোভো। কথাটা শুনে সবাই আঁতকে উঠছে। ওখানে মানুষ যায়? ওটাতো একটা বদ্ধভূমি। এক মহাশ্মশান’। সম্মানিত পাঠক, এটুকুর ভেতর দিয়ে যখন দৃষ্টিপথ মেলে ধরবেন নিশ্চয়ই আপনাদের মনে কি, কেন, কোথায়, এসব প্রশ্ন জাগবে। বদ্ধভূমি কেন – মহাশ্মশান কিভাবে হলো, এসব বিষয়ে আগ্রহ জাগবে। এভাবেই লেখক টেনে নিয়ে গেছেন তার প্রান্তিক অবস্থানে। যেহেতু কর্মসূত্রে অবস্থান, এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব রয়েছে, তাই অনেক তথ্য এবং তত্ব জানা এবং উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে লেখকের। তাড়না ছিল না চটজলদি অবস্থা এবং অবস্থান ফেলে চলে যাবার। আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু, ঘোরা যাবে, দেখা যাবে, জানা যাবে। সময়ের অভিজ্ঞতা অনেক গুরুত্ব বহন করে। কসোভোতে জহিরের অবস্থান চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, আনন্দের সান্নিধ্যে টেনেছে এবং অত্যন্ত জ্ঞানসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ রচনায় সহায়তা করেছে। বইটির একাদশ অধ্যায় থেকে কসোভোর ভৌগলিক অবস্থার সাথে পরিচিত হবেন সুধী পাঠক। জানবেন এর পূর্বদিকে মেসিডোনিয়া, দক্ষিণে আলবেনিয়া, পশ্চিমে মন্টেনিগ্রো এবং উত্তরে সার্বিয়ার সাথে কসোভোর যে সীমান্ত তা আজ আন্তর্জাতিক সীমান্তের মর্যাদা লাভ করেছে। এই সীমান্তকে এখন বলা হয়, “জাতিসংঘ সীমান্ত”। কসোভোতে বর্তমানে কোন সরকার নেই। যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রভিন্স কসোভোর পুরো নিয়ন্ত্রণ করছে উনমিক। উনমিকই এখন এখানে সরকার। উনমিকের ব্যাখ্যা হচ্ছে, ইউনাইটেড নেশন্স মিশন ইন কসোভো। লেখক ইওরোপিয়ান টেরিটোরির কসোভোর ভিটিনায় মূল প্রশাসনের একজন সিভিল পদস্থ কর্মকর্তা হিশেবে ভোটার ও সিভিল রেজিস্ট্রেশনের মতো একটি স্পর্শকাতর কাজের দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছেন। ভিটিনা মিউনিসিপ্যালিটির জন্যে ছয়জন আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রেশন সুপারভাইজার এসেছেন। লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম তাদের একজন। লেখক বলেছেন – তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা সবাই যেন আকাশ থেকে নেমে আসা একদল এঞ্জেল। গলায় স্বর্গের আইডি ঝোলানো। কোন এক ঈশ্বর যেন তাদেরকে পাঠিয়েছেন সে দেশের অসহায় মানুষকে যুদ্ধের বিভীষিকামুক্ত একটি স্বর্গরাজ্য উপহার দিতে। এজন্য সার্বিয়ান এবং আলবেনিয়ান দ্বন্দ্ব –সংঘাতের পূর্বাপর ইতিহাস বিশদ জানার প্রয়োজন হয়েছে লেখকের। সার্বিয়ানরা সংখ্যালঘু। ওদের বাড়িগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিহিংসাবশত যে কোন সময় আলবেনিয়ানরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে সার্বিয়ানদের বাড়িঘর। এহেন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই গ্রীন হাউজে থাকতে হয়েছে লেখককে। জাতিসংঘ সিস্টেমে কাজ করতে হয়েছে। প্রচুর মিটিং করতে হয়েছে। কমিউনিটি লিডারদের সাথে মিটিং এবং কাজ করতে খুব ভাল লেগেছে। এদের সাহায্যেই সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়েছে। আলবেনিয়ানরা কসোভোতে ফিরে এসেই ভোটার রেজিস্টারে নিজেদের নাম লেখাচ্ছেন নিজেদের তাগিদেই। সুতরাং কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
অমন বিভূঁই বিদেশে এদেশের কবি জাহিদ হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়েছে লেখকের। তিনিও সেখানে কর্মরত একজন, এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। অনেক অনেক বিদেশী এবং কিছু স্বদেশীর সাথে কসোভোতে দেখা হয়েছে লেখকের। তবে কবি জাহিদ হায়দারের বাসায় পিকনিক পিকনিক আমেজে খাওয়া-দাওয়া করা লেখকের মনে স্কুল পালানো বালকের ভয়ানক এক্সকারশনের মতো স্মৃতিবহুল ছবি এঁকে দিয়েছে।
কসোভোর নারী-পুরুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে অনেক ভালোলাগা-ভালোবাসা, আনন্দ-বেদনা এবং প্রীতিকর সম্পর্কের জন্ম হয়েছে। ধরা পড়েছে সেখানকার শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাবার, অর্থ ও সামাজিক পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের ঘটনা। লেখক অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় এবং আন্তরিক মননে কসোভোর নানাবিধ বৈশিষ্টের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মানুষের মনের ভেতরে অনেক ইচ্ছের কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। লেখক কখনো কখনো, কোথাও কোথাও বেশ আবেগপ্রবন হয়ে কিছু গোপন কথা অবলীলাক্রমে বলে গেছেন। এখানে লেখক শুধু সাহসী নন সৎ একজন মানুষ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। জীবনে মানুষ একা নয় – পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে মানতেই হয় এবং সে জন্যে হয়তো বেশ কিছু ছাড় দিতে হয় সঠিক মূল্যায়নের জন্যে।
কসোভোর পথে প্রান্তরে বইটি পড়তে সবার যে ভালো লাগবে তা নয়। কারণ এ বইতে অনেক বেশি তথ্য-উপাদান সংযোগ করা হয়েছে। ভ্রমণ কাহিনী বটে, তবু শুধুমাত্র ভ্রমণ নয় “কসোভোর পথে প্রান্তরে”, এটি একটি শিক্ষনীয় গ্রন্থও। যারা জ্ঞান পিপাসু তাদের অবশ্যই ভাল লাগবে।
ধন্যবাদ লেখক কাজী জহিরুল ইসালামকে তার অনবদ্য গদ্যের জন্যে।
মিরপুর, ঢাকা। মার্চ ২০০৭।
ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ : একটি সফল
নিরীক্ষার অপর নাম
সুবিমল চক্রবর্তী
ধারনাটা অবচেতনে অনেক দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল নিশ্চয়ই। তা না হলে রবীন্দ্রবলয়, তিরিশ, তিরিশোত্তর এই শব্দগুলো কেনই বা মনে হবে? অনেকটা নাজেল হওয়ার মতই ক্রিয়াপদহীন কবিতার ধারণা সহসাই কবির চিন্তায় ভর করেছিল। একটু দ্বিধান্বিত হলেও নিরীক্ষণশীল সাহসী কবি লিখতে শুরু করলেন ক্রিয়াপদহীন কবিতা। না, কবিতা থেকে ক্রিয়াপদকে তিনি পুরো নির্বাসনে পাঠালেন না। তাঁর কবিতার দর্শন হল অনেকটা এই রকমঃ কবিতায় ক্রিয়াপদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকে কবিতার ভিতরের কবিতাকে আচ্ছন্ন করে দিতে না পারে যেন। তবে প্রয়াত কবি শহীদ কাদরীর কথাটা কিন্তু মাথায় রেখেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। তাই তো সতর্ক বিনয় মাখানো আবেদনঃ দেখবেন কবিতা কবিতা হয়ে উঠেছে কিনা। আমরা জানি তা না হলে কৃত্রিমতার ভারে সব আয়োজন ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
“ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ” নামের কবিতার বইটির পঁয়ত্রিশটি কবিতার সবগুলোই পড়েছি। রসাস্বাদন করতে চেয়েছি। বলব, কবির ভয় অমূলক। সবগুলো কবিতাই কবিতা হয়ে উঠেছে। কবিতাগুলো ২০১৫ সনের ১৬ই আগস্ট থেকে শুরু করে ২০১৬-র ৪ঠা এপ্রিল এই নয় মাস ধরে লেখা হয়েছে। একটি-দুটো কবিতা বাদে সবগুলোই কালানুক্রমিকভাবে সাজানো হয়েছে। সময়ের প্রবাহের সাথে চিন্তার প্রবাহের সঙ্গতি থাকবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে। তবে অনন্ত কালপ্রবাহের মধ্যে এই নয় মাস কিছুই না। কিন্তু সময় তো নিরন্তর ঘটনাবিক্ষুব্ধ। সময় স্মৃতিজাগানিয়া। তাই সঙ্কীর্ণ সময়ের মধ্যে লেখা হলেও তার পায়ের ছাপ কবিতায় থাকবেই। কবিতাগুলোর নাম বিষয়বস্তুর ব্যাপকতার দিকে ইঙ্গিত করতেই পারে। কিন্তু আসলেই কি তাই? যতটা বুঝেছি তাতে উল্টোটাই মনে হয়েছে। স্থান ও কালজাত নিরবয়ব একটি বোধ যেন সব কবিতার উপর ছায়া বিস্তার করে আছে।
পঁয়ত্রিশটি কবিতা নিয়েই আলাদা আলাদা আলোচনা হতে পারে। তবে সে পথে না গিয়ে একটি সাধারণ আলোচনায় লেখাকে সীমিত রাখছি। আগেই বলেছি সব কবিতাই কবিতা হয়ে উঠেছে। সত্যি সত্যি প্রায় প্রতিটি কবিতাকেই ‘বহু বাসনায়’ক্রিয়াপদ থেকে বঞ্চিত করে ‘বাঁচানো’ হয়েছে। কিন্তু এই ‘অধ্যবসায়ের’ ছাপটুকু কবিতায় অনুপস্থিত বলেই কবিতাগুলো কবিতাই। যেমন, প্রথম কবিতা “হাইফেন”-এর (কবির দৃষ্টিতে “পৃথিবীকালও এক সুবৃহৎ হাইফেনমাত্র”, পূর্ণ বিরতি নয়। কবি হয়ত অনন্ত সময়গ্রন্থির কথাই ভাবছেন।) কথাই ধরা যাক। “আমাদের কারো যাত্রাই পশ্চাদমুখী নয়” লাইনটিতে “নয়” ক্রিয়াপদ ঠিকই, কিন্তু কবি আগেই বলে নিয়েছেন সব ক্রিয়াপদ বাদ দেওয়া হয়নি। “ক্যাথিড্রাল-সন্ধ্যা”র মতন নতুন শব্দ চয়ন করেন কবি। তিনি তৈরি করেন অপূর্ব উপমা। যেমন, “স্পাইরাল পতন” কবিতায় লিখছেনঃ “কৈশোরের প্রথম চুমুর মত উজ্জ্বল”। প্রবাসজীবনের একটা দিক তুলে ধরেন চমৎকার চিত্রকল্প দিয়ে—“স্যাঁতস্যাঁতে বেইজমেন্টে, স্বপ্নের ভারে বিনিদ্র রাত” (“বোকা পরবাস”)।
কবি রাজনীতিসচেতন। কিন্তু কবিতায় রাজনৈতিক স্লোগান নেই, ক্রোধ নেই, যা আছে তা হল বিস্ময় আর বিমর্ষতা। তাই বুঝি তাঁকে বলতে দেখি, “মারটিন লুথার কিং, স্বপ্নের ফসিল, এখন…“। “ছায়াবৃত্ত” কবিতায় কবি যখন প্রশ্ন করেন, “প্রকৃতিবৈরিতাই কি মানুষের আজন্ম তৃষ্ণা নয়?”, তখন কি মনে হওয়া অস্বাভাবিক যে, তিনি পরিবেশ সংরক্ষণের কথাই বলছেন? কিন্তু কাব্যিক গুণ রাজনীতিকে আড়াল করে রাখে। আমার মনে হয়েছে “ফ্রাঙ্কেস্টাইন” সেই একই রাজনীতিসচেতনতা, ইতিহাসসচেতনতা। আলোকের আভিসারী কবি। কবিকে তো তা-ই হতে হয়। চমৎকার কতোগুলো লাইন রয়েছে কবিতাটিতে :
“মরুঝড়ে বিধ্বস্ত চিন্তার কোমল চারাগাছ, বাকস্বাধীনতা
জেলাবির ভেতরে রক্তাক্ত তরবারি ফোরাতে উষ্ণ স্রোত
গুহা মৃত্যুর কথাও তো বিস্মৃত নয়, কী নির্মম শৃঙ্গপতন
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নরম পলিতে পুরনো জিন, দানবীয় আস্ফালন
ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর
স্ফীত বক্ষ, নির্দয় বাহু
আরক্ত জ্বরেরও দেশান্তর আছে, ইতিহাসে”।
শব্দে শব্দে সুন্দর ছবি আঁকেন কবি। “পর্যবেক্ষণ” কবিতায় এটি সুস্পষ্ট। কবির পর্যবেক্ষণ বাহ্যিক নয়। তাই তিনি বলতে পারেন :
“পর্যবেক্ষণ তো কবিরই কাজ, এমনকী নারীর অন্তর্বাস”।
আরো রয়েছে একই কবিতায়ঃ “কিশোরীর জামরঙা ঠোঁটে সন্ধ্যার চুমু”। “চণ্ডীদাসের প্রতীক্ষায় নিস্তরঙ্গ দুপুর”, অথবা “বিকেলের নড়বড়ে সাঁকোতে বসন্তের পারাপার”। পরিশেষেঃ “আমাদের অস্তিত্বের রাত্রি, প্রগাঢ়, অন্তহীন পর্যবেক্ষণের সুদীর্ঘ বিছানা।” আমি পরাবাস্তবতার সুস্পষ্ট চিহ্ন দেখি এখানে সেখানে।
রাত এখনো পোহায়নি। ক্রিয়াপদহীন বাক্য তৈরি করেন কবিঃ “ভোরের আলো তখনো দূরের অতিথি”। ইমিগ্র্যান্ট জীবন। সকলেই তো আর বৈধ নয়। হলেই বা কি! কারো কারো “পাকা দালানের মত কাঁধ”। তাই তো এরাই পারবে স্বপ্নের দেশ গড়তে। এদের সবাই কিন্তু একেকটা স্বপ্ন, তাই কবি চমৎকার দ্যোতনা নিয়ে বলেন, “একটি ওয়ার্কিং ভ্যানের আগমন, স্বপ্নের ঠাসাঠাসি আপলোড”। আরও একটি গভীর কাব্যিক পর্যবেক্ষণ দেখি “অমিল সুন্দর” কবিতায়। নারীদেহ “অমিত্রাক্ষর। অমিল ছন্দের নিটোল বুনন সারা দেহে।” স্বপ্নেরও করিডোর থাকে। সেটা সবাই দেখে না। “স্বপ্নের করিডোরে মৃতদের সারি, সারারাত।”। সে করিডোরে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, উজ্জ্বল মিছিল। মিছিলে শরিক খ্যাত-অখ্যাত মানুষ। কবি কিন্তু বলেন না যে, এটি তাঁর স্মৃতিকাতরতা।
প্রকৃত ভালোবাসা অজর, অমর, স্বর্গীয়। ভালোবাসাকে সময়ও জারিত করে। ভালোবাসাও ক্লান্ত হয়। এই বোধ থেকে অথবা এক দার্শনিক চিন্তা থেকেই কি কবি বলেন, “ভালোবাসারও আছে কালপ্রবাহ, বার্ধক্যের ক্লান্তি”? তা না হলে হেমিংওয়ের বুড়ো এবং সমুদ্রের কথা কেন আসবে? জীবনের প্রতি ভালোবাসায় ক্লান্তি এসে গিয়েছিল বলেই কি হেমিংওয়ের কথিত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল? লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই!
কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় শব্দাবলীর সহজ প্রবাহ টের পাওয়া যায়। শব্দ দিয়ে অকারণ জটিলতা তৈরি করেন না তিনি। সহজ করে কথা বলাটাই তাঁর অন্বিষ্ট। কিন্তু সহজ কথা যায় না বলা সহজে। কবিতার ক্ষেত্রে কথাটা নির্মমভাবে সত্য। কবিতার প্রয়োজনে ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে কলমে ধরা দেয় অমোঘ পঙক্তি “আকাশ নয়, কৈশোরের বিনিদ্র শ্লেট”। তৃষ্ণাকে নতুন ডাইমেনশন দেনঃ “তৃষ্ণার উচ্চতা কত?” অথবা, “শিশার ধোঁয়ার ভেতর ঈশ্বরের বাস, তার সাথে কথোপকথন, খানিক বিতর্ক,”। অথবা তাকানো যাক এই লাইনটির দিকেঃ “আমি এক ভয়ঙ্কর হাঁ-দেহ ঝিনুক, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সমান”। চারদিকে তাকিয়ে কবির বিবমিষা জাগে। তাই তাঁকে বলতে শুনি “মিথ্যাশিল্পের চাষাবাদ আমাদের পরম্পরা”। “লোভ” কবিতায় তাঁকে বলতে শুনি, “লোভের চেয়ে দীর্ঘ মানুষই কেবল স্বাধীন।“ “ডানার তরঙ্গে উড়ালসন্ধ্যা” অথবা “শরত-হেমন্তের বুনো মৈথুন” কবির অভাবনীয় কল্পনাশক্তির অনন্য সাক্ষী।
অনেক উদ্ধৃতিই দেওয়া যেত। অনেক বিশ্লেষণ করা যেত। কিন্তু প্রকৃত কবিতার আলোচনা অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। ভাল কবিতার আলোচনা যেন অন্ধের হস্তীদর্শনের মত। তবে আরেক বার বলব, সব কবিতাই কবিতা হয়ে উঠেছে। ক্রিয়াবিহীন কবিতা লেখায় অবশ্যই নতুনত্ব আছে। তবু আমাদের শহীদ কাদরীর কথা মনে রাখা দরকারঃ ক্রিয়াপদ কবিতার শক্তি, আবার দুর্বলতাও। কথাটা সব পদের ক্ষেত্রেই খাটে। যে কোনো কিছুর বাহুল্যই কবিতাকে পাতালমুখী করে। মূল কথা হচ্ছে, কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। কাজীরও ওই একই কথা। কাজী কথা রেখেছেন।
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭।
প্রিয় কবি
সাজ্জাদ বিপ্লব
শুভেচ্ছা জানবেন। জানবেন অভিনন্দন।
আপনি অর্ধশতবর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন, জেনে প্রীত হলাম। হলাম আনন্দিত ও গর্বিত।
একজন কবি’র জীবনে পঞ্চাশ বছর মানে একটি ভাষার, একটি দেশের সাহিত্যের-কৃষ্টির- সভ্যতার তথা সামগ্রিক সৃষ্টিশীলতার চলমানতার অনন্য ইতিহাস। সমৃদ্ধতার গৌরব।
আপনি, আমি, আমরা– যারা সাহিত্যে সৎভাবে নিবেদিত, উৎসর্গিত– তারা এ গর্বের দাবীদার। হকদার। সে অর্থে আমরা সবাই সতীর্থ। আত্মার আত্মীয়। একে-অপরের সুখ-দুখের সাথী। আমরা যেমন আমাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই। ঠিক তেমনি বিপদের দিনেও পাশে থাকি, দাঁড়াই সমানভাবে।
আপনার জন্মদিন আসা মানে আমারো উৎসবের দিন, আনন্দের দিন সমাগত। আমরাও মেতে উঠবো আনন্দে।
এই যে, আপনি একাধারে একজন সাংসারিক, সামাজিক, ভ্রামণিক, লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক, সঞ্চালক –আপনার বিভা বহুবর্ণে বিচ্ছুরিত। আপনি প্রস্ফুটিত নানা দিকে। নানা ভাবে।
এই ছোট্ট মানবজীবন অথচ কত অর্থময়। কত সুন্দর। কত স্বার্থক।
কিন্তু আমরা না জানলেও, বুঝতে পারি এর পেছনে কত ত্যাগ, কত পরিশ্রম, কত গভীর অদম্য ইচ্ছা ও সংকল্প লুকিয়ে আছে। থাকে।
এই সব কিছু জোড়া দিয়ে যে আপনি দাঁড়াচ্ছেন, নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছেন, ছড়িয়ে যাচ্ছেন সবার মধ্যে, এ অমূল্য।
তার জন্য আপনি আনন্দ করতে পারেন। গর্ব করতে পারেন।
জানেন তো, আমাদের গুরু আল মাহমুদ কি বলেন? তিনি বলেন, “সাহিত্য কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। “
এই কথাটি কি ধ্রুব সত্য নয়?
এই একটি কথাই কি আমাদের লোভ ও লাভ কে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? আমাদের আকাঙ্ক্ষার না’য়ে প্রেরণার ঢেউ লাগানোর জন্য, এ রকম আশ্বাসবাণী একটি-ই একশো!
এই যে, আপনি, আমি, আমরা সাহিত্যচর্চা করছি। লেগে আছি সৃষ্টিশীলতার পেছনে। এর চে’ যদি বেশী সময় লেগে থাকতাম, বৈষয়িক উন্নতির পেছনে, আমাদের ধন-সম্পদ-জৌলুস আরো কি বৃদ্ধি পেতো না? নিশ্চয় পেতো। কিন্তু, তবু, আমরা অন্য ধান্দা (‘ধান্দা’ কথাটি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করলাম, আশেপাশে যত ধান্ধাবাজ দেখছি!) না করে, কেন সাহিত্যে ব্যাপৃত? কি পাচ্ছি এর থেকে? আদৌ কিছু কি পাচ্ছি?
আমি তো মনে করি, অবশ্যই পাচ্ছি। অনেক কিছু পাচ্ছি। (যদিও তা বিষয়আশয় এর মাপকাঠিতে ঠিক যাচাই করা যাবে না। যায় না।) সত্যি বলতে কি, খালি চোখে তা দেখাও যায় না, এ অন্ধ সমাজে।
কিন্তু আমরা যারা আলোকিত মানুষ। যারা কিঞ্চিৎ সৃষ্টিশীল জগতের বাসিন্দা, তারা কিন্তু ঠিক-ঠিক বুঝে যাই, এ জগতের বাসিন্দাদের মর্যাদা ও উচ্চতা। তাই তো আমার কাছে একজন মন্ত্রী বা আমলা বা ব্যাবসায়ী বা ধনকুবের বা অধ্যাপকের চেয়ে একজন কবি অনেক বেশী আকর্ষণের। অনেক বেশী মর্যাদার।
আমাদের আরেক গুরু, সদ্য লোকান্তরিত ‘কবি অগ্রজ’ (এই বাক্যবন্ধটি কবিগুরুর একটি চিঠি থেকে অদ্য পেলাম) শহীদ কাদরী, যার মূল্যবান সঙ্গ ও সংস্পর্শ আপনিও পেয়েছেন, তার একটি কথা আজ খুব করে মনে পড়ছে। তিনি বলতেন, “জীবন যাপন করো। পৃথিবীর দিকে তাকাও। বিভিন্ন বিষয়ের উপর কবিতা লেখো। আস্তে-আস্তে লেখো। যাপিত জীবন থেকে কবিতা বেরিয়ে আসবে।”
আমি সেই থেকে তার আদেশ মান্য করার চেষ্টা করছি। জীবনকে যাপন তথা উপভোগ করছি। দুনিয়া দেখছি। মানুষ দেখছি। মানুষ চিনছি (কতটুকু চিনতে পারছি–এটিও প্রশ্নবোধক)। আর প্রতিনিয়ত লিখছি। লিখছি কবিতা। আমার যাপিত জীবন থেকে সত্যি-সত্যিই বেরিয়ে আসছে-কবিতা। আমাকে কষ্ট কল্পনা করে লিখতে হয় না। আরেকটি জিনিস কবি শহীদ কাদরী আমাকে করতে আদেশ করেছিলেন, সেটি–ছন্দে লেখা। আমি তাও মান্য করার চেষ্টা করছি। আপনি, খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন, আমার আগের কবিতা ও এখনকার কবিতার গুণগত পার্থক্য। এর জন্য আমি, এ সুযোগে কবি শহীদ কাদরী’র ঋণ স্বীকার করছি।
লিখছি কবিতা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিজস্ব ভাবনা। প্রবন্ধ। মুক্তগদ্য। ইত্যাদি। পড়া আমার সাহিত্যচর্চা-র একটা বিরাট অংশ জুড়ে আছে। কত কি যে পড়ি! পড়ছি!!
আমি মূলত পড়তে-পড়তে লেখক–বলতে পারেন।
আপনার সঙ্গে আমার অনেক সাযুজ্য আপনাকে আমার কাছে টানে।
আমি এ কয়দিন যাবৎ আপনার “কবিতাসমগ্র” পড়ছি। একটু-একটু করে। জানেনতো, এই প্রবাস জীবনে সময়ের কত স্বল্পতা! নিজের যৎ সামান্য লেখালেখি (বউয়ের ভাষায় : পাগলের প্রলাপ), পড়া, কাজ, সংসার ও পরিবারের জন্য সময়, শরীরের জন্য বিশ্রাম–এতো সব একসাথে করা কত যে দুরূহ –তা আমার মতো ভুক্তভোগী জানেন। আর জানেন আল্লাহপাক ভালো। তবু, এ সবের মাঝে আমি, আপনি সাহিত্যে আছি–থাকবোও আগামীতে, ইনশাআল্লাহ –আমাদের সমগ্র উদ্যোগ তারই স্বাক্ষী।
আপনার “কবিতাসমগ্র” পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আপনি বইটির শেষের দিকে আপনাকে নিয়ে কবি আল মাহমুদের যে লেখাটি সংযুক্ত করেছেন, এটি একাধারে মূল্যবান ও চমৎকার।
গুরু আল মাহমুদ আপনার ও আপনার কবিতা সম্পর্কে যা উচ্চারণ করেছেন–তা লক্ষ্যভেদী এবং সঠিক। এই একটি লেখাই আপনাকে বোঝার জন্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। আল মাহমুদ যে কতটা অন্তর্ভেদী –তার প্রমাণ গেঁথে আছে আলোচনাটিতে।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তিনি যাকে কবি বলে সন্মান জানিয়েছেন, তারাই আজ টিকে আছে। তার দেখার চোখ আছে–বলতে হবে।
এখন যে প্রচারকাল–এ, আপনি, আমি, আমরা সবাই ভালো করে দেখছি। জানছি। বুঝছি।
আমরাই বা কেন প্রচারণায় পিছিয়ে থাকবো?
তবে অন্যের সঙ্গে আমাদের, বিশেষকরে আমার, একটি মূলগত বা মৌলিক পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি। তা হলো–অন্যেরা যেখানে মিথ্যার আশ্রয় নেয় বা সত্য গোপন করে–আমি তার বিপরীত–সত্যকে প্রকাশ করি বা তুলে ধরি, খোলা আসমানে। সাদা চোখে সকলে দেখুক–এ অভিপ্রায়ে। যে কারণে দেখবেন, সত্যিকার অর্থে আমি একা, একেলা–এ পথে। আমার প্রকৃত বন্ধু বা সহযাত্রীর সংখ্যা খুব কম। সহজেই এদের হাতে গোণা যায়। কিন্তু তাদের অফুরান ভালোবাসা ও দোয়া, আমার প্রাণশক্তি বলে আমি মনে করি। মাথা পেতে গ্রহণ করি।
আমি এ সময়ের সাহিত্যের একজন নিবিষ্ট পাঠক, বলতে পারেন। খুব আগ্রহ নিয়ে, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়ার চেষ্টা করি সব লেখা। সবার লেখা।
বই কিনি। পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন কিনি। সংগ্রহ করি। আর ফেসবুক তো আছেই। সবকিছু–সারা দুনিয়া মূহুর্তে আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। এ প্রযুক্তির কল্যাণেই। তো, সারাদিন আমার সামনে ভেসে উঠছে, কোথায় কি ঘটছে? কারা বা কে-কে, কি-কি লিখছে! এই যে নিমগ্ন পাঠ বা সাহিত্যসংশ্লিষ্ঠতা–এ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে পারি–আমরা অন্য অনেকের চেয়ে অনেক ভালো লিখি। লিখছি। যেমন—নিউইয়র্কে : আপনি–কাজী জহিরুল ইসলাম, সিডনীতে : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, বরিশালে : নয়ন আহমেদ বা আটলান্টা’য় : আমি–সাজ্জাদ বিপ্লব।
আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারে, এমন কাউকে দেখি না। এটি আমাদের আত্মম্ভরিতা বা আত্মগর্ব নয় আত্মবিশ্বাস।
আমাদের সমকালে কতজনকে দেখলাম, কি দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন–সাহিত্যের জগতে! তারা আজ কোথায়? তাদের মিঁউ-মিঁউ আওয়াজও শোনা যায় না। আর তো গর্জন। কিন্তু আমরা ধীর গতিতে কচ্ছপের মতো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি–সাহিত্যের মূল সড়কে। সাহিত্যও এগিয়ে যাচ্ছে, সমানতালে, আমাদের হাত ধরে।
এসেছে ভাষার মাস। আমাদের আশার মাস। কিন্তু আশা কোথায়? ভরসাই বা কিসে? মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সহ (সদ্য আমেরিকাও এই অতলে অন্তরীন) সমগ্র বিশ্ব আস্তে-আস্তে ঢেকে যাচ্ছে, ঘোর অন্ধকারে। এই অন্ধকারের কথাই কি বলেছিলেন, জীবনানন্দ দাশ? কি জানি!
আমি তো তার চেয়েও বেশী কিছু দেখতে পাচ্ছি। এতো অনাচার দেখে আমার কেন জানি না, মনে হচ্ছে —কিয়ামত কি সন্নিকটে? আল্লাহই ভালো জানেন।
আমি শুধু আমার শংকার কথা উল্লেখ করলাম।
বিশ্বাস করেন, গত দুইদিন হলো আমি নিজেকে অসহায় ভাবছি। এতো ভয় বা অনিশ্চয়তা আমি গত দশ বছরে একটি দিনের জন্যও কল্পনা করিনি। ট্রাম্প এর কাল আমরা কীভাবে যে পাড়ি দিবো–এ নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। জীবনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে–নতুন করে।
এতোদিন (প্রায় এক দশক) আমেরিকা আছি। খুব সহজেই (ঠিক সহজে না হলেও, খুব একটা দুরূহও নয়। বলা যায় সুন্দরভাবে। মাঝখানে ব্যক্তিগত ঝড় বাদ দিলে) আপন করে নিয়েছি এ দেশ। এর মধ্যে কখনো নিজেকে খুব একটা বহিরাগত মনে হয়নি। নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগিনি। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া। লোকজন-প্রতিবেশীও মন্দ নয়। বিভিন্ন দেশের, কত ভাষার, কর ধরণের মানুষ! যে যার মতো আছি। থাকছি। কিন্তু হঠাৎ স্বপ্নের ভিতর দৈত্যের মতো বাস্তবে এসে হাজির এক সাদা রাক্ষস–ট্রাম্প। ঠিক যেমনটি এক রাক্ষুসী–হাসিনা। কত মিল তাদের। দু’জনে দু প্রান্তে, আমাদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। আমাদের সুখ কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের উচ্ছেদ করতে চাইছে–আমাদের অধিকার ও বসতভিটা থেকে। যেন এ যুগের ফেরাউন তারা। কিন্তু তারা কি দেখেনি–দেখে না—স্বৈরশাসকের পতন। পচন। কোন পিরামিড কি কখনো সুরক্ষা দিতে পেরেছে, কোন ফ্যাসিবাদীকে? পারে? পারেনি। পারবেও না কোনোদিন।
আমাদের অতীত, ইতিহাস বলে, আমরা এদের তাড়িয়েছি। স্বমূলে ধ্বংস হতে দেখেছি, নীল নদে। বঙ্গোপসাগরে। এরাও উৎপাটিত হবে, সময়ে। কিন্তু নিয়ে যাবে অজস্র ঘৃণা আর মানুষের অভিশাপ। পৃথিবীর সমস্ত নীল বেদনা ও শাস্তি এদের প্রাপ্য।
আমি রাজনীতিক নই। কিন্তু রাজনীতি প্রবণ। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদী না হয়ে পারি না। যেটুকু ক্ষমতা বা সাধ্যে কুলায়, সে অবস্থা বা যায়গা থেকেই প্রতিবাদ জারী রাখি। প্রতিবাদ আমার নামের মতো রক্তে মিশে আছে। আমি জন্মপ্রতিবাদী। প্রাকৃত-প্রগতিবাদীও বলতে পারেন।
আমার সামান্য সাহিত্যজীবনে এর প্রতিফলন দেখতে পাবেন।
আমার বাসা পাইনল্যাণ্ড এভিনিউ, ডোরাভিল, থেকে শ্যাম্বলী স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৮/১০ মিনিটের ড্রাইভ। তারপর কর্মক্ষেত্রে শ্যাম্বলী স্টেশন থেকে পিচট্রি সেন্টার স্টেশন বা ফাইভ পয়েন্টস স্টেশন পর্যন্ত মাত্র ২০/২৫ মিনিট রেলযাত্রা। নেই কোন জ্যাম বা ট্রেনের স্কেজুল লেট। এই অল্প সময়ে আমি যাওয়া অথবা আসার পথে আমার প্রিয় ফোন ডিভাইসে আমার সাহিত্যচর্চা সম্পন্ন করি। কখনো লিখি কবিতা। কখনো গদ্য। কখনো সম্পাদনা। নিজের লেখা গোছানো ও সংরক্ষণ।
এর ফাঁকে-ফাঁকে আপনাকে উপলক্ষ প্রতিদিন লিখছি এই লেখাটুকু। আপনার প্রতি সন্মানপ্রদর্শনপূর্বক আমার স্মৃতি তর্পণ।
আপনি কিভাবে লেখেন জানি না। তবে, কোনকিছুর প্রতিক্রিয়ায় আমার অনেক লেখার জন্ম হয়। সে অর্থে আমি প্রতিক্রিয়াশীল লেখক। হা… হা… হা…। আবার অন্য অর্থেও হয়তো আমি ঠিক তাই। প্রতিবাদ করি। প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেই। ফেটে পড়ি। অন্যদের মতো কেন কাল্পনিক বা বানানো লেখা লিখতে পারি না–বলতে পারেন? কেন নিজের জীবন, নিজের সমাজ, নিজের দেশ–আমার লেখার বিষয় হয়! কেন অন্যায়ে রক্তে বাজে যুদ্ধের, প্রতিবাদের দামামা। কেন পারি না অন্যদের মতো চুপ থাকতে? চোখ থাকতেও অন্ধ থাকতে? কেন আমার গা’য়ে গণ্ডারের চামড়া নাই?
দেখুন, আপনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে, লিখছি নিজেকে নিয়ে। নিজের বয়ান। ক্ষমা করবেন। আসলে কি জানেন, সবাই কে সব কথা বলা যায় না। সবাইকে নিয়ে লেখাও যায় না। আপনাকে বলা যায় আপন মনে করে, কাছের মনে করে। তাই এতো কথা বলা। তথা লেখা। আপনাকে নিয়ে বিশদে লেখা দরকার। সে জন্য সময় দরকার। অন্য কোন একদিন, কোন এক সময়ে লিখবো, ইনশাআল্লাহ। বিস্তারিত।
এবারের বইমেলায় দেখলাম আপনার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর জন্য আপনাকে অভিবাদন। শুভেচ্ছা। লেখকের পরিচয় তো বইয়ে। প্রত্যেকটি বই একেকটি আদরের সন্তান। আদরের ধন। অমূল্য সম্পদ। আমাদের কাছে। প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় মনে এলো। জানিয়ে রাখছি।
আপনি হয়তো ইতিমধ্যে জেনে থাকবেন যে, আমি মূলত এবং প্রধানত লিটল ম্যাগাজিন জগতের লোক। লেখক। যারা এ জগতে বিচরণ করেন বা করেছেন, তারা কেউ-কেউ আমাকে চিনে থাকবেন অথবা জেনে থাকবেন। লিটল ম্যাগাজিনের কথা উঠলে আমি কেমন জানি অন্য রকম হয়ে যাই। আমার রক্তের মধ্যে একটি স্রোত বয়ে যায়। কয়েকদিন আগে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ধারাবাহিক একটি লেখা লিখতে গিয়ে নতুন করে আবিষ্কার করলাম, এজরা পাউণ্ড কে। যিনি শিকাগো থেকে প্রকাশিত “পোয়েট্রি” পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইউরোপ ঘুরে ফাণ্ড কালেকশন করছেন তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ লেখদের লেখা প্রকাশনার জন্য। পক্ষান্তরে সভ্যতা রক্ষার জন্য।
তারমানে বোঝা যাচ্ছে, লেখা গুলিকে মলাটবদ্ধ করা কতটা জরুরী!
আপনি, আমি আমাদের সাধ্যমতো সেই কাজটি করে যাচ্ছি। অর্থাৎ লেখার পাশাপাশি বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি কাকতালীয় প্রসঙ্গের উল্লেখ করলে মন্দ হয় না। আজ আপনি পঞ্চাশে পা দিচ্ছেন আর এই শুভ মূহুর্তে আমার “বগুড়ার ছড়া : চর্চার অর্ধ শতক (১৯৫৮–২০০৮) গবেষণা মূলক গ্রন্থটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছায়। এটি হয়তো নিছক মিল। তবু আমার ভাবতে ভালো লাগছে, যে একজন ঐতিহ্যসন্ধানী কবি আপনি, আর আমার এই কাজটুকু ঐতিহ্যের মূল্যায়ন। সেদিক দিয়ে আমার ভালো লাগা। তা ছাড়া আপনিও দেখলাম “শেকড়ের খোঁজ” নামে একটি শেকড় সন্ধানী গ্রন্থও বের করছেন। এ সব মিলিয়েই আমাদের আনন্দ। কি বলেন?
আমরা আমাদের অতীত স্মরণ করে, অতীত কে নিয়েই সামনে এগিয়ে যাই। যেতে চাই। আমাদের ঐতিহ্যের মূল্যায়ন সে ক্ষেত্রে একান্ত দরকার। জরুরী।
যে কারণে আমি দেশে থাকতে উত্তর আধুনিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি–সে কথাটি এখন মনে পড়ছে। আরো মনে পড়ছে আমার পত্রিকা : স্বল্পদৈর্ঘ্য-র কথা। কত প্রাণময় ছিলো নব্বই দশকের সেই দিনগুলো! পরে আল্লাহ চাহে তো এ নিয়ে লেখা যাবে। শুধু ২/১ সংখ্যার কথা চকিতে উল্লেখ করছি। বিশেষ করে : আল মাহমুদ সংখ্যা : ১ ও ২, নব্বই দশক সংখ্যা, প্রসঙ্গ : বগুড়া, উত্তর আধুনিক ভাবনা, ইত্যাদি।
স্বল্পদৈর্ঘ্য’র প্রতিটি সংখ্যা ছিলো একেকটি গল্পের আকর। কষ্ট ও আনন্দের–একই সঙ্গে আন্দোলনের–কাহিনীতে ভরপুর।
আপনিও এক সময় পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্যের প্রতি আপনার দায় ও দরদ আমি বুঝি। আমাদের কাজ একদিন ঠিক-ই মূল্যায়িত হবে, দেখবেন।
আমরা সেই যে যাত্রা করেছি, এ পথে, সাহিত্যের পথে, আমরা যেন এমন সৃষ্টিশীল ও সচল থাকি আজীবন, আমার এ কামনা থাকবে। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। হোন আরো সৃষ্টিধর ও বিস্তৃত। সৃষ্টির ‘শত জল ঝর্ণার ধ্বনি’ আমাদের ভাসিয়ে দিক অফুরান আনন্দে।
সতত মঙ্গল কামনা করছি।
পরিশেষে, কবিগুরু’র ভাষায় :”–যে কথাটি বলবার জন্যে চিঠি লিখতে বসেছি সেটি খুব দীর্ঘ নয়–সেটি হচ্চে–বাহবা, সাবাস, সোভান আল্লা।”
ইতি,
আপনার
কবি-ভ্রাতা
সাজ্জাদ বিপ্লব
২.৯.১৭
আটলান্টা, জর্জিয়া।