spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি ফররুখ আহমদ এর "নতুন লেখা" : প্রসঙ্গ বাংলার ষড়ঋতু

লিখেছেন এ কে আজাদ

কবি ফররুখ আহমদ এর “নতুন লেখা” : প্রসঙ্গ বাংলার ষড়ঋতু

এ কে আজাদ

ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ  বলেছেন– “Nature is the mystic mother”(প্রকৃতি হলো রহস্যময়ী মা)। এই প্রকৃতির কোলেই জন্মগ্রহণ করে মানুষ। প্রকৃতির আলো বাতাস গায়ে মেখেই বেড়ে ওঠে। মহান সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় প্রকৃতির দানেই মানুষ নির্বাহ করে জীবন ও জীবিকা। এই প্রকৃতিই হলো মানব জীবনের শান্তনার আশ্রয়স্থল। মাতৃদুগ্ধের কাছে মানুষের যেমন ঋণ থাকে প্রকৃতির কাছেও থাকে মানুষের অনুরূপ ঋণ। আর একজন কবি তো সেই প্রকৃতিরই পালক পুত্র। তাই তো প্রকৃতির রহস্যে পুলকিত হয় কবির মন; প্রকৃতির লীলায় কবির সেই মনে জেগে ওঠে ভাবের গুঞ্জন। সেই গুঞ্জনই ছন্দের যাদুময় স্পর্শে হয়ে ওঠে কবিতা। কবি ফররুখ আহমদ সে রকমই একজন কবিতার শিল্পী যার ছন্দময় বুনোনে নক্শী কাঁথার মত চিত্রিত হয় বাংলা প্রকৃতি। ষড় ঋতুর  দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ছয়টি ঋতুতে নানান রঙে নানান রূপে সজ্জিত বাংলার বর্ণিল প্রকৃতি। প্রকৃতির সেই স্পর্শ-রূপ-রস আর গন্ধে কবি ফররুখ আহমদের মন মেতে ওঠে ছন্দে। সেই পুলকিত মননের ছন্দময় প্রকাশ কবি ফররুখ আহমদের “নতুন লেখা’’। 

ঋতুর রাজা বাংলার বসন্ত। ফাগুন-চৈত্র এই দুই মাসে হয় বসন্তকাল। হাড় কাঁপানো শীতের শেষে সবুজ পাতার ঘোমটা পরে নতুন বধুর সাজে এই বাংলায় আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুনের। হিম হিম বাতাসের সাথে দিনের আগমনী গান গেয়ে ওঠে এক ঝাঁক ভোরের পাখি। পাখির সে গানের সুর মিসে যায় মুয়াজ্জিনের আজানের সুরের সাথে। সকালের সোনামাখা শিশির এসে টুপ করে চুমু খায় ঘাসের ডগায়। বেলা বাড়তে না বাড়তেই নীল  আকাশের গায়ে পাখনা মেলে ওড়ে যায় সাদা বক। গাছে গাছে সবুজ পাতারা জেগে ওঠে ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠার মতনই। চমৎকার লাগে চারপাশের পরিবেশ । কবির ভাষায় :

আচনক দুনিয়াটা আজব লাগে 

আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে। 

লাল নয় কালো নয় সবুজ ছাতা 

জেগে ওঠে এক রাশ সবুজ পাতা।  [ফাল্গুনে]

ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বাগান। রঙিন ঘুড়ির মতন পাখনা মেলে আনন্দে নেচে ওড়ে প্রজাপতির দল। কুল গাছে পাকে বুনো কুল। বনের গাছে গাছে দৌড়-ঝাঁপে আর ফল খেতে মতে ওঠে কাঠ বিড়ালী। হাজারও ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করে বন। ফুলের মধু  খেতে উদ্বেলিত হয় মৌমাছিদের মন। পিঁপড়েরা কাজে দেয় মন।  

হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি

প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি। 

……………………………..

পিঁপড়েরা নামে কাজে দায় এড়াতে 

মৌমাছি চৌগাছি যায় বেড়াতে।  (ফাল্গুনে)

বসন্ত কালের আরেক মাস চৈত্র। ফাল্গুন শেষে রৌদ্রের খরতাপ নিয়ে  চৈত্র আসে বাংলাদেশে। খরায় শুকায় খাল-বিল নদী নালা। মাটি  ফেটে চৌচির হয়। পথ ঘাটে মাটি শুকে ধুলা হয়। চৈত্রের ঘুর্ণী বায়ে সে ধূলা ওড়ে ধু ধু মরুভূমির বালুর মত। বিষাক্ত বোলতার মত গণগণে রোদ তারা করে মানুষ আর জীব জন্তুকে। 

গণগণে রোদ দিনের সাথে 

মাঠে মাঠে বিষম তাতে 

(আগুন রঙের বোলতা যেন 

কেউ জানে না হঠাৎ  কেন 

পাখনা মেলে আসছে তেড়ে) 

পালায় মানুষ পথটা ছেড়ে।  (চৈত্রের কবিতা) 

এ যেন এক ইংরেজ কবি Persy Bishy Shelly (পার্শি বিশি শেলী) এর কবিতার প্রতিধ্বনি :

Scatter as from an unextingushed hearth 

(জ্বলন্ত চুল্লি থেকে যেন গণগণে ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে) 

 [Ode to the West wind]

চৈত্রের খরতাপে ক্লান্ত হয় মানূষ, পশুপাখি সব। ক্লান্ত পথিক পথের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে ছায়া সুনিবিড় অশ্বত্থ গাছ কিংবা অন্য কোন গাছের নীচে।  গাছের ডালে বসে ঝিমায় বনের পাখিরা। 

আমবাগানের মাঠের সীমায় 

সারা দুপুর কাকটা ঝিমায়।  [চৈত্রের কবিতা]

রৌদ্রের খরতাপে মরে যায় গাছের পাতা। মরমরে হয়, ঝরে যায়। পানির তৃষ্ণায় কাত্রায় জীব সকল। 

কোথায় পানি, কোথায় পানি 

সবাই করে কানাকানি 

পানকৌড়ির পানির আশায় 

দূরের বিলে যায় উড়ে যায়।  [চৈত্রের কবিতা]

চৈত্রের খরা আর তাপ দাহে অতীষ্ট হয়ে উঠে মানুষের জীবন। পরিত্রাণ চায় মানুষ। কবিও বোঝেন সেই অনুভূতি। সেই অনুভূতিরই প্রকাশ কবির কবিতায়– “দিন ফুরালে মানুষ বাঁচে”।

চৈত্রের দিন শেষে বোশেখ আসে। ঝড় ঝঞ্জায় কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস। 

বৈশাখের মরা মাঠ পড়ে থাকে নিষ্পন্দ যখন 

নিষ্প্রান যখন ঘাস বিবর্ণ, নিষ্প্রভ ময়দান ।    [বৈশাখ : মুহূর্তের কবিতা] 

বৈশাখ আসলেই চমকে ওঠে মন। এই বুঝি ঝড় আসে, কালবৈশাখী ঝড়। ঝড় আসে, ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় সব। ধ্বংস করে সব। কিন্তু ধ্বংসে হতাশ নয় কবিরা। ঝড় মানে ধ্বংস; আর ধ্বংস মানেই নতুন জীবন। নতুন আশা। পুরাতনকে নিঃশেষ করে নতুনভাবে নতুনের যাত্রা শুরু। সকল শৃঙ্খল, সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে মুক্তির পথের উম্মোচন। তাই তো কবির কলমেও ওঠে ঝড়। সে ঝড় মুক্তির ঝড়, সে ঝড় কল্যাণের ঝড়।

আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব বিচ্ছুরিত বজ্রে ও তুফানে 

মুহুর্তে ঘোষণা করে মুক্তি বার্তা সহস্র বন্দীর ।  [ঝড় : মুহূর্তের কবিতা] 

শুধু ফররুখ আহমদ কেন বাংলা ভাষার বাংলার কাল বৈাশাখী ঝড়ের মতই যে কবির আগমন, সেই ঝড়োকবি কাজী নজরুল ইসলামও ধ্বংসের পূজারী, ঝড়ের পূজারী । “প্রলয়োল্লাস” কবিতায় তিনি লেখেন–

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে 

কালবোখেখী ঝড় 

তোরা সব জয়োধ্বনী কর।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শুধু বাংলার স্বপ্নচারী কবিরাই ঝড়ের তান্ডবে আশার জাল বোনেননি। ১৮২৯ সালে ইংরেজী সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের কবি পার্শি বিশি শেলীও লিখেছেন– 

Drive my dead thoughts over the universe 

Like withered leaves to quicken a new birth  

 [Ode to the West Wind]

 [(হে ঝড়) আমার মূমূর্ষ চিন্তাগুলোকে উড়িয়ে দাও পৃথিবী হতে,

ঝরা পাতার মত; নতুন সৃষ্টিকে তরান্বিত করতে]

ঝড়ের শেষে শান্তি আসে। গ্রীষ্মের শেষে আষাঢ় আসে। রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা বাংলার কিষাণ কিষানী, কামার, কুমার, গোয়ালা সবাই উম্মুখ চেয়ে থাকে আষাঢ়ের বৃষ্টির পানে। গাছে গাছে পাখিরাও গান গায় “বৃষ্টি হোক, বৃষ্টি হোক’’ বলে। অবশেষে 

গগণে গরজে ঘেম ঘন পরসা 

কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা

 [সোনার তরী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] 

আর বহমান প্রবন্ধে আলোচ্য কবি লেখেন–

আজ আষাঢ়ের পয়লা রে ভাই 

আজ আষাঢ়ের পয়লা 

আকাশ পানে চেয়ে থাকে 

কিষান চাষী গয়লা 

………………………

নতুন পাতায় নতুন ঘাসে 

বাদল দিনের স্বপ্ন ভাসে 

নয়া পানির ঢলে নেমে 

যায়রে সকল কয়লা।  [পয়লা আষাঢ় ॥ এক]

আষাঢ়ের বৃষ্টি যখন নামে কৃষক মাঠে ধান বুনে। মাটির বুক চিরে গজিয়ে ওঠে নতুন ধানের কচি কচি চারা। আর কবির কলমে বিধৃত হয় শ্যামল বাংলার সেই মায়াময় চিত্র-

আকাশ জুড়ে বেড়ায় উড়ে

মেঘ মেলে তার পাখনা

কচি সবুজ ধানের চারা

খোলে মাটির ঢাকনা।  

[পয়লা আষাঢ় ॥ এক]

যখন আষাঢ়ের বৃষ্টি নামে খাল বিলের পানিতে খেলা করে টেংরা, পুঁটি, কৈ, মাগুর, শোল সহ নানান প্রজাতির মাছ। তাই তো রঙ্গ করে লিখেছেন কবি–

কে যেতে চায় ডাঙ্গা দিয়ে

লুকিয়ে দেখে বনের টিয়ে

পুঁটি মাছের বিয়ে হবে

সে হবে রাজরানী।

[পয়লা আষাঢ় ॥ দুই]

আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাসে নিয়মিত বৃষ্টি হয় এই ভাটি বাংলায়। বৃষ্টির পানিতে ভরে যায় খাল বিল। ডোবার পানিতে ব্যাঙ ডাকে – ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। পল্লী বধূরা যখন মুড়ি ভাজেন তখন মুড়ির তপ্ত কড়াইতে যেমন চটমট চটমট শব্দ হয় ঠিক তেমনি মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতে পদ্মায় ভেসে চলে ইলিশের ঝাঁক। কবি ফররুখ আহমদের কলমে উঠে আসে তাও।

ইলিশ খুঁজে ইলশে গুড়ি

বিষ্টি ঝরে মুড়কী মুড়ি  । [ইলিশ]

শ্রাবণ মাসে যখন বৃষ্টি নামে, তখন সারা পড়ে কাশ বনে। ঝাঁকে ঝাঁকে বকের সারি লুকোতে যায় বাঁশ বনে। নদীতে খেয়া পাড়ের নৌকা চলে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। দেয়ার ডাক আসে। চড়াৎ চড়াৎ মেঘের গর্জনে আতঙ্কিত হয় পরিবেশ। বর্ষার পরশে কদম কেয়ার গাছে ফোটে ফুল। কবি ফররুখ আহমদ এসবেরই সরব দর্শক। তাঁর দেখা দৃশ্যাবলী বন্দি হয় কবির স্বরবৃত্তে।

বিষটি এলো কাশ বনে / জাগলো সারা ঘাস বনে

বকের সারি কোথায় রে / লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে / ডাকলো দূরে দেয়া যে

কোন সে বনের আড়ালে / ফুটলো আবার কেয়া যে।  [বৃষ্টির ছড়া]

যুঁই চামেলী ফুলের বোঁটায়

বিষ্টি নামে ফোঁটায় ফোঁটায় । [শ্রাবণের বৃষ্টি]

বর্ষাঋতু শেষে নীল আকাশে সাদা সাদা পেঁজা তুলার মত মেঘের ভেলা উড়িয়ে এই বাংলায় আসে শরতের সকাল। দোয়েলের শিষ আর পায়রার বাক্বাকুম বাকুম ডাকে ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গে, সোনালী ঊষায় হেসে ওঠে শরতের শিউলী, হাসনা হেনা আর বকুলের ফুল। গাঙচিল, মাছরাঙ্গা আর হাজারও পাখির কলতানে মুখরিত হয় গ্রাম বাংলার খাল বিল আর ডোবার কিনারা। বক শালিকের কিচিরমিচির ধ্বনিতে ছন্দময় হয়ে ওঠে গ্রামীণ পরিবেশ। 

ঝিলমিল ঝিলমিল নীল

আসমানে ওড়ে গাঙ চিল

সাত রঙ রাঙা পাখনায়

মাছরাঙা বউ উড়ে যায়।  [শরতের সকাল] 

শরতের শেষে হেমন্ত আছে। সকালের সোনারোদে হিম হিম বাতাসে ঘাসের ডগায় শিশিরকণা হাসে। রাত্রি শেষ হলে ভোরের আঁধার চিরে হেসে ওঠে ঝলমলে দিন। যখন কার্তিক আসে, তখনও মাঠের ফসল পাকা শুরু করেনি। কৃষকের হাতে কাজ থাকে কম, পূর্ণিমা রাতে হাল্কা শীতের আমেজে পাড়ায় পাড়ায় বসে কিস্সা কাহিনী, গল্প বলা, পুঁথিপাঠ ও বাউল গানের আসর। কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ন আসে। মাঠে মাঠে পাকে ধান। ফসলের উৎসবে কিষাণ কিষাণীর কন্ঠে ভাসে গান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পাকা ধান, এ যেন সোনার হরিণের মতই দামী ।

রাত্রী শেষে ঝলমলে দিন 

বেড়ায় মাঠে সোনার হরিণ 

দিন শুরু হয় আলোক লতার 

সময় আসে কিস্সা কথার ।  [হৈমন্তী সুর]

সোনালী ধানের ঋতুর শেষে পৌষ ও মাঘ মিলে এই বাংলায় আসে শীত কাল। একজন কবি তো প্রকৃতির নানান কলায় আশীর্বাদ পুষ্ট এই মাটিরই সন্তান। প্রকৃতি যখন হাসে মানুষও তখন হাসে। প্রকৃতি যখন  ঝঞ্জাগ্রস্থ হয় মানুষও তখন কষ্ট পায়। আর কবি তো অতি সংবেদনশীল একজন মানুষ বৈ ত নয়। গ্রীষ্মের তাপ দাহে যেমন তিনি পোড়েন, আষাঢ়ের বৃষ্টিতেও তেমন ভিজেন। হেমন্তের সুখ যেমন তার মনে দোলা জাগায়, শীতের তীব্রতাও তেমন তার দেহ ও মনে কাঁপুনী জাগায়। যে ঋতুই আসুক না  কেন, কবির হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে ফেলে যায় দাগ। 

হেমন্তের ধান কাটা শেষে পৌষ আসে। নতুন ধানের নতুন চালে বানানো হয় আটা। সেই আটা দিয়ে গ্রামের বধূরা তৈরী করে নানান সাঁচের নানান স্বাদের পিঠা পুলি। খেজুরের গাছ কাটা হয়। মাটির কলসি ভরে রস হয়। সেই রস জাল দিয়ে তৈরী হয় গুড়। পিঠা পুলির সাথে যোগ হয় সেই স্বাদের নালিগুড় আর পাটালি গুড়। বাইরের পরিবেশে কিছুটা ঝিম ধরা ভাব হলেও গোলাভরা ধানের সুখ, আর পিঠাপুলির মধুর স্বাদে ভরা থাকে গ্রামের কিষাণ কিষানীর মুখ। 

মাঠের ফসল আসলো ঘরে 

ধান দেখে ভাই পরাণ ভরে

কিষাণ চাষীর মন ভরে যায়

গল্পে গানে; মিঠাই পিঠায় 

গুড় পাটালির সোয়াদ পেলো 

পউষ এল ! পউষ এল !  [পউষের কথা]

পৌষের পরে আসে মাঘ মাস। ঘন কুয়াশার চাদরে যেন ঢাকা হয় গাছ-পালা তরু লতা সব। 

মাঘ আসে, – আবছায়া কুয়াশার পাখা 

ঢেকে ফেলে আসমান কালি ঝুলি মাখা।  [মাঘের শীত]

পল্লীগ্রামে যখন ঘন রাত বাড়ে, ঝোপঝাড়ে শিয়ালেরা হাঁক ছাড়ে। ঝিঁঝিঁ ডাকা হাড় কাঁপুনে নিঝুম রাতের শেষে কুয়াশার চাদরে ঢাকা সকাল আসে। চাদর মুড়ি দিয়ে মুড়ি আর খেজুরের রস খেতে লাগে ভারী মজা । তাই তো কবি বলেন — “যশোরে খেজুরের রস খাই কেঁপে জারে।’’ 

সকালে সমস্ত গাছপালা লতা পাতায় ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির জমে থাকে। তবে মজার ব্যাপার এই যে, প্রচুর শাক সব্জি পাওয়া যায় এই শীতে। ভিটামিনে ভরপুর গাঢ় সবুজ কিম্বা লাল, হলুদ বা বেগুনী রঙের শিশির  ভেজা শাক সব্জির উপর যখন সকালের মিষ্ট রোদ এসে পড়ে, সেগুলো যেন ঝলমল করে। 

সব্জির ক্ষেতে শুধু রঙ ঝলমল

বিহানে নীহার মাঠে করে টলমল । [মাঘের শীতে]

যখন প্রচন্ড শীত নামে, বিশেষ করে সাইবেরীয় অঞ্চলে যখন প্রচন্ড তুষার পাত হয়, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি  নেমে যায়, তখন ঐ এলাকায় বসবাস করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। যেসব পাখি উড়তে পারে সেগুলো অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে পাড়ি জমায়। যেহেতু বাংলাদেশ একটি নাতিশীতষ্ণ দেশ এবং শীত কালে বড় অসহানীয় শীত পড়ে না, ফলে বেশ কিছু অতিথি পাখি উড়ে আসে আমাদের এই বাংলাদেশে। সেই সাথে এই অতিথি পাখিদের খাবারেরও কোন অসুবিধা হয় না আমাদের এই দেশে। শীতের কারণে পাখিদের খাবার পোকা মাকড় ইত্যাদি মাটির উপর থাকে না। তাই খাবারের সন্ধানে পাখিদের দল বেঁধে যেতে হয় খাল বিল কিংবা নদীর পাড়ে। প্রকৃতির এই ঘটনাবলীও এড়িয়ে যায়নি কবি ফররুখ আহমদের চোখ। তাই তো কবি লেখেন –-

দল বেঁধে ভাই চল সবাই 

পদ্মা পাড়ে যাই উড়ে যাই” –

সাইবেরিয়ার হাঁস উড়ে যায়

ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস দূরে যায়। [শীতের পাখি]

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, কবি ফররুখ আহমদ পরিবেশ সচেতন একজন কবি যিনি তার সাবলীল ছন্দের পরতে পরতে এঁকেছেন বাংলার ষড়ঋতুর ছবি। গ্রীষ্ম কালের বৈশাখের বর্ণনা থাকলেও তাঁর ছড়ায় অর্থাৎ “নতুন লেখা’ গ্রন্থে গ্রীষ্মকালের বহুল আলোচিত মধুমাস জৈষ্ঠের কোন ছড়া বা কবিতা নেই। তবুও পুরো গ্রন্থে বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুতে প্রাকৃতিক যে অবস্থা তা কিন্তু উঠে এসেছে বেশ যত্নের সাথেই। সেদিক থেকে বলা যায় যে, কেউ যদি বাংলাদেশর ষড়ঋতুর কোন্ ঋতুতে প্রাকৃতিক পরিবেশ কেমন হয় তা এক নজরে জানতে চান তাহলে তার জন্য প্রকৃতি প্রেমের কবি ফররুখ আহমদের “নতুন লেখা’ই যথেষ্ট। 

[লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা