spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি সুধেন্দু মল্লিক

লিখেছেন : মুহম্মদ মতিউল্লাহ

কবি সুধেন্দু মল্লিক

মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতা যখন ‘কৃত্তিবাস’-এর হাত ধরে তুমুল একটি কলরবে মুখর হচ্ছে, অন্যদিকে ‘শতভিষা’-র আত্মনিবিষ্ট কবিরা অন্তর্মুখীনতার ভেতর তাদের নিবিড় শান্তস্নিগ্ধ উচ্চারণগুলি আধুনিকতার অন্তর্নিহিত আর এক প্রবণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনি ‘কৃত্তিবাস’-এর পাতাতেই উঠে এল সুধেন্দু মল্লিকের একগুচ্ছ কবিতা— সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ এক একাকীর কন্ঠস্বর। সমকালীন কোনো কবির কবিতার সঙ্গেই যার সুর মেলেনা। না বিষয়ে, না আঙ্গিকে। এই নতুন নিঃসঙ্গ ঈশ্বরচেতনাবলয়িত  কবিটির নাম সেই প্রথম শোনা গেল—সুধেন্দু মল্লিক। পঞ্চাশের কবিরা যখন তাঁদের পূর্বসূরিতার অনুষঙ্গে  মজে আছেন কেউ বুদ্ধদেব-বিষ্ণু দে-জীবনানন্দে, কিংবা চল্লিশের সমাজসম্মুখীন রাজনীতিক কবিতায়, সেসময়ে সুধেন্দু মল্লিকের যাবতীয় উচ্চারণ প্রেম ও অধ্যাত্মচেতনায় অবলীন থেকেছে। এবং কবি নিজে থেকে গেছেন একাকী, যে কোনো পত্রিকাগোষ্ঠী কিংবা সংঘ থেকে নিরাসক্ত দূরত্বে। তথাকথিত আধুনিকতার যে সমস্ত চিহ্ন বাংলা কবিতাকে ধারণ করে থেকেছে একাকিত্ব, ব্যক্তিবিষাদ,  বিচ্ছিন্নতা, ঈশ্বরহীনতা ও নৈরাশ্যের বোধ— এসবের কিছুই  সুধেন্দু মল্লিকের কবিতাকে স্পর্শ করেনি।  তাঁর কবিতাকে  এক অর্থে অনাধুনিক কবির কবিতা বলেই  নির্ধারণ করে দেওয়া হয়তো যায়। তবু প্রেম ও ঈশ্বরচেতনার পারস্পরিকতাকে সামনে রেখে গোষ্ঠীহীন একা এই কবি বারবার জিতে গেছেন, মনে হয়েছিল আলোক সরকারের। কিন্তু কাদের কাছে এই জিতে থাকা? সামান্য  কিছু পাঠকের কাছেই হয়তো।  সত্যি বলতে বাংলা কবিতার বৃহৎ পাঠক এই কবিকে চিনলনা। তাদের কাছে অপরিচিতই থেকে গেলেন এই কবি।

 তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে ‘হিরন্ময় অন্ধকার’ (১৯৬৩), ‘বৃষ্টিকে করেছ বৃষ্টি’(১৯৬৭),‘কেয়াকে সর্বস্ব’(১৯৭২)  অভিমানাহত প্রেমের এক আত্মলীন নিস্তব্ধতা পাঠককে বিহ্বল করে। পরের বই ‘সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ’(১৯৭৯) তে এসে প্রেম আর পূজা তাঁর একাকার হয়ে আসে। ‘তোমার জন্য হাত করি জোড়/ভালোবাসার বকুল প্রহর/তোমার নামে ভাসাই জলে/সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ।’ কিংবা ‘এসেই যখন কড়া নাড়ি/ অন্ধকারে বুঝতে পারি/ দমকা হাওয়ায় বাড়ি খালি— বাড়ি খালি।/ দরজা ঘেঁষে ধরেছে উই/ ভাঙছে বাড়ি শুধু শুধুই—/ চেঁচিয়ে ডাকি বনমালী বনমালী।/ দ্যাখরে আমার ফুলের চারা/ অবহেলায় যাচ্ছে মারা/ দমকা হাওয়ায় শুকনো পাতার করতালি।/ এই কি ফেরার বাড়ি আমার/ এই কি ধরন তোর পাহারার/ দমকা হাওয়ায় কোথায় ঘুমোস বনমালী—/বনমালী।’ তাঁর কৃষ্ণ কিংবা গোপাল কখনও সখ্যভাবে, কখনও অপত্যভাবে কবির সারাৎসারকে ছুঁয়ে রয়েছে।  কবির এই অধ্যাত্মচেতনায়, ঈশ্বর ভাবনার  মধ্যে কোনো আরোপিত তাত্ত্বিকতা নেই, আছে এক ‘সত্যআত্মীয়তা’। এক চেতনাময় উপলব্ধির জগৎ।

 তাঁর কবিতায়  প্রেম ও পূজার এই যুগপৎ  গমনাগমনের একমাত্র তুলনা হতে পারে রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রেমের গানের সঙ্গে। এর বাইরে রবীন্দ্র-উত্তর আর কোনো কবির কাছে তাঁর পূর্বসূরিতা নেই। বরং তিনি গোষ্ঠীহীন, নিঃসঙ্গ লাজুক অভিমানাহত একক! তাঁর পরবর্তী অনুচ্চকন্ঠের কবিতার বইগুলি—‘পতিত পৌত্তলিক’(১৯৯২),‘শুধু শব্দ শুধু অপেক্ষা’ (১৯৯৫) ,‘ধন্যবাদ অশেষ ধন্যবাদ ‘(১৯৯৭), এই সবই আমার কবিতা ‘(২০০৪), ‘মেঘে আশ্বিন হাওয়ায় আমার জন্মদিন’ (২০১০),‘এই তো পাওয়া,ভীষণ পাওয়া’(২০১১),‘পুষ্পিত ধিক্কার’(২০১৬),‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’(২০১৭) বইগুলি প্রকাশিত  হয়েছে খুব নিঃশব্দে। হয়তোবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এইসব বই ঘিরে কোথাও কোন বিজ্ঞাপনিক ঝলসানি দেখা যায়নি যেমন, তেমনি ওঠেনি কোনো আলোড়ন। কোথাও কোনোদিন কোনও কবিসভায় দেখা যায়নি এই কবিকে। সারাজীবন থেকে গেলেন প্রচারমঞ্চ থেকে দূরে, বিজ্ঞাপনিক হুল্লোড় থেকে দূরে। মুষ্ঠিমেয় কিছু নিবিষ্ট পাঠকের মনে শুধু তাঁর উপস্থিতি। বৃহৎ কোনো পত্রিকাগোষ্ঠী তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি, গুরুত্বপূর্ণ কবিতার সংকলনগুলিতে কোথাও তেমন তাঁর অন্তর্ভুক্তি নেই। এর কারণ হয়তো তাঁর স্বভাব লাজুকতা। হয়তো তাঁর অভিমানাহত অনাসক্তি। তবু বাংলা কবিতার পরম্পরায় এই কবিকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তথাকথিত আধুনিকতাকে বরণ না করেই এই কবি তাঁর ঐশী উপনিবেশে শেষ পর্যন্ত একক স্বরাট থেকে গেলেন। অনুচ্চকন্ঠের মন্ত্রোপম তাঁর নিঃসঙ্গতার শ্লোকগুলি নিশ্চয় আগামীদিনের পাঠক আবিষ্কার করবে একদিন। তার প্রস্তুতিপর্ব দেখা দিয়েছে ইদনীং। আগ্রহ বাড়ছে তরুণদের মধ্যে। এবং হয়তো সে কারণেই পুনর্মুদ্রিত হতে যাচ্ছে তাঁর একক বইগুলি। দুখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যসমগ্র একাধিক প্রকাশনা থেকে।

১৩ জুলাই ২০২৩  ৮৫ বছর বয়সে  পল্লিকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের পৌত্র কবি সুধেন্দু মল্লিক নিঃশব্দে বিদায় নিলেন। জেনে গেলেন না তাঁর কাব্যসমগ্র প্রকাশের সংবাদ। জেনে গেলেন না  তরুণ কবিরা তাঁর স্মৃতিসভায় এসে  তাঁর ঐশীঅভিমান সুরভিত প্রেম ও পূজার চমৎকারিত্বে  স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা