spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা মহাকালের অন্তর্লীন স্রোত

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা মহাকালের অন্তর্লীন স্রোত

আবু তাহের সরফরাজ

সেদিন কী হয়েছিল, শুনুন।
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৃষ্টি স্বাভাবিক না। অস্বাভাবিক। প্রথমে ঝড়, তারপর বৃষ্টি। এখন চলছে ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের মধ্যে নাকিসুরের একটা কান্নার ভাব। দুপুর থেকে শুরু হয়েছে। এখন সন্ধ্যা সাতটা। থামার নামগন্ধ নেই।
‘কসোভোর পথে-প্রান্তরে’ ভ্রমণগদ্যের আরম্ভটা এভাবেই করেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। এটুকু পড়েই নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, শব্দ বুননের মুনশিয়ানায় তিনি কতটা জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। যেন গল্প পড়ছি, মনেই হচ্ছে না কোনো ভ্রমণগদ্য পড়তে চলেছি। কী বলছেন তার দিকে খেয়াল রেখে কাজী জহিরুল ইসলাম বলার কথাকে এমন কৌশলে শব্দের বাহনে চড়িয়ে দেন যে, তার সৃষ্ট শব্দযান চলতে শুরু করে তরতর গতিতে। এই গতির প্রভাবে পাঠকও পেয়ে যায় গতি। পাঠককে গতিশীল করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। ভীষণ কঠিন কর্ম। কঠিন এই কর্মটি কাজী জহিরুল ইসলাম খুব স্বচ্ছন্দ্যেই করে থাকেন। যেন বিষয়টি তার স্বভাবসিদ্ধ। তার বইয়ের সংখ্যা ৯০ এর ওপরে। গল্প, উপন্যাস ও কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের নানা শাখায় লিখেছেন তিনি। এখনো লিখেই চলেছেন। এই অর্থে তিনি একজন বিরলপ্রজ প্রতিভা। গদ্যপ্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও আমি আসলে তার কবিতার বিষয়প্রকরণ, ভাষাশৈলী, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ে আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা তুলে ধরব। তার গদ্যের খানিক ঝিলিক তুলে আনার কারণ, তার দশকের মানে নব্বইয়ের দশকের দু’চারজন ছাড়া আর কোনো সাহিত্যিক তার মতো সাহিত্যের নানা বিভাগে সফলভাবে লিখতে সক্ষম হননি। সবচেয়ে বড় কথা, তার বইয়ের সংখ্যা যা তাতে মনে হতে পারে, আগাছার বাড়বাড়ন্ত বেশি। কিন্তু তা আসলে নয়। বিস্তর লিখলেও কী লিখছেন, কিভাবে লিখছেন— সেদিকে তার শিল্পদৃষ্টি সবসময়েই সচেতন। অনেক সময় দেখা যায়, খুব বেশি লিখতে গিয়ে লেখা শিল্পসৌন্দর্য হারিয়ে বসে। গৎবাঁধা বিষয় ও আঙ্গিকই ঘুরেফিরে প্রতিটি লেখাতে উঁকিঝুঁকি মারে। আমাদের দেশে বাজারি অনেক লেখকই আছেন, বিশেষ করে কথাসাহিত্যিক, যারা পাঠকের মূর্খতার সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন পাঠক ঠকিয়ে আসছে। কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলামের কথাসাহিত্যে ও কবিতায় সেরকম কোনো কৌশল আমার চোখে পড়েনি। যা-ই তিনি লিখেছেন, খুব দরদ ঢেলে শিল্পের নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করেই লিখেছেন। ফলে, বহুপ্রজ লেখক হয়েও তিনি অনন্য, একইসঙ্গে শিল্পের কুশলী জাদুকর।
বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদহীন কবিতার প্রবর্তক কাজী জহিরুল ইসলাম। বিষয়টি কারো কারো কাছে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্রিয়াপদ বাদ দিয়ে কবিতা লেখার মাহাত্ম্য কি? কিংবা, ক্রিয়াপদ রেখে কবিতা লিখলে ক্ষতিই বা কি? আসলে ক্রিয়াপদ ছাড়া কবিতা লিখলে তাতে মাহাত্ম্য নেই, আবার ক্রিয়াপদ রেখে কবিতা লিখলে তাতে ক্ষতিও নেই। তবে নতুন একটি নীরিক্ষা হিসেবে বিষয়টি অভিনব, সন্দেহ নেই। কবিতায় এরকম নীরিক্ষা অনেক মহৎ কবিই করেছেন। তাদের সেসব নীরিক্ষার ফলাফল হিসেবে আমরা পেয়েছি নানা স্বাদের নানা আঙ্গিক ও প্রকরণের কবিতা। নীরিক্ষাধর্মী কবিতানির্মাণে খানিক ঝুঁকিও রয়েছে। পাঠক কবিতা কেন পড়ে? ভালো লাগে, তাই পড়ে। ভালো কেন লাগে? কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠক জীবনবোধের নানা স্পেসে পরিভ্রমণ করেন। এই পরিভ্রমণ করতে করতে পাঠক অনুভূতির নানা রঙে ও রসে জারিত হন। আর এ কারণেই কর্মব্যস্ত জীবনের কোনো এক ফাঁকে পাঠক খুলে বসেন তার প্রিয় কোনো কবির কবিতার বই। সেই কবিতায় যদি নিরীক্ষার নামে খটোমটো কোনো বিষয় এসে জুড়ে বসে, তাহলে তা পাঠকের জন্যে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে। কাজী জহিরুল ইসলামের ক্রিয়াপদহীন কবিতার শিল্প-উৎকর্ষ হচ্ছে, পাঠক ধরতেই পারবে না যে, সেখানে নীরিক্ষা চালানো হয়েছে। বরং কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক কবিতারই আস্বাদ পাবে। সাহিত্যে নিরীক্ষার শিল্পশৈলীর কারণেই এমনটি ঘটে থাকে। যা পাঠক ধরতেই পারে না। জগতের প্রতিটি মহৎ লেখকের রচনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানেই। বাংলা সাহিত্যেও এমন উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। পাঠকের অগোচরে গদ্যে কিংবা পদ্যে নিরীক্ষাধর্মী ভাঙচুরের কাজ করেছেন অনেক সাহিত্যিক। তবে এজন্য শিল্পের বহুমাত্রিক কৌশল আয়ত্বে থাকতে হয়। নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন কবির কবিতায় নানা আঙ্গিকের নিরীক্ষা আমাদের চোখে পড়ে। কেউ কেউ নীরিক্ষার নামে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে প্রলাপ বকে গেছেন। আর সেসব প্রলাপ কবিতা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে পাঠকের কাছে। আবার, দু’একজনের কবিতায় নীরিক্ষা শিল্পসৌন্দর্যে অভিভূত করে তুলেছে পাঠকের অন্তর্জগৎ। কাজী জহিরুল ইসলামের ‘ক্রিয়াপদহীন কবিতা’ বইয়ের ‘হাইফেন’ কবিতাটি পড়ে নেয়া যাক:

গোল ভূগোলে
আমাদের মিলন অবধারিত
পরস্পর বিপরীত যাত্রা বিরহ নয়, খানিক বিরতি কেবল, সময়ের হাইফেন
এক মহামিলনের আনন্দময় প্রতীক্ষা এবং তা সুনিশ্চিত

আমাদের কারো যাত্রাই পশ্চাদমুখি নয়

পৃথিবীকালও এক সুবৃহৎ হাইফেন মাত্র।

গোটা কবিতায় কোথাও ক্রিয়াপদের ব্যবহার নেই। পড়তে গিয়ে ক্রিয়াপদের অভাবও পাঠক বোধ করছে না। মনেই হচ্ছে না, কবিতার শরীরে কিছু একটা নেই। বরং নির্মেদ, ঝরঝরে অথচ টানটান এক ধরনের আবহ ঘিরে আছে পুরো কবিতাটি। পাঠকের বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয় না যে, হাইফেন এখানে প্রতীকী। ‘পরস্পর বিপরীত যাত্রা’ বলতে কবি বোঝাতে চাইছেন, মৃত্যু। প্রতিমূহর্তে আমাদের ভেতর থেকে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। খুব প্রিয়জন কেউ মারা গেলে আমাদের ভেতরটা ভেঙে যায়। মুষড়ে পড়ি। শরীর অসাড় হয়ে যায়। ভেঙে পড়ি প্রবল ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মতো। আর ভাবি, তিনি চলে গেলেন। আহা, আর দেখা হবে না। কিন্তু কবি বলছেন, এই চলে যাওয়া খানিক বিরতিমাত্র। যেন, সময়ের হাইফেন। ভূগোল বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি, পৃথিবীর আকৃতি। কিন্তু কবি বোঝেন সমগ্র মহাবিশ্ব। এমনকি আদি-অন্ত-স্থিতিজুড়ে কবির ভূগোল বিরাজমান। আদি মানে, বিং ব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগের সময়। স্থিতি মানে, পৃথিবীতে মানুষের অবস্থানের সময়। আর অন্ত মানে, মহাবিশ্ব ধ্বংসের পর মানুষের আরেক জীবন। কোরআন ও হাদিসে যাকে আখিরাত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কবি আখিরাতকে মনে করেন, মহামিলন। এই মহামিলন সুনিশ্চিত। তাই কেউ মারা যাওয়া মানেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নয়। বরং আখিরাতের মহামিলনের সুনিশ্চিত প্রত্যয় মৃতদের জন্য আমাদের প্রতীক্ষাকে আনন্দময় করে তোলে। শেষবাক্যে কবি বলছেন, পৃথিবীকালও সময়ের খানিক বিরতি। মানে, হাইফেন।
মাত্র কয়েকটি বাক্যে কী বিশাল একটি দার্শনিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন কাজী জহিরুল ইসলাম! অবশ্যি কবিতার শিল্পোৎকর্ষতা এখানেই। প্রতীকে ও উপমায় ছোট্ট একটি পরিসরে বিচিত্র ও বিস্তৃত পরিসর কবিতায় তুলে আনা সার্থক কবিসত্তার পরিচয় বহন করে। আর তাই হয়তো কবিতাকে বলা হয় কবির আত্মদর্শন। বলার কথা খুব ফুলিয়ে-ফেনিয়ে না বলে যে কবি যত ছোট্ট পরিসরে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় বলতে পারেন, সেই কবি তত বড় কবি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, মাত্র ছয়টি বাক্যের এই কবিতায় শব্দের অপচয় নেই। এতেই বোঝা যায়, কাজী জহিরুল ইসলামের শব্দের পরিমিতি বোধ। তবে একটি কবিতা দিয়েই কোনো কবির সামগ্রিক কবিতার বিচার করা বোকামি। কবিতা আলোচনার সীমাবদ্ধতা আসলে এখানেই। কোনো কবির কবিতার মোটামুটি একটা নির্যাস পাওয়া যায় আলোচনায়, কিন্তু কোনোভাবেই পুরোপুরি আস্বাদ সেখানে ফুটে ওঠে না। তবে সান্তনা হচ্ছে, হাঁড়ির দু’তিনটে ভাত টিপলে যেমন বোঝা যায় সিদ্ধ হয়েছে কিনা, একইভাবে একজন কবির দু’চারটে কবিতাকে শিল্পের মানদণ্ডে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ওই কবির কবিতার উপরিতলের একটি ধারণা পাওয়া যায়। উপরিতল বললাম কারণ, কবিতা ভাত নয়। কবিতা, কবিতাই। ভাত পেটের খিদে পূরণ করে। কিন্তু কবিতা বোধের খিদে পূরণ করে। মানুষের পেট ছোট্ট একটুখানি জায়গা। কিন্তু মানুষের বোধের জগৎ মহাবিশ্বের মতো বিস্তীর্ণ। সেই বিস্তীর্ণ জগতের সামান্য আভাস পাওয়া যায় এ ধরনের কাব্যালোচনায়। এই আভাস পেয়ে যদি কোনো পাঠক ওই কবির আরও কবিতা পাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠে তাহলে সেটাই হয়তো আলোচকের বড় প্রাপ্তি।
মহাজাগতিক বোধ যে কোনো কবির বড় সম্পদ। জীবন ও জগৎকে পর্যবেক্ষণ খুব সূক্ষ্মভাবে করতে না পারলে কবির কবিতা হয়ে ওঠে মোমবাতির আলোর মতো। পাঠকের অন্তর্জগতের খুবই অল্প একটু জায়গাই ওই কবিতা দ্বারা আলোকিত হয়। কিন্তু আমরা জানি, মানুষের বোধের জগতের বিস্তৃতি মহাবিশ্বের মতো। সেই জগৎকে কবিতার আলো ফেলে দেখার চেষ্টা কাজী জহিরুল ইসলাম তার অনেক কবিতাতেই করেছেন। ‘মহাকালের ঘড়ি’ কবিতাটি পড়া যাক:

মেঘের নিচে দালান সারি সারি
ক্লান্ত ডানা সন্ধ্যারেখায় খোঁজে আপন বাড়ি।

ঝিরিঝিরি বইছে হাওয়া ধীরে
যেতে যেতে আলোর রেখা তাকায় ফিরে ফিরে।

রঙের খেলা, আকাশ কোজাগরী
ঘণ্টা বাজায় কোথাও কি এক মহাকালের ঘড়ি?

সন্ধে নামছে। এই দৃশ্য শব্দগুচ্ছে বর্ণনা করছেন কবি। আমাদের সকলেরই পরিচিত এই দৃশ্য। কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত মানুষ ফিরছে যার যার বাড়ি। হাওয়া বইছে ঝিরঝির। দিনের শেষ আলোটুকু পশ্চিম দিগন্তে হারিয়ে যেতে যেতে যেন একটুখানি পেছন ফিরে দেখে নেয়। এরপর গোধূলির বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে কবিতায়। রঙের খেলা, আকাশ কোজাগরী। সন্ধের এই নির্জন সমাহিত রূপ দেখে কবির হঠাৎই মনে হয়, কোথাও যেন ঘণ্টা বাজাচ্ছে মহাকালের ঘড়ি। মহাকালের ঘড়ি এখানে প্রতীকী। এই প্রতীকের আড়ালে আসলে মৃত্যুর কথাই বলতে চেয়েছেন কবি। মনে পড়ছে জসীম উদদীনের সেই বিখ্যাত পঙক্তি: ‘আজান হাঁকিছে মসজিদ হতে বড় সকরুণ সুর/মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।’ সন্দেহ নেই, এই আজান মাগরিবের আজান। সন্ধের রূপটাই আসলে করুণ। পুরোটা দিন পৃথিবীকে আলোকিত রেখে সন্ধের ফিকে অন্ধকার একটু একটু করে মুছে দেয় আলো। পৃথিবীর বুকে নেমে আসে অন্ধকার। এই অন্ধকার জীবনের নিরাশার পিঠ। আর আলো জীবনের আলোর পিঠ। কাজী জহিরুল ইসলাম নতুন কোনো ইঙ্গিত এই কবিতায় না দিলেও স্বরবৃত্ত ছন্দে সন্ধের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনন্য। তার বেশিরভাগ কবিতাই আসলে ছন্দোবন্ধ। বোঝাই যায়, ছন্দ তার নখদর্পনে। কিন্তু কোনো কোনো কবিতায় ছন্দের দোলায় দুলতে দুলতে যে শব্দগুলো তিনি বুনে চলেন সেসব শব্দের কোনো কোনোটা কবিতাকে শিল্পোৎকর্ষতা দেয় না। বরং শৈল্পিক সুষমা বিঘ্নিত করে। ‘অচেনা চোখ’ কবিতা থেকে একটু পড়া যাক:

অচেনা শহরে অচেনা লোক
কারো কারো চোখে মৃত নগরীর শোক
কারো চোখে দেখি ভয়াবহ দুর্যোগ
সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে কারো চোখ
চারপাশে কিছু কাস্তের মতো নোখ
রক্তলোলুপ দৃষ্টিতে কিছু জোঁক
কেউ গেলে শুধু লোভি শৃগালের ঢোক।

ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের বুননে নির্মিত হয়েছে কবিতাটি। একটি শহরের মানুষদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এখানে। কারো চোখে মৃত নগরীর শোক। কারো চোখে ভয়াবহ দুর্যোগ। কারো আবার সন্দেহ ভরা চোখ। কেউ আবার জোঁকের মতো রক্তলোলুপ। এরকম এক একটি শহরেই আসলে আমরা বসবাস করছি। ফলে শহরটি আমাদের প্রত্যেকের কাছেই ভীষণ চেনা। কিন্তু অচেনা এক লোক হঠাৎ একদিন আমাদের এই চেনা শহরে এসে পড়লেন। আর তার চোখে শহরবাসীর যেসব কীর্তিকলাপ ধরা পড়ল সেসব ওই আগন্তুকের কাছে অচেনা। মোটামুটি এরকম একটা ছবিই কবিতাটি থেকে আমরা পাচ্ছি। ছন্দের গাঁথুনি চমৎকার, কিন্তু কবিতার উপস্থিতি খুবই কম। বাক্যগুলো পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে, নাহ, ঠিক কবিতার মতো যেন নয় পঙক্তিগুলো। যদিও কবিতার স্বতঃসিদ্ধ কোনো সংজ্ঞা নেই, এরপরও কবিতার এক ধরনের সৌন্দর্য আছে, দ্যুতি আছে। যা পাঠকের বোধের জগতে আলো ফেলে আলোকিত করে। আর শব্দের গতি মানে ছন্দ বোধের জগতে ঢেউ তুলে পাঠককে তাড়িত করে। কাজী জহিরুল ইসলামের কয়েকটি কবিতায় এরকম ব্যাপার চোখে পড়বে। আবার কোনো কোনো কবিতা পাঠে পাঠক উপলব্ধি করবে তার কবিতার অন্তর্নিহিত ধ্বনির ব্যঞ্জনা। যেমন: ‘অস্তিত্ব’ কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘প্রতিটি স্বাধীন পদক্ষেপ তোমার অস্তিত্ব/নিজের কণ্ঠই তোমার সার্বভৌমত্ব।’ ব্যক্তিসত্তার এই যে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, এই দৃঢ়তা পাঠককে তার অস্তিত্বের কিংবা বলা যায় ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে উস্কানি দেয়।
সমকালীন নানামুখি অসঙ্গতির প্রতি শ্লেষ দেখতে পাওয়া যায় কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায়। তবে তা নগ্ন আক্রমণ হিসেবে নয়, শৈল্পিক উপায়ে। ‘প্রমৃত-বৃত্ত’ কবিতা থেকে পড়া যাক:

তোমাদের সাহেবী কবিতাগুলো স্যুট-টাই পরে গঙ্গজলে নেমে পড়ে;
দেশিগুলো নেংটি পরে ঢুকে পড়ে কর্পোরেট সভায়,
বহুজাতিক কোম্পানির নান্দনিক সুউচ্চ ভবনে।
কতবার বলব একথা আর
নেংটি পরলেই গান্ধী হওয়া যায় না।

কবিদের সিন্ডিকেটে বাংলা কবিতার অঙ্গন এখন জেরবার। এরই ফাঁক-ফোকড়ে কেউ কেউ এখনো নিজের মতো করে কবিতা লিখে চলেছেন। কাজী জহিরুল ইসলাম তাদের একজন। তার কবিতা সহজেই বোঝা যায়। আর বলার কথা তিনি অকপটে বলে ফেলেন। তিনি পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন। মিশেছেন নানা জাতি ও বর্ণের মানুষের সাথে। ফলে, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি নেহায়েত কম নয়। এসব অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায় তার অনেক কবিতায়। মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি জহুরির চোখ দিয়ে। যেহেতু তিনি কবি, সেহেতু তার পর্যবেক্ষণ বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনার দাবি রাখে। কেন? এর জবাব তিনি দিচ্ছেন তার ‘পর্যবেক্ষণ’ কবিতায়: ‘পর্যবেক্ষণ তো কবিরই কাজ, এমনকি নারীর অন্তর্বাসও/তারও অভ্যন্তরে কেবল কবিরই অনুপ্রবেশ, দৃষ্টির।’
সম্ভবত আইনস্টাইন বলেছিলেন, যার যত বেশি কল্পনাশক্তি সে তত বেশি জ্ঞানী। এই অর্থে কবির চেয়ে বড় জ্ঞানী জগৎ-সংসারে আর কেউ নেই। কবির চোখ মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করে। এমনকি নারী শরীরের অন্তর্বাসেও কবির কল্পনার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। সম্ভোগের তৃপ্তি না নিয়েও সম্ভোগ-অবগাহনের কবিতা খুব সহজেই লিখে ফেলতে পারেন কবি। যদি তাই হয় তাহলে কবিতার মতো প্রবাহমান বোধের স্রোতে সহজেই কবি ভেসে থাকতে পারেন তার শিল্পের রসদ নিয়ে। আর দেখে যেতে থাকেন, জগৎ-সংসার। কবির এই দ্যাখার চোখের মুখোমুখি যদি পাঠক না দাঁড়াতে পারেন তাহলে তার পক্ষে কবিতার শরীর ছুঁয়ে থাকা অসম্ভব। কাজীর কবিতার আস্বাদ পেতে হলে তার কবিতার শরীর ছুঁয়ে থাকতে হয়। কেননা, তিনি কবিতার শরীরে কেবলমাত্র কারুকাজ করেই হাত তুলে নেন না। কবিতায় তিনি ভাঙচুর চালান। সেই ভাঙচুর ঘটে নানা আঙ্গিকে, নানা মাত্রায়। মূলত তার কবিতায় আমরা ছবি পাই। সেই ছবির পাঠোদ্ধার করতে গিয়েই শব্দের ভেতর লুকিয়ে থাকা কবিতাকে আমরা ছুঁতে পারি। আর তখন আমাদের বোধে ধরা পড়ে নানা রঙের জীবন। মহাকালের অন্তর্লীন স্রোত।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা