খোরশেদ মুকুল
মহামারি বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যায় কোনো রোগের সংক্রমণকে বোঝায়। এখানে একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে ‘নির্দিষ্ট জনসংখ্যা’। যেটা জনগণনা ছাড়া সম্ভব নয়। আর জনগণনা একান্তভাবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থারই দস্তুর। সে হিসেবে দেখলে, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তৃত হওয়ার আগে ‘মড়ক’ ছিল, কিন্তু ‘মহামারি’ ছিল না। তাই বাঙালি তাকে ‘মহামারি’ বলত না, বলত ‘মড়ক’। কারণ, ‘মহামারি’ টার্মটির সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের যোগ। গোটা পৃথিবী দুঃসহ সময় অতিক্রম করছে। করোনার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বে অনেকটাই স্থবিরতা বিরাজ করছে। মানবজাতির জন্য এমন নিদারুণ অভিজ্ঞতা সম্ভবত এই প্রথম। এর আগে পৃথিবীতে বহুবার বহু মহামারি এসেছে, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ সম্ভবত কখনো একই সঙ্গে এমন মহামারির মুখোমুখি হয়নি। সম্ভবত বললাম এই কারণেই যে, প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা আমরা পুরোপুরি জানি না। হয়তো প্রাগৈতিহাসিক কালেও এমন কোনো মহামারি নেমেছিল পৃথিবীতে। মানুষ হয়ে পড়েছিল মানুষ থেকে পৃথক। মানুষের যূথবদ্ধতা ভেঙে দিয়েছিল মহামারি। কিন্তু ইতিহাসে আমরা এমন মহামারির কথা পাই না, যে মহামারি একই সঙ্গে গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ধবংস করে দিয়েছে জীবন-জীবিকা; সম্পর্কের মায়াজাল। তবুও মানুষ ফিনিক্স পাখির মত আপন অস্থি-মজ্জার ভষ্মস্তুপ থেকে আবারও আপন অস্তিত্ব নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে জীবনের জয়গান করছে।
বঙ্গভূমি যেমন প্রকৃতির উদারহস্ত আশীর্বাদের ফলে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’, তেমনি আবার নানা প্রাকৃতিক-সামাজিক কারণে এখানে রোগবালাইয়ের আবির্ভাবও কম ঘটেনি। মহামারি নতুন কিছু না হলেও নানা বিধ্বংসীরূপে যুগে যুগে কালে কালে আঘাত হেনেছে এই উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশ-ভারতে। কখনো প্লেগ নামে, কখনো কলেরা নামে, কখনো সোয়াইন ফ্লু, কখনো বার্ড ফ্লু, আর কখনো এইডস বা কালাজ্বর নামে। কিন্তু বাংলায় আগে যেসব মহামারি আসত, আমাদের পূর্বপুরুষরা সেসব মহামারির নাম দিয়েছিল ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, মড়িবিবি ইত্যাদি। ব্যাধির বিষভরা কুঁজ নিয়ে তারা আসতো দোর্দণ্ড প্রতাপে। মরণদণ্ড ঘোরাতে ঘোরাতে বিরাণ করে দিতো জনপদের পর জনপদ। কত গ্রাম, কত গঞ্জ, কত নগর যে বিরাণ হয়ে পড়েছিলো, তার কোনো শুমার ছিলো না। সংস্কৃতি আর সভ্যতায় যেমনই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়; তেমনি সাহিত্যেও। সেসব মড়কের কথা উঠে এসেছে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধে। তবে কলেরার কথা বাংলাসাহিত্যে যেভাবে এসেছে অন্যগুলো সেভাবে আসেনি বললেই চলে। মারা গিয়েছেন সুকুমার রায়ের মত অনেক কবি-সাহিত্যিক কিংবা তাঁদের আপনজন। যা আমরা তাঁদের লেখায় পাই।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে সরাসরি মড়ক কিংবা মহামারীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে বৌদ্ধ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীত হিসেবে রচিত এইসব পদে রূপকের আশ্রয়ে সমকালীন দরিদ্র বাঙালির নিত্যদিনের যে জীবনযাত্রা তথা অভাব-অনটন, ক্ষুধা, দুঃখ-দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি-বেদনা-পীড়িত জীবনের করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। অতীতে তেড়ে আসা এসব নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারীর নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীকে কল্পনা করা হতো এবং এসব থেকে বাঁচার জন্য পূজা-অর্চনাসহ নানাভাবে তাদের পরিতুষ্টিবিধানের চেষ্টা করতো অজ্ঞ-অসহায় সাধারণ মানুষ। সেই ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায় মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্য নামের বিশিষ্ট সাহিত্যকর্মেও। মঙ্গলকাব্যে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারী কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর মাহত্মকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বসন্তের দেবী শীতলাকে নিয়ে শীতলামঙ্গল কাব্য এবং কলেরা বা ওলাউঠার নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হিসেবে দেবী ওলাইচণ্ডীকে নিয়ে উলামঙ্গল বা চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। এসব কাব্যে শীতলা দেবী বা দেবী ওলাইচণ্ডীর উপাসনার মধ্যদিয়ে সেই সেময়ে বসন্ত, কলেরার মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলা হয়েছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রতিষেধক-প্রতিরোধক আবিস্কারের আগে এবং আমাদের দেশে দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে অতীতে ম্যলেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, প্লেগের মত রোগ প্রায়শঃই মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। এমন উজার গ্রামকে নিয়ে অনেক অতিলৌকিক বা ভৌতিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে লোকের মুখেমুখে। প্রচলিত এমন একটি গল্প : ‘বহু দিন পরে জামাই ভিনগ্রামে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেছে অনেক রাতে। শুনশান গ্রামে নিশুতি রাতে শ্বশুরবাড়িতে জামাইকে খেতে দিয়েছেন শ্বাশুড়ি। জামাই একটু লেবু চাইতে শ্বাশুড়ি ঠাকরুন ঘর থেকেই হাত বাড়িয়ে দূরের বাগানের লেবুগাছ থেকে লেবু পেড়ে আনলেন। তা দেখে জামাই ভয়ে অজ্ঞান। পর দিন জ্ঞান ফিরতেই দেখতে পেল এক জঙ্গলের মধ্যে সে পড়ে রয়েছে। কোনও রকমে পালিয়ে এক জনপদে পৌঁছে সে জানতে পারল, তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। তাই সেখানে এখন ‘তেনাদের’ রাজত্ব।’ প্রচলিত এই গল্পে এককালে এদেশে মহামারির ভয়াবহতা কীরূপ ছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সাহিত্য সমাজের দর্পণ, জীবনের আরশি। এ আরশিতে ফুটিয়ে তোলা হয় সমাজ, সমাজের মানুষ, সমকালীন পরিস্থিতি। রোগ-শোক, মহামারি মানুষের জীবনের করুণ সত্য। এ সত্য যেমন ফুটে উঠেছে বিদেশি সাহিত্যে, তেমনি ফুঠে উঠেছে বাংলা সাহিত্যেও। জীবনের রঙে রঙিন হয় প্রতিটি শব্দ, বাক্য। জীবনের ছন্দপতনের দোলা আছড়ে পড়ে ছড়া-কবিতার ছন্দে, গল্পের চরিত্রে চরিত্রে। বাংলা কবিতাতেও বাদ যায়নি মড়ক-মহামারি প্রসঙ্গ। উনিশ শতকের ঢাকার এক ‘বটতলার কবি’ কুশাই সরকার লোকমুখে প্রচলিত বুলিতে ওলাওঠার মহামারি নিয়ে লিখেছেন ওলাওঠা নামে কবিতা। তারও বহু আগে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘বোধন’ কবিতায় বলে গেছেন- ‘মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/ আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন/ ভাঙা নৌকার পাল/ এখানে দারুণ দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের কাল’- এর কথা। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের অভিসার কবিতার রাজনর্তকী বাসবদত্তা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। কবির ভাষায়, ‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ / রোহমসী-ঢালা কালি তনু তার/ লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখা/ বাহিরে দেলেছে করি প্রহার।/ ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার পুরাতন ভৃত্য কেষ্টার মৃত্যু হয়েছিল মহামারীতে। কবি জীবনান্দ দাশের সুচেতনা কিংবা আট বছর আগে একদিন কবিতায়ও উঠে আসে মহামারি প্রসঙ্গ। আট বছর আগে একদিন কবিতায় কবি বলেন – “ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!/ রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি” উপমায় প্লেগের জীবাণুবাহী হিসেবে বর্ণিত। কিংবা তাঁর সুচেতনা কবিতায়, ‘পৃথিবীর গভীর অসুখ এখন/মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে/ – এই কবিতাংশের বিষয় মহামারিকেই ইঙ্গিত করে। পল্লীকবি জসীমুদ্দীনের ‘আসামনী’ কবিতায় পাই- ‘ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে।’ এছাড়া ১৯৪৪ সালে কলকাতার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত ফররুখ আহমদের ‘লাশ কবিতাও অন্যতম। মহামারি বাংলার চিত্রকলাকেও সমৃদ্ধ করেছে। বরেণ্য চিত্রকর জয়নুল আবেদীন এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তিনি বাংলার মহামারি ও দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষের জীবনচিত্র ক্যানভাসে ফুটিয়েছেন চমৎকারভাবে, জীবন্তভাবে। মৃত মায়ের বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা শিশু, স্ত্রীর শবদেহের আর্তনাদরত স্বামী, ডাষ্টবিনের খোঁজে মানুষ ও কুকুর। মৃত মানুষের চোখ ঠুকরে খাচ্ছে একদল কাক। মহামারী কেন্দ্রিক কালজয়ী এই চিত্রকর্মে সে সময়ের চরম ব্যস্তবতা ও মানবিক সঙ্কট ফুটে ওঠে। এছাড়া বিজন ভট্টচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ মহামারি কেন্দ্রিক আরেক কালজয়ী সাহিত্য সম্ভার।
বাংলা উপন্যাসের ধারায়ও উঠে আসে মহামারি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদিপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে আমরা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর-কালীন মহামারির বর্ণনা পাই। যেমন : ‘রোগ সময় পাইল। জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।’
রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চতুরঙ্গ উপন্যাসে এবং বিভিন্ন ছোটগল্পে কলেরা, প্লেগ, ম্যলেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও মহামারির উল্রেখ করা হয়েছে। মহামারির ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো। ‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর বয়ানে পাই, “কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে ও স্বামী মারা গেলেন।” কিংবা চতুরঙ্গ উপন্যাসে উদার ও ঋজু চরিত্রের জ্যাঠামশাই জগমোহন মারা যায় মহামারিতে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন চিঠিতে মহামারির উল্লেখ এবং এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।
অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত ও পণ্ডিত্মশাই উপন্যাস এবং লালু গল্পে পাওয়া যায় মহামারির কথা। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে। রাজলক্ষ্মীর থেকে বিদায় নিয়ে বর্মাদেশে (মিয়ানমার) যাচ্ছে শ্রীকান্ত। কিন্তু সেখানে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে রেঙ্গুইন সরকার বহিরাগতদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে। “ খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine : তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। ” প্লেগের মহামারি রূপ এবং কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে নানা তথ্য এবং সামসময়িক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা শ্রীকান্তে বিস্তর আলোচনা পাই। এছাড়া কলেরার মহামারি রূপ নিয়ে রচিত হয় পণ্ডিতমশাই উপন্যাস। গ্রামের একমাত্র পুকুরে যেখানে সারা গ্রামের জলের চাহিদা মেটায় সেখানে কলেরা রোগীর পোশাক ধোওয়া হতে থাকে পণ্ডিতমশাই বৃন্দাবনের চোখের সামনে। ফলে সেই জল পান করে গ্রামে মড়ক লাগে। তিনি গ্রামে কলেরা দূর করতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করছেন। ঠিক তখনই ঘরে তাঁর মা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি নিজের সন্তানকেও কলেরায় হারান পণ্ডিতমশাই।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও গল্পেও মহামারির বর্ণনা এসেছে। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণের মুখে সেই বিবরণ শোনা যাক : ‘সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।’ কাছারির কিছু লোককে সঙ্গী করে সত্যচরণ সেই বস্তিতে যায়। যেখানে বাঁচার জন্য ন্যুনতম খাবারের জোগান নাই সেখানে চিকিৎসা যেনো বিলাসিতা। স্বস্ত্রীক মুমূর্ষু স্বামী মারা যাওয়ার খবরে তাই আক্ষেপ করে সত্যচরণ বলেন, ‘আমার মনে কষ্ট রহিয়া গেল যে, আমি তাহাকে তাহার মুখের অত সাধের ভাত দুটি খাইতে দিই নাই। ’
ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের নায়ক শিবনাথকেও কলেরা আক্রান্তের সেবা করতে গিয়ে নানান বিরুদ্ধতার শিকার হতে হয়েছে। বৃন্দাবনের মতো একই দৃশ্য দেখতে হয়েছে তাকেও। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে কলেরার বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন তারাশঙ্কর। আর ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে দেখা যায় যে, ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করে কলেরায় মৃত্যু আটকাতে চাইছে। কুয়ো খুঁড়তে কোদাল ঘাড়ে নিয়েছে। তাদের নাম হয়েছে ‘কোদালি ব্রিগেড। সেবাব্রতের সঙ্গী তারা। কলেরার মড়ক থেকে গ্রাম বাঁচাতে তৎপর। উপন্যাসস্ত্রয়ে মহামারি কলেরার নানা পর্যায় এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন লেখক।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের নায়ক শশীর গ্রামে থাকা ভেস্তে যায় মহামারির কারণে। কারণ তাদের গ্রাম গাওদিয়া ছিল যেনো কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর ও বসন্তের মতো রোগগুলোর স্থায়ী আবাসস্থল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর্দ্র-কর্দমাক্ত এই পল্লিকে দেখেছেন ‘জীবাণুর তীর্থ’ হিসেবে; শশী ডাক্তারের কাছে গাওদিয়া গ্রাম ছিল অনন্ত নরক-পর্যটন।
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে কলেরার মড়ক বর্ণিত হয়েছে এভাবে : ‘অবশেষে আরও আট দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।’ ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে মেতর বউ-এর জবানীতে হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, ‘এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।’ আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে কলেরা থেকে পলায়নপর মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে পাশের বাড়ীর মানুষ উধাও।’ শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে বসন্ত রোগের প্রকোপের সময় মানুষের এ পলাতক মনোভাব ফুটে উঠেছে, ‘কবর আর কবর। মুশকিল হচ্ছে, যারা বেঁচে আছে, তারাও পালাচ্ছে ভয়ে।’ সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে ‘বুধা’ তার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছে। বুধার মানসিক বিপর্যস্ততার ইঙ্গিত লেখিকার কলমে ধরা দিয়েছে, ‘চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকতে পারে?’ হয়তো পারে না। তাই পৃথিবীব্যাপী আজ কান্নার রোল। কলেরা মহামারি কীভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু উপহার দিয়েছে সেলিনা হোসেন তারও উল্লেখ করেছেন। ‘সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক।’
অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিট-১৯ এর থাবায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশও। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি বিষয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের মত কবি-সাহিত্যকরাও উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠিত। করোনাকে ঘিরে অনুভব-অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে রচনা করছেন ছড়া, কবিতা, গল্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এগুলো প্রকাশিতও হচ্ছে। করোনা কালে রচিত কবিতা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। মহামারির শেষযাত্রা মৃত্যুর মহামিছিলেও কবিরা আশাবাদী। কারণ তাঁরা স্বপ্নচাষী। এই মৃত্যুর যাত্রা থেকে ফিরে আশার প্রার্থনা জানিয়ে তরুণ কবি সহস্র সুমন লিখেছেন ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’। এই কবিতাটি গত ৮ এপ্রিল তার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন দেশের ২১ জন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। আর এই অবৃত্তি পরিচালনা করেন নাট্য অভিনেতা টনি ডায়েস। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর করুণ ও অসহায় চিত্র তুলে ধরে রংপুরের প্রতিশ্রুতিশীল কবি মিনার বসুনিয়া লিখেছেন ‘ঈশ্বর হোক সবার’ শিরোণামে একটি কবিতা। তার এই কবিতা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কবি কামাল চৌধুরী রচিত ‘তোমার পৃথিবী চিনতে পার না’ শিরোণামে একটি কবিতাটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। করোনা নিয়ে রচিত এদুটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভিনেতা ও আবৃত্তিকার আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়া এই কবিতাগুলো নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক ভিডিও। আল-মাসুম পাঁচটি কবিতা লিখেছেন। করোনার বিভিন্ন দিককে উপজীব্য করে রচিত এসব কবিতা আবৃত্তি করেছেন এপার বাংলা ও ওপার বাংলার জনপ্রিয় বাচিক শিল্পীরা। যাঁর একটি কবিতা ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেছেন গবেষক সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। ইংরেজী করার পরে কবিতাটি মোট ১৩ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে, করা হয়েছে আবৃত্তি। বার্লিন প্রবাসী বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের কলমে উঠে এসেছে করোনাকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা। তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ কবিতা। কবির ভাষায়- “চলছে ‘করোনা’-কাল। এই ‘কাল’ নিয়ে এক লহমায় (যাকে বলে ‘এক সিটিং-এ’), ছোট ছোট পদ্য লিখলুম কয়েকটি। ওপার বাংলার নন্দিত কন্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী কবিতাও লিখেন। তিনি ‘করোনা’ শিরোণামে একটি কবিতা লিখে ঝড় তুলেছেন । নিজের ফেসবুক পেইজে একটি কবিতার ভিডিও প্রকাশ করেছেন নচিকেতা। নচিকেতা নিজেই আবৃত্তি করেছেন কবিতাটি। তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক খোরশেদ মুকুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে লকডাউনের দিনগুলি নামে গল্পসংকলন। এছাড়া দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক পত্রিকায় নজর দিলেই বুঝা যায় যাপিত জীবনের নির্মম রেখাচিত্র। সাহিত্য পত্রিকাগুলো এঁকে যাচ্ছে করোনার পদচিহ্ন। রেখে যাচ্ছে কালের সাক্ষী।
কালের আবর্তে হয়তো চলে যাবে এই মহামারি, করোনা। কিন্তু ফেলে যাওয়া স্মৃতি বুকে নিয়ে লিখিত হবে আরও অনেক গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস ইত্যাদি। যেমনিভাবে ইতিহাসের ধারায় রচিত হয়েছে কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, বসন্ত প্রভৃতি রোগ নিয়ে। “এ যাত্রায় বেঁচে গেলে” কালের রেখা পার করে হবে কালোত্তীর্ণ।
কবি ও প্রাবন্ধিক