জাফর তালুকদার
🦬
দেখতে দেখতে উত্তেজনা চরমে পৌঁছল। বিশেষ করে লেকভিউ হোয়াইট ম্যানসনের কথা না বললেই নয়। এখানে যারা বসবাস করেন সবাই হোয়াইট নন। ব্ল্যাকও আছেন কিছু। সেটা অবশ্য ধর্তব্যের বিষয় নয়। বরং যারা হোয়াইট-ব্ল্যাক কোনো অভিধায় পড়েন না তারা ডিজিটাল রূপরেখায় বোদাই হিসেবে চিহ্নিত। একটু ভদ্রোচিত ভাষায় যাকে বাদাইম্যা বলে বিবেচনা করা যায়।
মিয়া হাশেম মনসুরের বাইরেটা যতই ফর্শা হোক, ভেতরে ভেতরে তিনি শুধু ব্লাকই নন, আলকাতরার চেয়েও এককাঠি সরেস। কিন্তু তার আচার-আচরণে সেটা মোটেই প্রতীয়মান হয় না। তিনি মোটা দাগে যথেষ্ট বিনয়ী। তার পরনের পোশাকটিও আশ্চর্য রকম দুগ্ধ-ফেননিভ। ডে-নাইট ক্রিমে চর্চিত প্রশান্ত মুখ। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ব্যাক-ব্রাশ চুলটি নানা কারিশমায় বেশ কায়দা করে ছাঁটা। এসব পরিচর্যার জন্য গুলশানের জেন্টলম্যান কেয়ারে হাজার বিশেক টাকা গুনতে হয় প্রতিমাসে। মাসাজের হিসাব আলাদা। ক্লাবে,বাসায় হামেশা পানের পরও দাঁতগুলোকে দুধসাদা পরিপাটি রাখতে পেরেছেন এটাই বড় কথা। এই বয়সেও হাসিটি কাশফুলকে হার মানায়।
আমোদে-বিহারে-উত্তেজনায় তিনি এই ভবনের একজন অলিখিত ডন।
তার কর্ম অজানা। জীবন-যাপন রহস্যময়। মানুষটির নাগাল পাওয়া খুবই শক্ত। তিনি সর্বত্র আছেন। আবার কোথাও নেই। দেখা যাবে কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। এক অদৃশ্য জাদুর আড়ালে তার বসবাস। ফোনে সাড়া পাওয়া দুরূহ। বেগম আর সাহেবের জন্য আলাদা দুখানা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ। ছেলেমেয়ে দুটির একটি ওয়াশিংটনে। অন্যটি লুক্সেমবার্গে। তাদের বাবা-মা’রাও কম যান না। বৃষ্টি পড়লে ছাতা খুলে ধরেন নিউইয়র্কে। গরমে শরীর জুড়ান সুইজারল্যান্ডে। লন্ডন আর বোষ্টনের বাড়ি দুটি ভাড়া দেওয়া। দুবাইতে কমার্শিয়াল স্পেস কেনার প্রসেস চলছে।
লেক ভিউ হোয়াইট ম্যানসনের মানুষজন কেউ কাউকে নিয়ে ভাবেন না। এরা সবাই একেকটা দ্বীপের মতো। কারো তরী সহজে ভেড়ে না অন্য দ্বীপের চৌহদ্দিতে।
তবে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন অলিখিতভাবে একটা প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেমনটা ঘটেছে এবারের কোরবানিতে। হামিম চাকলাদার ১০০ফুট থেকে ট্রাকে দশ লাখ নব্বই হাজার টাকায় এক দৈত্য-গরু এনে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। হাবিব পাটোয়ারি গাবতলি থেকে এনেছেন আট লাখ আশি হাজার টাকার বিশাল শিংয়ের এক লাল বলদ। মান্নান খন্দকার অকারণ একটু খুঁতখুঁতে আর হিসেবি টাইপের। তিনি নেই নেই করেও শেষ পর্যন্ত সাত লাখ পঁচাত্তরে গিয়ে ঠেকেছেন। এর বাইরে তিন থেকে চার লাখের মধ্যে এসে জড় হয়েছে নানা কিসিমের অসংখ্য গরু। দাম-ভেদের কারণে এগুলো তেমন একটা গোনায় আনছে না কেউ। বেসমেন্টের পুরো চাতালটা কেয়ারটেকার, সিকিউরিটি, রাখাল আর ক্লিনারের হৈ-চৈয়ে রীতিমতো গরু-হাট বনে গেছে। অভিজাত পাড়ার সুরক্ষিত চকচকে ভিআইপি ফ্ল্যাট-বাড়িটা এখন আর সহজে চেনা যায় না!
তবে স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হাসিটি নিশ্চয় হাসবেন মিয়া হাশেম মনসুর। তিনি শেষতক কী জাদুর খেল দেখাবেন এ নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। কেউ বলেন উট। কারো মতে শাহীওয়াল। ফ্রিজিয়ানের পক্ষেও মতামত জুটেছে কিছু। যারা অতি উৎসাহী তারা অক্লেশে মতামতের দোকান খুলে বসেন: টাইটানিক, মহারাজা, জো বাইডেন, নেতানিয়াহু, কালাপাহাড়, আকাশচূড়া, দৈত্যশ্বর, বাহাদুর, সাকিব খান, পরীমনি..আহা, নামের বাহার কতো! তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
দুপুরে বাসায় কিঞ্চিৎ খানাপিনার এন্তেজাম করেছেন হাশেম মনসুর। খুব কাছের হাতে-গোনা কয়েকজন মানুষ। এটা শেরাটনের স্পেশাল পার্শ্বেল-লাঞ্চ। আনন্দদায়ক কিছু ঘটলেই তা সেলিব্রেট করা অলিখিত নিয়ম। বিশেষ করে কোরবানির গরু নিয়ে যে-ব্যাপারটা ঘটতে যাচ্ছে সেটা হবে টক অব দ্য টাউন। গ্রিন অ্যাগ্রোর সঙ্গে অনলাইনে সব ডিল হয়ে গেছে। বাকি পেমেন্টও সেরে ফেলেছেন যথারীতি। এক কোটির নিচে ওরা নামল না। খুব ট্রাডিশনাল জাতের কাউ বলে কথা। হাজার বছরের সমৃদ্ধ বংশগত ঐতিহ্য রয়েছে এই জাতের। ওদের পূর্ব পুরুষরা কেবলমাত্র রাজকীয় পরিবারের আনুষ্ঠানিক ভোজনবিলাসের জন্য নির্বাচিত হতো। এই মাংসের স্বাদ জাত-পাত ভেদে সংরক্ষিত হয়ে আসছে কুলীন সমাজে। যাকে বলা চলে ওল্ড ইজ গোল্ড..।
উত্তেজিত হাশেম মনসুর খাবার টেবিলে সর্শে-বাটা ইলিশ মাছের মুড়োটা দাঁতে চিবিয়ে ধরেছেন কী, হঠাৎ যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। প্রচণ্ড কামড় খেয়ে জিভের ডগাটা ক্ষত হয়েছে দারুণভাবে। থুতু ফেলতে গিয়ে দেখেন রক্তের দলা নেমেছে গল গল করে। বেসিন উপচে এই ধারা গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। তাজা রক্তের স্রোত কতদূর গিয়ে থামবে কে জানে!
—————————