লুয়াংপ্রবাং নগরীর মৃদু অপরাহ্ণে
লুয়াংপ্রবাং নগরীর মৃদু অপরাহ্ণে আজ
তৈরী হয়েছে— একান্তে হেঁটে বেড়ানোর বিরল প্রহর,
মন্দিরে দেখা হতে পারে—
বিগত শতকে অগ্নিদাহে অনাথ হওয়া বুদ্ধের বিগ্রহ
যদি জারি থাকে আগ্রহ,
পাওয়া যেতে পারে গৃহযুদ্ধে নিখোঁজ সন্ন্যাসীর খতেন-খবর।
ফুটপাত জুড়ে পাতা হয়েছে
আদিবাসীদের পসরা— পরিজাতপ্রতিম পণ্য
বিছানো হয়েছে মঙ গোত্রের নক্সিকাঁথা,
মন্থর পায়ে হাঁটে নারী এক— মেখলায় অনন্য
মাথার উপরে ছায়া ফেলে রেশমের চিত্রিত ছাতা।
ঝলসে মৃদু মৃদু চম্পনিধি ত্বকের নিরাবরণ বাহু
বিছেহারের রূপালিতে রেখে দৃষ্টি.. ..বলা দুষ্কর—
নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বায় এ যুবতী কামু গোত্রের— নাকি লাহু?
রাজকুমারীর আঙিনায় জলভরা চৌবাচ্চা
আধফোটা শাপলায় শোভিত আর্দ্র কর্দম,
এ অপরাহ্ণে পদব্রজের প্রয়াস— নিখাদ সাচ্চা
দাড়ে পোষা তোতাপাখিটি কেবলই ফুকারে ‘গৌতম গৌতম’।
ঝোপঝাড়ে সমাচ্ছন্ন উপবনে
নির্জনতা ঝিল্লির নিস্বনে হয়েছে প্রখর,
নীরবে দাঁড়াই—
সামনে স্বর্ণলতায় প্রচ্ছন্ন ফরাসী অভিযাত্রিকের কবর,
ইচ্ছা হয় অতিক্রম করি রাজপুরির মজা গড়খাই
মনে হয় হৃৎমহলে বুঝি বা সিঁদ কটেছে নিধুয়া এক তস্কর।
কোথায় যেন নীরলে তৈরী হয় অনিকেত যোগসূত্র
থাকে না প্রভেদ তেমন—
কে পর্যটক— কার পরিচয় রাজকন্যা—আর কে ভূমিপুত্র;
মনে হয় —নিভৃতে তৈরী হচ্ছে আবেশ-ঋদ্ধ প্রীতি
পল্লবিত হবে হয়তো খানিক,
দৃশ্যের বর্ণালী বিষ্ফোরণে বিভ্রান্ত পদাতিক—
না, থাকবে না— এ অপরাহ্ণের কবোষ্ণ কোন স্মৃতি;
নদীপাড়ে বঙ্কিম ভঙ্গিতে নেমে যাওয়া আদিবাসী কন্যার
কাঁধে ঝলসায় জরির জড়োয়া শাল—
মনে হয়— সতেজ সবুজ তরুটিও একদিন হবে জীবাষ্ম,
সন্ন্যাসীদের তপোঋদ্ধ অস্থি শ্মশানে পুড়ে হবে ছাইভষ্ম—
মজেছি এ মুহূর্তে যার অধ্যাসে— তার দেহও
হবে কালের করোতোয়ায় ভেসে যাওয়া এক কংকাল।
গোধূলির মূর্চ্ছনা
মনে পড়ে ভিয়েনচানে কাঠের কটেজ
মেকং নদীতে ছায়া আঁকে ঝুলন্ত বেলকনি,
জুয়ার দানের মতো তা-ও হলো হাত বদল
হ্যামোকে শুয়ে শুয়ে শোনা মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি,
তাবৎ কিছু হলো নিহারিকাময় স্মৃতির শতদল।
তারপর প্রিটোরিয়ার স্টাডিতে জড়ো করেছি
মধুভুক পতঙ্গের মতো
ফরাসি চিত্রের রেখাবর্ণিল বেভুল বই যত,
প্রতিটি ইমেজ মনে সাজিয়েছে
সর্ষের সোনালি খেতে টিয়ের সবুজ সংসার,
কেটেছে মাত্র বছর কয়েক
তুমুল পুস্তকরাজি হয়েছে উঁইপোকার আহার।
প্রকৃতির প্রবল প্রণয় নিয়েছে কেড়ে
দৌড়ে দক্ষ এথলিটের সুঠাম পা..
বাহু….বুকের বা-পাশ,
যা ছিলো নিকট কারো খুব প্রিয়
আমার দেহজ দরবারের আমখাস।
ভালোবেসেছি সারা জনম
জোছনার বৃষ্টিতে ভরপুর ঋতু,
দিয়েছো তীব্র খরা .. অসহনীয় গ্রীষ্ম
শুকাওনি চোখের সংবেদনশীল নীর,
করেছো সর্বস্বান্ত নীড়হারা নিঃস্ব
নীরবে দিয়েছো দুচোখে গাঢ় তিমির।
কখনো প্রার্থনা করিনি—এবার পেতেছি দুহাত
সমুদ্রের ঘাটলায় বসেছি সূর্যাস্তে
ভরে দাও বহুকালের বিস্মৃত বরাত,
রত্নময় সংগীতের মেহদীরঙিন একটি কলি
ভিক্ষা দাও,
অন্তিমে আমার রূপালি রূহানি
গোধূলির মুর্চ্চনায় নিভৃতে বাজাও।
দূরের মানুষ
পাতা-ঝরা পথের প্রান্তিকে চোখে সবুজিম আলো জ্বেলে
ওঁত পাতে ফারাও এর কালো বিড়াল,
খুঁড়লে তো মাটি ফরেনসিকের নিষ্ঠায়— মুখখানা যাচ্ছে কী চেনা
শরীরের কিছু তো থাকেনি অবশিষ্ট—শুধু পড়ে আছে কংকাল।
একটু অপেক্ষা করো— ফোর্ট পলাসকির বুরুজ থেকে
এখনই দাগা হবে কামান,
সিপাহসালারের শিরস্ত্রাণে গোঁজা পালকের কলম
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দোয়াতদান।
না, বিরূপ হয়নি বনানী
তাঁদের তপ্ত প্রশ্বাসে তরতাজা হচ্ছে ফুসফুস,
কাছে আসা কঠিন হে— তাই এসেছি দ্বীপদেশে
হয়েছি দূরের মানুষ।
যমুনার বহমান জলপটে
ইস্পাতের সাঁকো—যমুনায় দীর্ঘতর এ সেতু
রেলিং এ হেলান দিয়ে ভাবা যেতে পারে
উপখ্যানের কথকথা—ফুল্লরার বাচনিকে কালকেতু;
অশোভন হবে না কিছু—
যদিও লোককথায় স্থবির ব্যথিত ব্যঞ্জনায় অন্য সময়,
পুঁথির ভাববিগ্রহে রূপসলিলের হয়েছিলো বন্য পরিণয়;
ইনসান অতিক্রম করে গেছে আবীরের রূপালি শান
বয়ে যায় নাও-শুশুকের পাল পরাণী পুরানো নদী,
গ্রীবায় জড়ায়ে সাপ ভেসেছে বেদে.. ভাটির প্রণয়
ভেসে গেছে জনপদ থিতু মানুষের সংসার সমাধি;
পাড়ে ঘাস ঝিঙেমাঁচা এসেছে ঋতু শিমুলে তীব্র লাল,
সাপের ঝাঁপি মাথায়..সর্ষে খেতে উড়েছে ফড়িং
দাঁড়িয়ে দেখেছে কে নিসর্গের ভাববিনয়.. ..সুরতহাল;
জালে ছলকে রোহিত…. স্রেফ রূপালি দৃশ্যমান,
সেতুর ছায়া কেটে ভেসে গেছে কলসি ভরা গয়না
ভাটিয়ালী পালে প্রসারিত হৃদয়ের পরিত্রাণ;
উদ্বেগ রহিত বাতাসে দোলেছে কাশফুল বালুতটে,
শিশুরা হয়েছে স্মৃতির কারিগর প্রণয়ে দিশেহারা
শুশুকের বিশাল বুজকুড়ি মাথা কুটে বহমান জলপটে।
জড়িয়ে যাই তন্তুজালে
যেতে চাইনি আর অবেলায় যাই-বা কীভাবে
কেবলই জড়িয়ে যাই তন্তুজালে
জড়িয়ে পড়ি অমূল লতানো ঊর্ণনাভে,
বেসামাল বাতাস এসে লাগে গয়না নৌকার পালে;
খুঁজে পাই না কাঙ্কিত ইশটিশন,
তবে কী জগৎসংসার থেকে উঠে গেছে চিঠিচাপাটির ডাকঘর
এক সময় করোতোয়ার এ উপত্যকায় ছিলো তো বৃষ্টিবন—
যাদের ভেবেছি আপন তারাও কীভাবে যেন হয়ে গেলো পর!
হালফিল পাই না খুঁজে সঠিক গন্তব্য
তাই যাই না কোথাও আর,
কররেখা থেকে বোধ করি মুছে গেছে ভবিতব্য
রাতনিশীথে শুনি ঝিঁঝির দিব্য ঝংকার;
মাঝেমধ্যে আকাশে খুঁজি ইঙ্গিতবাহী ধুমকেতু
সবুজাভ আভা ছড়িয়ে পরিযায়ী জোতিষ্ক যদি-বা আসে ফিরে,
জড়ো করেছি উপাদান প্রচুর— চাইলে গড়াও যেত পারাপারের সেতু
অলকানন্দার সিগ্ধ কুয়াশা এসে জড়ায় আমাকে পুষ্পিত সমীরে।
জ্যামিতির উপপাদ্য
সামনে কেবলই প্রসারিত হয় মায়াবি এক রেখা
পৃথক প্রকৃতিতে যখনই হই একা—
ফুলগুলো আর থাকে না বৃক্ষের বৃন্তে গ্রন্থিবদ্ধ
উড়ে উড়ে ছড়াচ্ছে দ্যাখো সবুজ সোনালি আলো
সব মূর্চ্ছনা যাদুবলে হয় স্তব্দ—
যাচ্ছে মোছে যাপিত জীবনের যা কিছু আলোকচিত্রে সাদাকালো,
যোগাযোগের উপায় কী
বাগিচায় কেয়ারিতে উড়ে এসে বসে পুষ্পের জোনাকি;
ফিরে আসে ফের স্পাইরাল বঙ্কিম রেখা
প্রকৃত স্বরূপের পাই না যে দেখা,
নিজে থেকে বিবর্তিত হয় বর্গক্ষেত্রে
বিস্তৃত হয় বেশ কতগুলো চতুর্ভুজে,
এখনও ইনকাদের পবিত্র ধংশস্তূপে কারা প্রত্ন খোঁজে
সব পরিসর হয়ে ওঠে ছককাটা সাদাকালো পাশা,
সমাধান করি সঠিকভাবে জ্যামিতির উপপাদ্য
কিন্তু উপসংহারে যায় না যে আসা..।
পরিচিতি
জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কবিতা ও গল্প লিখছেন। হালফিল লিখেছেন কিছু ভ্রমণ-ভিত্তিক আলেখ্য। প্রাচীন মুদ্রা, সূচীশিল্প, পান্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো দিনের মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।