পরিহাস
পেনসেলভানিয়ার গেটিসবুর্গে, একটা মনোরম বিকেলজুড়ে, আমাদের, বসে থাকবার কথা ছিলো: জাতীয় সেনা পার্কে; ‘দ্য ফার্স্ট সেটেলার’ শিরোনামের একটা কবিতায়, তুমি, আমাকে, জেমস গেটিস এর গল্প শোনাতে চেয়েছিলে— যার নামে, ওই শহর;
অনেক বছর ধরে, পারস্যপঞ্জিকা পাঠ করছিলাম আমরা; কথা ছিলো: নওরুজে, বসন্তের প্রথম দিন, তেহরানের রাস্তায়, হাতে হাত রেখে, আমরা, দু’জন, হেঁটে বেড়াবো— উদ্দেশ্যহীন— তারপর, আজাদি টাওয়ারে, জলের ফোয়ারার পাশে, বসে থাকবো— এক ঘন্টা;
সিয়াটল থেকে আরও দক্ষিণে, সেইন্ট হেলেনস পর্বতের দৃশ্যমালায়, পুরো একটা দিন, আমাদের কাটানোর কথা ছিলো— আগ্নেয়গিরি আর লাভাস্রোতের খুটিনাটি নিয়ে, অলোচনা করতে করতে;
তখনও, জানা ছিলো না— গণতন্ত্রের নামে, কোথাও, শুরু হবে— গুপ্তহত্যা… মানবতার নামে, গণনিধনযজ্ঞ— কী প্রকার মাত্রাসমীকরণ নিয়ে, উসকে উঠবে! কোনও কোনও, সুচতুর, অসুরের হাতে, অপহৃত হবে— মানুষের স্বপ্নাবলি;
অথচ
তাদেরই বিগ্রহ সাজিয়ে, গোটা এক ভূ-সমগ্রকে, ব্রহ্মোত্তর বানাবো— আমরা!
আবার আসবো
আমরা আবার আসবো: শুকনো পুকুরে জল, ন্যাড়াগাছে নবকিশলয়; মাঠে মাঠে, শস্যগন্ধ্যা হাওয়া। আসবো: মাটির গহন থেকে; অগোচরে হারানো মানুষ।
অপকৌশলের দিনে, মহারাজ সেজে বসা— পচা-গলা-সাম্যবাদীর সামনে, আমরা আবার আসবো: রয়েল বেঙ্গল। সামুদ্রিক দমকা-স্রোতের ত্রাস, দুর্বল হতে না হতেই, তৎপরবর্তী, আরও বেগবান স্রোত— আমরা, আসবো…
আমরা আবার আসবো: অন্ধকারে নিহত ও অপনয়ের দিকে চলে যাওয়া, এতিম শিশুরা— শাদা শাদা— ঠিকানা ও দাবিনামা সাথে নিয়ে, আসবো: প্রকট যৌবন। আবার আসবো, ফজর-ওয়াক্তে প্রাণত্যাগী যুবা, বিনা-অপরাধ; জবরদখলকৃত জমি আর স্থাবর সম্পদ।
আমরা আবার আসবো: প্রগতির পাকস্থলী ছিঁড়ে-ফেঁড়ে বের হবো— গিলে ফেলা খাল, গাঙ, জলাভূমি, ছোটখাটো নদী। নিরুদ্দেশের দিকে গুপ্ত-হারানো-সঞ্চালিত, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা; আমরা, আবার আসবো, আদিরূপে ফিরে আসবো: ধসে-যাওয়া স্টক এক্সচেঞ্জ।
পুরনো কাঠের তক্তা ফালাফালা করে দিতে, ধারালো কুঠার আমরা, আবার আসবো; গ্রাম-গঞ্জ-লোকালয় থেকে, কোটি কোটি পিষ্ট থেঁতলানো হাত, কেটে নেয়া জিভ; আমরা, ফিরে আসবো; তোমার মুখের সামনে, বলে দেবো:
‘যথেষ্ট হয়েছে; আর না’—
পালাবদল
আমার সকল গানই তো কেবল
পাখিদের ঠোঁটে গাওয়া;
বাতাসে হঠাৎ ভেসে এলে যে!
নাম কি তোমার? …হাওয়া?
অঝড়ো বাতাসে বহু বিউগল বাজে—
এত নির্জনে আদম হওয়া কি সাজে?
বাতাসে বাতাসে উড়ে উঠি, চলো,
ছিটকাই দুইদিকে;
আদি ও প্রথম অভিশাপ-স্মৃতি
কত আর হবে ফিকে!
বহু যুগ পর, বহু দূরদেশে,
লাল জলপাই বনে;
দেখা হোক ফের অনুতাপী বেশে
আদিপাপী দুইজনে!
পালাবদলের কাল এসে গেছে: লহুঝরানোর দিনে,
তুমি গিয়ে পড়ো লঙ্কায়; আর আমি সে-ফিলিস্তিনে।
মাতৃভূমি
বুকের ভিতরে রাখলে, যন্ত্রণা বেশি—
বারবার, বক্ষপিঞ্জর খুলে,
হৃৎপিণ্ড ফালি ফালি করে, দেখতে হয়;
কষ্ট পেতে হয়। কাঁদতে হয়—
প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে,
[রাজারা যেমনটি অনুমতি দেবেন];
মেখে বা বিধে, যেভাবেই থাকুক—
স্পর্শকাতরে সম্পর্কিতদের, মগজে রাখাই ভালো;
মাতৃভূমি,
তুমি আমার মস্তিষ্কের নিউরনে,
অজস্র পেরেকের মতো, গেঁথে আছো;
হাত অবশ হয়ে আসছে… চোখ দুটো ঝাপসা—
সেতু
দু’পাড়ে, দু’ধরণের মানুষ;
মাঝখানে সেতু— অংকপটু, ঝলমলে।
মিটারে, সেন্টিমিটারে, একচুলও কমবেশি নয়—
নিখুঁত বলতে পারে: মাঝের দূরত্বটা কত।
২.
সেতুতেই পার হওয়া যায়, তবু,
খেয়ায় চলছে— এপার, ওপার;
না হলে যে, নদী, মরে যাবে!
৩.
জুড়ে দিতে চেয়ে— সেতু আজ
দ্বিধা করছে: তোমাকে-আমাকে;
৪.
যেখানে মানুষ নেই, ও নদী,
তোর বুকে— সেখানেই,
সেতু হয়ে, শুয়ে থাকবো, রে!
রহমান হেনরী [১৪ জানুয়ারি ১৯৭০ – ]: কবি, বিশ্বকবিতার বাঙলায়ন কর্মি, ‘পোয়েট ট্রি’ নামক একটি অনিয়মিত কবিতাকাগজ সম্পাদনা করেন। জন্ম তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকূমায়; বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন।
রহমান হেনরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
কবিতা: বনভোজনের মতো অন্ধকার[১৯৯৮]; সার্কাসমুখরিত গ্রাম [১৯৯৯]; প্রকৃত সারস উড়ে যায়[২০০০]; অন্ধকারবেলা[২০০৪]; খুনঝরা নদী[২০০৫]; গোত্রভূমিকাহীন[২০০৮]; ত্রাণসুন্দরী[২০০৯]; ব্রজসুন্দরীর কথা[২০১২]; শতরথগুঞ্জন[২০১৬]; শ্রেষ্ঠ কবিতা[২০১৮]
বাঙলায়ন: নোবেলজয়ীদের কবিতা[২০১৩]; অধিকৃত ভূখণ্ডের কবিতা[২০১৩]; কবিতার ত্রিভুবন [২০১৪]; আদোনিসের কবিতা[২০১৪]
সম্পাদনা: বিশ শতকের বাঙলাকবিতা[২০০৯]
দারুণ সব কবিতা।সম্পাদককে ধন্যবাদ। কবিকে শুভেচ্ছা।