শাহনেওয়াজ বিপ্লব
চুম্বনে যদি সন্তান হতো
মিশর দেশে একটি মেয়ে দৈববাণী শুনেছিল–
‘যদি পুরুষ ব্যাঙের মুখে থুতু দিস,
চুম্বনে তখন হবে না সন্তান ।’
মিশরের যত পুরুষ ব্যাঙ,
সেই ভয়ে নীল-জলে ডুবে মরেছিল।
তাদের মৃত্যুতে নীল নদ আজো করে সন্তাপ।
আসলে এসবই রটনা–
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আকাশে যত তারা,
আমি তো তার চেয়েও বেশি করেছি চুম্বন।
চুম্বনে যদি সন্তান হতো,
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এতদিনে বত্রিশ কোটি ছাড়িয়ে যেতো।
নিজের মেয়েকে লেখা এক বেশ্যার চিঠি
সোনা মেয়ে আমার!
মাথা উঁচু করে বলিস–
আমি তোর মা,
আর এই ঢাকা শহর তোর পিতা ।
এই শহরের সতী সাধ্বীদের বলিস–
আমার মা
ভালোবাসা শিখিয়েছে তোমাদের পুরুষদেরকে;
শহীদ হয়েছে সে,
নিজেকে বলি দিয়েছে সে,
হাজার নারীর মান বাঁচাতে ।
মা আমার, পুরুষেরা কামনার সমুদ্র ।
সেই সমুদ্র পার হতে গেলে,
পেরোতে হয় শরীরের সীমানা ।
তাই তো প্রতি রাতে কামনার আগুন জ্বালিয়ে
পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হই রোজ সকালে ।
মাথা উচু করে দাঁড়াস, মা আমার !
তুই বাঁচবি আমার কবরের উপর দাঁড়িয়ে ।
মোকাবিলা করিস সমানে সমানে ।
সূর্যেও কিরণ মুঠো ভরে কুড়িয়ে নিস,
আমি যা ছুঁতেও পারিনি ।
আমি কামনা জয় করেছি,
তুই জয় কর লোভ।
আমরাই এই সুন্দর পৃথিবী, এই প্রকৃতি;
আমরা শুধু দিয়েই যাই, নিই না কিছুই ।
সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি : বয়স্কদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন
লোকাল বাসগুলোতে উঠলেই দেখবেন,কোথাও লেখা নেই–
‘বয়স্কদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন’।
অথচ লোকাল বাসগুলোতে উঠলেই দেখবেন,
মহিলা সিটের সামনে, মেয়েদের পাশে বা পেছনে দাঁড়ানোর জন্যে–
বাবা-মামা-চাচাদের অপরিসীম ঠেলাঠেলি!
এমনকী কয়েকদিন গভীর মনযোগে খেয়াল করলে দেখবেন,
গভীর রাতে উঠে শাশুড়ি কান পাতছেন ছেলের ঘরের দরজায় !
না না,ছিঃ অন্য কিছু শোনার জন্যে নয়–
কান পাতছেন, বউ তার ছেলের কানে কোনও কুমন্ত্রণা দিচ্ছে কি-না তা শোনার জন্যে।
বয়স হলে মানুষেরা ফুটপাথের এত ধার ঘেঁষে হাঁটেন,
যে তারা নোংরা পাড়াবেনই ।
বয়স্কদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন।
এমনকী, যখন আমার বয়স হবে, তখন আমার থেকেও!
কবিতা
আমি যা দেখি আর আমি যা বলি,
আমি যা বলি আর যা আমি বলি না,
যা আমি বলি না আর যা আমি স্বপ্নে দেখি,
আমি যা স্বপ্নে দেখি আর যা আমি ভুলে যাই
ঠিক তার মাঝখানে থাকে কবিতা।
হ্যাঁ আর না –এর
ভেতর দিয়ে সে ফসকে যায়,
সে বলে দেয়
যা আমি বলি না ,
আমি যা বলি
সে বলে না,
সে স্বপ্ন দেখে
আমি যা ভুলে যাই ।
কবিতা কোনো কথা নয়
কবিতা একটা কাজ ।
এটা এমন একটা কাজ
যা কথা দিয়ে তৈরি ।
কবিতা
কথা বলে। কবিতা কথা শোনে;
আর আমি যখনই বলি, কবিতা ছোঁয়া যায়-
সে তখন কেবলই পালিয়ে বেড়ায় ।
মসজিদ
অসহায় মাদি কুকুরটার কোথাও যাবার জায়গা ছিলো না,
তাই মসজিদের বারান্দায় মাদি কুকুরটা প্রসব করল
তিনটি তুলতুলে বাচ্চা।
মসজিদ পবিত্র হল !
সাপটা আশ্রয় নিল,
মাজারের নরম গালিচায়।
পুরনো খোলসটা মাজারে ছেড়ে নতুন জন্ম নিয়ে,
সাপটি পালিয়ে গেল।
মাজার পবিত্র হল !
আমাদের দেশের অসৎ ব্যবসায়ী, মিথ্যাবাদী রাজনীতিবিদ,
জোচ্চোর পুলিশ আর গলাকাটা ফি নেয়া ডাক্তার-এর নামাজ-কালাম;
কি এর চেয়েও পবিত্র ?
এক পাথরের গল্প
পাথরটাকে তুলে এনে মাজারে বসাতেই চিৎকার করতে শুরু করল সে–
‘পাপী আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ! থাকতে দে আমায় পাথর;
বন্দী করিস না আমায় ফুল-পাতায়,আগরবাতির ধোঁয়া আর জিকিরের শোরগোলে।
ফিরিয়ে দে সূর্যের আলো,বৃষ্টিরা আবারো আমাকে গোসল করাক তাদের ইচ্ছেমতো।
কে দিয়েছে তোদের এই অধিকার, আমায় বাধছিস নামের ফাঁদে ?
ফিরিয়ে দে আমায় সেই নদীতে,যে হাসতে ভুলে গেছে আমায় হারানোর বেদনায়।
তোদের আগরবাতির ধোঁয়ায় অন্ধ হয়ে গেছি আমি,
লাল দুটো চোখ মেলে এবার একটু সূর্যের আলো দেখতে চাই।
তার পরের সকালে রক্তমাখা পাথরটা লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়ল নদীতে।
নদীতে পড়ার আগে ইটের আঘাতে থেতলে গেল কচি কচি ঘাসের মাথা;
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা বলে উঠল, হায় রে মানুষ ! তোরা মানুষ ! ‘
তিনটি শিশির-কণার গল্প
আমরা তিনজন ছিলাম চাঁদের অপেক্ষায়,বৃক্ষের পাতায় ।
একজন উথালপাতাল আবেগে বললো–
ও আমার সাথে কথা বলেনি …
কোকিল তুমি ওকে বকে দিও …ভীষণ বকে দিও ।
এই বলতে বলতে সে উঁচু পাতার ওপর থেকে ঝাপিয়ে পড়লো নিচে ।
চাঁদের অপেক্ষা করলো না আর।
আরেকজন বললো- আজ মাতাল হবার দিন।
স্বকীয়তা ভুলে সে এগিয়ে গেল অন্য শিশিরবিন্দুর দিকে।
চোখ বুজে আমার তবু চাঁদের প্রতীক্ষা। লম্বা সফরে ঘটনাবহুল দীর্ঘজীবন ।
সহযাত্রীদের শোকে অবসন্ন মন । হঠাৎ প্রচন্ড আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল।
দেখি সামনেই সূর্য । আমাকে দেখে সে বললো- শিশিরকণা,কি সুক্ষ ! কি সুন্দর তুমি!
কেন অবহেলায় ঘাসের পাতায়? এসো শিশিরকণা তোমাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর রাখবো আমি ।
এই বলে সূর্য তার রোদেলা হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।
আমি শেষ শিশিরকণা মুহূর্তে শুকিয়ে গেলাম বৃক্ষের পাতায়।
বৌদ্ধভিক্ষুর হাসি
ভিক্ষুটি ঠিক করেছিল,
সর্বত্র সে হাসি দিয়ে সবকিছুর উত্তর দেবে;
নিন্দা-প্রশংসা-ধর্ম আলোচনা আর ব্যক্তিগত প্রশ্ন–
সবকিছুর উত্তরে,হাসবে সে ।
তারপর প্রতিদিন সকালে ও রাতে
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রহস্যময় হাসিচর্চা করতে লাগল সে
কিš‘ অকস্মাৎ একদিন তার ভাল লাগলো এক মেয়েকে ।
ভালবাসলো সে । গভীর চোখে তাকালো মেয়েটির চোখে।
তবে হাসিচর্চার মহৎ উদ্দেশ্যে নয়
বরং নিজের চেহারা খুটিয়ে দেখার মানসে ।
আজকাল না সেজেও কিছুটা সাজে সে ।
……………………………………………….
তেমনই একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
নিজেকে দেখতে দেখতে আতমগ্ন মানুষটি
প্রশ্ন করে-কেমন লাগছে আমাকে?
আর আয়না তৎক্ষণাৎ রহস্যময় হাসলো বৌদ্ধভিক্ষুর মত ।
যে মন কবিতা লেখে
আমি হাট থেকে হাটে ছেঁড়া মাদুর আর ছাটাই পেতে
যত হাড়হাভাতে চাষির কাড়া-না-কাড়া চাল
দু এক মুঠো যা কিনতে পেরেছি তা আবার বিক্রি করে,
দু চার টাকা যা পেয়েছি তা দিয়ে কিনেছি
আমার ফুটো শিশিতে সামান্য তেল,দু টাকার লবণ
আর আমার হাত রক্তাক্ত হয়েছে;
আমার হাত রক্তাক্ত হয়েছে দূর দূর গ্রামে গিয়ে
যখন সদয় হয়ে কেউ কেউ তুলে নিতে বলেছে আমাকে
তাদের বাগানের কাঁটায় ভরা বেগুন আর পাতিলেবু ।
আর এসব করতে গিয়ে
ফাকে ফাকে তুলে নিয়েছি কখনো কখনো দু-এক মুঠো ঘাস
আকাশের এক চিলতে রঙ,
শীত-নদীর ওপর জমে থাকা ভোর আর সন্ধ্যার কুয়াশা ।
আজ যখন আমি ঘুমোতে যাই
আমার পিঠের নীচে জেগে ওঠে নতুন নতুন দ্বীপ,
আমি যখন কথা বলি এখন, কৃষ্ণচূড়া আর দেবদার“
আমার হয়ে কথা বলে সাদা পৃষ্ঠার সাথে
আর সেই সাদা পৃষ্ঠার ওপর দিয়ে বয়ে যায় নদী,
আমি সেই নদীর গর্ভে ঘুমিয়ে পড়ি
আর আমি জেগেও উঠি এক সশব্দ আর্তনাদে-
যার নাম কবিতা ।
পাঠ
আম্মু বলেন পড়তে যাও-স্কুলে
আব্বু বলেন পড়তে যাও -স্কুলে
স্কুলে যাই, পড়া হলো শুরু:
—বাংলা—–
বাংলা কদু,বাংলা মদ, বাংলা সাবান,বাংলা সেমাই
বাংলা ব্র্যান্ডের দাম কম, বাংলা শিখে লাভ নাই।
—ইংরেজি—
ভাষার জন্যে ব¬াড দিয়েছে যে দেশ,
দ্য কান্ট্রি নেমড বাংলাদেশ।
—গণিত—-
মুক্তিযুদ্ধে দাদু আমার শহীদ হয়েছে
সে দেশে আজ রাজাকার বেশ রয়েছে,
গুণ অংকের হিসেবে দুর্নীতি আজ বেশ বেড়েছে ।
—-পরিবেশ পরিচিতি—–
কাটো গাছ, কাটো পাহাড়, দালান বানাও
ভরাট করো খাল-নদী হাতের কাছে যা-ই পাও
—ছুটির ঘণ্টা—-
ঢং ঢং
ঢং ঢং ।
অনুরোধ
আজ দুপুরে যারা ভাত খাবেন,
তাদের আমার অনুরোধ-
একটা ছোট্ট অনুরোধ,
কেন এমন হয়না যে, আজ দুপুরে
আমরা ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে
সোজা চলে যাই গ্রামে।
কোনো এক দুরের ধানখেতে গিয়ে
ধানের মঞ্জরির কাছে জেনে নিই,
চাল তৈরি হবার আগে-
মেশিনের যন্ত্রণায় কতটা ছটফট করেছিল ধানেরা ।
অথবা কৃষকের কাঁচি
কতটা নির্মমভাবে
কেটে নিয়েছিল ধানের গলা।
কেমন হয়, যদি আজ দুপুরে
আমরা ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে
চলে যাই ধানের মঞ্জরির কাছে !
ঠিকানা
পাখিদেরও একটা ঠিকানা আছে;
চিত্রিত দিনের ছবি ¤øান হয়ে এলে,
তারাও গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফেরে।
পথ-ঘাট সব তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হলে,
কাক আর কুকুরেরাও ঘরে ফিরে যায়।
কেবল আমারই কোনো ঠিকানা নেই.
অথচ আমারও সাধ জাগে,
জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের সুউ”চ গম্বুজে উঠে দেখি-
দূর দিকচক্রবালে কোন দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে, চাটগাঁর আকাশ
আর বড় জানতে ই”েছ হয়-
কী করে একটি দুটি খড়কুটো নিয়ে সংসার পাতে
চড়ুই পাখিরা ।
আজ কতদিন হল, মনে নেই
এই শহরের পথে পথে আমি
কচুরিপানার মত উদ্দেশ্যবিহীন ঠাই খুঁজে ফিরি ।