শিমুল আজাদ
আমার যায় আসে
কেউ সামনে এসে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে
কিছু কি যায় আসে ?
যদি পরক্ষণে ভিড়ের হৃদয়ে নেমে কুৎসা রটায়!
যেনো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
আমার যায় আসে না
সুন্দরীর গালের একটি কি দু’টি তিলে।
আমার যায় আসে না
নারীরা পুরুষদের মতো সিগারেট খেলে।
যায় আসে তখন–
যখন কেউ অবিরাম অনৈতিকে ডুবে;
সম্মুখে আমাকে পেয়ে–
সৎ কার্যের উপদেশ দিতে থাকে।
তাতে আমার খুব যায় আসে।
পাখাদের ভিড়ে ঘোরে আধিপত্যবাদ
মাথার উপরে সিলিং ফ্যানটি খুব কাজে লাগে।
যখন গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে নিজেকে স্থির রাখা সহজ না হয়।
খুব কাজে লাগে। এক মিনিটও অপেক্ষা সহ্য নয়।
সহনের কাল কেবলিই গুড়িয়ে যায়।
দেখি এই পাখার কারিস্মা!
প্লেনের বাসের জাহাজের এয়ারকন্ডিশনে
এমনকি কম্পিউটারেও ঘোরে এই পাখা মিহীন গতিতে।
অসম্ভবের সম্ভাব্যে প্রগতিরা পাখা নির্ভর শান্তি নির্ভর নিশ্চুপে;
এক স্থান থেকে আরেক স্থানে।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে বাণিজ্যরা তুমূল হুল্লোড়ে
নিংড়ে নিচ্ছে দেহদের রক্ত,
অস্থি মজ্জা মগজের উর্বরতা, কলিজার স্বাদ।
এখন প্রয়োজন বিশ্বব্যাপি এক প্রবল গণবিক্ষোভ।
এখন প্রয়োজন সত্য পথে দুর্বার যাত্রীর।
এখন প্রয়োজন ষড়যন্ত্রের আখড়াকে ধুলিস্মাৎ করা।
এখন প্রয়োজন মোড়লের গৃহে অগ্নির প্রজ্বলন।
এখন প্রয়োজন আধিপত্যবাদের কালো হাতকে
পাথরে থেৎলানো।
মাথার উপর পাখা নয় পুঁজিবাদের হাত।
মাথার উপর স্বস্থি নয় ভয়াবহ ভূমিকার দৌঁড়।
মাথার উপর শান্তি নয় পুঁজির বিকাশক্রিয়া
রয়েছে থম থম।
যেভাবেই যাও কেবলই উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রের নিত্য কৌশল।
যেখানেই যাও অপরিচিত গন্ধ বর্ণ চারিপাশ রেখেছে দখল।
বাস্তবিক আমরা জ্বলি সাম্রাজ্যবাদের শরীরে
ওরা যখন ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে
আমরা তখন ধ্বনিকে শাণ দেই।
ওরা যখন অণু-পরমাণু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত
তারও ক্ষুদ্রে প্রোটনে পৌঁছে
পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণে ভয়াবহ উল্লাস পোষণ করে–
আমরা তখন শব্দে শব্দে স্রেফ আগুন জ্বালিয়ে দেই।
স্রেফ বাক্যের পর বাক্যে নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করি।
নতুন নতুন শব্দ নতুন নতুন বোধ কোনো এক চৈতন্য দর্শনে
পৌঁছে দেই ভাষারাজ্য প্রতিষ্ঠায়।
ওরা যখন নিঃস্ব ভিখারি হয়ে যায়
ফন্দি-ফিকির আটে, বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে
নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দেয়।
শিশু, নারী বৃদ্ধদের নিধনে দানবকূল সম্রাট হয়ে
হেঁকে বেড়ায় বীভৎস উল্লাসে।
রাতের আঁধারে তেলকূপ নিংড়ে নিতে থাকে।
তখনও কবিতা বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে।
তখনও কবি প্রতিরোধের ধ্বনিতে কাঁপিয়ে তোলে বিশ্বকে;
লুণ্ঠণের হত্যার লাম্পট্যের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান দাঁড় করান।
হে বর্বর শত্রুগণ, দানবকলেরা ভেবো না
ধ্বনিরা শব্দরা বড়ো বেশি অসহায়প্রবণ,
বড় বেশি ম্রিয়মান!
ভেবো না মারাত্মক অক্ষম এবং শক্তিহীন!
জেনো এখানে খাঁটি রোদের তাপ।
জেনো এখানে চাঁদের স্নিগ্ধতার ছোঁয়া।
নদীর উজান ঢেউ সমুদ্রের গর্জন
নক্ষত্রদের আনাগোনার মিশ্রণ
আরও আছে মাটির তুমূল প্রলেপন–ফুল, ফল,
ফসলে বৃক্ষদের নিরব প্রার্থনা!
ভেবো এসবে তোমাদের ভয়।
জেনো এসবে তোমাদের ক্ষয়।
কবির শক্তির কাছে তোমরা কেবল গালিভারের দেশ।
ফুটপাতের ভিখারি আর বিকলাঙ্গের বেশ।
ওরা যখন কবিতার গুষ্ঠি উদ্ধার করে
আমরা তখন ধৈর্য্যরে চূড়ান্ত পরীক্ষা দেই।
শব্দাস্ত্রকে তৈরী করতে থাকি নানামূখি নিপুণ অব্যর্থে।
ওরা যখন ভোগের ভাগাড়ে তন্ময়
আমরা তখনও শব্দে শব্দে স্রেফ আগুন জ্বালিয়ে দেই।
প্রত্যাশার প্রহর
দিন কখনো একরকম নয়। হয় নাকো!
আপাতদৃষ্টিতে দিনগুলি সব একই রকম মনে হয়।
তাই দেখে মুর্খরা মরে;
আর আত্মতুষ্টি লাভ করে পেয়েছি উপায়।
সব দেশ সব জাতি আমাদের অধীন।
দাসত্বে শৃঙ্খলে শোষণে বঞ্চনায়
যা খুশি তাই করে যাই সুখ ভোগ রাজ্য শাসন।
কিন্তু দিনতো একরকম নয়।
কোন কোন দিন সাদা শান্ত শিষ্ট
আর স্নিগ্ধ নীল নীল ছোপ নিয়ে চলমান।
কোন কোন দিন কালো মেঘেদের দখলে
গর্জে ওঠে বিদ্যুৎ চমকায়।
আর যা পারে ভেঙে তছনছ করে।
এ সব চিহ্ন উদাহরণ স্বরূপ।
অনেক অনেক দর্শন-নীতি কথা সংবেদন নিয়ে বাড়ে।
প্রচেষ্টাকে চায় অনন্ত এক্সপ্রেসের যাত্রী করে তুলতে।
সাধনাকে চায় একমুখিন তন্ময়তায় জাগাতে।
যা শুদ্ধ কল্যাণকর।
যা চিরন্তন শাশ্বত যা স্রষ্টার পক্ষ থেকে
আশীর্বাদ স্বরূপ তার দিকে
ঝুঁকে পড়তে দিনেরা দৈনিক আসে;
প্রাত্যহিক রাত আর অব্যক্ত ধ্বনিগন্ধে উতাল।
তাকে ঠিক-ঠাক বোঝা চাই।
তাকে ঠিক-ঠাক পরিমাপের জ্ঞান অর্জনে
বড়ো বেশি ঝুকে পড়া চাই।
চাই একটি দিন ঝকঝকে।
একটি রাত নিঃসীম নিরবে
সামগ্রিক দর্শনে এসে ডাকুক আমাকে।
অতিক্রান্তের গল্প
ইমাম সাহেব প্রতিদিন দাওয়াত পান কারো না কারো বাড়ি।
ইমাম সাহেব ওয়াজ করেন সপ্তায় শুক্রবারের একটি দিন।
স্কুল ছুটিতে কলেজ ছুটিতে আর সকল পেশাজীবীর
বন্দের দিন উপলক্ষে তিনি কেঁপে ওঠেন
মৃত্যু আসন্ন কোনো প্রাণীর থরথর কম্পনে।
ইমাম সাহেব বেতনভুক্ত জনকর্মচারী।
মসজিদের দোকানগুলি থেকে যে আয় আসে
এলাকায় বসবাসকারীর চাঁদা থেকে যা পাওয়া যায়;
তারপরও সমাজের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কাছ থেকে
ইমাম সাহেব মাসওয়ারী খরপোষ নেন।
প্রায়শ: ঈমাম সাহেব একটি লাল হোন্ডা চালিয়ে যান
আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে।
আমি যখন হেঁটে হেঁটে শহরে যাই
তখন তাকে দেখি কাঁদা ছড়িয়ে,
ধুলো উড়িয়ে তিনি ওভারটেক করে যাচ্ছেন আমায়।
তদুপরি ইমাম সাহেব আমাদের ছাড়েন না।
মাসওয়ারী চাঁদা চান তার চেয়ে
অধিক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের কাছে।
মাঝে মধ্যে মসজিদে তার পিছনে নামাজে দাঁড়াই।
মাঝে মধ্যে তার সাথে কুশল বিনিময় হয়।
তিনি স্রষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি।
তার মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের উপায়।
তার প্রার্থনায় আমাদের সুখ-দুখের খবর রচিত হয়।
ইমাম সাহেব মাঝে মধ্যে হাঁটেন সেখানেও তিনি
আমাদের অতিক্রমের চেষ্টা করে যান– নিখুঁত উদ্ধারহীন মানসে।