spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যছন্দহীন জীবনে কাব্যময় হৈমন্তিক প্রেম

লিখেছেন : মাহফুজুর রহমান আখন্দ

ছন্দহীন জীবনে কাব্যময় হৈমন্তিক প্রেম

মাহফুজুর রহমান আখন্দ

গ্রামীণ জনপদেই আমার নাড়িপোঁতা। গ্রামের ছনের ঘরে জন্মেছি। বাঁশের ছেঁচার বেড়া ছনের ছাউনি। আব্বা-মা থাকতেন সেই ঘরে। বেড়ে উঠেছি টিনের ঘরে। নকশা করা কাঠের সৌখিন বেড়া এবং টিনের ছাউনি। প্রশস্ত বারান্দা। দাদাভাই আর বম্মার ঘর। বম্মা মানে বড় মা। দাদী। মায়ের মতো আঁচলে ঢেকে বড় করেছেন। তাই বম্মা। এক এক করে ছয়ভাই দুইবোনের সবাই প্রায় বড় হয়েছি দাদাভাই আর বম্মার ছায়ায়। আটসন্তানের বিশাল সংসারে আব্বা সারাদিন খেটেই চলেছেন মাঠে ঘাটে বাজারে। মা সারাদিনই সংসারের ঘানি টেনেছেন। লেখাপড়া আর স্বপ্নবোনার কাজটি করে দিয়েছেন দাদাভাই-বম্মা।

খুব ছোটবেলা থেকেই গৃহস্থলী কাজের প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিলো আমার। বড়ভাই ছিলেন পড়াপাগল। লেখাপড়ার বাইরে কিছুই বুঝতেন না তিনি। পড়তে ইচ্ছে করতো না আমার। তবে ভাইয়ের পাঠ্যবইয়ের ছড়াগুলো শুনে শুনেই মুখস্ত করতাম। গৃহস্থলী কাজেই মজা পেতাম বেশি। ছাগল পালনে খুব পটু ছিলাম। একপাল ছাগল চড়িয়ে দিন কাটাতাম। গরুর খাবারও দিতাম আব্বার সাথে সাথে। জমিতে চাষ দিতে আব্বার সাথে মাঠে যেতাম। মাছ ধরা ছিলো আব্বার প্রতিদিনের রুটিন। আমিও থাকতাম আব্বার সাথে। ধান-পাটের বুনন থেকে নিড়ানী, কাটা-মাড়াই সব কিছুতেই আমি আব্বার সহযাত্রী ছিলাম। বলা চলে কৃষিকাজে আব্বার একান্ত সঙ্গী ছিলাম ছায়ার মতো। 

সংসারের মেয়েলি কাজেও মার সাথে সহযোগিতা করতাম। মাছ মেরে এনে মার সাথে বসে কাটিকুটি করে ধোয়ার কাজও করতাম। রান্নাবান্নার সময় চুলোয় জ্বাল ঠেলতাম। পুরনো কাঠ-বাঁশ কিংবা খড়পাতার জ্বালানী। ঢেঁকিতে ধান ভানতাম মার সাথে। ছোট-ভাইবোনদের চারজন বড় হয়েছে আমার কোলে-কাঁখেই। ঋতুপরিবর্তনের সর্দিকাশি কিংবা অন্যকোন উপসর্গ মুখস্ত ছিলো সেই ছোট্টকালেই। 

গ্রামীন জীবনের ঋতুবৈচিত্র্য আমাকে ভীষণভাবে টানতো। গ্রীস্মের দাবদাহে মরা-নদীর শুকনো খালে ধান কাউনের ক্ষেত আমাকে মুগ্ধ করতো। মুগ্ধ করতো মাঠের কচিকচি পাটের ক্ষেত। বাউড়ি বাতাসে ধুলোর গোলপাকানো উড়াউড়ি। ছাগল-ভেড়া নিয়ে সেই মরাখালের পেটে গজানো সবুজ ঘাস খাওয়ানোর মজাই আলাদা। বাড়ির পাশের কালপানি নদীর পেটের গভীরে লুকোচুরি খেলা আজো শিহরণ জাগায়। আমাদের গ্রামের পূবপাশে বাড়ির সামনে বিশাল ডোবা। ডোবার আধা-শুকনো চুয়োর মাছের কিলিবিলি চিত্র মনের খালে নতুন ছন্দ জাগায় এখনো। পাশের গ্রামে তেলিয়ান বিলের শুকনো শরিরে ফাটাফাটা ক্ষতে পদ্মগোটা কিংবা পদ্মশেকড় তুলে খাওয়া অন্যরকম এক মজা। পদ্মগোটাকে সল্লের খোঁচা এবং পদ্মশেকড়কে বলতাম নাল। বর্ষা আসার আগেই গ্রীস্মকালীন বৃষ্টিতে নালগুলোতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়। বিলের ফাঁটাপলির চাপ উল্টে কালো কালো পদ্মগুটি তুলে খাওয়ার কি যে মজা। আহ্। ভিন্নরকম এক অনুভ‚তি। গ্রীস্মের কালবৈশাখী ঝড়ে গুড়–ম গুড়–ম কড়াৎ কড়াৎ বিজলিচমক আর দেয়ার ডাক পেরিয়ে আমকুড়ানো, সে এক অন্যরকম মজা। বৃষ্টির পানি গড়ানো শুরু হলেই ডাক-চেলকন মাথায় নিয়েই কালপানিতে উজান মাছ ধরার চমক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিহরণ। বর্ষার মজাটা ছিলো আরেকটু ভিন্ন আঙ্গিকে। বানের পানিতে মাছ ধরা, নৌকা বাইচে ড্রামের তালে তালে গান গাওয়া। ভীষণ আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো বাড়ির উঠোনে লোকগানের আসর। 

সবচেয়ে বেশি মজা হতো শরৎ-হেমন্তে। ভাদ্র-আশ্বিন মাস মানেই বানের পানি নেমে যাবার ক্ষণ। নিচুজমি, ডোবা-বিলে মাছ মারার মহোৎসবে মেতে উঠা। পানি নেমে যাওয়া নিচু জমিতে হালচাষ দেয়া। কাদার মিষ্টি গন্ধমেখে ধানের নমলা চারা রোপন করা। বানের পানি থেকে বেঁচে যাওয়া মাথা উঁচু করে থাকা ধানক্ষেতের হাঁটু পানিতে কৈজালা পেতে মাছ মারা। গর্ভবতী ধানের মাথায় জমে থাকা শিশির বিন্দুতে রোদেলা পরশ। গুটিগুটি মুক্তোর হাসি। মেঠো পথে বানডোবা ঘাসের কচিপাতার হাতছানি। বিলের ধারে, ডোবার কিনারে কিংবা পলিমাখা ক্ষেতের আইলে বানবিদায়ী ঘ্রাণ। কচুরিপানার মুখে ময়ুরপুচ্ছের মতো রঙমাখা সাদা ফুল। মনটাকে আটকে রাখতো আদুরে মায়ের মতো। 

আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে কালপানি নদী। নদী মানে খাল। বর্ষা মৌসুমে ভরে ওঠে চারিধার। মিটিমিটি ¯স্রোত বয়। চৈতালি খরায় মরে যায় বেশিরভাগ অংশ। মরাঘাটির কাছে তখনো পানি থাকে দশ বারো হাত। মরাঘাটি মানে হিন্দুদের লাশ পেড়ানো জায়গা। নদীর সেই বাঁকটা অনেক গভীর। নদীর দুপাড়ে অসংখ্য গাছ-গাছালি, বাঁশঝাড়। গোরস্থান। বেশ উঁচু জায়গাগুলো। প্রচুর পাখ-পাখালির উড়াউড়ি। মাঝে মাঝে দু’চার বিঘাজুড়ে ছন-কাশের মেলা। আগের দিনে ছনগুলো ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার করা হতো। এখন আর ছনের ঘর চোখে পড়ে না। ছন-কাশের জমিগুলোও আর তেমন নেই। শরৎ-হেমন্তে ছন-কাশের জমিগুলো জংলি বনের মতো মনে হতো। সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটতো। জংলী ফুল। নানা প্রজাতির ব্যনপ্রাণি থাকতো এ সব জঙ্গলে। বর্ষার পানিতে সব ধরনের বন্যপ্রাণি আশ্রয় নিতো এ জঙ্গলগুলোতে। কার্তিক অঘ্রাণ মাসে দূরদূরান্ত থেকে সাঁওতালরা আসতো দল বেঁধে। কাশবন ঘিরে ফেলতো। তারপর অনুসন্ধানের জন্য ঢুকে পড়তো একটি গ্রæপ। বাকিরা তীর-ধনুক নিয়ে রেডি থাকতো। শেয়াল, গেছোবাঘ, মেছোবাঘ, খেকশিয়াল এ সব প্রাণি মেরে নিয়ে যেতো। আমরা দেখার জন্য বড়দের সাথে যেতাম। মজাও পেতাম। কিন্তু যখন প্রাণিগুলো শিকার করতো তখন খুব কষ্ট লাগতো। 

কার্তিক-অগ্রহায়ন মিলেই হেমন্ত। হেমন্ত মানেই রিক্ততার বেদনা। হেমন্ত ডাকে ছন্দহীন জীবনে কাব্যময় প্রেম। ছন্দহীন জীবন মানেই ক্ষুধা-দারিদ্রের এক রশি টানাটানি। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস ঋতুকন্যার দুঃখঝরা দিন। ফসল তোলার পূর্ব মাস। ‘মঙ্গার মাস’ কার্তিক। পোয়াতি ধানের দিকে তাকিয়ে থাকে কৃষক পরিবার। গোলায় ধান নেই, কুঠিতে চাউল নেই। ক্ষুধার্ত কান্নায় রান্নার হাড়িটাও ঠনঠন করে বাজে। মধ্যবিত্ত কৃষকেরা মহাজনের বাড়িতে পা বাড়ায়। ধানের উপর অগ্রিম টাকা নেয় কেউ কেউ। গ্রামের দুচারজন দরদী ধনীমানুষ গোলা থেকে ধান নামিয়ে ধার দেয়। ‘নিয়ে যাও একমন ধান। ছেলেপুলেগুলো একমুঠো ভাত খেয়ে বাঁচুক।’ আধাপেটা ভাত আর খালবিলের মাছ দিয়ে উদরপূর্তি।

সকাল বিকেল ধান ক্ষেতের আইলে হাঁটাহাঁটি। ধান ফুলেছে। মাথা হেলেছে শীষের। মৃদু বাতাসের নাচানাচি। আলতো আলতো দমকা হাওয়ার লুটোপুটি। রোদেলা মেঘে লুকোচুরি। রাঙা হলুদে আলতা মেখেছে কোমল রোদ। হালকা হিমেল বাতাসে আলতো ভেজা প্রকৃতি। ধানের দানায় সোনালি আভা। কাঁচা সোনার মতো নবযৌবনা ধানের শীষগুলো কুয়াশায় স্নাত হয়ে নববধুর মতো রাঙালজ্জায় মুখটা নিচু করতে শুরু করেছে। কৃষকের চোখে অমূল্য সম্পদ পাকা ধান। সোনালি স্বপ্ন দোল কৃষকের চোখে। পাতলা কুয়াশায় টুপটাপ স্নান। মাথা জাগানো ধানের পাতায় মাকড়শা জাল বোনে। বোনা জাল যেনো মশারির আবরণ। ভেতরে চুঁয়ে-পড়া আলোয় ধানগাছগুলো নতুন বউয়ের মতো ঘুমিয়ে থাকে। আহ্, কি যে আনন্দ কৃষকের। নতুন বৌ ঘরে তুলে আনার সময় আসছে এগিয়ে। দিনক্ষণ গণনা চলে। আর মাত্র একসপ্তাহ। এইতো সামনের বৃহস্পতিবার। 

বুধবার রাতে আর ঘুম ধরে না। সকালে ধান কাটতে যাবে। নতুন ধান। মৌ মৌ গন্ধ। কোমলা চাউলের নতুন ভাত। গরম ভাতের বাউড়ি ভাপে বুকটা তৃপ্তিতে ভরে উঠবে। বিয়েবাড়ির ধুমধাম বুকের ভেতর। নতুন ধান মানে নতুন বউয়ের আগমন বাড়িতে। অন্যরকম উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসার ঢেউ বুকের ভেতর। 

কোমল ভোরে ঘুমভাঙে কৃষকের। দুমুঠো বাসিভাত পেটে দিয়ে জমিতে যায়। বেছে বেছে কয়েক আঁটি ধান কাটে। বাহুকে বেঁধে কিংবা আঁটি বেঁধে মাথায় করে বাড়ি ফেরে। বাড়িতেও চলে সাজ সাজ ভাব। বাড়ির বৌ সকালে উঠেই উঠোন পরিস্কারে মনোযোগী হয়। গোবর আর কাদাপানি দিয়ে লেপে। গোবর দিয়ে কাদাপানি মাখলে উঠোনে ধুলোবালি থাকে না। উঠোনটা বেশ কড়মড়ে শুকনো হয় হয়। ধান নষ্ট হয় না। তাড়াতাড়ি শুকোয়। শিশুদের চোখে মুখেও খুশির ঝিলিক। বাড়িতে প্রথমবারের মতো ধানগাছ ফেলতেই আনন্দময় এক দৃশ্য। হাঁস-মুরগির আনন্দঘন লাফালাফি। নতুন ধান খাওয়ার ফন্দি-ফিকির। শিশুদের হাতে থাকে কঞ্চির লগি। মুরগিকে তাড়া করা। নতুন ধান খাস নে। যাঃ পালা। 

আঁটি কুপিয়ে ধান আলাদা হলেই মসজিদের হুজুরকে খবর দেয়া। আগামীকাল রাতে আমাদের বাড়িতে একটু হাতধোয়ার দাওয়াত। কয়েক আঁটি ধান কেটেছি। নতুন ধান। আপনি একটু দুআ করে আসবেন। চোখে-মুখে অনাবিল তৃপ্তির হাসি। 

নতুন ভাতে হুজুরকে দাওয়াত। বিল থেকে ভালো মাছ মারতে হবে। সোল মাছ। মাগুর মাছ। কৈ মাছ। হুজুর আসবেন। গৃহিনীরও ব্যস্ততা। ধানসিদ্ধ করা। শুকানো। ঢেকিতে ধানভানা। নতুন ধানের গন্ধে দারুণ এক উৎসব পুরোবাড়ির ভেতর বাহির। এশার নামাজ শেষ করেই চলে আসেন হুজুর। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শিশুরাও। হুজুর এলেই খাওয়া। নতুন ধানের ভাত। হুজুরকে খাইয়ে তারপর সবাই খাবো। বরকতের একটা ব্যাপার আছে না?  আহারে। সেই মজা এখন শুধুই স্মৃতি। এক টুকরো ইতিহাস।

সপ্তাহ না পেরুতেই পুরো মাঠজুড়ে সোনালি ধানের হাসি। হিম শীতল হাওয়ায় সোনালি ধানের শীষে খুশির ঢেউ। শাদা শাড়িতে ঘোমটা পরা জোসনা। কোমল আলোয় কুয়াশা-প্লাবিত রাত। কুয়াশার চাদরে ঢাকা সকাল। ভোরের কোমল-কাঁচা রোদে পাখির কিচিরমিচির ডাক। শিশিরে ভেজানো মেঠোপথের সবুজঘাস। বানেভাঙা শুকিয়ে যাওয়া পথঘাটের ফোঁকলা হাসি। কাঁচা-পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ। সোনা-জাদুমাখা শিল্পীর ছবি আমার বাংলাদেশ। 

অঘ্রাণ মানেই চারদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। নতুন আমেজ। উৎসবের হাওয়া পুরো গ্রামজুড়ে। মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম। হেমন্তের মাঠ থেকে কৃষকরা ঘরে তোলে নতুন ফসল। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানের উড়াউড়ি। গভীর রাতে ঢেকিতে চিড়াকোটার শব্দ। পিঠাপুলির সুগন্ধি বাতাস। অর্ধমরা খালবিলে বালিহাঁস ও পানকৌড়ির মাছ শিকারের ধুম। একপায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কানাবক। শাদা বকের উড়াউড়ি ঝিলের হাঁটুপানিতে। শালিকসহ নাম না জানা হাজারো ছোটপাখি ক্ষেতের ধানকাটা মাঠে পোকা-মাকড় ধরার আমোদে বিহ্বল। গরু-মহিষের পাল ছেড়ে দিয়ে রাখাল বালকেরা মেতে ওঠে ডাঙগুলি-গোল্লাছুট, দাড়িয়াবাধাসহ লোকজ খেলায়। হালকা শীতে শুরু হয় তাফসিরুল কুরআন মাহফিল, গজলসন্ধ্যা, বৈঠকি গানের আসর। প্রকাশনার জগতে আসে হৈমন্তিক সংখ্যা। হেমন্তের গানে জাগরিত গণমাধ্যম, অনলাইন ইউটিব, সাহিত্যের গ্রুপ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের সকল ভার্চ্যুয়াল জগত। লেখকের কলমে আসে নতুন ছন্দরস, মাটি-মানুষের স্বপ্নসুখ। শিল্পীর কণ্ঠে ওঠে নতুন সুর, জীবনের সংলাপ। নতুন সৃষ্টির আনন্দ-উল্লাসে কাব্যময় মুগ্ধতায় নেচে ওঠে হৈমন্তিক জনজীবন। সৃষ্টির সুখের উল্লাসে কাব্যময় হৈমন্তিক প্রেমে জেগে ওঠে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ