আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
গ্রন্থটি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। ইতিমধ্যে বইটি সাড়া জাগিয়েছে পাঠক মহলে। কবি, আলোচক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক জাকির আবু জাফর।
কখনো গল্পের ছলে কখনো কবিতায় লাখো শ্রোতা ও পাঠকের মনের গহীনে লুকানো কথা, সমাজের কথা, প্রেমিকের কথা চমৎকার করে তুলে ধরেছেন তিনি। দেশের অন্যতম প্রধান পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্তের সাহিত্য সম্পাদক কবি জাকির আবু জাফরের কবিতার বই ‘নিজস্ব মৌনতার আসর‘। বইটি সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ তরুণী ও পাঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। রকমারী’তে বিক্রিও হয়েছে প্রচুর।
উক্ত গ্রন্থে ৪৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতা গুলো প্রথমে একটু কঠিন মনে হলেও মনোযোগ দিয়ে পড়লে তাঁর কবিতার সুপ্ততাপ অনুভব করা যায়। হৃদয়ের গভীরে দাগ কেটে যায়। বসন্তের মতো মৌ মৌ করে উড়ে সুগন্ধি বিলায়।
কবিতাগুলোর নামকরণ হয়েছে অনন্য। যেমন ছাপচিত্রের নকশা, হৃদয় গ্রন্থের পাতা, চোখের নদী, রঙবার্তা, মনান্তরের পাখি, রূপকথা চুপকথা, ভাষাহীন ভাষার কল্লোল, নিজস্ব মৌনতার আসর, সবুজ রক্তের শিখা, এক চিমটে স্বাক্ষর, কে তুমি জ্যোতির যৌবন। নামকরণে যেমন চমক দেখালেন ভেতরেও আছে আগুনের ভালোবাসা।
প্রথম কবিতা ছাপচিত্রের নকশা। এতে তিনি ইতালীর বিখ্যাত চিত্র শিল্পী এডভেঞ্চার লিওনার্দোর হাতের তুলি নিয়ে রঙে রঙ মিশিয়ে প্রিয়ার নকশা আঁকার চেষ্টা করেন। প্রিয়ার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় ভোমর হুস হারিয়ে ফেলে। অথচ প্রিয়া প্রজাপতির মতো রঙিনই থাকে। তিনি প্রেমমুগ্ধ হয়ে শেষে বলেন অন্তত ‘জলছাপ তুলে ঠোঁটছাপ একে দাও পৃথিবীর মুখে’। যেন পৃথিবী মুগ্ধ তার প্রেমে।
দ্বিতীয় কবিতার নাম দিয়েছেন ‘হৃদয় গ্রন্থের পাতা’। এখানে কবি প্রেমের শিখা জ্বালিয়ে খুঁজেছেন প্রিয়ার হাসির রহস্য।
তিনি লিখেছেন–
জীবন গ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজি তোমার মন- গ্রন্থের নাম
কোথায় লিখেছো এক টুকরো হাসির যাদু
কোথায় রেখেছো আনন্দময় প্রেমের চিঠি
কি করে রেখেছো বুকথরো দৃষ্টির দহন।
আরেকটু পরেই লিখেছেন–
তোমার কাছেই স্মৃতি গ্রন্থটি জমা রাখতে চাই
এটি খুললেই কেবল পাবে নদীর মতোন
গোটা এক জীবন
এপাশ ওপাশ যুথসই নিতে পারো তৃষ্ণার ঘুম
দুঃখ-সুখের চিত্রশালা বুক-গ্রন্থটি খুলতে চেয়েছো তুমিই।
‘চোখের নদী’ কবিতায় লিখেছেন–
জুলেখার চোখের নদী আকাশ গাঙে
স্মৃতি ঢেউ প্রেম যমুনার শরীর ভাঙে।
নীলাম্বরী নীলাম্বরী হৃদয় ডেরায়
একাকী দৃষ্টি রেখে দৃষ্টি ফেরায়।
‘চোখের নদী’ কবিতায় মৌনতা ভেসে উঠেছে এভাবে–
যেনো শব্দের দোতনা বেজে উঠেছে। নীলিমার নীলাম্বরী যেমন বাদ্যের মতো বেজে উঠেছে তেমনি একাকী দৃষ্টি রেখে দৃষ্টি ফেরায় এসে নদী কূলে আকুল আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আশ্রয় পেতে।
অদ্ভুত শব্দ চয়নে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। একই কবিতার শেষ লাইনে আরেকবার সুরের ঝংকার বেজে ওঠে।
“কে থাকে থাকার ঘরে একাই থাকুক,
জীবনের জন্যে সবাই জীবন ডাকুক।”
‘আজ বৃষ্টিদিন’ কবিতায়–
শুনশান নিঝুমতা চারিদিক
নীরবতার নিজস্ব কানাকানি
ভাষাহীন ভাষার কথন
বিরহহীন বিরহের ছাঁট
বৃষ্টির ভাষায় কথা নাড়ে সময় ঠোঁট।
যেন সুর তুলে বৃষ্টির ছন্দে কথা বলছেন পাঠকের সাথে। কি চমৎকার অনুভূতি কি দারুন শব্দ চয়ন, কি দারুন প্রেমের ভাষা, শব্দহীন কথোপকথন।
‘হেমন্তময়’ কবিতায় লিখেছেন–
” জলে ডোবা শামুকের বুক যদি খোলো
শাপলার মুখ ছেনে রঙ টেনে তোলো।
জীবনের বাঁকে বাঁকে সেই রঙ মাখো
শ্যামলিম দেশটারে বুকে ধরে রাখো।
‘রঙবার্তা’ কবিতায়–
“একদা মানুষ ছিলো সত্যের আত্মীয়
রঙ ছিলো মানুষের মনে
এখন মানুষ মিথ্যের দোসর
রঙ কেবলি মুখের প্রলেপ।”
কি দারুন মনের কথা ছন্দে ছন্দে ফুলে ওঠে বুক।
শেষের দিকে আছে–
কি আর করি
তোমার নিসঙ্গ চোখ থেকে একাকীত্বের দাগ মুছে
পান করি জীবনের ঝোল
মুখরঙগুলো যদি আবার ফেরে মনের শহরে!
এখানেই ধরা পড়ে কবি মৌনতার আসর বলতে কি বুঝাতে চেয়েছেন। কবির নিস্তব্ধতার ভাষা কবিকে উঁচুতে পৌছে দিয়েছে। না বলা কথা, না বলা ব্যথা, না বলা মৌনতা সব বলে দিচ্ছে মুখরঙগুলোকে। মৌন সম্মতি যেমন স্বপক্ষে থাকার লক্ষ্মণ তেমনি তিনি আরো বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন “মুখ ও মুখের মানুষ” কবিতায়। লিখেছেন —
“কিছু থাকে কষ্টরঙ বিষন্নমুখ
মন থেকে মৌনতার শিস ফোঁসে দীর্ঘশ্বাসে
চোখ ভরা নিষন্ন দৃষ্টির কুয়াশা।”
‘মনান্তরের পাখি’ কবিতায় লিখেছেন–
“আমি তাই ঘেঁটে তুলি এই আমির ভাষাহীন মনের অক্ষর
হয়তো তুমিও জানো মনের গহনে ডুবে থাকে এক বিস্ময় সমুদ্র
এসব অক্ষরে বাঁধা ঢেউয়ের পৃষ্ঠাগুলো
জীবনের সাথে এঁকে দিলে সে হয় বিস্তীর্ণ জলের উজান।”
কবির কবিতায় প্রকৃতি যেমন ফোটে উঠেছে তেমনি প্রেমের অব্যক্ত লেলিহান স্মৃতি ব্যক্ত হয়েছে। ‘রূপকথার চুপকথা’ কবিতায় মনের দহন বিস্ফোরিত হয়েছে প্রেমের প্রকাশ লিখেছেন এভাবে–
“কিছু কথা কোনোদিন কথা হয়ে ওঠে না
কোনোদিন ফোটে না শরমের স্বর ঠেলে শব্দফুল
ভাষাহীন ভাষার ভেতর থেকে যায় চিরদিন।”
কবিতার শেষে না বলা লুকানো মনের দহন ব্যথার কথা, পরিবারহারা স্বজনের কান্নার কথা, গুম খুনের চুপ থাকার কথা, প্রেমের অসহনীয় মর্মবেদনার কথা লিখেছেন এভাবে–
কথাগুলো জ্বলে
ভীষণ জ্বালায় তুষের আগুন মতো
কী নির্বিচারে পোড়ায় বুকের বিতান
মনপোড়া গন্ধ চিরটাকাল বহন করে বুকের নদী।
‘দীর্ঘশ্বাসের বই’ কবিতায় লিখেছেন–
পৃথিবীর বুকে বুকে প্রেমের শিশির
এবং সবুজ যৌবন জলে তৃষ্ণার পরিতৃপ্তি।
পরের অংশে আছে–
“বৃক্ষের মৌনতা এঁকে ছায়ার একাকীত্বের কাছে রাখলেই
তোমার নিঃসঙ্গ মনের নকশা ফোটে”
এভাবে ব্যক্ত করেছেন কোটি প্রাণের কথা।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে বই পুস্তক প্রকাশন থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১৫০/ একশত টাকা। বইটি বাংলাবাজারসহ রকমারীতে সারা দেশে পাওয়া যাবে। আশা করি নবীন প্রবীণ সবাই বইটি পড়ে তৃপ্তি পাবেন।