সেঁজুতি জাহান জিনাত
‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ কেন উপন্যাসের নাম হলো?
আমি বলব, এ এক এমন পৃথিবীর দলিল, যাতে লেখা আছে ঐতিহাসিক নিপীড়নের কথকতা। আছে ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি বিষয়ক অখণ্ড দার্শনিক প্রশ্নসমূহ। প্রথম অধ্যায়ে হাসানের স্বপ্নের সূত্রে লেখক খোদ ঈশ্বরকে চমৎকার একটি মৌলিক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন- ‘একাই যদি ছিলে তবে আরও অসংখ্য একা এবং একাকিত্ব বানালে কেন!’ মানুষ শেষপর্যন্ত একা। যৌথতার অভিনয় শিখে একটি কৃত্রিম ও আরোপনমূলক সমাজে বসবাস করে। বদ্ধ থাকে সমাজব্যবস্থার নানা বিধিনিষেধের কারাগারে। কৃত্রিম অভ্যাসগুলো আয়ত্তে এলে সফলতা তার, অসফল মানুষ নিজের একাকিত্ব টের পায়, টের পায় ঈশ্বরের তাবত ষড়যন্ত্র!
মানুষের একাকিত্ব নিয়ে হাসানের চিন্তায় এমন মৌলিক দর্শনাক্রান্ত প্রশ্ন হাজির হওয়া মানেই, ব্যাপারটা নিয়ে হাসান বা লেখক মজিদ মাহমুদ অনেক ভেবেছেন। বা অন্য অনেক ভাবনার ভিতরে মৌলিক এই ভাবনাটি সবসময়ই ছিল, হয়তো। সম্রাট অশোক আর ঔরঙ্গজেবের সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে ভাইদের হত্যা করে একার রাজত্ব কায়েমের ব্যাপারগুলো এসেছে সাড়ে সাতশ’ কোটি শুক্রাণুভ্রাতার সঙ্গে সংগ্রাম করে একটি ভ্রণের টিকে থাকার প্রক্রিয়ার একধরনের বৈধতা থেকে। পৃথিবীর বুকে মানুষকে তো সেই একাই টিকতে হয়। প্রজন্ম রক্ষার জন্য মাঝে মাঝে যৌথতার প্রয়োজন হয়, বা যদি বলি মানুষ যৌথ হওয়ার ভান করে সমাজ-কানুনের খপ্পরে পড়ে, সেটাও অসত্য নয়। মানবসমাজসৃষ্ট এই যৌথতায় আবার আছে নানা ট্যাবুর প্রকোপ। যৌথতা হবে আবার ঈশ্বরের সম্মত পন্থায়। কিন্তু ঈশ্বর তো সর্বজ্ঞ, দুর্জ্ঞেয় কতিপয় মানুষের মূর্খ দৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রেই সেই সর্বজ্ঞকে ছাপিয়ে গিয়ে অবিচার কায়েম করে ফেলে।
হাসানের গ্রামের ইয়াসিন, বিলুর স্মৃতি উজ্জ্বল আকলিমা বা মলিনারা যার উদাহরণ। হাসানের কিশোরী দেহোপজীবিনীর প্রতি সন্তানতুল্য স্নেহ পুলিশের চোখে ধরা পড়ে না, ফলে হাসান একজন তথাকথিত নষ্ট মানুষ হিসেবে ধরা পড়ে যায় এবং জেলের নোংরা পরিবেশ হজম করে। হজম করে কথা বলার মতো মৌলিক অধিকারও। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও তথাকথিত ভুল বুঝার পদ্ধতি এই সমাজে ঈশ্বরের ধারণার মতো প্রতিষ্ঠিত। একজন দেহোপজীবিনীর সঙ্গে স্নেহময় অবস্থানও করা যাবে না, অদৃশ্য শাস্ত্রে তা নিষেধ আছে। অদৃশ্য শাস্ত্রের এই ভাষা-ভঙ্গি আমাদের এই পরম আরাধ্য সমাজেরই দান। সর্বজ্ঞ দেখছেন, তবু নিজের ব্যাপারে সত্যটা বলার অধিকার হারিয়েছে মানুষ। না, সব মানুষ নয়, একটি কালেকটিভ কনসাসনেসের ভিতরে থাকা অজ্ঞতানির্ভর সমাজব্যবস্থায় পিষ্ট মানুষ। এই মূর্খ সমাজব্যবস্থার মধ্যে আবার এক নারীবাদী লেখিকা চেয়ে বসেছেন এক দূরবর্তী অধিকার, জরায়ুর স্বাধীনতা।
লেখক বলছেন : ‘যেখানে বাক-স্বাধীনতা নেই- সেখানে জরায়ুর স্বাধীনতা কীভাবে থাকে!’
সত্যি তাই। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন কথা বলার ন্যূনতম স্বাধীনতা। বাক-যোগাযোগ। কিন্তু তা কে আর আমাদের দেয়! যেকোনো আধিপত্যবাদী সমাজব্যবস্থা তাদের শব্দ-সম্ভার আরোপ করে দেয় একদম লেজার-বর্ডারের মতো। পাশ ঘেঁষলেই যেন মৃত্যু বা মৃত্যুময় জীবন অনিবার্য।
ইয়াসিনকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। সে নিজের পক্ষের সত্যটা বলতে পারেনি। আরোপিত ভাষা-ব্যবস্থায় সে পিষ্ট হয়েছে প্রতিনিয়ত। অসম্মানের দায় কারও ওপর চাপানোর ভাষা তার জানা ছিল না, বা জানা থাকলে চাইলেও পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে তা চাপানোও যায় না- এটা ইয়াসিনের জন্য যেমন সত্য, সত্য হাসানের জন্যও। নিজেকে যেন আর নিজে সম্মান করতে পারে না। মানুষকে ধীরে ধীরে ভারসাম্যহীন করে ফেলে এই আরোপিত ভাষা-ব্যবস্থা। হাসানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। রিয়া আর তাকে বিশ্বাস করছে না। মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তরণের মূল হাতিয়ার হলো তার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেওয়া। এই ভাঙনে কেউ কেউ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে ইয়াসিনের মতো আত্মহত্যা করে, কেউ কেউ হাসানের মতো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়।
এখন কথা হলো, আধিপত্য বিস্তরণ কে করে? মজিদ মাহমুদ এ প্রসঙ্গে শত শত বাক্য লিখেছেন এই উপন্যাসে। আধিপত্য কায়েমের জন্য ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন মানুষ। মানুষের শত কোটি ভ্রণকে হত্যার পর একটি থেকে জন্ম নেয় মানুষ। শত কোটি মানুষের ভিতর থেকে আধিপত্য বিস্তার করে গুটি কতক মানুষ। এই মানুষগুলোই তাদের আধিপত্য জারি রাখতে গিয়ে বায়োলজিক্যালি বা বাক্যাবলি দিয়ে খুন করে সমাজের বা রাষ্ট্রের আর সব সাধারণ মানুষকে। গোটা উপন্যাসে এই ব্যাপার একটি রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে। যে প্রকল্পকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা একজন জাত ঔপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব। মজিদ মাহমুদ যেমন একজন জাত কবি, তেমনি তিনি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তার জাত চিনিয়ে দিলেন।
হাসানের ভিতর যেমন একজন ইয়াসিন ছিল, হাসানের বান্ধবী বিড়াল-নয়না বিলুর মধ্যেও তেমনি একজন দাদি ছিলেন। চরিত্র দুটির নানামাত্রিক ভাবনায় ইয়াসিন ও দাদি চরিত্রগুলো এসেছে। দুজনই এই চরিত্র দুটিকে ঘিরে জীবনের ব্যাপারে মৌলিক সব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে কখনো চলে গেছে নিজেদের এবং কখনো পৃথিবীর নানা সময় পরিক্রমায়। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকা-সহ সমসাময়িক হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা সংযোজন করেছেন একেবারেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রসঙ্গের দাবিতে। এখানে লেখকের বৌদ্ধিক সত্তা যথেষ্ট রাজনৈতিক বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছে।
বিলুর ভেতরে যে নারী সচেতনতা, তথাকথিত সংরক্ষণবাদিতার অনবদ্য মেলবন্ধন দেখা যায়, তার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে যেন দাদি-বিলুর কথোপকথন। দাদির সঙ্গে নারীজীবনের সব শেয়ার করা যায়। ধর্ষণের যে চমৎকার ব্যাখ্যা দাদি বা দাদির মাধ্যমে মজিদ মাহমুদ দিয়েছেন, তা অসামান্য।
দাদি বলছেন : ‘সাপের বিষথলির মতো পুরুষের মাথায় বিষথলি থাকে, বিষথলি পূর্ণ হয়ে গেলে সেটি খালি না করা পর্যন্ত সাপ পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, কোনো মানুষ দেখলে সাপের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মানুষের শরীরে বিষদাঁতের ফাঁক দিয়ে তা ফেলে দিতে চেষ্টা করে। পুরুষ মানুষও ঠিক একই রকমÑ একা অপরিচিত মেয়েমানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে, অসতর্ক মুহূর্তে তার শরীরে বিষদাঁত ঢুকিয়ে বিষ ফেলে দিতে চেষ্টা করে।
মনে রাখিস, কখনও অচেনা পুরুষ মানুষের সামনে একা এক ঘোরাঘুরি করবি না। তবে চেনা মানুষরাও এ কাজ করতে পারে।’ দাদি বিলুকে শরীর ঢেকেঢুকে বের হতে পরামর্শ দিতেন। বিলু তা মানত না, কিন্তু মনের কোথায় যেন এ ব্যাপারে এক শক্তিশালী সায় থাকত।
বিলুর প্রতি দাদির পরামর্শমালা মূলত বাঙালি নারীজন্মের আদর্শশিক্ষা। মুরুব্বিদের এই সব পরামর্শ থাকে বাঙালি প্রায় প্রতিটি নারীজন্মের ঘরে। সত্যতা ধরা পড়ে বিলুর রাবীন্দ্রিক সম্পাদকের ডিকটেশনের ক্লাসে। কোকের মধ্যে এক পেগ জিন মিশিয়ে দিয়ে বিলুকে ভোগ করতে চাওয়া সম্পাদকের দুরভিসন্ধিতে বাধ সাধল বিলুর ‘জ্বীনে ধরা’ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। জিন খেয়ে বিলু জ্বীনে ধরাদের মতো ফেইন্ট হয়ে যায়। একজন রবীন্দ্রপ্রেমী সম্পাদকের পক্ষে এ সময়ে তথাকথিত পশুবৃত্তি করা সম্ভব নয়, তাতে খোদ রবীন্দ্রনাথই যেন কলঙ্কিত হবেন!
লেখক সুকৌশলে একশ্রেণির ধর্ষককে চিনিয়ে দিলেন, যারা একই সঙ্গে রবীন্দ্রপ্রেমী এবং অশ্লীল মাত্রার ভোগবাদী। এরা ‘ধর্মে আছে জিরাফেও আছে’ টাইপের। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণির কাছে ধর্মাবতার প্রতীম। রবীন্দ্রনাথের কোমল স্বরকে এদের অনেকে ব্যবহার করে কামশর রূপে। জিন খাওয়া ‘জ্বীনে ধরা’ নারীকে ভোগ করায় নীচতা আছে, কিন্তু কৌশলে সিচুয়েশন ক্রিয়েট করাতে যেন কোনো কালিমা নেই!
বিলুর মাধ্যমে আমরা নারীবাদের নানা দিক টের পাই। বিলু সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান। কিন্তু সমাজ তার ওপর সেই আধিপত্যবাদী ভাষাকেই আরোপ করে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধতে চায়। সম্পাদক কিছুতেই টের পান না বিলু কেমন টাইপের মেয়ে। সমাজ আরোপিত ভাষায় বিলু আসলে কোন ক্যাটাগরির? অর্থাৎ, ক্যারিয়ারের জন্য চরিত্র বিসর্জন দেওয়া বা না দেওয়াÑ কোন টাইপের?
লেখক বলছেন : ‘কিন্তু বিলুকে কোনো জাতের মধ্যেই ফেলতে পারেননি তিনি।’ বিলু সংরক্ষণবাদী আবার ক্যারিয়ারসচেতন আবার কর্মনিষ্ঠও। কিন্তু, তথাকথিত রাবীন্দ্রিক সম্পাদক থেকে শুরুকরে আকলিমা বা মলিনার ধর্ষক পর্যন্ত সকল সাপগ্রস্ত পুরুষের কাছে নারী মাত্রই সুড়ঙ্গ-সর্বস্ব চরাচর। হাসান আর বিলু চরিত্র দুটির মাধ্যমে লেখক সমসাময়িক গুম, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, ক্ষমতা সংরক্ষণ ও পরিচালন পদ্ধতির সংবাদগুলোর পাশাপাশি কোলাজের সাহায্যে কখনো কালেকটিভ কনশাসনেসের ফোকাস, কখনো ঐতিহাসিক নিপীড়ননামা, কখনো দেশি-বিদেশি ঘটনার তুলনামূলক ভাবদৃষ্টি তুলে ধরেছেন।
ঘটনাপ্রবাহের বিচরণ বেশ বিস্তৃত কিন্তু সবই যেন একটি কাঁঠালের অসংখ্য রোয়ার মতো নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে বিন্যস্ত।
লেখক এক অদ্ভুত ফর্মুলায় নির্ধারিত চরিত্রের মাধ্যমে চলে গেছেন ইতিহাসে, চলে গেছেন পুরাণে, চলে গেছেন সর্বকালের আলোচিত ঘটনাপ্রবাহে। চেতনাপ্রবাহরীতি এক্ষেত্রে লেখকের বাহন হয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নতারা’ গল্পের ‘আমু’র মতো যেন উপন্যাস জুড়ে হাসান আর বিলুর বিচরণ। তারা ভাবছে, কিন্তু তারা আদতে ভাবাচ্ছে পাঠককে। এ এক অভিনব পাঠ-যাত্রা, পাঠক এখানে যেন দিকহারা পথিক।
এসব কী ভাবছে হাসান? কোথায়ইবা যাচ্ছে? সিনেমা কলাতে থ্রিডির মাধ্যমে যে পর্দা দেখার একটা ব্যবস্থা চালু আছে, যেখানে দর্শক নিজেই যেন নিজের উপস্থিতি টের পান, ঠিক সেই কৌশলটিই এখানে কাজ করেছে। অর্থাৎ পাঠক নিজেই যেন উপন্যাসের ভিতরে অবস্থান করেন।
উপন্যাসের চারটি অধ্যায়। চারটি ভিন্ন শিরোনামে সংযোজিত। শিরোনামের ধরন দেখে ‘পথের পাঁচালী’র অধ্যায়গুলোর কথা মনে পড়ে। ‘পথের পাঁচালী’তে যেমন বল্লালী বালাই (পরিচ্ছেদ ১-৬; ইন্দির ঠাকরুণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে), আম-আঁটির ভেঁপু (পরিচ্ছেদ ৭-২৯; অপু-দুর্গার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, চঞ্চল শৈশব, দুর্গার মৃত্যু, অপুর সপরিবারে কাশীযাত্রা চিত্রিত হয়েছে) এবং অক্রূর সংবাদ (পরিচ্ছেদ ৩০-৩৫; অপুদের কাশীজীবন, হরিহরের মৃত্যু, সর্বজয়ার কাজের জন্য কাশীত্যাগ এবং পরিশেষে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে), তেমনি ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ ভাগ ভাগ করে উপন্যাস ও হাসানের পরিণতি বিধৃত হয়েছে এভাবেÑ
প্রথম অধ্যায় : ইয়াসিন মেমোরিয়াল ক্লাব (‘দশচক্রে ভগবান ভূতে’র পাল্লায় পড়া আত্মহত্যাকারী ইয়াসিনের স্মৃতিবিজড়িত ক্লাবটি ৭১-এর পরে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতীকী এই ঘটনার আবডালে বা বাস্তবতায় একইভাবে হাসানের জীবনের ঘটনাপ্রবাহ ধাবিত হয়)।
দ্বিতীয় অধ্যায় : বেথেলহেমের পথে পথে (সন্তান জন্মের প্রক্রিয়ায় অবৈধতার যাবতীয় দায় নারীর, দায়িত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন পুরুষের বৈধ পরিচয়। বেথেলহেমের পথেই যেন জীবনের প্রকৃত মুক্তি। আকলিমার পিতৃপরিচয়হীন সন্তানটি ঈশ্বরের বলে সে দাবি করেছিল। পিতৃপরিচয়হীন হয়েও মা মেরি ঈশ্বরের সন্তানের মা হতে পারেন, কিন্তু আকলিমা কাজের মেয়ে হওয়াতে তার সন্তান আর ঈশ্বরের হয় না)।
তৃতীয় অধ্যায় : ছয়কুলার রাত (এক মাস দশ দিন হাজত বাসের পর হাসানের পূর্ববৎ স্বপ্ন-ঘোরে ডুব দেওয়া। মর্জিনা, আব্দুল কাদের, ফতেবিবি, আবদুল খালেকের মতো অতীত চরিত্রগুলো ঘিরে থাকে অনাহারী হাসানের মগজকে। আছে হাসানের ভাগ্যগণনার ফলাফল। উত্তরাধুনিক শিক্ষিত জীবন সচেতন সাংবাদিক হাসানের ভাগ্য গণনা করে ফতে বিবি যা বলেছিলেন তার থেকে হাসান যেন কিছুতেই বেরোতে পারেনি। এই ভবিষ্যদ্বাণী কি হাসানের অবচেতনে ঢুকে থেকে তাকে সর্বদাই প্রভাবিত করেছে, নাকি আসলেই ফতে বিবি কোনো তথাকথিত ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন নারী)?
চতুর্থ অধ্যায় : শৃঙ্খল-গণ (মর্জিনার ভিতরে রিয়া, রিয়ার ভিতরে মর্জিনাকে গুলিয়ে ফেলা বিধ্বস্ত হাসান : মনের অবস্থা চরম খারাপ। মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। ফারিয়ার সঙ্গে হাসানের ছাড়াছাড়ি। বিলুর সঙ্গে হাসপাতালসূত্রে নতুন এক সম্পর্কের দিকে ইতিবাচক অগ্রসরতা)।
প্রথম অধ্যায়ের পরে তৃতীয় অধ্যায়ে পৌঁছাতে অর্থাৎ একমাস দশ দিন পার করতে লেখক অত্যন্ত সুকৌশলে পাঠককে বিলুর ঘটনাবলি পাঠে মনোযোগী করান। এটা খুবই নান্দনিক প্রক্রিয়া। বিলুকে পাঠ করতে করতে পাঠক যেন হাসানকে একমাস দশদিনের জেলযাপন করতে দিয়ে আসে!
পৃথিবীর প্রায় সব লেভেলের অনাচার, নোংরা এবং প্রতিষ্ঠিত চিন্তা যেন এই ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’-এ ধরা আছে। ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’-এর চেতনাপ্রবাহরীতিতে এসেছে স্বপ্ন ও ঘোর, এসেছে দেশি-বিদেশি নানা অনুষঙ্গ ও পরিচর্যা। আফ্রিকান ইয়াম থেকে শুরু করে খেজুরের রস পাড়ার দৃশ্য- সব ধরা পড়ে একজন হাসানের ঘোরগ্রস্ত মগজে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা শহীদুল জহিরের মতো অতিপ্রাকৃত পরিচর্যা দেখি পুরো উপন্যাসে।
‘মেমোরিয়াল ক্লাব’-এ আসলে একটি আধিপত্যবাদী ভাষা-ব্যবস্থার চাপে একজন সুস্থ মানুষের মধ্যে কেমন করে বিকার বিস্তৃত হয়, তারই প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাই। একটি ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ আসলে ইয়াসিন মেমোরিয়াল ক্লাব নয়, এটি প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস থেকে ইতিহাসে ঘুরে বেড়ানো ভাগ্যবঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের স্মৃতি-সমৃদ্ধ ক্লাব। এখানে আপনি আপনার স্মৃতিময় ভাবনাগুলোকেও দেখতে পারেন থ্রিডি পদ্ধতিতে।
এই উপন্যাসের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও সুখপাঠ্য। আমি মনে করি একজন প্রকৃত কবিই সরল ও প্রাঞ্জল গদ্যে কথা বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে মজিদ মাহমুদ তার স্বাক্ষরটি স্পষ্ট করতে পেরেছেন। সর্বোপরি, একজন ‘মাহফুজামঙ্গলের’ নিরীহ কবি কেমন করে, কবে এরকম একখানা মারদাঙ্গা উপন্যাস ফেঁদে বসে আছেন- সেই বিস্ময় জাগে মনে!
কবি ও মারদাঙ্গা ঔপন্যাসিক মজিদ মাহমুদের জন্য অনেক শুভকামনা।
……
সেঁজুতি জাহান জিনাত : কবি ও শিক্ষক