টুটুল রহমান
সরকারি দলের সাথে অ্যালায়েন্স হবার পর থেকে মধ্যবয়সী কমরেড সৈয়দ সমর একটু অস্বস্তিতে আছেন। একটু অসুখীও বটে। অ্যালায়েন্স হওয়ার আগে রোলিং পার্টির মুখপত্র বললেন, দ্যাখেন নির্বাচন কমিশন বিশ্বস্থতার সাথে কাজ করবে। আমরা পাওয়ারে আছি। সুতরাং ক্ষমতায় আবারও আমরা। তিনি এও বললেন, আপনাদের তো কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। কোনো মিটিংয়ে চেয়ারপূর্ণ হয় না। তবুও আমাদের দলের প্রধান আপনাদের গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি চান আপনাদের পাতে কিছু পড়ুক।
কমরেড সমর এই কথাগুলো হজম করার লোক নয়। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। সমাজতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে লড়াই করছেন ৩০ বছর। পরিবার ছেড়েছেন। সংসার হয়নি। ভালো ছাত্র ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও সরকারি চাকরিতে গেলেন না। ছাত্র পড়িয়ে পেট চালাতেন। কেউ চাকরির কথা উঠলে বলতেন, চাকরি করলে পার্টির কাজ কে করবে? প্রেম-বিয়ে ভাবনার মধ্যে ছিল না। বলতেন, ‘আগে চাই সমাজতন্ত্র। তারপর অন্য কিছু।’
বাবার সাথে এসব নিয়ে দ্বন্দ্বে ঘর ছেড়েছিলেন। মায়ের কান্না কান্না মুখ আজো জ্বলজ্বল করছে।
লোকটি আবার বলতে লাগলেন, একজন ফুল মিনিস্টার পাবেন আপনারা। তিনজন এমপি। তবে শর্ত আছে। নির্বাচন করতে হবে আমাদের প্রতীকে। মানে বুঝছেন আমাদের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়বেন।
কমরেড সৈয়দ সমর দলের সেক্রেটারী। তিনি এসব অপমানজনক কথাবার্তার একটা জবাব তৈরি করছিলেন মনে মনে। তার ইচ্ছে মুখের মধ্যে থুথু ছিটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন। উপায় নেই। সরকারি দল ডেকেছে। আরো ছোটখাটো অনেক দলের সাথে গত কয়েকদিন হলো মিটিং চলছে। অ্যালায়েন্সের ব্যাপারে সব দল মত দিয়েছে। দু‘একটি দল মন্ত্রীত্ব আর এমপি ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে।
কলপ না দেয়া পাকা চুলের বিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট ঘাড় কাত করে শর্তগুলো মেনে নিচ্ছিলেন দেখে কমরেড সমরের শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছিল। প্রেসার কন্ট্রোল করতে পারছিলেন না। এসি রুমে বসেও তিনি মিটিংয়ের মধ্যে ঘামছিলেন।
৪০ বছর পার্টিকে সময় দিয়ে লোকটা এমন নির্লজ্জ বেহায়ার মতো বুর্জোয়া একটা পার্টির সাথে স্বানন্দে অ্যালায়েন্স করতে এসেছে।
অ্যালায়েন্স মিটিং শেষ করে বেরিয়ে প্রেসিডেন্টের একটা ভাঙ্গাচোরা গাড়িতে চেপে বসতে বসতে কমরেড সমর বললেন, দেখেন যাদের বিরুদ্ধে সারাটাজীবন আন্দোলন করলেন, ‘ফ্যাসিবাদী বলে গালমন্দ দিলেন তাদের সাথেই আমদুধে মিশে যাওয়াটা কি ঠিক হলো? পার্টির তো বদনাম হয়ে যাবে।’
প্রেসিডেন্ট তেমন কিছু বললেন না। তিনি শুধু ইঙ্গিত করলেন, ‘নির্দেশ কোথা থেকে এসেছে আপনি বুঝতে পারছেন না? শেষে ওরাও যদি দৃষ্টি সরিয়ে নেয় পলিটিক্স করবেন কিভাবে? মানে ডোনারের কথা বলছি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাওয়া বুঝছেন না? নিজেদের আগে টিকিয়ে রাখুন সমাজতন্ত্রের কথা পড়ে ভাবা যাবে।’
কমরেড সমর আর তর্ক বাড়ালেন না। পার্টিকে দূর থেকে কারা নাচায় সেটা তো তিনিও জানেন। কতবার তিনি বিদেশী প্রভু মুক্ত হয়ে একটা বাংলাদেশী খাঁটি সমাজতন্ত্রী দল গঠন করতে চেয়েছেন। কিন্তু হয়নি। এদিকে চীনপন্থী বামেরা তো মন্ত্রী সভায় শপথ নেয়ার জন্য তড়পাচ্ছে। তারাও একজন ফুল মিনিস্টার পাবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
পার্টির সেক্রেটারী হিসেবে তিনি এমপি হতে পারতেন। হলেন না। সেটা কার দোষ। প্রেসিডেন্ট তো ফুল মিনিস্টার হয়ে পাজেরো গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মিনিস্ট্রিও পেয়েছেন দামি। দলের দুজন প্রেসিডিয়াম মেম্বর এখন এমপি। দুটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি। অথচ কমরেড সমর কিছুই নিলেন না। তাকে পার্টির বন্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ফের বের করার দায়িত্ব দেয়া হলো। বললেন, সরকারের তরফ থেকে মাসোয়ারা দেয়া হবে। বিনাশুল্কে কাগজ পাওয়া যাবে। ছাপানোর টাকাও দেবেন মাসে মাসে। কিন্তু কমরেড সমর ভাবলেন, সেখানে কি লেখা হবে? তিনি কি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারবেন? তিনি কি দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া হয়ে পড়েছে, গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে, মানুষ উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে–এসব নিয়ে জোড়ালো কিছু লিখতে পারবেন? কারা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালন করছে। এসব কি লিখতে পারবেন? পারবেন না। তাদের টাকায় কি তারা এসব ছাপতে দেবে। তিনি পত্রিকার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন না।
দেখতে দেখতে অফিসটাও বেশ বড়সর হয়ে গেলো। পায়া খসে যাওয়া চেয়ারটেবিলগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না নতুন অফিসে। পার্টির প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারীর জন্য আলাদা আলাদা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ হলো। অফিসে প্রতিদিনই লোকের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। জেলা কমিটি তো বটেই উপজেলা কমিটি গঠনের তদবির আসতে লাগলো। অস্থির করে তুলছে সবাই। উপজেলাতেও এখন পার্টির মিটিংয়ে শত শত লোক হয়। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করে পার্টিকে চাঁদা দেন। বলেন, ‘একটু খেয়াল রাখবেন। আপনারা তো সরকারের সঙ্গে আছেন।’ কমরেড সমর ভাবেন, পুরো দেশেই এখন সমাজতন্ত্রী আর বিপ্লবীতে ভরে গেছে।
ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারী ঘনঘন বিদেশ ট্যুর পেতে লাগলেন। তাদের ভালো চাকরিও নেয়ার কথা বলা হলো। তারা রাজি হলেন না। বললেন, এলজিডিআরে উন্নয়নের জোয়ারের অনেক কাজ হচ্ছে। আমাদের কিছু দিন। চাকরিতে আর কত আসে। সমাজতন্ত্রের জন্য রাজপথ কাঁপিয়ে তোলা এইসব ছেলেগুলো এখন টাকা কামানোর ধান্ধায় নেমে পড়েছে। কমরেড সমর আরো অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলেন। এখন তো বেশির ভাগ তদবির আসে তার কাছে। পার্টির প্রেসিডেন্ট মন্ত্রী হওয়ার পর তার কাছে যাওয়া মুশকিল। সেক্রেটারীকে ধরে সবাই। ভাই আপনার কি মন্ত্রীর চেয়ে কম পাওয়ার? ‘পাওয়ার’ শব্দটা নব্যসমাজতন্ত্রীদের মুখে শুনে তার শরীর ঘিনঘিন করে। পাওয়ার খাটিয়ে সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট করে ভাড়া দেয়ার প্রস্তাব নিয়েও কয়েকজন এসেছিলেন। কমরেড সমর শরীরে-মনে অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলেন।
২.
ক্রমাগত তিনি একই স্বপ্নই দেখে যাচ্ছেন। স্ত্রীকে গলা টিপে মারছেন। পুত্রকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। অথচ তিনি তো বিয়ে করেননি। সন্তান হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তিনি কেন এই স্বপ্ন দেখছেন তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করাতে পারছে না। অবশ্য অনেকেই বলছেন, দেখুন আপনার বয়স মাত্র ফিফটি ক্রস করেছে। সরকারি দলের অনেকেই তো সত্তরেও কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আপনিও তো এখন রুলিং পার্টির অংশ। করে ফেলুন বিয়ে। সরকারি প্লট পাবেন তো নিশ্চিত। তাতে দশ তলা উঠে যেতে বেশি সময় লাগবে না। কতটা নিশ্চিত জীবন আপনি বুঝতে পারছেন? কমরেড সমর কিছু বলেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।
শুধু তাই নয়, স্বপ্নে তার বাবাও তাকে জ্বালিয়ে মারছে। প্রায়ই স্বপ্নে বলছে, ‘দেখলি তো খোকা সমাজতন্ত্র হলো না। জীবনটা নষ্ট করলি। দেশের শাসন ব্যবস্থা পাল্টাবি বলে ঘর ছাড়লি। একটা পাড়া মহল্লা পাল্টাতে পারলি না। পার্টির লোকও তো ভেতরে ভেতরে কেউ পাল্টায় নি।’
স্বপ্নেই বলুক আর জাগরণেই বলুক বাবা তো আর মিথ্যে কিছু বলছে না। কোনো কিছু তো পাল্টালো না। এতো কার্লমার্ক্স, লেলিন, মাও সেতুং পড়ে ফল কি হলো? মোটামোটা বই পড়ে, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে। যৌবন খুঁইয়ে কি পাওয়া গেলো। আর কি বা পাবেন। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে।
আরো স্বপ্নে দেখেন বায়তুল মোকাররমে খাঁটিয়ার ওপর তিনি সাদা কাপড়ে মোড়ানো। অথচ তিনি তো মরণোত্তর দেহদান করেছেন। এইসব বিপরীতমুখী স্বপ্নদৃশ্য তাকে ব্যাকুল আর অসুস্থ করে তুলছে। আজকাল পথ হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খান। এরি মধ্যে দুবার চশমা পথচারীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েছে। চশমা ছাড়া পৃথিবীটা খুব ঝাপসা।
ঘুমের এসব আজগুবি স্বপ্নের মধ্যে যতটা সময় জেগে থাকেন কমরেড সমর সমাজতন্ত্রের স্বপ্নই দেখেন।
কমরেড সমর পার্টি থেকে পদত্যাগ করলেন একদিন। বেরিয়ে পড়লেন। জ্বলজ্বলে দুপুরে দাবিদাওয়ার লিফলেট ছাপানোর জন্য তিনি পুরো ফকিরাপুল, নীলক্ষেত ছুটে বেড়াচ্ছেন। কোনো প্রেস রাজি হয় না। একটি প্রেস ছাপলো। কিন্তু ছাপার পর দেখা গেলো লিফলেট পুরোটাই সাদা। অক্ষরগুলো খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। রাগে টনটনে মেজাজ নিয়ে তিনি খসে পড়া অক্ষরগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে লিফলেটে বসানোর চেষ্টা করছেন। খাঁ খাঁ রোদে তার গালশুকিয়ে যাচ্ছে তার। তিনি হাঁটছেন। নীলক্ষেত থেকে প্রেসক্লাব। পল্টন থেকে ফকিরাপুল। মতিঝিল থেকে মুগদা, টিটি পাড়া। সব খানে তিনি হাঁটছেন। অক্ষর খসে পড়া লিফলেট তিনি মানুষের হাতে দিচ্ছেন। শহরের মানুষগুলো অক্ষরবিহীন লিফলেটগুলো টিস্যু ভেবে পরিশ্রমের ঘাম মুছছেন। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে পরম ক্লান্ত কমরেড সৈয়দ সমর ঘুমের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলেন।