তাজ ইসলাম
ছেড়ে যাই সদানন্দপুর। বলেছেন কবি ছেড়ে যাচ্ছেন তিনি সদানন্দপুর। সদানন্দপুর কি? হয়তো কবির গ্রাম। গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আপন কর্মস্থলে। এমনতো বহুজনের জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা। আধুনিক জীবনের অংশ। গ্রাম থেকে, নিজের শহর থেকে ভিন্ন জায়গায় কর্মস্থান বহুজনের।
ছুটিতে, সুযোগে , প্রয়োজনে বাড়ি যান। আবার চলে আসেন। হয়তো ছেড়ে আসার চিত্রায়ন করতেই কবি বলেছেন ” ছেড়ে যাই সদানন্দপুর”।
অথবা এই নামে কোন গ্রামই নাই। তাহলে এ কোন সদানন্দপুর?
পুর অর্থ গৃহ, ভবন, আলয়, নিকেতন, বাড়ি; নগর, শহর।
সদা অর্থ সবসময়।
আনন্দতো বুঝেনই।
তাহলে বলা যেতে পারে কবি প্রতি মুহূর্তে আনন্দে থাকতেন। আনন্দিত ছিলেন সবসময়। সুখ ও সুখি ছিলেন। জীবন এখন সেখানে সে অবস্থায় নেই। তিনি সদা আনন্দবাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন। এই চলে যাওয়া ঐচ্ছিক না, বাধ্যতামূলক! সময় ও পরিস্থিতির অনুগত হয়ে তিনি যাচ্ছেন। যাবার সময় বন্ধু,স্বজন, পরিচিতজনদের জানিয়ে যাচ্ছেন। গতজীবনের আনন্দবাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। মূলত তিনি যাননি। আনন্দ, সুখ, সৌভাগ্য তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। এমন বিষাদ জীবনে নানা ছলে হামলা হতে পারে। অর্থের অনটনের বেশে। চাকুরি বিচ্যুতিতে। স্বজন বিয়োগে। শারীরিক সুস্থতা চলে গিয়ে। জীবনে তখন বাহ্যিক চাকচিক্যের ভিতরেও দৌরাত্ম দেখায় দুঃখ, হতাশা। লোকেরা বলে না, চেপে রাখে। কবিরা বলেন। কবি সত্য বলে ফেলেন শব্দের যাদুতে। মুজতাহিদ ফারুকী কবি, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক। শব্দ তার পকেট ভর্তি। ইচ্ছে হলেই সাজিয়ে ফেলেন বাক্য। গল্পের জমিদারকে চাকর সাজিয়ে দিত হুঁকো। মুজতাহিদ ফারুকীকে কলম সাজিয়ে দেয় বাক্য। কোন দুঃখে ছেড়ে যাচ্ছেন সদা আনন্দপুর তা জানা যাবে কবিতার ভিতরে একটা চক্কর দিলে। আমরা আপাতত তার শিরোনামেই ঘুরঘুর করছি। ঘুরে বুঝলাম কোন এক দায়বদ্ধতায় পড়ে কবি ছেড়ে যাচ্ছেন সদানন্দপুর।
অথবা কবির বক্তব্য অন্য কিছু।
পৃথিবী রঙিন জায়গা। জীবনে দুঃখ, দারিদ্র্য, হতাশা, বঞ্চনা, না পাওয়ার বেদনাকাল সাঁতরিয়ে মানুষ যাপন করে জীবনের রঙিন মুহূর্ত। জীবনের দুঃখ ঢেউ অতিক্রম করেই জীবনকে ভোগ করে। স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা প্রেম দিয়ে রাঙিয়ে নেয় আপন জীবন।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এক সময় এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়। যেতে হবেই। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বুঝতে পারে আমি যাচ্ছি। যেতে হবেই। সবাই যায়, সবাই যাবে। কেউ বলে, কেউ বলে না। কবি বলেন। যাওয়ার আগেই বলে দেয় ” আমি যাচ্ছি”। আমি যাচ্ছি বলা কষ্টকর। কষ্টকর কথাকে সহজে বলে ফেলা সহজ নয়। কবি সহজেই বলে ফেলেন। প্রবীণ বৃক্ষ বুঝে কোন এক কালবৈশাখে পতন হবে তার। শান্ত পরিবেশে বেদনা মিশ্রিত কণ্ঠে ঝড়ো হাওয়ার আগেই ঝরাপাতা, মরা ডালের সংকেত দিয়ে বলে যায় “আমি যাচ্ছি”।
মুজতাহিদ ফারুকী বয়সের হিসাবে প্রবীণ বৃক্ষ দেখেছেন। হয়তো তাকিয়েছেন নিজের দিকেও। কমে গেছে চোখের দৃষ্টি শক্তি। বাহু বলও আগের মতো সক্রিয় না। পদযুগল হয়তো প্রকাশ করে নিজের অক্ষমতা। বয়স হলে মানুষ কী ভাবে পৃথিবীতে থাকার সময় কমে আসছে! ভাববেইতো। কবিও হয়তো ভাবছেন একদিন ছেড়ে যাব তোমাদের এই পৃথিবী। তাই আগেভাগেই বলে দিলেন
” ছেড়ে যাই সদানন্দপুর। “
কবি তার কবিতায় যা বলতে ছেয়েছেন প্রথমেই পাঠক হুবহু বুঝে ফেলেছেন। এটি হল কবিতার সহজিয়া সুর।
কবি যা বুঝাতে চেয়েছেন পাঠক তা উদ্ধার করতে না পেরে ভিন্ন অর্থ করেছেন। এভাবে কবিতা কবির বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে বাঁক নিয়েছে পাঠক অর্থে। বহুজনের বহুমতে। এটি কবিতার বৈশিষ্ট্য। কবিতা তখন ধারণ করে বহুমাত্রিক রূপ।
কবির বক্তব্যের তোয়াক্কা না করে পাঠক বুঝে নেন যার যার মতো করে । কবিতা তখন হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
পাঠক হিসেবে যে অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে হয়তো কবি তার একটিও উদ্দেশ্য করেননি। লুকিয়ে রয়েছে অন্য আরেকটি অর্থ। সর্বজনে বহু অর্থ ধারণ করার সক্ষমতাই একটি সফল ও সার্থক কবিতা। কবি কবিতা লিখবেন। তার কোন দায় আছে বলে মনে করি না যে তিনি তার কবিতার অর্থ বলে বেড়াবেন জনে জনে। পাঠকেরও দায় নেই কবির কাছ থেকে জেনে নিবে অর্থ। পাঠক কবিতা পাঠ করবে। অর্থ করবে নিজের মতো করে । বড়জোর পঙক্তিকে ব্যাখ্যা করবে কবিতার অনুবর্তী হয়ে। আমরা কবিতার ভিতর বাহির পর্যবেক্ষণ করিনি। করব। আগে উদ্ধারে নেমে গেছি ” ছেড়ে যাই সদানন্দপুর” কোন সদানন্দপুর তা জানতে। একদিন জেনে যাব সত্যি সত্যি সদানন্দপুর কোথায়? কেন ছেড়ে যাচ্ছেন? তার আগে কবির প্রতি বিনয়ী চাওয়া– থাকুন সদানন্দে, সদালাপে সদা মশগুল সদা সর্বত্র।
ভাষানদী জ্যান্ত মুখে মুখে… / তার জন্য রেখেছি সাজিয়ে/ খনিজঋদ্ধ জল স্ফটিক স্বচ্ছ সাদা গ্লাসে/(ভাষানদী)”। এটি বইয়ের প্রথম কবিতা। এর আগে আমরা করেছিলাম এক লাইনের তাফসির। তাহলে এখন দাবী রাখে পূর্ণাঙ্গ একটি কবিতার তাফসির। একটি সফল কবিতার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা জটিল। কবিতার শরীরে গাঁথেন কবি শব্দের সুঁইয়ে নানা রকম চিত্রকল্প,উপমা,উৎপ্রেক্ষা। ভাবের গভীরতা, কবিতার বহুমুখী যাত্রা তো আছেই। তবু একটা কবিতা পাঠ করি। কবিতার নাম ” খুব কাছে সন্ধ্যা স্টেশন”। কবিতা যদি হয় নকশিকাঁথা তাহলে থাকবে সুঁইয়ে শত ফোঁড়। কবিতায় প্রবেশের আগে আমরা শিরোনামে দেখি।
” খুব কাছে সন্ধ্যা স্টেশন”।
সহজে সামনে যাওয়া আর হল না। শুধু যদি বলা হত ” খুব কাছে স্টেশন”। তাহলে গোজামিল দিয়ে একটা অর্থ খাড়া করা যেত। কোথাও যাওয়ার স্টেশন। বাস,কিংবা ট্রেন স্টেশন। এই যে সন্ধ্যা যোগ হল। এটিইতো কবিতা। এখন প্রশ্ন জাগে সন্ধ্যা কি? সন্ধ্যা কি কোন নাম? নাকি সময়? স্টেশনটি সন্ধ্যা নামক জায়গায়? নাকি অন্যকিছু। সন্ধ্যা মানে জীবন? জীবনের পড়ন্ত বেলা? থাক। আমরা কবিতায় যাই।
“গোধূলিটা মায়া রঙে আঁকা, দ্রুত মুছে যায়/ ছায়া মঞ্চে পর্দা পড়ে, দপ করে আলো নেভে/ফিরে যেতে যেতে কেউ জিভে চাখে ট্রাজেডির রস/( ঐ ) “
একজন সাধারণ পাঠক হয়তো গড়গড় করে পাঠ করে চলে যাবে। কিন্তু শিল্প রসিক-পাঠক– ভাববে। কবি তার কবিতায় সে ভাবনা রোপন করেছেন। তিনি পাঠ করবেন ,
“গোধূলিটা মায়া রঙে আঁকা”
আর ভাববেন এই মায়াটা কী? মায়ার রঙই বা কেমন? “ছায়া মঞ্চে পর্দা পড়ে, দপ করে আলো নেভে/” এখান থেকেও তার ভাবনাকে সরাতে পারবে না।
” ফিরে যেতে যেতে কেউ জিভে চাখে ট্রাজেডির রস/(ঐ) “
ট্রাজেডির রস? অবাক কথা। এই যে, রহস্যময়তা,অলংকার,রূপকের ছড়াছড়ি। তা কবিতাকে টেনে নেয় ভাবনার মোহময় জগতে।
পাঠক অর্থ উদ্ধারে পাঠের গতি থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়। চিন্তার জগতে সূ্ত্র খোঁজে কবিতা অর্থের। কবিতা ছোটে নিজের মতো। এক রূপ হাজির হয় বহু রূপে।
ট্রাজেডির রস কি কেউ কখনও চেখে দেখেছে? কেউ কি জানে তা– অম্ল না মধুর? কবি চেনা শব্দকে এই যে অচেনা অর্থে পরিণত করেন এটা তার দক্ষতা। বিশ্লেষকের ভাষায় তা কখনও চিত্রকল্প, কখনও রূপক। কখনও তা হয় শুধু অনুভবের বিষয়। মুজতাহিদ ফারুকী কবিতাকে নিয়ে যান এমন পর্যায়ে। তার একটি কবিতা আলোচনা বা বিশ্লেষণ করা দুরূহ, দুর্বোধ্য না হলেও ব্যাখ্যার বিস্তৃতি কলেবরকে বৃদ্ধি করতে থাকে।
কখনও কখনও একটি লাইনেই ভাবনারা থাকে তন্ময় হয়ে। তার কবিতায় এমন তন্ময়তা বিশিষ্ট লাইন আছে বইয়ের পাতায় পাতায়। কবিতার ছত্রে ছত্রে।
যেমন আমরা যখন আলোচ্য কবিতাখানা পাঠ করতে করতে অবলোকন করি পঙক্তিময় চিত্রকল্প।
” দেউরিতে রাঙা বউ, ঘোলা জলে ঝুপঝাপ নেংটা পোলাপান,” তখন পরিচিত হয়ে আসি আবহমান বাংলার দেউরি শব্দের সাথে। সেই কবে নজরুলের গানে শুনেছিলাম
” দেহেরও দেউরিতে” তারপর আর সেভাবে শোনা হয়নি, দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া। নিবিষ্ট নিবিড় চিত্তে মগ্ন হই তার পঙক্তি ” আদিগন্ত বিছানো আজান” এ।
আজান অর্থ আহবান, ডাক। আদিগন্ত বিস্তৃত মহান স্রষ্টার দিকে ফিরে আসার ডাক।
জগতময় ছড়ানো তার নামের মাহাত্ম্য।
পৃথিবীব্যাপি তার সৃষ্টির সৌন্দর্য।
এতো গেল শাব্দিক অর্থের মোড়ক উন্মোচনের পর অর্থের বাঁকের কথা। রূপকে গেলে শব্দ হাজির হয় রহস্যময় হয়ে। রহস্য ভেদ করে পৌঁছতে হয়, পৌঁছা যায় বিচিত্র অর্থে। বিছানা তো শান্তি– স্নিগ্ধতার প্রতিক।
মহান স্রষ্টার নাম আদিগন্ত বিস্তৃত। তার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজমান বিশ্বময়। যে নামে জড়ানো আছে রহমতের পরশ। আজান শ্রেষ্ঠত্বের কথা, মহত্বের কথা,আহবানের অর্থ প্রকাশ করে।
“আদিগন্ত বিছানো আজান” তিন শব্দের ক্ষুদ্র একটি বাক্য আমাকে ভাবায়। আমাকে ডাকে। আমি মোহাবিষ্ট হই। আমরা কবিতার পূর্ণ ব্যাখ্যা থেকে নিবৃত হই। কলেবর কলকলিয়ে বেড়ে যাবে। চলে যাই অন্য কবিতায়।
‘স্বপ্নভোজ’, ‘ খঞ্জনিতে পাগলা তাল’ , ‘রেডিও টকের বিষয়’ , এমন কিছু কবিতা আছে সাদামাটা,গতানুগতিক। তবে মানহীন বা নিম্নমানের না। অকবিতা তার বইয়ে নাই। এগুলো অযত্নে কিংবা স্বভাবসুলভ লেখা। এই তুলনা অন্য কবির সাথের তুলনা না। এই তুলনা তার এই বইয়ের অন্য একটি ভালো কবিতার সাথে। মুজতাহিদ ফারুকীর হাতের ছোঁওয়ায় এগুলোও কবিতা হয়ে উঠেছে। অন্য অনেকের রুচিতে হয়তো এগুলোও মনে হবে চমৎকার। সবার রুচি তো একরকম না। আমার রুচি
” ভোর থেকে মন চায় রাত” উত্তম বলে সায় দেয়নি। কেন দেয়নি? “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকাই” মনে হয়। শুরু যখন করি
” রাত মানে অন্ধকার! কে বলেছে?/” কবিতা আর টানেনি। না টানলেও ” সৌরভের নিবিড় আশ্রয়/ নিবেদিত প্রেমিকের নিগূঢ় শিকড়”।/ শেষ করেছি।
প্রত্যাশিত মনে হয়নি। প্রত্যাশার আধিক্যও এই মানসিকতার জন্য দায়ী। ছোট কবিতাই তো, তাই ভালো না লাগলেও পড়ে ফেলেছি। তার চেয়ে ভালো লাগে শুরুতেই, ” যখন রাতগুলো প্রজাপতি ছিল” কিংবা ” বসন্ত চলে গেলে, আমাদের কারও চোখে/ বিসমিল্লার সানাই বাজেনি”
আমাকে ঘোরগ্রস্ত করে, তন্ময়াবিষ্ট হই। আমার মন ছন্দিত,স্পন্দিত হয় ” সবটুকু জল গিলে ফেরাউন জলের ডাকাত” কবিতা যাত্রা। আমাকে কী মুখপোড়া বলবেন? বলেন।
উপমহাদেশের মুসলমানের অন্দর মহলে পরিচিত ছিল এন্তেজার, তকদির, খুশবুদার, শা- নজর–শব্দ। জবানে ছিল কাতর কলম, হেকিমি হালুয়া, রুহের মাগফেরাত, নোক্তাদার আলিফ, আয়াতে মুতাশাবি, হকিকত। একটি দেশ পরাধীন হলে সে জাতি শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা হারায় না। জবানের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন হয়। ভাষার ঘাড়েও চেপে বসে দখলদারের ভাষা দৈত্য। পলাশীর ট্রাজেডি কিংবা পলাশী প্রহসনের পর এদেশের রাষ্ট্রভাষা বা সরকারের দাপ্তরিক ভাষার চেয়ারে বসে দখলদারদের ভাষা। মুসলমানদের জবান থেকে পর্যায়ক্রমে হারাতে থাকে আরবী, উর্দু, ফারসী ভাষার শব্দ সমূহ।
মুজতাহিদ ফারুকী কবি। ইতিহাস সচেতন কবি। সাংস্কৃতিক যোদ্ধারাই পারেন অতীতকে ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে। কবিতার শরীরে তিনি সেঁটে দেন সেসব শব্দ। ভাষানদে পালতোলা নৌকার মতো ভাসতে থাকে কবিতা চরণ। বিভিন্ন কবিতা থেকে তেমন উজ্জ্বল কিছু কবিতা পঙক্তি উল্লেখ করলাম। যেসব পঙক্তিতে প্রয়োগ করা হয়েছে আরবী,ফার্সী,উর্দু শব্দ।
“আপনার কুদরতি আঙুলের জীয়ন্ত মাখলুক।”
“চুর চুর হব ঐশী এশক মহব্বতে”
“আজনবি বুক জ্বলে”
“মন তুলে দেরাজে রেখেছো।”
“তুমিও তো মারেফতি হরফের অন্তহীন পাতা”
“মজে আছে আজনবি গজলের গ্লাসে “।
শব্দের প্রয়োগ, ছন্দের তাল, ভাবের দ্যোতনায় মন চনমন করে যখন পাঠ করা হয় :
“মজে আছে আজনবি গজলের গ্লাসে “। অথবা–
“তুমিও তো মারেফতি হরফের অন্তহীন পাতা”। নিঃসন্দে উপমার মিশ্রণে মহত্তম দার্শনিক প্রকাশ।
” মাজায় বেমক্কা চোট পেয়ে ইন্না লিল্লা বলে হাত – পা ছেড়ে দেন জয়িফ জেঠুরা।/ আন্ধাগুন্ধা লাফিয়ে পড়ে কজন দুঃসাহসী।/( সুরলোকের যাত্রীরা)।” কিংবা “হামাক লিয়ে চল/ নল্লি ফাড়কে কান্দি যুদি দোহে/ নাও ভাসা পানি ভরবি না?( সমব্যথী)।”
অতীত থেকে বর্তমান , ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের সেতু স্থাপন সম পঙক্তিগুলো মুজতাহিদ ফারুকীর উল্লেখযোগ্য কাজ বলে স্বীকৃত হবে।
তিনি যদিও বলেন, ” মহৎ উপন্যাস, মহাকাব্য এখনও লিখিনি,” কিন্তু পাঠক যখন পাঠ করে,
“টকটকে রঙ ছাড়ে দোতারার ফুর্তিবাজ তারে” কিংবা ” নদীও জীবিত সত্তা বলেনি কি বিজ্ঞ আদালত” বোঝা যায় তিনি বিনয়ী বৃক্ষ। মহৎ লেখেন কিন্ত বলেন না।
“যে যুবক বিনাযুদ্ধে পিঠ দেখিয়েছে/ কে তাকে দেবে ইলোরার নিভৃতি?” কবির প্রজ্ঞা এখানেই। পুরো একটি কবিতা না, একটি লাইনেই লুকিয়ে রাখেন একাধিক পৃষ্ঠার ব্যাখ্যা।
মুজতাহিদ ফারুকী সরল শব্দে সহজ বাক্যে কবিতায় রোপন করেন জীবন দর্শনের কথা। বাস্তবতার কথা । সে কথা হৃদয়ে আঘাত হানে কঠিন কঠোরভাবে। তাকে আমরা বলতে পারি ভাবের নীরব ঘাতক।
” বুকে হাত, বলে যাই, আর ফিরব না।” কবিতায় আর মন দেবার সময় কই? এক লাইনেই জীবনদর্শন,এখানেই তিক্ত সত্য,রূঢ় বাস্তবতা,এখানেই কবিতার ডুব সাঁতার।
” মাঝে মধ্যে জিহ্বাও সুপুরুষ হয়/ ভোট ছাড়া এমপি,পিএম,জনপ্রতিনিধি।/( চরদেশের দিন)।” অনুচ্চ আওয়াজে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ সবাই পারেন না। মুজতাহিদ ফারুকীর মতো প্রজ্ঞাবানদের পক্ষেই সম্ভব। এবং নিজের পরিচয় কিংবা আত্মতৃপ্তির কথা বুঝতেও তার সংক্ষিপ্ত বয়ানই যথেষ্ট।
” মানুষ তো ভেঙে যায়, আমি যাই… তুমি/ নির্মাণের ইতিবৃত্ত জমা থাকে ভাঙনের অভঙ্গুর খামে।( ভেঙে ভেঙে যাই)।” আত্মতৃপ্তির কথা বলছিলাম।” ইরি নয়, ভালো লাগে, এ মাটির খাঁটি বিন্নি ধান”/( ভালো লাগে খাঁটি বিন্নি ধান)।”
হাইব্রিড না প্রকৃত তার পছন্দ। প্রকৃতিতে মিশে যাওয়া তার বাসনা। শহরে থাকেন। গ্রাম ভুলেননি। মানুষ মা ও মাতৃভূমিকে ভুলতে পারে না। সমগ্র স্বদেশই মাতৃভূমি। এটি নাগরিক সূত্র। নাগরিকের নাড়ীপোঁতা থাকে গ্রামে। কবি আধুনিক নগরে বাস করেও বারবার ফিরে যান মা ও মাতৃবসতিতে। মায়ের ভিটায়,মায়ের কবরের কাছে। যাবার সময় দাওয়াত দিয়ে যান শহরবাসী বন্ধুকে। দাওয়াত দেন মায়ের মুখনিঃসৃত শব্দে ।
আঞ্চলিক শব্দে অনেকেই কবিতা লিখেন। সেসব কবিতার অধিকাংশ অতিক্রম করতে পারেনি আঞ্চলিকতার দেয়াল। মুজতাহিদ ফারুকী আঞ্চলিকতার উচ্চারণে নির্মাণ করেন আধুনিকতার স্মারক। আঞ্চলিকতার প্রলেপে নির্মিত হয় অনন্য আধুনিক একটি কবিতা।
কবি তার বন্ধুকে প্রলুব্ধ করেন নিজস্ব ঢঙ্গে ” জেফত দিলাম বন্ধু আমার” যাবে? গেলে কি খাওয়াবে তার বর্ণনার ছলে বলেন ” দেশি মুরগার গুশ্ আছে আর আনসি মাশকলাই”। আমরা যেতে প্রস্তুত। কবি মুজতাহিদ ফারুকীর জেফত কবুল। তিনি সদানন্দপুর ছেড়ে যেতে চাইলেও আমরা তাকে যেতে দেব না। সদানন্দপুরের পাঠক বারবার মনে করবে কবিকে। মনে রাখবে কবিকে।
একটা চিকন কথা বলা হয়নি। ১৯৫৯ এ জন্ম তার। বয়সে প্রৌঢ়। ৬৫ বছরে প্রবীণের মনে খেলা করে বয়স ১৮ র রোমান্টিকতা। কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলেন,
” যতই তোমাকে দেখি টিশার্ট লেহেঙ্গা ফেড জিন্সে,/….( আমি কিন্তু) শাড়িতে তোমাকে চাই/ “
ও মেয়ে বাঁচতে চাইলে একটা কিছু ধরো।
” আইস ক্যাপ বুকে করে গ্রহ বাঁচে, মানুষ বাঁচে না/ কী নিয়ে বাঁচবে গো মেয়ে? আগুন চেনো না তুমি, রসায়ন পড়োনি ইন্টারে! “
কবিতার নাম খুঁজে নিবেন।
……..
অনশ্বর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান : বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশ হয়েছে কবিতার বই ” ছেড়ে যাই সদানন্দপুর “ মুজতাহিদ ফারকী : কবি,সাংবাদিক,কলামিস্ট, কথাশিল্পী। চারু পিন্টু এঁকে দিয়েছেন প্রচ্ছদ। ৩০০ টাকা বিক্রয় মূল্য। আপনি কিনলেই একটি কপি ফুরিয়ে যাবে। ভালো বই রিপ্রিন্টের জন্য বই কিনুন।