কবিতা ভাবনা
খুব ব্যক্তিগত হাহাকার আর শূন্যতার ভেতর দাঁড়িয়ে কবিতা ছাড়া আমার আর কোনো অস্ত্র নেই। বিবেকের দহন, সভ্যতার রক্তাক্ত প্রচ্ছায়া আমাকে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করে দেয়। মানুষের কাছে সতত যে প্রার্থনা তা ভালো পৃথিবী সৃষ্টির জন্য। কিন্তু তা কি সম্ভব? মানুষ যে বিশ্বাস ভঙ্গের ভেতর এক তাড়নায় আমাকে নিপতিত করে।
তবু একান্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভেতর নিজের অবস্থানটির অন্বেষণ চলতে থাকে। মায়াময় এক জগতের আত্মপরিধির বিস্তার এভাবেই। ক্রিয়া, বিশেষণ, সাধু-চলিত রীতির সব পথেই জীবনের এই স্বপ্নচারী প্রলাপ। কবিতা যেন বাঁচারই প্রতিধ্বনি। প্রেমের পাশে দুঃখকে রাখা, অথবা হাহাকারের পাশে স্বপ্নকে। আত্মনিবেদনে দেশ আর মনুষ্যত্বযাপনের ভাষা এইসব কবিতায়।
………
মধ্যরাতের বালক
আমাদের ঘুমের বারান্দায় চুপি চুপি চাঁদ নেমে এসেছিল
আমি মধ্যরাতের বালক
স্বপ্নে জ্যোৎস্নার সঙ্গে লুকোচুরি খেলি
চাঁদ জানে কীরকম অসফল আমি
তবু খোলা জানালায় আমার বিলাসি রাত চেয়ে থাকে
নক্ষত্রদের পাড়ার ঝিকিমিকি গান ম্লান হয়ে যায়
অলৌকিক অদৃশ্য ডানায় আমি উড়ে উড়ে ফিরি
ইতিহাসের হিরণ্য পাতা থেকে উঠে আসে মায়াবিনী
তাকে রোজ ছুঁয়ে আসি স্বপ্নের জ্যোৎস্নায়…
কালকেতুর সংসার
কালকেতু ফিরে আসে রাতে
সারাদিন মাঠে বনে তাহার শিকার
মাটির কলসির জলে হৃদয় জুড়ায়
গ্রীষ্মকাল দাহ আনে, আনে পোড়া ছাই
তবু নাচ , তবুও উঠোন ভরা ঘর
অপরিমেয় জীবন সংসার
নাচের উঠোন আর এতটুকু ঘর
এখানেই বসতি কালকেতু ফুল্লরার
প্রতিদিন মেঘ নামে, চাঁদ নামে
পাখির কাকলি হাওয়া ঝড়
হাঁস-মুরগির ঝাঁক কলকোলাহল
ভেজা শাড়ি শুকিয়ে নেয়
দড়ি বাঁধা আলনায় ওড়ে পৎ পৎ…
সহবৎ
অনন্ত পরিধির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে
আত্মদ্রোহের বাজনা
বিরামহীন বৃক্ষমূলে তবু মাটির নিঃশ্বাস
কার্যত আমারই সমূহ সহিষ্ণু সংগ্রাম
তীব্র বাঁচাব় ধ্বনি
নিয়ত বিশ্বাসের অভ্যাসে জাগরুক বন্দনায় শিখি সহবৎ ।
স্বাতন্ত্র্য
নৌকা কোথায় ডুবে গেল ?
তীরে আমি অপেক্ষায় আছি
তুমি তো সাঁতার জানো
ফিরে আসবে একদিন , আসবেই জানি !
তোমার স্বাতন্ত্র্য বুঝি , স্বাধীনতা বুঝি
যুগস্রোত তোমাকে কি ভাসাতে পারে ?
নীল জল হেসে ওঠে আর সমস্ত বিস্মিত আবেগী জলে
তোমার হাসির ঢেউ সমুদ্রময় কলরোল তোলে !
অসময়
ঘুরে দাঁড়াচ্ছি যদিও
নিজেকে বোঝাবার উপমা নেই আর
চারপাশে ঘোর কোলাহল
দম আটকে যাচ্ছে প্রায়শ
দুইপায়ে জড়িয়ে আছে লতা
মাথার উপর ভাঙা মেঘ
পাখিরা উড়ে যাচ্ছে অন্যকোনও বসন্তের দিকে.…
উৎস
চিকন হংস পালকের মতো ঢেউ
তোমার শরীরে থেমে আছে
জ্যোৎস্নার রঙে সাজানো বাগান
পুষ্পদল ফুটছে কোনো অদৃশ্য সৌরভে
সুবচন এসে তোমাকে লিখুক আজ
আমাদের সব উল্লাস তোমার নিকটে এসে থামে
সব আলোর উৎসে তোমাকে পাই
যেদিকেই হাওয়া বয়ে যাক
বসন্ত তোমারই নিকটে
কূজন গুঞ্জনে চলে আনন্দ উৎসব ।
অবিরাম
অবিরাম ট্রেনে আলোরা হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে
আমরা আদিম পৃথিবীর গুহায় ফিরে আসছি
অন্ধকারের ভাঙা ভাঙা পথে
আমাদের বিপন্ন দিন
ম্রিয়মাণ অস্তিত্ব ছড়িয়ে দিচ্ছে
কাঁদতেও পারছি না আর
অবিরাম ট্রেন চলে যাচ্ছে
অবিরাম হাসির ফোয়ারায় ভেসে যাচ্ছে গান
আমাদের নিশুতি দুঃখের ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে চাঁদ।
জল প্রার্থনা
এখনো তার কলসির জল
উৎসুক হয়ে উঠি পানে —
জল দাও , জল দাও কুমারী
দাঁড়িয়েছি স্নিগ্ধ আমবনে !
পাশে নদী গড়ে যাচ্ছে
সূর্যের সোনালি রশ্মি
পড়েছে আঁচলে
গোছা গোছা চাবিগুলি
উঠছে দুলে দুলে !
এই আমার বঙ্গদেশ ,
এই আমার জল প্রার্থনা ,
সব শস্যক্ষেত জুড়ে
আসন্ন সন্ধ্যার শাঁখে
বাজুক বন্দনা !
ডাক
তোমার বসন্তে ফুটে উঠলাম
আমি আজ কী ফুল ? কী ফুল ?
গোধূলি রঙের পাপড়ি
মেঘে মেঘে সোনালি উত্তরীয়
২৫ বৈশাখ এসে ডাক দিল !
এত সংশয় , অন্ধকারে ডুবে আছে পথ
প্রহরে প্রহরে জেগে ওঠে বিষন্ন কাক
তবু যুগ, যুগের পথিক
নিরালোকে খোঁজে সেই মুখ
তুমি ডাকো , ডেকে নাও
আমার সন্দিগ্ধ চেতনায় হে ২৫ বৈশাখ !
উদাস হইলাম
কাহার ছলাৎ ছলাৎ শুনিলাম ?
মোহনায় দাঁড়াইয়া রহিলাম
আমার পিতলের কলস ভাসিয়া গেল
শেষ রৌদ্রে আকাঙ্ক্ষা সেঁকিয়া বাড়ি ফিরিলাম
অন্ধকার আমাকে ডাকিতে লাগিল…
তৈমুর খান, জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে ।পিতার নাম—জিকির খান। শিক্ষা—বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এম এ এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি-এইচ-ডি। পেশা—উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ আটটি, উল্লেখযোগ্য হল—কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), প্রত্নচরিত (২০১১)এবং গদ্যগ্রন্থ কবির ভাঁড়ারের চাবি (২০০৬), আত্মসংগ্রহ (২০০৯), নব্বই দশকের কবি ও কবিতা (২০১০) । পুরস্কার —কবিরুল ইসলাম পুরস্কার (২০১০) ও দৌড় সাহিত্য সম্মান (২০১৫) ।
ঠিকানা—রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০