১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিল?
উত্তর: প্রথম প্রকাশিত ছোট্ট কাব্যগ্রন্থ মোট দশটি কবিতা নিয়ে ‘কোথায় পা রাখি’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে ‘দৌড়’ পত্রিকা প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
ছাত্রাবস্থা থেকে কবিতা চর্চা করলেও আমার একক কাব্যগ্রন্থ কখন প্রকাশিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ১৯৯৪ সালে তখন আমি বি-এড এর ছাত্র। ‘দৌড়’ পত্রিকার সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাসের সঙ্গে খুব বেশিদিনও পরিচয় ঘটেনি। কয়েকবার তাঁর কলকাতার বাসায় গেছি মাত্র। প্রথম তিনিই উদ্যোগ নিলেন সম্ভাবনাময় তরুণ কবিদের একক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করবেন। আমাকে চিঠি লিখে দশটি কবিতা পাঠাতে বললেন। তখন আমি মালদহ জেলায় সরকারি ট্রেনিং কলেজে পাঠরত। চিঠি পেয়েই আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এক রাতের মধ্যেই দশটা কবিতা লিখে পরেরদিনই ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। পাণ্ডুলিপি পেয়েই মধুমঙ্গল বিশ্বাস চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁদের পছন্দের কথা। কবিতার একটি পংক্তি উল্লেখ করে কাব্যের নামকরণও করেছেন কবি তীর্থঙ্কর মৈত্র। মাসখানেকের মধ্যেই কাব্যটি প্রকাশিত হলো। কয়েক কপি সরাসরি আমাকে মালদহতেই পাঠিয়ে দিলেন। পেয়ে সে কী আনন্দ! সাদা প্রচ্ছদের উপর বাদামি বর্ণে বড় বড় হরফে লেখা হয়েছে ‘কোথায় পা রাখি’ তার নিচেই আমার নাম। নতুন বইয়ের গন্ধ একটা অনাস্বাদিত শিহরণ যেন পৃথিবী জয় করার আনন্দ। সারারাত বুকের উপর বইগুলি নিয়ে ঘুমিয়ে থাকলাম। ঘুম ভাঙলে মাঝরাতেও খুলে খুলে দেখলাম। পরে বুঝেছিলাম, বই প্রকাশের আনন্দের সঙ্গে চাকরি পাওয়া বা বিয়ে করার আনন্দেরও তুলনা হয় না। এই আনন্দ সবারই ভাগ্যে জোটে না।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
উত্তর : আমি কার উত্তরাধিকার বহন করি সঠিকভাবে এ কথা বলতে পারব না। আর যদি বলতেই হয়, তাহলে বলব আমারই অন্তর্গত এক অন্তহীন বিষণ্ণতা আমাকে সর্বদা চালিত করে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। দিন-আনি দিন-খাই সংসারের মানুষ। তাই নিত্য দৈন্য পীড়িত জীবনের উত্তাপ নিয়েই বড় হতে হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য একটি আশ্রয় পেয়েছিলাম প্রাচীন সাহিত্যে। রোজ সন্ধেবেলা লন্ঠন জ্বেলে বাবা পাঠ করতেন হাতেমতাই, আলিফ-লাইলা, কসসুল আম্বিয়া, বিষাদসিন্ধু, রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি আরও বহু প্রাচীন সাহিত্য। সেগুলির মধ্যেই খুঁজে নিতাম নিজস্ব একটি জগৎ। সেসবের ধ্বনি-ঝংকার, জয়-পরাজয়, কারুণ্য-হাহাকার, যুদ্ধবিগ্রহ, ভাষাশৈলী আমার অনুভূতি ও কল্পনাশক্তিকে মুক্তি দিত। লেখার স্ফুরণ তো তখন থেকেই। তখন মালার্মে, র্যাবো, জাঁ পল সার্ত্রে, শার্ল বোধলেয়ার, স্তেফান, এজরা পাউন্ড, মারিয়া রিলকে, ব্রেশট, আলবার্ট কামু, টি এস এলিয়টের সাক্ষাৎ হয়নি। বাড়িতে কিছু বই ছিল বাবার। সে যুগে বাবা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। সেই বইগুলিতেই পেয়েছিলাম কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায়,জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে। তাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়তাম। আর পেয়েছিলাম বাবার বিয়েতে পাওয়া একটি উপহার মৌলানা কোরবান আলীর ‘মনোয়ারা’ উপন্যাস। এই ছিল আমার পুঁজি। পরবর্তীকালে অনেককেই পেয়েছি, কিন্তু কারও উত্তরাধিকার হয়ে উঠতে পারিনি। নিজেরই ক্ষরণ, নিজেরই শূন্যতা, নিজেরই বিনাশ ও বিস্ময় লিখে চলি। সেখানে প্রতিবাদও থাকে, জীবনের দীর্ঘশ্বাসও থাকে। আবার মানবতাবাদ এর কথাও ফিরে আসে। তাই কখনো জীবনানন্দ দাশ, কখনো নজরুল, কখনো এলিয়ট, কখনো র্যাবোও এসে ভর করতে পারেন। আসলে সময়েরই উত্তরাধিকারী আমি এ কথা বলাই যায়।
৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
উত্তর : এযাবৎ আমার ২৩টি কাব্যগ্রন্থ, ৯টি গদ্যগ্রন্থ, ১টি গল্প গ্রন্থ এবং ১টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আমি মূলত কবিতা লিখলেও কবিতা বিষয়ক গদ্য এবং আত্মগত গদ্য লিখে বেশি তৃপ্তি পাই। ২০০৬ সালে প্রথম গদ্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে যে বইটি প্রকাশিত হয় তা হলো ‘কবির ভাঁড়ারের চাবি’। কবিতা লিখিয়ে লোক প্রচুর, কিন্তু কবিতার যে বহুমুখী পর্যায়, বাঁক পরিবর্তনের যে অভিঘাত তাকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্যই গদ্যলেখার বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এই কারণেই আমি একের পর এক কবিতা বিষয়ক গদ্য বইগুলি লিখেছি। উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো: ‘মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা'(২০০৯), ‘কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা'(২০২০), ‘বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক ধারা'(২০২৩)। প্রথম দুটি গদ্য বইয়ের চাহিদার কারণেই দ্বিতীয় সংস্করণও হয়ে গেছে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনচেতনা, শিল্পচেতনারও যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার উল্লেখ আছে এই বইগুলিতে।
গদ্য সাহিত্যের আরেকটি বিশেষ ধারায় আমি খুব স্বচ্ছন্দবোধ করি, তা হলো একান্ত ব্যক্তিগত জীবন রসায়নকে সাহিত্যের আলোয় আলোকিত করা। আমার ব্যক্তিজীবন, আমার সংগ্রাম, নানা অভিজ্ঞতা, সমাজচেতনা, রাষ্ট্রচেতনা, ধর্মচেতনা এবং সময়চেতনাকে কেন্দ্র করে যে ক্ষরণ ও যাপন ঘটে চলেছে সেই উপলব্ধিকে তথা দর্শনকে আমি বিভিন্ন লেখায় রূপ দিয়েছি। এরকমই বিষয় কেন্দ্রিক গদ্য সাহিত্যের বইগুলি হলো ‘আত্মসংগ্রহ'(২০১০), ‘আত্মক্ষরণ'(২০১৬), ‘আত্মস্বর'(২০২১) এবং ‘এই কবিতাজীবন'(২০২৩) । এই বইগুলিতে আছে জীবনের গল্প যা বাস্তব ও সত্য; সেখানে কষ্ট ও কান্না, দীর্ঘশ্বাস ও নিপীড়ন, বঞ্চনা ও প্রতিবাদ উঠে এসেছে। আমি তো এরকমই লিখতে ভালোবাসি যা জীবন থেকে পাই।
৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘এই কবিতাজীবন’ নামে গদ্য বই এবং ‘কাহার অদৃশ্য হাতে’ নামে কাব্য সংকলন।
গদ্য বইটির বৈশিষ্ট্য হলো, আমি কেন কবিতা লিখতে এলাম, কী করে কার কাছ থেকে কবিতা লেখার প্রেরণা পেলাম, কবিতা লিখে কী পেয়েছি, কীভাবে কবিতাও জীবন সংগ্রামের ভাষা, বেঁচে থাকার আত্মধ্বনি ইত্যাদি এসবেরই এক একটি পর্যায় এবং আত্মদর্শনের অভিজ্ঞান। মোট ২৭টি পর্বে জীবনের নানা পর্যায়ে এইসব অভিজ্ঞতার কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে। ‘কাহার ওদৃশ্য হাতে’ মোট ১৭ টি কবিতা নিয়ে একটি কাব্য সংকলন। এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব কবিতাগুলিই তৎসম শব্দ প্রয়োগে বাংলা সাধু ভাষায় লেখা। সাধু ভাষায় গদ্য লেখা হলেও কবিতাও যে লেখা যায় সেই বিষয়টিরই প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন একটি কবিতার কিছু অংশ:
“নিজেকে মহামূর্খ ভাবিলাম
কোনও আন্দোলনেই সামিল হইলাম না
কোনও দলেই নাম লেখাইলাম না
অন্ধকারেই রহিয়া গেলাম
আমার ব্যক্তিত্ব ফুটিল না
পৃথিবীতে কত হাওয়া উঠিল
কত ধার্মিক হাওয়ায় ভাসিল
কত বিজ্ঞানী হাওয়ায় উড়িল
আমি মাটির ঘরে চাটাই পাতিয়া
মায়ের একখানা তেলচিটা বালিশে ঘুমাইলাম
ঈশ্বর লইয়া ভাবিলাম না
দেশ লইয়া ভাবিলাম না
মানুষের কথা কী করিয়া বলিতে হয়
জানিলাম না”
৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
উত্তর : নয় দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমি লিখতে শুরু করি, তখন আমি ছাত্র। সুতরাং নিজেকে নয় দশকের কবি হিসেবেই উল্লেখ করি, কিন্তু এটি শুধু মাত্র সময়ের হিসাব। তবে নিজেকে কোনো দশকেই সীমাবদ্ধ করতে চাই না। কবির ও কবিতার কোনো দশক হয় না, শুধু বোঝার জন্য দশকের উল্লেখ করা হয়। মানবজীবনের আবেগ আদিকাল থেকেই প্রবহমান। মূল প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটে না। শুধু প্রকাশভঙ্গি পাল্টে যায়, ভাষা পাল্টে যায়, সময় পাল্টে যায়। সব দশকের কবিরাই আবহমান সময়ের কবি। সুতরাং জয়দেব থেকে চণ্ডীদাস, ভারতচন্দ্র থেকে মধুসূদন, জীবনানন্দ থেকে আজকের তরুণ কবিটিও একই বৃত্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
উত্তর : আমার সমকাল বলতে ১৯৮৫ থেকে ২০০০ এর আগে পর্যন্ত সময়কে যদি ধরি তাহলে দেখতে পাই, এই সময় সারা পৃথিবী জুড়ে বহু কাণ্ড ঘটে গেছে। মানুষের জীবনযাপনেও পরিবর্তন ঘটেছে। সাহিত্যশিল্পেও তার ছাপ পড়েছে। এই সময় যা ঘটেছে তা দেখে মনে হয় মধ্যযুগ এখনো আছে। টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসেছে, কিন্তু আমরা পিছিয়ে গেছি আমাদের মানসিকতায়। জাত-ধর্মের রাজনীতি; শিক্ষা-দীক্ষায় অন্তঃসারশূন্য আস্ফালন; গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রহসন; ভোট কেনাবেচার রমরমা; এক থালা ভাতের জন্য যোনি পেতে থাকা নারী; নারী পাচার অথবা নারী বিক্রির রমরমা ব্যবসা; মৌলবাদী ফতোয়া; সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ; নিষিদ্ধ দল ও গোষ্ঠীর উত্থান; মধুচক্রের আসর, সেখানে স্বয়ং প্রশাসন বিভাগের লোক; সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বডিগার্ডদেরও ধর্ষকরূপে পাওয়া; প্রোমোটারদের সুচতুর দাঁতনখে রক্তাক্ত মানুষের চেহারা; হত্যাযজ্ঞে ভাড়াটে খুনিদের কর্মকাণ্ড; সেইসঙ্গে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান; ক্রিকেট উত্তেজনা; প্রায় নগ্ন ফ্যাশনের প্রভাব; কিডন্যাপিং-এর বাড়বাড়ন্ত; প্রেম নিছক প্রমোদ সঙ্গম; বিবাহে নয়, দায় এড়ানো সহবাসে, ভোগে আত্মচরিতার্থতা খোঁজা– এইসব চিত্রই যখন দেশের অভ্যন্তরে গা-সওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চলছে উথালপাথাল এক ভাঙনকালের স্বাক্ষর। বাবরি মসজিদ ভেঙে পড়েছে, তার জেরে বাংলাদেশেও ভাঙাভাঙির খেলা। সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে। পাকিস্তানে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক উত্থান। সাম্প্রদায়িকতার নির্লজ্জ ছোবলে ওড়িশার গ্রাহাম স্টেইন ও তার দুই পুত্রকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আফগানিস্তানে ভেঙেছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। বার্লিন প্রাচীর, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, একে একে ভেঙে গেছে। তার পরেই গুজরাটে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ঘটেছে বিস্ফোরণ। নব্বইয়ের পরেও এসব ঘটনা ঘটলেও তার প্রস্তুতির বীজ ছিল নব্বই দশকে। ‘একটি চাকরি দাও মা’ গান গাওয়া যুবকের দল দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত এসেছে স্কুল সার্ভিস। কিছু চাকরিও জুটেছে। ঋণ প্রকল্পে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গজিয়ে উঠেছে। বেড়েছে গ্রামের মানুষের শহরমুখী অভিযান। আবার গ্রামে গ্রামে ঢুকে গেছে নানা টিভি চ্যানেল, ভিডিও হল, সিডি-ডিভিডি কত কী। সিনেমা প্রীতি, মাধুরী-শাহরুখ প্রীতি দিন দিন বেড়ে গেছে। ঘরের ঝিও এখন নিজেকে মাধুরী ভাবতে ভালোবাসে। সর্বত্রই একটি মেকি আভিজাত্যের পালিশ। পকেটে মোবাইল, গলায় পীরের দোয়া, মা কালীর মাদুলি তাবিজ, হাতে জড়ানো গিঁটমারা লাল সুতো–একইসঙ্গে চলেছে রেনেসাঁস ও সংস্কার। কে কাকে দেখে। সবাই সমান।
এই সময়ের পরিচয় দিতে গিয়ে নব্বই দশকের কবি রুদ্র প্রতি লিখেছেন: ”আমরা যারা নয়ের দশকের শুরু করেছিলাম তারা কিন্তু কেউ প্রান্তিক চাষী, কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ কয়লাখনির শ্রমিক।নব্বই দশকের প্রথম কবিতা কলকাতা থেকে মফস্সল হয়ে গ্রামের প্রান্তে পৌঁছেছিল। সত্তর দশকের কবিতা কলকাতা থেকে মফস্সলে পৌঁছেছিল। আর নব্বই দশকের কবিতা শহর থেকে মফস্সল শহর হয়ে গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। যে জন্য নব্বইয়ের দশক উল্লেখযোগ্য।
নব্বই দশকের কবিরা শুধু অবক্ষয়ী নগ্ন আধুনিক কবিতা লেখেননি,তাঁদের প্রয়োজন হয়নি ভিটা গোল্ড এক্স কিংবা ভায়াগ্রার। তাঁরা দারিদ্র্য দেখেছে, ধানফুল দেখেছে, মাঠে মাঠে গাই-গরু চরিয়েছে, কয়লা খাদান থেকে কয়লা তুলে হাত ধুয়ে কবিতা লিখেছে— জীবনের, আনন্দের, দুঃখের। নব্বই দশকের প্রায় ৭০ শতাংশ কবি মদ্যপান থেকে বিরত থেকেছে।” (পাঠকমন: কবি সম্মেলন, জুন ২০০৫)। গ্রামের দু’বেলা ঘাস কাটা মজুরের ছেলেটিও রাজনীতির গড্ডালিকায় না গিয়ে বলে দিতে পেরেছে:
“না বাবু কামাই হলে আমিই উপোস
কী খাই কী খাই সারাদিন?…”
এই যখন অবস্থা পরিবর্তনের জোয়ার, ‘ঠাণ্ডা ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক’ তখনই নব্বই দশকের সকাল। আমরা দেখি:
বোলপুর: ৩রা আগস্ট
“ধর্ষণ ঘটেছে একটা ইঁটভাটায় কাল
এক কাপ চায়ের পাশে দোমড়ানো সকাল
তিনটে মেয়ে খুন হয়েছে,মোট তিনটে লাশ
ভাঙা বোতলের টুকরো, আধ ভাঙা গেলাস
পুলিশ কুড়িয়ে পায় ঝুপড়ির ভিতরে
পরদিন সমস্ত ফাঁকা, শুকনো পাতা ওড়ে
শুধু একটা শুকনো পাতা উড়তে উড়তে খোঁজে আজকেও কি কিছু ঘটলো খবরের কাগজে?”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর :শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
হ্যাঁ, প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটছে। আর পুলিশ লেফট রাইট করে পালাচ্ছে। পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ থেকে ধানতলা বানতলা পর্যন্ত। হাতকাটা পার্টির দাদা পর্যন্ত। আর সেই ফাঁকে চলছে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন। বর্ণ উল্লেখ করে পাত্র পাত্রীর খোঁজখবর। টেপ রেকর্ডারে বাজছে:
“মেহেন্দি লাগাকে রাখ না
ডলি সাজাকে রাখ না”
এসব ১৯৯০ এর ঝলকানি। কুশীলবেরা একেই আত্মস্থ করে বেড়ে ওঠেন, মাস্তানি করেন। আর কবিরাও পেয়ে যান ভাষা:
”আমাদের মতো করে কথা বলো উনিশশো নব্বই
বুবুনের মতো শূন্যে ছুঁড়ে দাও দুহাতের মুঠো
কাকলির মতো হেসে ভেঙে ফেলো ক্যান্টিনের গেলাস
সুমনের মতো রাগে দাঁড়িয়ে গিটার হাতে গাও”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর: শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
এই বসন্তকালে খুর-তোলা মস্তানের মতো পলাশ চমকাচ্ছে। রাজনীতির গরম হাওয়ায় দাঙ্গা, কার্ফু, বনধ, জিপের টহল। সবই চলছে। তবু—
“সবকিছু অমান্য করে উল্টোডাঙা ব্রিজে প্রেম।”
থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে এফ. আই. আর লেখা হচ্ছে। কিন্তু কাদের নামে? তাদের মুখেই শোনা যাক:
“লেখো এফ. আই. আর, লেখো আমাদের সকলের নাম
আমরাই গুলতানি মেরে ক্যান্টিনে জমিয়ে রাখতাম
লিখুন ও. সি সাহেব, স্পষ্ট করে লিখুন এস আই আমরাই ভোটের দিনে দলবেঁধে ছাপ্পা দিতে যাই কোমরে মেশিন গুঁজে গান শুনি, আশ্চর্য সময় আমাদের পাস করলে চাকরি হয় না, পার্টি করলে হয়”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর:শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
এই তো ১৯৯০ এর জিন্দাবাদ। পিনাকী ঠাকুরও একে ‘মুক্তির দশক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
নব্বই দশকের বিচিত্র কাব্য-ভাবনা প্রাচীন রীতির ছন্দকে আবার নতুন করে অনুশীলনে, শব্দ প্রয়োগের বাছ-বিচারহীন নিষ্ঠায় কবিতা-চর্চা হয়ে উঠেছে আত্মজীবনী রচনার মতো। জয় গোস্বামী যে পথ দেখিয়েছিলেন সেই পথেই অসংখ্য কবি এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, চিত্রধর্মিতায়, রহস্যে, ব্যক্তিত্বের স্বয়ংপ্রভ আলোয় উদ্দীপিত হয়েছে কবিতা। কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আমরা এখান থেকে পেয়ে যাই:
১) অস্থির ভাঙনকালের পরিমাপ—প্রেমে,স্বপ্নে, নির্মাণে, পলায়নে।
২) জীবনের আদি ও অন্তিম প্রলাপ।
৩) ঐতিহ্য ও সংস্কারের ভেতর আত্মদর্শনের প্রয়াস।
৪) পোস্টমডার্ন ভাবনায় স্বয়ংক্রিয় উদ্ধার।
৫)আত্মিক সংকট থেকে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
৬) যন্ত্রণা ও পলায়ন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো।
৭) মিশ্রবৃত্ত ও মুক্তক ছন্দকেই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া।
৮) ঘৃণা ও শ্লেষের ভেতর সনাতন ধর্ম সংস্কারে উঁকি মারা।
৭. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
উত্তর : সাম্প্রতিককালে অনেকেই ভালো লিখছেন, কবিতাকে বহুমুখী প্রজ্ঞার অভিমুখ করে তুলেছেন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: সাম্য রাইয়ান, মাহমুদ শাওন, সজল সমুদ্র, তানিম কবির, আহমেদ শামীম, সালেহীন শিপ্রা, গোলাম রসুল, অনুপম মুখোপাধ্যায়, বেবী সাউ, নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, হিন্দোল ভট্টাচার্য, ইশিতা ভাদুড়ী, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী রায়, যশোরধরা রায়চৌধুরী, নিবেদিতা আচার্য প্রমুখ। তবে সংখ্যাটি এখানেই থেমে থাকেনি, ভালোলাগার তালিকায় আরও কতগুলি নাম করা যায়: ব্রাত্য রাইসু, মজনু শাহ, মতিন রায়হান, মাতিয়ার রাফায়েল, পাঁশু প্রাপণ, পরিতোষ হালদার, তপন বাগচী, টোকন ঠাকুর, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, আমীর খসরু স্বপন, জাফর আহমেদ রাশেদ প্রমুখ।
৮. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
উত্তর : ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার উত্তরে রামপুরহাট-১ নং ব্লকের পানিসাইল গ্রামে আমার জন্ম। এখানেই থাকি। ছোট্ট একটি গ্রাম, হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেই বসবাস। প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা এবং লেখাপড়ার সূচনা। পরবর্তীতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রামপুরহাট মহাবিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষায় অনার্সসহ বি-এ পাস এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম-এ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে গবেষণা ও ২০০১ সালে এইচডি ডিগ্রী প্রাপ্তি। অংশকালীন অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করলেও ২০০৪ সাল থেকে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থায়ী সহশিক্ষক হিসেবে যোগদান। বিদ্যালয়টি মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত, বোখারা হাজী জুবেদ আলী বিদ্যাপীঠ। ২০০৫ সালে নলহাটি ব্লকের অন্তর্গত বসন্ত গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিণয়। সাবিনা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম এ। ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে কন্যা তিয়াসি খান এবং পুত্র শ্রেয়ান খানের জন্ম।
৯. আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
উত্তর : না, আমি বাংলাদেশে কখনো আসিনি। সেরকম কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তবে যতদূর জানি শস্য-শ্যামলা জল-জঙ্গলের দেশ বাংলাদেশ। আবহাওয়া আর্দ্রতার কারণে মানুষেরা বেশিরভাগই আবেগপ্রবণ, বাংলাভাষাপ্রেমী। প্রাকৃতিক মুগ্ধতার মধ্যেই তাদের জীবন সংগ্রাম চলতে থাকে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘাত, বহুমত বহুপথের দিশারী তারা, তবুও তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঐক্যসুর শোনা যায়।
১০. বাংলাদেশের সাহিত্য পড়েন? আপনার প্রিয় বা পছন্দের বাংলাদশী সাহিত্যিক কে-কে বা কারা? কেন?
উত্তর : বাংলাদেশের সাহিত্য পড়তেই হয়, আমার মনে হয় না পড়লে সম্পূর্ণতা আসে না। একটা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটা দেশের জন্ম। আর সেই ভাষা যখন আমারও মাতৃভাষা, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা অন্তরের তাগিদ অনুভব করি। কোথায় যেন হৃদয়ের আদান-প্রদান ঘটে। বাংলাদেশের কবি-লেখকরা সাহিত্যের নতুন নতুন বাঁকের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, আত্মদান আমাদের ভারতের থেকে অনেক বেশি গৌরবের। আমার পছন্দের কবি-সাহিত্যিক বহু আছেন: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, আবুল হোসেন, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ। এঁরা কোনো না কোনো দিক দিয়েই বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী প্রতিভা। দেশ, জাতি, ইতিহাস,প্রেম, স্বাধীনতা, চিরন্তন মানবিকতা, ভাষা, প্রকরণ ইত্যাদি সবকিছুতেই এঁদের লেখার মধ্যে এক মেধাবী উত্তরণ খুঁজে পাই। বাংলা সাহিত্য কত সমৃদ্ধ, কত জীবনদর্শী, কত নিরীক্ষাপ্রবণ এবং বিতর্কিত তা এঁদের দেখে বোঝা যায় । আমার মনে হয় এঁদেরকে বাদ রেখে বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ।
১১. বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের মিল ও তফাত — কোথায়? কী-কী?
উত্তর : বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টির উৎস মূলত বাঙালির আবেগ, বাঙালির মনন, রুচি ও জীবন দর্শন। তাই যে বাঙালির জন্ম বাংলাদেশ, সেই বাঙালি পশ্চিমবঙ্গেরও বাসিন্দা হতে পারেন। আবার যে বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের, তিনিও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। সুতরাং জাতীয় আবেগের সঙ্গে সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়টিও জড়িত। বাংলার মা, রূপসী বাংলা, নদ-নদী, পাখির ডাক, সূর্যকিরণ, ঘাসের শিশির, শস্য-শ্যামলা সবুজ মাঠ, রাখাল বালক, মেঠো সুর, নৌকা-মাঝি সাহিত্যে বারবার ফিরে আসে। উভয় বঙ্গের কবিরাই এর বর্ণনা দিয়েছেন। নজরুল যখন মা-কে নিয়ে লিখছেন:
“আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা-র;
মার বড়ো কেউ নাই –
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!”
তখন যেন এর পরের অংশটি জসীমউদ্দীনের ‘মা ও খোকন’ কবিতাতেই পাই:
“মা যে তখন খোকারে তার বুকের মাঝে ধরে,
বলে আমার সোনা মানিক!লক্ষ্মী মানিক!
ঘুমো দেখি আমার বুকের ঘরে।
খোকা বলে,মাগো আমার সোনা মানিক।
সকল শ্রানি-তোমার কোলের পরে।”
কথাসাহিত্যে প্রেম-প্রণয়ের কাহিনির মধ্যেও যথেষ্টই মিল আছে। জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রহস্য, ঐতিহাসিক কাহিনি, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশপ্রেম নিয়ে লেখা আখ্যানগুলিতেও জাতীয় আবেগের মিল পাওয়া যায়।
তফাতের ক্ষেত্রে অনেকটাই দেখার বিষয়। ভারতীয় জনজীবন বৈচিত্র্যময়। শুধু বাঙালিই নয়, বহু অবাঙালি সংস্কৃতিরই সমন্বয় ঘটে চলে এখানকার জীবনযাপনে। মেট্রো সিটি অথবা কর্পোরেট জগতেরও ছায়া পড়ে সাহিত্যে। তবে স্থির জলাশয়ের মতোই তা বৃহৎ হলেও প্রবাহহীন। তাই নতুন বাঁক এখানকার সাহিত্যে খুব কম জন্ম নেয়। বাংলা ভাষার প্রতি দরদ থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষার প্রতি কোনো সমীহ দেখা যায় না। বাংলাদেশ সেই দিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে। সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। মানুষের মর্মের মাটির ঘ্রাণে উজ্জীবিত হয় সাহিত্য। গৌরবান্বিত বাংলা ভাষার ইতিহাস যেমন প্রেরণা দেয়, তেমনি বহু সংঘাতময় জীবন সংগ্রামও সাহিত্যকে আলোকিত করে। ধর্মবাদ এবং ধর্ম বিরোধীবাদেরও জন্ম হয়। ভারতে এই পরিসর কম। সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম।
১২. এই দুই দেশের সাহিত্যিক মেলবন্ধন উন্নয়নে কোন-কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর : দুই দেশের সাহিত্যকেই দুইদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া পত্রপত্রিকায় আলাপ-আলোচনা, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যিকদের সম্মান জানানোর ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। পত্র-পত্রিকার বিশেষ বিশেষ সংখ্যায় দুই দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন করতে হবে। সহজে যাতে বইপত্র আদান-প্রদান করা যায় সেই ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
১৩. আপনি কখনো কি কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
উত্তর : ‘কাঞ্চিদেশ’ এবং ‘অনুভূতির ডানা’ দুটি পত্রিকাই সম্পাদনা করেছি। দুটিই লিটল ম্যাগাজিন। তবে কোনো সংকলন সম্পাদনা করিনি। কয়েকটি বিশেষ বিশেষ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছি। লেখকদের পরামর্শ দিয়েছি কোন বিষয়গুলি রাখা উপযুক্ত হবে। তবে পত্রিকার সম্পাদনার কাজটি খুব শক্ত। অনেক কঠিন হতে হয়। লেখার মান বিচার করতে গিয়ে লেখকের মুখ মনে রাখলে হয় না।
১৪. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কী? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
উত্তর : লিটল ম্যাগাজিন একটা দুঃসাহসের নাম। প্রচলিত শিল্প-সাহিত্যের বিপরীতে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন কিছু সম্ভাবনাময় সৃষ্টিকে প্রকাশ করার মাধ্যমই লিটল ম্যাগাজিন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প, সমাজ সংস্কারের ভাবনা, রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসনের সমালোচনা, নানা অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করা এবং নতুন সৃষ্টিকে ধারণ করাই একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য। কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা ব্যক্তি অনিয়মিতভাবে তা প্রকাশ করে থাকেন। লাভজনক কোনো ব্যবসার জন্য নয়। কারণ লিটল ম্যাগাজিনের বাণিজ্যিক কোনো অভিমুখ থাকে না। ব্যতিক্রমী সৃষ্টিটাই তার মূল উদ্দেশ্য। সাহিত্যকে নতুন পথে চালনা করার, বা সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের জন্য লিটল ম্যাগাজিনের দরকার হয়। তবে বর্তমানে এই উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। এর কারণ দুটি— লিটল ম্যাগাজিনকে বাণিজ্যমুখীকরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা এবং বাণিজ্যিক কাগজের লেখক তথা কর্পোরেট জগতের লেখকদের লেখা প্রকাশ করে জাতে ওঠার চেষ্টা। এই দুটি কাজই লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রকে পথভ্রষ্ট করে দিচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিনের যা আদর্শ, ব্যতিক্রমী চেতনা, সৃজন বিষয় নিয়ে কম্প্রোমাইজ না করে বিচক্ষণতার ভাবনা তা খুব কমই চোখে পড়ছে। হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড সম্পাদনায় প্রকাশিত বিশ শতকের প্রথম দিকের লিটল ম্যাগাজিন Poetry: A Magazine of Verse (Chicago 1912) এবং প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে বাঁক পরিবর্তনের যে দুঃসাহস দেখিয়েছিল তা আজকের দিনে বিরল।
১৫. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর : বর্তমান ব্যস্ততার যুগে কাগজ-কলমের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে, তার বদলে বেড়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল এর ব্যবহার। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই এখন মোবাইল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধারের সঙ্গে অনলাইন পিডিএফ পাঠেও ছাত্র-ছাত্রীর আগ্রহ বেড়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইন ম্যাগাজিন প্রকাশ হয়ে চলেছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পাঠকের কাছে তা পৌঁছানোর খুব উপযোগী একটা মাধ্যম। পাঠের পর প্রতিক্রিয়া জানানোর পরিসরও যথেষ্ট। সুতরাং এর পজিটিভ দিকটিই আমার কাছে বেশি বলে মনে করি। যখন ইচ্ছা তখনই পড়া যায় আবার বহন করাও যায় যেটা ম্যাগাজিন বা বইয়ের পক্ষে সম্ভব নয়।
১৬. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
উত্তর : আমরা যে সাহিত্যের কথা ভাবছি অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নতুন বাঁকের কথা চিন্তা করছি, তাতে আমরা জীবনকে বাদ দিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারব না। বিভিন্ন সময়ে সাহিত্যের বিভিন্ন আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। ভাষা-প্রকরণে, ছন্দ ও ছন্দোহীনতায় সাহিত্যকে পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেসব সাহিত্যের ধারা খুব বিস্তৃতি লাভ করেনি। যে সাহিত্য মাটির কাছাকাছি, জীবনের কাছাকাছি, স্বপ্নের কাছাকাছি অবস্থান করবে; যে সাহিত্য উত্তরণের কথা বলবে, চিরন্তন মানবিক বোধের ধারক হবে, বিষয়কে কেন্দ্র করেও বিষয়ের বাইরে তার আবেদন পৌঁছে দিতে পারবে—ভবিষ্যতে সেই সাহিত্যই বেঁচে থাকবে। এর বাইরের সাহিত্য মানুষের কাছে গ্রহণীয় হবে না।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
নভেম্বর ১৪, ২০২৩