spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধদুনিয়া বদলানোর আগে নিজেকে বদলানোর শিল্পকৌশল কাজল শাহনেওয়াজের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

দুনিয়া বদলানোর আগে নিজেকে বদলানোর শিল্পকৌশল কাজল শাহনেওয়াজের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

সময়ের কালখণ্ডের পরিমাপে কাজল শাহনেওয়াজকে আশির দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তার কবিতা পড়লে মনে হয়, আশির দশকীয় কবিতার বৈশিষ্ট্যে তার কবিতা পড়ে থাকেনি। বরং এই পর্যন্ত যতগুলো দশক পেরিয়ে গেছে প্রতিটি দশকের বৈশিষ্ট্য কাজলের কবিতায় ছাপ ফেলে আছে। কবিতায় এ ধরনের কৃতিত্ব বঙ্গের খুব অল্প কয়েকজন কবির কবিতায় আমরা দেখতে পাই। কবিতাকে নানা বিষয়ে ও প্রকরণে নির্মাণ করতে কাজলের যে প্রচেষ্টা তার জন্য শিল্পের প্রতি গভীরভাবে ধ্যানস্থ হতে হয়। সম্ভবত এই ধ্যান থেকেই তিনি ইঙ্গিত পান বহুবর্ণিল কবিতার।
আশির দশকে যে কাব্যযাত্রা শুরু হয় সেই যাত্রায় খুবই অল্প সংখ্যক কবি আগের দশকের বলয় ভাঙতে পেরেছেন। কিংবা বলা যায়, নতুন ভাষারীতি ও বিষয়-বৈচিত্র্যে কবিতাকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। পাঠক যে রীতির কবিতা পড়তে অভ্যস্থ সেই রীতির বাইরে আলাদা আঙ্গিক ও বৈচিত্র্যের অনাস্বাদিত শিল্পবোধে সেসব কবিতা জারিত। কাজল শাহনেওয়াজের কবিতার বেলায় এসব মন্তব্য যথার্থ। তার প্রথম বই ‘জলমগ্ন পাঠশালা’। এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, আশির দশকের আরসব কবিদের কাব্যভাষা থেকে তিনি আলাদা একটি ভাষাশৈলী রপ্ত করে নিয়েছেন। কেবল তা-ই নয়, স্বকীয় শিল্পশৈলীও তিনি তৈরি করে নিয়েছেন তার কবিতায়। যে উপায়ে তিনি কবিতায় তার বক্তব্য প্রকাশ করেন সেই উপায়ে তার সমসাময়িক আর কোনো কবি কবিতায় বক্তব্য ব্যক্ত করেন না। এই উপায়টি পুরোপুরি কাজলের নিজস্ব একটি ফর্ম। বলা যায়, কাজলীয় ঘরানা। ‘আমি আমার শত্রুর চশমা’ কবিতাটি পড়া যাক:

আমি আমার শত্রুর চশমা পরার পর
এখন বেশ আগের চেয়ে ভালো দেখতে পাচ্ছি
শত্রুর চশমায় একটা আলাদা লেন্স লাগানো থাকে বুঝি
ছয়টা ইন্দ্রিয়ের সতর্কতা সেখানে অনবদ্য
অন্য ভাষায় লেখা সব দর্শন
যা দেখি তার অন্যরকম মানে
তুমি যখন আমার সাথে অনর্গল মিথ্যা বানানো কথা বলতে থাকো
আমি তখন সেই বিশেষ চশমাটা চোখে লাগাই
তখন সব ফকফকা। তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাই
এতসব করি কেন?
কারণ তোমাকে আমি ক্ষমা করতে চাই
এতে যদি কিছু শাস্তি পাও, সেটা কি কঠিন শাস্তি হবে না?

আশির দশকের বেশির ভাগ কবিতার ভাষাশৈলী ও এই কতিার ভাষাশৈলী কিন্তু একই প্যাটার্নের নয়। কাজলের কবিতার ভাষার অভিব্যক্তি এমন যেন, কবিতার সাথে তার নাম না থাকলেও তার যে কোনো কবিতা পড়লেই পাঠক চট করে বুঝে ফেলবেন, এটা কাজল ছাড়া আর কারো নয়। কবিতার ভাষারীতিতে এই স্বকীয়তা নির্মাণ কিন্তু খুব বড় একটি শিল্প-কুশলতা। আমরা দেখেছি যে, কাজলের কবিতার শব্দগুলো আটপৌরে। ঠকঠক, খটখট আওয়াজ তুলে তার কবিতার শব্দপুঞ্জ পাঠকের কানকে বিরক্ত কোরে তোলে না। যেমনটা আমরা দেখি আশির অনেক কবির কবিতায়। মানে, কাঠখোট্টা শব্দের বুননে অনুভূতিকে এলোমেলোভাবে কী যেন বলার একটা চেষ্টা অনেক কবির কবিতায় আমরা দেখি। কিন্তু কাজলের কবিতায় গল্পচ্ছলে যা বলা হয় সেখানে বলার কথাগুলো খুব গোছানো। আপাতদৃষ্টিতে কোথাও কোথাও একটু খাপছাড়া মনে হলেও সেটা কাজলীয় প্যাটার্ন। এই প্যাটার্নে শিল্প-আস্বাদনের এক ধরনের মজাও আছে। এই মজা বুঝে ফেলতে পারলে কাজলের কবিতা পাঠককে চুম্বকের মতো টানতে থাকবে। শিল্পের এই ক্ষমতা কোথায় পেলেন কাজল? আমরা তো মনে হয়, গল্প লেখার অভিজ্ঞতা থেকে। কাজল গল্প লেখেন। গল্পেও তিনি ঈর্ষণীয় মেধাবী। কী শব্দ বিন্যাসে, কী বিষয়-প্রকরণে। তো, গল্প কথনের শিল্পবোধ নিয়ে তিনি যখন কবিতাকে শিল্পরূপ দেন তখন সেই কবিতা হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য। একইসঙ্গে অনাস্বাদিত শিল্পস্বাদ।
বঙ্গের বেশির ভাগ কবির কবিতা সুসজ্জিত শব্দের পেলব বুননে নরম সোফায় শায়িত। কাজলের কবিতা কিন্তু সেই রকমও নয়। তার কবিতার শব্দেরা কাটকাট। গ্রীবা উঁচু কোরে যেন শব্দগুলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দ্যায়। বাক্যগুলোও কাটকাট। বক্তব্য প্রকাশে কোনোই জড়তা নেই। ভণিতা নেই। বলার কথা সহজ উপায়ে বলে দিচ্ছে। তবে সেই বলার ঢঙে শিল্পের যে মোড়ক আমরা দেখি, সেই মোড়কের ভেতর শব্দগুলোকে জ্বলজ্বল মুক্তার দানা মনে হয়। মানে, বাক্যের শরীরে শব্দগুলো নিজস্ব অর্থময়তা নিয়ে হাজির হলেও গূঢ়ার্থে আরও কিছুর মানে প্রকাশ করে। ‘আমি আমার শত্রুর চশমা’ কবিতায় কাজলের এই কৌশল নিশ্চয়ই পাঠকের চোখ এড়ায়নি। শত্রুর চোখ দিয়ে নিজেকে দেখার যে কৌশল কবিতায় বর্ণিত হয়েছে সেই কৌশল কারো কারো কাছে ফ্যান্টাসি মনে হতে পারে। কিন্তু এই কৌশল নির্মম সত্যকে প্রকটিত কোরে তোলে। নিজেকেই শত্রুর বৈপরীত্যে দাঁড় করানোর এই যে অভীন্সা, এই উপায়কে নিশ্চয়ই আত্মদর্শন বলা যেতে পারে। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে বারবার নিজের ভেতরটা আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা কাজল শাহনেওয়াজের প্রায় কবিতাতেই আমরা দেখতে পাই। ‘একদিন আনারস’ কবিতার কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

নির্জন জায়গা দেখে আমি একদিন আনারস ক্ষেতে ঢুকে
চুপ করে একটা আনারস হয়ে গেলাম
অনেকগুলি চোখ দিয়ে একসাথে অনেক কিছু দেখবো বলে।

শত্রুর চশমা নিজের চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখার মতোই ঘটনা এখানেও। আনারসের গায়ে যেসব ছাপ থাকে সেসব ছাপকে আমরা সাধারণভাবে আনারসের চোখ বলে থাকি। তো, কাজল আনারস হয়ে অনেকগুলো চোখ পেয়ে গেলেন। এরপর তিনি দেখতে লাগলেন চারদিক। কত কী যে দেখলেন! সেসবের বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন কবিতায়, তার নিজস্ব ভাষাশৈলীতে। এরপর হঠাৎই দার্শনিক ভাবনায় তিনি উপলব্ধি করলেন, অনেকগুলো চোখ হলেও তার আসলে একটাই চোখ। অনেকগুলো সংবেদন হলেও অনুভব মাত্র একটাই। আমরা জানি, যা-কিছুই আমরা দেখি না কেন সেসব দেখার সাথে-সাথেই আমাদের ভেতর দৃশ্যময়তা তৈরি হয়। মানে, যা দেখি সেই দৃশ্য আমাদের ভেতর সংবেদী একটি রূপ ফুটিয়ে তোলে। এই উপলব্ধি থেকেই কাজল দার্শনিক বিচারে সত্য খুঁজে পাচ্ছেন। এর পরপরই তিনি আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন, আনারসের মতো অনেকগুলো চোখ নিয়ে কোনো কিছু দেখলে অনেক রকম ভাবনাকে রূপ মানে মূর্তিময়ী আকৃতিতে দেখতে পাওয়া যায়। এই যে দেখাদেখির ব্যাপার, এখানে কাজল শাহনেওয়াজ নিজের স্বরূপকেই আসলে আবিষ্কার করতে প্ররোচিত হয়েছেন। মরমী সাধকদের মতো বলতে হয়, নিজেকে দেখার বাইরে জগতে আর কিছু দেখার নেই।
কবিতায় কাজল কিভাবে উপমার ব্যবহার করেছেন সেটা দেখবার একটি বিষয়। কারণ, তার কবিতায় ব্যবহৃত উপমা পদ্ধতি প্রথাগত নয়। প্রথাসিদ্ধ উপমারীতি থেকে বেরিয়ে পুরোপুরি নিজস্ব একটি ঢঙে কাজল তার কবিতায় উপমাকে শিল্পমাত্রা দেন। এ বিষয়ে তার মত হচ্ছে, “আমি চেষ্টা করলাম অন্যভাবে। উপমার জগৎ থেকে উপমিতকে বদলে ফেলার চেষ্টা করা হলো তখন। দুনিয়া বদলানোর আগে নিজেকে বদলানো। এক ধরনের সংকোচন পদ্ধতি শুরু হলো, রূপকল্প ও বাকধারায়। আরেকটা জিনিস হলো, একটা সামগ্রিক বিরোধিতা নেমে এলো কবিতার শরীরে।” তার কথার সত্য-অসত্য খুঁজে দেখা যেতে পারে তারই কবিতা থেকে। মানে, উপমার ব্যবহার বিষয়ে তিনি যা বলছেন তা বুঝে নিতে তার কবিতায় ব্যবহৃত কিছু উপমা এবার আমরা পড়ে ফেলবো।

ক. তুমি এলে ট্রাক্টরের কলকব্জা নড়ে ওঠে
নিশ্বাসে কাঁপে ঘাম।
খ. ধানখেতে কালো ফড়িং পেশী টানটান করে দাঁড়ায়।
গ. শক্ত পাকস্থলী কই যাতে পাথরের গিঁট আর ফুলের তীক্ষ্ণ কামড় হজম করতে পারে?
ঘ. কী সুন্দর তোমার দাঁতফুল
তোমার চুল মেঘের কাশফুল।
ঙ. আমরা যেন আগামীকাল থেকে পাশবিক গোস্ত খাইতে পারি।
চ. তখন ভদাম করে আমার বন্ধু ছোট্ট হাতি একটা পাদ দিয়া ওদের কবিতার খাতা ভরে দিতো।

ওপরের বাক্যগুলো পড়তে পড়তে আমরা যদি আশির দশক ছাড়িয়েও আজকের সময়ে লিখিত বঙ্গের কবিতার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, কাজলের উপমা-উৎপ্রেক্ষা কিংবা শব্দ নির্বাচনের সাথে আর কারো কবিতার তুলনা চলে না। কাজল যেন সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের কাব্য নির্মাণরীতি চালু করে ফেলেছেন কবিতায়। প্রেমিকা প্রেমিকের কাছে এলে ট্রাক্টরের কলকব্জা নড়ে ওঠে— এমনতর উপমা আর কারো কবিতায় কি পড়েছে বঙ্গের পাঠকসমাজ? নিশ্বাসে বুক কাঁপে জানি, কিন্তু ঘাম আবার কিভাবে কাঁপে? এই উৎপ্রেক্ষাও আমাদের কাছে নতুন। ধানখেতে ফড়িঙের ওড়াওড়ির নানা রকমের বর্ণনা আমরা কবিতায় পেয়েছি। কিন্তু পেশী টানটান করে দাঁড়ানোর যে ভঙ্গিমার কথা কাজল লিখেছেন, তা আর কোনো কবিতায় আমাদের চোখে পড়েনি। কিংবা ধরা যাক, পাথরের গিঁট ও ফুলের তীক্ষ্ণ কামড়। কী আশ্চর্য অভিনব শব্দবন্ধনি, না? প্রেমিকার দাঁতকে ফুলের সাথে তুলনা করতে কোথাও কি আমরা শুনেছি? আবার প্রেমিকার চুলকে তুলনা করা হচ্ছে মেঘের কাশফুলের সাথে। এসব উপমা যে কেবল রীতিবিরুদ্ধ ও অভিনব, তা নয়। বরং এসব উপমা কবিতার পাঠককে নতুন ধরনের কবিতা পাঠের নতুন বোধে জারিত করে। কবি আশাবাদ ব্যক্ত করছেন তিনি যেন পাশবিক গোস্ত খেতে পারেন। গোস্ত কিভাবে পাশবিক হয়? এই জিজ্ঞাসার জবাব প্রকৃত পাঠক মাত্রই জানেন। কিন্তু বলার কথা হচ্ছে, এ ধরনের উপমা বাংলা কবিতায় নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছে। আবার ধরা যাক, ছোট্ট হাতির পাদ দেয়ার প্রসঙ্গটি। আমাদের ধারণা ছিল, পাদ শব্দটি কবিতার সৌন্দর্য হানিকর। কিন্তু শব্দটিকে যেভাবে যে উদ্দেশ্যে কাজল ব্যবহার করেছেন সেক্ষেত্রে পাদ শব্দটির যথার্থ প্রয়োগ ঘটেছে বলেই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হয়। ‘একটা হাতির বাচ্চা কিনতে মন চায়’ কবিতার একটি অংশে কাজল হাতির বাচ্চাকে নিয়ে আজিজ মার্কেকেট গেছেন। সেখানে উঠতি কবির দল ছোট কাগজের প্রৌঢ় সম্পাদককে ঘিরে তেলবাজি করে চলেছে। কবিদের এই তেলেসমাতি বাস্তবতাকে শ্লেষ করতেই কাজল হাতির বাচ্চার পাদ দিয়ে তাদের কবিতার খাতা ভরে দিতে চেয়েছেন। কেননা তিনি জানেন, এইসব নাবালক কবি আসলে কবিতার ধ্যানে নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়েই আজিজে জড়ো হয়েছে। কবিতাকে ব্যবহার করে তারা জীবিকা চালাতে চায়। তাদের লেখা কবিতার খাতায় শিল্প নয়, হাতির পাদই উপযুক্ত।
কাজলের কবিতা পাঠের পর আমাদের আগের কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা ভেঙেচুরে যায়। কবিতা যে এমন হতে পারে, এই রকম উপায়ে লিখিত হবে পারে, কাজলের কবিতার পড়ার আগে আমরা ভাবতেও পারিনি। তার সময়ের কবিতাদের থেকে এখানেই মূলত কাজলের কবিসত্তার নিজস্বতা। তার সময়কে ছাড়িয়ে আজকের সময়ে এসেও তিনি যেসব কবিতা লিখছেন সেসব কবিতায় কাজলের নতুন নতুন শিল্পনৈপুণ্য আমরা দেখতে পাই। বলা দরকার, আশির দশকের কবি-সম্প্রদায় কয়েকটি কবিতার কয়েকটি প্রবণতাকে লক্ষ্য রেখে কাব্যযাত্রা শুরু করেন। তার ভেতর একটা প্রবণতা ছিল চমক সৃষ্টি। কাজল তার কবিতায় সার্থকভাবে চমক সৃষ্টি করেন। তার চমক কখনোই অযৌক্তিক হয়ে ওঠে না। ‘ব্যাঙনি’ কবিতাটি পড়া যাক:

তুমি সেই প্রাগৈতিহাসিক ব্যাঙনি
যে কিনা বহু ফুট মাটির নিচে সারা বছর বসবাস করো
আর কেবল যৌনমাসে অন্ধকারের উপরে আলোকে উঠে আসো আর
একটা ছোট্ট ব্যাঙকে পিঠে চড়িয়ে
ঘুরতে যাও প্রান্তরের পথে
তুমি দুনিয়া, আমাকে তুমি দারী দেখাতে দেখাতে
হঠাৎই ফেলে দাও বিগ ব্যাং খাদে
আমিও চমকে উঠি সেই সংবাদে
আমি নরম ব্যাঙ, তুমি শক্ত নারী
একটা বিশেষ কাজের জন্য তুমি আমাকে পিঠে চড়িয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছো
তোমাকে কি ফেরাতে পারি?

রূপকথার মতো কোরে একটি গল্প বলতে চেয়েছেন কাজল শাহনেওয়াজ। গল্পটা আসলে গল্প নয়, কবিতাই। এখানে এক ধরনের চমক আছে। আবার, ব্যাঙনি ও ব্যাঙের যে বর্ণনা আমরা পাচ্ছি সেখানেও রূপকথার মতোই চমক রয়েছে। কিন্তু এসব চমক কোনোভাবেই বাগাড়ম্বর হয়ে ওঠেনি। বরং খুবই যৌক্তিক উপায়ে কবিতাকে একটি সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। চমকিত হওয়ার পাশাপাশি পাঠক আবিষ্কার করেন কবিতার অভিনব এক ভাষাশৈলী, যা এর আগে পাঠকের অভিজ্ঞতায় ছিল না। কাজল শাহনেওয়াজের কবিতায় ক্রিয়াপদের মৌখিক রূপ আমরা দেখতে পাই। আশির দশকের আর কোনো কবির কবিতায় এই চর্চা তেমন একটা আমাদের চোখে পড়ে না। তবে আশির পরবর্তী সময়ে এসে অনেক কবিই মৌখিক ভাষায় কবিতা লিখেছেন। সেই অর্থে কাজলকে তাদের অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্রিয়াপদের মৌখিক ব্যবহারে তার কবিতা কোথাও কি টাল খেয়ে গেছে? তা কিন্তু খায়নি। বরং দেখা যাবে, ক্রিয়াপদের মৌখিক ভাষা না থাকলেই কবিতার বাক্যস্রোত ঝিমিয়ে পড়তো।

তুমি বললে বনতুলশী, আমি বললাম ভুল
মাঠের মাঝে ফুটলো আমার নন্দনেরই ফুল।
মাঠ কুমড়ো নদী ঘেঁষে অবাক করা চোখ
আকাশ থেকে পড়লো বুঝি অপূর্ব আলোক।
সরু ফিতে কার যে চুলের নীরব অসহায়
আমার বুকের রাস্তা দিয়ে অল্প ঘেঁষে যায়।
পথের পাশে এগিয়ে গেলে অশ্বত্থের পাশে
ঈশ্বরেরই নাকের মতো মঠ এগিয়ে হাসে।
সবুজ জলাভূমি হেঁটে বাঁক ফেরালেই দেখি
বনতুলশী ঝোপে তুমি নীরবতার পাখি।
নিজেই বলি বনতুলশী, আবার ভাবি ভুল
মঠের মাঠে এ যে আমার নন্দনেরই ফুল।
একদা অজস্র স্বপ্ন তুমি ও দৃশ্যপট

কাজল শাহনেওয়াজের বেশির ভাগ কবিতাতেই প্রথাগত কোনো ছন্দ নেই। ছাড়া-ছাড়া বাক্যের বিন্যাসে গদ্যের ঢঙে সেসব কবিতা লেখা। এর মানে এই নয় যে, তিনি ছন্দ জানেন না। বরং ওপরের কবিতাটি পড়ার পর আমরা নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছি, ছন্দ তার রক্তের স্রোতের সাথে মিশে আছে। কিন্তু ছন্দে তার কবিতার সংখ্যা খুব একটা আমাদের চোখে পড়ে না। হয়তো প্রথাগত ছন্দে কবিতা লিখতে তিনি আরাম পান না। সেটা তার শিল্পসত্তার অভিরুচি। পাঠক হিসেবে সেখানে আমাদের ঢুঁ মারার অধিকার নেই। তবে কাজলের হাত দিয়ে ছন্দের যে কারুকাজ আমরা পড়লাম, এরপর তার লেখা ছন্দের কবিতার প্রতি আমাদের মুগ্ধতার তৃষ্ণা বাড়তেই পারে। ওপরের কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দের। যেন রেলগাড়ি। মাঠঘাট বন পেরিয়ে ছুটে চলেছে ঝিকঝিক ঝিকঝিক। মাঠের মাঝে একটা বনতুলশী গাছ। কিন্তু কবির কাছে বনতুলশী কেবল একটি গাছ নয়, বনতুলশী কবির বংশধর। আমরা জানি, বনতুলশী কবির কন্যার নাম। আত্মজকে কাজল শাহনেওয়াজ প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করছেন এই কবিতায়। কখনো তার কাছে মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে ঝরে পড়া অপূর্ব আলো। কখনো নীরবতার পাখি। কবিতাটি আসলে কবির স্নেহ-উৎসারিত একটি উপলব্ধি। যে অনুভবকে তিনি ছন্দের মাধুর্যে রাঙিয়ে দিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা