বাংলাদেশ
শিয়রে আমার হিমালয়
পায়ের কাছেই বঙ্গোপসাগর
বুকের সবুজে সূর্যোদয়
বর্গীতে আমার কেনো ভয়!
২
বাংলাদেশ নামের আপন উচ্চারণে
বোধের বিপ্ল¬ব ঘটে যায় রক্তের স্পন্দনে
ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইল দুই চরণে
আমি মেলেছি আকাশে ডানা
বুকে আমার হাজার নদীর মোহনা
কে তুমি আমায় করো উড়তে মানা?
৩
নদীর দেশে জন্ম আমার পলির দেশে বাস
রোদবৃষ্টিতে জ্বলেভিজে জমিন করি চাষ।
শস্য ফলাই মাড়াই করি ভরে ওঠে ঘর
লড়াই চলে রক্ত ঝরে জাগে নয়া চর।
কাজিয়ায় কে বাঁচেমরে, কার বুক ভেঙে যায়
স্মরণে সেই কথা বাজে, মা’র সুখ ভেঙে যায়।
তবু আবাদ নিয়ে ফসল নিয়ে স্বপ্ন আঁকি
বাঁচার নেশায় আশার বীজে বিপুল আস্থা রাখি।
আলের পথে হেঁটে চলি কালের হাওয়া গায়ে
শহীদেরা শক্তি জোগায় সবার পায়ে পায়ে।
জীবন চলে সাহস নিয়ে লাঙল আছে আগে
যুগে যুগে চেরাগ জ্বালি মানুষ মরে জাগে।
অপরাজিত
এতো দুঃখবোমা ফাটে, হৃৎপিণ্ড ফেটে যায়
এতো কষ্টগুলি চলে, ফুসফুস ফুটো হয়ে যায়
বারবার যন্ত্রণাসিডর তছনছ করে দেয় শস্যখেত, ঘরবাড়ি সব
ঘুরেফিরে বৈশাখী ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসে আপদবিপদ
প্রাত্যহিক নিয়মের মতো হয়ে গেছে অপঘাত মৃত্যু, সংঘাত
তবুও জীবন জ্বলে আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে!
প্রতিদিন ক্ষোভের জোয়ার আসে, ডেকে আনে হতাশার বান
রাগের উদ্ধত ফণা ইঁদুরের মতো আপসের গর্তে বাঁধে বাসা
বরিন্দের খরার মতন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে খা খা হাহাকার
ঠক, চোর, দালাল ও ডাকাতের হুক্কাহুয়া ডেকে আনে অন্ধকার
প্রতিদিন একটু একটু করে যেন ক্যান্সার কেবিনে মরে মরে যাচ্ছি
তবু রোজ ভোরে পথে প্রান্তরে জীবন হেঁটে চলে মনজিলে!
আবাদের খোঁজ নেই, বুকে জ্বলে শুধু সোনালি খড়ের পালা
স্বপ্নের হদিস নেই, শুধু দুঃসংবাদ সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে
দেহমনে পোশাকের মতো লেপ্টে আছে অবিশ্বাস, রুদ্ধশ্বাস ও সন্ত্রাস
বোয়ালের দেশে ছোট মাছ হয়ে নিত্যদিন বাঁচার লড়াই
অথচ কখনো ঝাঁক বাঁধি না, করি না ঝাঁকবাঁধা প্রতিরোধ
তবু বাঁচার আশায় ঠেলাগাড়ি হয়ে শরীর গড়ায়!
পূর্বপুরুষের রক্তমাখা মাটিতে জন্মায় জীবনের শস্য
অপরাজিত আত্মারা খুঁজে খুঁজে ফেরে বাঁচার রহস্য।
নদীর নগরে
নদীর নগরে বাস করি, নদীর পানিতে চাষ
বিষের বাতাসে বসবাস ছেড়ে নদীতে নিঃশ্বাস।
নদীনাওমাছপাখি– এইসব নিয়ে বেঁচে আছি
নগরে বসতি, তবু আছি প্রকৃতির কাছাকাছি।
চর ভাঙে চর গড়ে পলিতে উর্বর চরাচর
সবুজ ধানের শীষে, কাশবনে বিমুগ্ধ অন্তর।
দেহমনেপ্রাণে শান্তি এনেছে, তৃষ্ণায় সজীবতা
ইলিশের স্বাদেগন্ধে মনে এঁকে যায় রূপকথা।
২
রূপকথা ভেঙে পড়ে, নাগিনীর বিষাক্ত ছোবলে
নদীর মরণে শিশুরাও কেঁদে ওঠে মা’র কোলে।
ঢেউ নাই স্রোত নাই পাল নাই ধু ধু বালুচর
মাছপাখি ধানের সবুজ চলে গেছে তেপান্তর।
শাড়িহীন পড়ে আছে শীর্ণ নদী মায়ের কঙ্কাল
ইতিহাস হয়ে গেছে ভাটিয়ালি, দাঁড়বৈঠাপাল।
তৃষ্ণাশান্তিস্বস্তিসুখ কোথা পাবো আর খুঁজে
নদী হত্যায় দর্শক হয়ে সয়ে যাবো মুখ বুজে?
পলির সভ্যতা মুছে যাবে পৃথিবীর ছবি থেকে?
গাঙের মানুষ এসো শোণিতের চিহ্ন যাই রেখে।
ঘরে ফেরে চরের মানুষ
–এই দাঁড়া দাঁড়া
–আমাহারে লিয়ে যা
এইমাত্র ছেঁড়ে দিলো নাও
লগি ঠেলে ঠেলে তীর থেকে সরে যায়
হাঁক মেরে তিনজন দৌড়ায় মাথায় নিয়ে বোঝা
নৌকা বোঝায় মানুষ, গরু-মহিষ-ছাগল
দিনমজুর, ঘরামি, কিষাণ, নাপিত, মিস্ত্রি, ফেরিওয়ালা, পাগল
এক নৌকায় সবাই–
গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে
ওরা চলেছে নদীর ওপারে, চরের ঘরে ঘরে
অনেকের কাঁধে ঝোলে গামছায় বাঁধা চালডাল– বাঁচার লড়াই
অনেকের হাঁটুর উপরে লুঙ্গি, কোমরে গামছা
মরা পদ্মার ঢেউয়ে ভডভড আওয়াজ তুলে
নৌকা ছেড়ে যায় তীর
সূর্যাস্তের রক্তাক্ত আলোয় চোখে মুখে শ্রান্তির কালিমা ঝরে ঝরে যায়।
চরের চৈতালি মাড়ায়ের শব্দগন্ধকণা
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে এসে লাগে
নাকে চোখে গায়ে মনে; নতুন ধানের চারা দুই পাড়ে
লকলকিয়ে ওঠে সবুজ পোশাকে
চৈতালি আর ধানের স্বপ্ন বুকভরা
পালের মতন ফুলে ফুলে ওঠে বুকের গহীনে,
প্রিয় মানবীর জন্য সন্তানের জন্য কিছু কেনাকাটা করে
বাড়ি ফেরে নদী ঘুরে ঘুরে
হটটিটি পাখির গানের সুরে সুরে।
মুক্তির আনন্দ
বরিন্দের ধানসিঁড়ি মুক্তির আনন্দে উঠে গেছে সবুজ দিগন্তে
মেঘেরা যেখানে নেমে আসে হাসে ঘরছাড়া হয়ে ধানের সুবাসে
একটি রঙিন ঘুড়ি সুতা ছিঁড়ে উড়ে উড়ে যায় পাখির পালকে
দিগন্তে দাঁড়ালে লালনীল স্বপ্ন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেয় অবাক বালকে
সেই বালক অপার বিস্ময়ে উড়াল দিতে চায় নীলের নগরে
আকাশে পবনে ডানা মেলে ইচ্ছেঘুড়ি উড়ায় সে মেঘের অরণ্যে
শৈশবের খাঁচা ছেড়ে কৈশোরের আনন্দে সে ঘুরে ঘুরে সুরে সুরে
দিগন্ত পেরিয়ে অন্য দিগন্তে হারিয়ে যাবে, যাবে নীল সমুদ্দুরে
অবিরত ঢেউ আর ঢেউ নীলিমায় হয়ে উঠে দিকচক্রবাল
সেইখানে বালকের মন হতে চায় রক্তপদ্মফোটা সূর্যোদয়
গাঙচিল ইলিশের ঝাঁক আর জাহাজের নাবিকের বন্ধু হয়ে
একদিন সাহসে প্রত্যয়ে আনন্দে আশায় বের হবে দিগ্বিজয়ে
আসলে বালক পৃথিবীতে হতে চায় দুঃসাহসী ডালিমকুমার
রাক্ষসের খাঁচা ভেঙে মানুষের বিজয় আসবে নিয়ে সে আবার।
তবুও দোয়েলের শিস
তবুও একটি দোয়েলের শিস
প্রতিদিন ভোরে সূর্য আর স্বপ্ন ডেকে আনে
আমাকে বাজায় জীবনের গানে।
প্রতিটি সকালে আমি শিশির মাখানো সবুজাভ দূর্বাঘাসে
পা ডুবিয়ে পুবের আকাশে অনেক আলোর আশায় তাকিয়ে থাকি
মর্মাহত জীবনের মাটিতে স্বপ্ন দেখার প্রতীক্ষা সফলতা পায় না কখনো।
কেবল কাকের কণ্ঠস্বর, হতাশার মতো কালো ডানার বিস্তার
কুয়াশায় আচ্ছন্ন দিগন্তে আঁকে জয়নুলী ক্যানভাস
চল্লিশ বছরে আজো পেলাম না সম্পূর্ণ আকাশ।
আজকাল বিষণœ বিকেলে ধূমায়িত আকাশ মাথায় নিয়ে
আমার নির্জন ছাদে শুধুই দেখতে থাকি সূর্যাস্তের দৃশ্য
চোখের ভূগোলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায় যেন এই ছবি
আমার শিরায় মস্তিষ্কের কোষে কোষে স্মৃতি হয়ে
প্রদর্শন হতে থাকে কেবল একটি দৃশ্য-
সূর্য ডুবে যাচ্ছে
সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
তবুও একটি দোয়েলের শিস
পৃথিবীর পথে আমাকে বাজায়অহর্নিশ।
আলো
ঝিনুকের মাঝে মুক্তা লুকিয়ে থাকার মতো
আমার সত্তায় আলোর একটি বীজ সুপ্ত হয়ে ছিলো বহুকাল
হঠাৎ সেদিন প্রথম সূর্যের মুখোমুখি হতে
বজ্রপাত হয়ে যেন ঝলকানি দিয়ে গেলো সপ্ত আকাশ পর্যন্ত
কি আশ্চর্য আমার হৃদয়ে দিগন্ত বিস্তারি সূর্যোদয়
কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে জ্বলে উঠলো সহসা
দুর্বা ঘাসের সবুজে গাছের পাতায় ফসলের মাঠে জনপদে
সেই আলো মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো বিদ্যুৎ রেখার মতো
পিরামিড যুগ থেকে বহমান সময়ের সমস্ত আঁধার
আমি নিমেষেই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম কালের ডাস্টবিনে।
অতঃপর সূর্যাস্তের শেষ আলো নদী ও আকাশের সন্ধিস্থলে
ডুবে গেলে দ্বাদশী চাঁদের আলোয় আমার প্রাণ
জোছনার জোয়ারে প্লাবিত স্নাত হয়ে গেলো মহানন্দে
কালো মেঘের ডানায় জোছনার গ্রাস হলে
হৃদয়ে আমার নক্ষত্রপুঞ্জ দীপ্তি ছড়ালো হাসিতে
আমি সত্যি বুকে পুরে নিয়েছি সাতটি তারার জ্যোতি থেকে
নিহারিকাপুঞ্জ পর্যন্ত সমগ্র আকাশ!
বঙ্গপোসাগর থেকে উঠে আসা আগ্রাসী মেঘের দৈত্য
আমার আকাশ ছেয়ে ফেলে মুহূর্তেই আমি
ডানা ঝাপটিয়ে আলোর তৃষ্ণায় সাঁঁতার দিলাম প্রাণপণ।
ফাগুনের ভোরে
কী এক অজানা টানে কুয়াশার ঘোর ভেঙে পাতাঝরা মেঠোপথ ধরে
হেঁটে যাই পুবের দিগন্তে
আমার দু’পায়ে শিশির ভেজানো ধুলো মেখে লুটোপুটি খায়
গায়ে এসে লাগে শরীর হৃদয় জুড়ানো শান্তির মতো শীতল হাওয়া
বাতাসে জানান দিচ্ছে ঝরা পাতার উৎসব– আহ্ দুঃখ যদি
এভাবেই শ্রাবণীধারার মতো ঝরে মিশে যেতো মাটিতেই!
নাকে এসে লাগে নবীন পাতার মন মাতানো ঝাঁঝালো ঘ্রাণ
যেন চেতনার সরোবরে পদ্মকুঁড়ি ফুটে উঠলো হঠাৎ।
সবুজ ঘাসের বুকে রক্তরাঙা পলাশের উজ্জ্বলতা যেন
পতাকার প্রতিচ্ছবি।
বুক পকেটে পলাশ পুরে হাঁটতে থাকলাম–
পূর্ণিমা চাঁদের মতো নতুন সূর্যের দিকে!
যে দিগন্ত থেকে আবেগের মতো সঞ্জীবনী আলো ছড়িয়ে পড়ছে
গগনশিরিষ মেহগনি আমের মুকুল দেবদারু শিমুল এবং
সোনালি গমের উর্ধ্বমুখী শিষে–
উৎসাহের মতো জীবন উঠছে জেগে- প্রাণখোলা আনন্দের মতো
হাসিতে দুলছে ভাঁটফুল।
একদিকে স্বপ্নভঙ্গের মতন ঝরাপাতার নির্ঝর
অন্যদিকে আশার মতন নতুন পাতা ও কুঁড়ির জাগরণ
সৃজন ও পতনের মাঝপথ দিয়ে আমি হেঁটে চলি পুবের দিগন্তে
সূর্যকে করতে আলিঙ্গন।
কুকুরের কান্না
একটানা কান্না
কান্নার তরঙ্গ
ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ছে
পৃথিবীর প্রতিটি দিগন্তে
সাতটি আকাশে
সাতটি তারার রাতে
দিনের সবুজ ঘাসে।
মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে কান্নার শব্দরা
থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে
কেঁপে উঠছে আবার
নিরন্ন বিরতি দিয়ে দম নিয়ে বাতাস কাঁপিয়ে
জনপদ থেকে রাজপথে সেই ধাবমান আওয়াজ
অঘ্রাণের কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করেছে মানুষের আহত অন্তর।
সারারাত ধরে মর্মছেঁড়া গগনবিদারি কান্না
কোন্ উৎস থেকে আছড়ে পড়ছে?
বুঝি না গভীর এই কান্নার ভেতর
কী এমন আছে যার চূড়ান্ত আঘাতে
ভেঙে পড়ছে রঙিন সভ্যতার সমস্ত খিলান!
বিপন্ন মা কুকুরের একটানা এই কান্না কী তবে
শোকাহত অগণন
মানব মায়ের লুকানো জামানো
বোবা কান্নার মিলিত প্রতিধ্বনি?
যা এখন আগ্নেয়গিরির লাভার মতন উদগীরণে
করোনার মতো ছড়িয়ে পড়ছে
এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তর!
জানি না কীভাবে বেঁচে উঠবে বারুদে রক্তে ভাসমান কম্পমান এই চরাচর!
অঘ্রাণের ভেজা ভোরে
অঘ্রাণের ভেজা ভোরে রহস্যের কুয়াশাচাদর গায়ে
হেঁটে চলি পুবের দিগন্তে
শিশিরের শিহরণে রোদের আশায় প্রতীক্ষিত দুর্বাঘাসে
পা ডুবিয়ে মাড়িয়ে একাকী হেঁটে চলি ধল প্রহরের দিকে।
দিগন্তে ঝাপসা গাছপালা ঘুমন্ত দৈত্যের মতো ভয় ধরায় হৃদয়ে
ঘরবাড়ি ডুবে আছে কুয়াশার জালে
বিদ্যুতের তারে কাক মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে জীবন তৃষ্ণায়
খেজুরের নাড়ি হাতে গাছি ছোটে খালি পায়ে রসের আশায়
সবুজের ভাঁজ খুলে আদিগন্ত মেঠোপথ ধরে
আমি হাঁটতেই থাকি
আমি হাঁটতেই থাকি।
আমার দু’পায়ে রক্ত ঝরে
আমার শরীর ক্লান্তশ্রান্ত
তীব্র শীতের কাঁপন ধরিয়ে দেয় হাড়ে
তবুও আমার পতচলা থামে না কখনো
আমি পথে প্রান্তরে গাছের নিচে
গাঁয়ে গঞ্জে জনপথে
যে-সব ক্ষোভের পাতা আর গোপন কান্নার ডাল জমে আছে
সে-গুলো দিয়ে মজ্জায় মেরুদণ্ডে শিরা ও উপশিরায়
জে¦লে দিয়েছি আগুন।
তাই ঠাণ্ডা এখন পালিয়ে যাচ্ছে দূরে
সকল আতঙ্ক মুখ লুকাচ্ছে ক্ষণিক কুয়াশার সুরে।
আমি অবিরাম হেঁটে চলি সূর্যোদয়ে
কাল থেকে মহাকাল যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে।