সুগন্ধা
দূরে থাকা নদীটির প্রেম–
রাখা ছিলো প্রখর দৃশ্যে;
মন মৎস্যআশাহীন।
খলবল করে ওঠা রূপালী ঝিলিক
ছিলো না যে, তা নয়!
বাঁকের পর বাঁক
গভীর থেকে গভীর
নদীটির বুক
অংগ-প্রত্যংগ সমূহ
কাঁপন তুলেছে–
কোনো কোনো রাধিকার মতন।
যদিও তার শুরু আর সমাপ্তিচিহ্ন
কখনও খুঁজিনি!
তার বুক বেয়ে ছুটে চলা প্রহরেরা
আশ্চর্য সংগীত।
নিজ অবস্থান
যাবতীয় আলসেমী গেঁথে গেছে প্রাণে।
অবনত চোখ তোলে তীর্যক ভঙ্গিতে।
দিন যায় মাস যায়, এমন কী বছর;
আলসেমী বাঁচে একা সংগ্রাম ছাড়াই।
ক্ষতিগন্ধ ধ্বংসরূপ মাথা উঁচু করে,
কেবলি বাঁচতে চায় জীবনের মত!
কিন্তু সেই দুর্নিবার স্রোতসারে মজে–
প্রাণেরা বিভ্রমে নাচে পৌঁছায় সুদূরে।
সঞ্চালন ইচ্ছা সব বড় নির্বাপিত!
উৎপাদন্মুখি প্রাণ গহীনে ডুবলেও
কিংবা হারালে সুদূরে-নিজ আঙ্গিনার
চুম্বকপ্রমাণ টান সহজে ফেরার।
পতনপ্রপাত থেকে জাগায় বাঁচায়–
আত্মমর্যাদার চূঁড়া– একান্ত নিকট।
যাপন ভাবনায়
গহীন গঞ্জনা সব বিঁধে আছে গলে
না পারি উগরাতে না পারি নামাতে!
প্রহর থেকে প্রহর তীব্র অস্থিরতা!
লেপ্টে থাকে কুরে খায় সত্তার নির্যাস
অস্বস্তির তীব্রজ্বালা শরীরের পলে–
সাহায্য করেনা কেউ সুদূরে পালাতে।
এরি মাঝে প্রবাহিত জীবনের ঢেউ
নিজ নিজ ভূমিকার ম্যারাথন দৌঁঁড়।
নিজ গোত্র পরিচয় মুছে যেতে যেতে–
ধবল বকের খোঁজে রূপসী বাংলায়;
বাঘের গলার হাড় যেভাবে তুলেছে,
প্রতিশ্রুতি পোড়ে এই অগ্নির চুল্লিতে।
ফিরে আসি মাছরাঙ্গা চোখের পলকে–
পানকৌড়ির কৌশল যদিও উড়াল।
মুগ্ধতার ভূবনে
পথের পিছুনে, ডানে-বামে–
এতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে যে,
আমি না পারছি এগোতে!
না পারছি পিছুতে!
আমার দৃষ্টি নিবিড়ভাবে
জড়িয়ে ধরে সবকিছু।
সতেজ ঘাসেরা–
বৃক্ষের অপরূপ ঢল,
পাখির কুজন;
আমাকে থমকে-চমকে দেয়।
আমি আমার গন্তব্য ভুলে–
পথেতেই স্থির;
ছুঁড়ে ফেলি যাবতীয় পিছুটান।
নিজ গোত্র, নিজ বাড়ি–
এমন কি স্রষ্টাকর্তৃকপ্রাপ্ত-
সন্তান-সন্ততির প্রিয় স্পর্শ,
শিহরণ ভুলে-আমি থাকি
এই ঝিকিমিকি সবুজের দিকে।
চোখ তুলে, আত্মায় শিশির-নিশির
ঝরে পড়ে ঘাসে।
আর মাথার উপর
ঝকঝক করে ওঠে নীলাকাশ,
সূর্যের সোনার শিহরণ;
আমি সব কিছু ভুলে–
নিস্তেজ হয়ে পড়ি–
এই সব অসাধারণ ভিড়ে।
তুমি আর ফিরিবে না জেনে
তুমি আর ফিরিবে না জেনে–
আমি আমার সব চেষ্টাকে গুটিয়ে রাখি
শৈশবের ঘুড়ির লাটাইয়ের মত।
আমি আমার সাধনার প্রহরগুলিতে–
ভুলেও তোমার ভাবনাকে–
প্রশ্রয় দেইনা মেডিটেশনে।
আজ দুই যুগ আমি
গৌরি পরিধানে–
সন্ন্যাস করেছি গ্রহণ।
নিয়েছি আশ্রয় চিরকুমার
হিমালয়ের পাদদেশে,
অরণ্যের নিঝুম গহীনে।
জেনেছি, সন্ন্যাস মানে–
উপেক্ষার হাজার ঢল;
মেনেছি, জীবন মানে–
ঝক্কি-ঝামেলার হাজারো চল।
তুমি আর ফিরিবে না জেনে–
আমি আজ নিজেই ফেরার;
নিকটাত্মীয় ও জনজীবন থেকে।
আয়ুরেখা
নদীর নরম মন হেঁটে যাচ্ছে সত্ত্বার তীর ঘেষে।
তার উপরিভাগ দেখে চোখ,
মধ্য ও নিম্নাংশের খবর সম্পূর্ণ জানে না!
মিশে থাকা জলজ জীবেরা–
যে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ভাসে;
তাতে বাঁধা,
মানুষের মুখে ঢুকে পড়া করুণ ঘটনা,
বেদনা পরিপূরক।
দিন-রাতের বৈভবে- কাছে-দূর
সম্পর্করা বিচ্ছিন্ন যদিও।
ঘোলাজলে আয়ুরেখা প্রকৃত নিষ্প্রভ।
প্রবেশাধিকার
বুকেতে অব্যক্ত কথা–
চোখেতে অবুঝ রঙ–
জ্বেলে সে কিছুই বলেনি।
হাজারো প্রহরে সে বরঞ্চ অবিচল।
তবুও আনন্দের অবিরল ঝর্ণাজল
তার চারপাশে;
অরণ্যের গহীনে হরিণের কোমল হৃদয়,
পাখিদের বর্ণিল উপস্থিতি;
যেন শান্তির আশ্চর্য এক উদ্যান রেখেছে ছড়িয়ে।
তবুও বিস্ময়-এই যে, তার কোনো আহবান নেই;
আছে কেবল এক, উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার!
চরাচরে
আমার জানারা অজানার হয়ে রয়–
কোনো কোনো আশ্চর্য ক্ষণে!
নির্জনে কেবল তার সুর, জাগরণ;
একা একা তার স্বাদ, অতলান্তিক বোঝা!
অন্যকে তার ফল, নিঃস্বতার, নির্বোধ।
আমার চিন্তারা বিক্ষিপ্ত-খাপছাড়া–
প্রাত্যহিক চরাচরে।
আমার সাধনারা ছিন্ন-ভিন্ন–
অন্যের নির্দয় ব্যবহারে।
আমার বোঝারা না বোঝার!
অভিজ্ঞতা-অনভিজ্ঞের–
প্রায়শঃ এই সামাজিক রণভূমে।
অবুঝ মৃন্ময়
মেঘের ভিতরে কাদের যেন বাস!
মাঝে-মধ্যে তাদের অবয়ব ভেসে ওঠে!
উঁকি মারা মুখ, চোখের ভরাট;
বিস্তৃত বক্ষ ও তার অপার হৃদয়।
–এমন শুভাকাঙ্খী দেখিনা ধুলিপৃষ্টে।
ঝরঝর বৃষ্টিকে লুকিয়ে–
সারাটি বছর, কোথায় যে হারায়!
শরতের ঝকঝকে আকাশও লুকায়;
যেন কারও অন্তর্ধান,
গ্রীষ্মের আকাশ পানে চেয়ে–
উসখুস হৃদয়।
বর্ষার অবিরল ক্ষণে তাদের উপস্থিতি–
স্বস্তিকার, বরাভয়।
মেঘের রাজ্যে যাবো, অবুঝ মৃন্ময়!
প্রিয়ভূমির স্পর্শে
এখানে সন্ধ্যার প্রবাহিত স্রোত–
সুগন্ধ্যার প্লাবন দেখে অজস্র প্রহর কাটে।
মুছে যাচ্ছে কালিজিরা,কীর্তনখোলার দৌঁড়;
যদিও বুকের গহীনে বহমান ধানসিঁড়ি–
এখনও যার দেখা দুচোখে জাগেনি!
কেবল রূপালি ইলিশের পানে চোখ–
হেঁসেলে দু একটা তার মাঝে-মধ্যে ঢুকে পড়া।
দুটি পা ছোটে এদিক-সেদিক।
প্রাচীন জীবনসন্তাপ ঠিকরে বের হয়–
সন্ধ্যার জোনাকির মতন।
মানসপটে বগুড়া রোড ক্বল জ্বল করে জ্বলে।
বি এম কলেজ, স্মৃতিতপ্ত হৃদয়ে নাচে।
শহরের প্রতিটি প্রান্তরে হাহাকার ছড়ানো-ছিটানো;
কালের যাত্রার এক্টু-আধটু বোল ফুটে ওঠে যত্রতত্র।
আশার কথা এই যে,
প্রিয়ভূমিতে কবিতার লোকজন আছে;
দুটি চোখ তাঁদের অলক্ষে গভীর,
জেগে ওঠে উন্মুখ, তৃষ্ণার্ত।
প্রবল তবু এক– জীবনানন্দ ঘোর।