ঘুরেফিরে কতিপয় গাড়ল
কেবলি গাড়ল কতিপয় ঘুরেফিরে এইখানে এসে বসে;
বসে বসে চিবোয় সুরভি পান, সারা গাল ভরে যায় রসে;
এক মনে এক ধ্যানে চিবোতে চিবোতে সেই পান
বাকরুদ্ধ জাতির সামনে,অতঃপর, খলবল করে গেয়ে ওঠে এক গান-
ঘুরেফিরে এক গান, এক সুর আর তার একই ম্যাসেজ;
তবু ফুর্তিতে গাড়লগুলো বিলেতি কুত্তার মতো
বাতাসে দুলাতে থাকে লেজ।
ক্রমাগত জাহান্নামে যায় দেশ, বেড়ে চলে দারিদ্র্য দুর্নীতি দুঃখ ও দুর্ভোগ
আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে সমগ্র জাতির দেহ ও মনের রোগ;
বাড়ে নিরাশা নৈরাজ্য রাহাজানি ছিনতাই উৎত্রাস উতরোল;
তবু উন্নতির বানে ডুবে গেছে সারা দেশ বলে চীৎকার করে কতিপয় বিশিষ্ট গাড়ল।
[ এবার একটিবার একসাথে, ২০১১]
শিক্ষিত ছাওয়াল
১.
লেহাপড়া কে বানাইলো- আমি তার মুণ্ডুপাত করি;
লেহাপড়া করে যারা, তারা আর থাহে না মানুষ;
দেহে-মনে আলো কই, এ যে শুধো আনে বিভাবরী,
অহঙ্কারে ফুলতি ফুলতি ফাটে’ যায় আঁধার ফানুস
আমার যে ছিলো এক চাঁদমুখ সোনার ছাওয়াল,
কাঁঠালিচাঁপার মতো চারিদিরি ছড়াতো সুবাসÑ
লেহাপড়া শিহে সে যে ছিঁড়ে গেছে সংসারের জাল,
সব কিছু ছেড়েছুড়ে আজ তার পরবাসে বাস
আমেরিকায় থাহে সে, ভুলে গেছে পাড়াগাঁর নাম
শুনলি দেশের কথা আজ তার হয় বিবমিষা
পশ্চিমের নগ্ন পায়ে তুলেছে সে স্বপ্নের বাদাম
চেনা রা¯তাঘাট ভুলে জীবনের হারায়েছে দিশা
যে-বিদ্যে ভুলায়ে দ্যায় মাতা ও মাতৃভূমির নাম
ধিক সেই লেহাপড়া, সেই বিদ্যে হারাম, হারাম
২.
আসতি চায় না দেশে একবারও ছাওয়াল আমার
বিদেশবিভুঁই-এ থাহে’ সে কেমন হয়ে গেছে কাঠ
আজ বড় খাখা করে ভিটেমাটি খেত ও খামার
খাখা করে আরও বেশি এ মনের শূন্য মাঠঘাট
কেন যে শিখাইলাম লেহাপড়া, ভাবি শুধো আজ
কেন, হায়, চাইলাম করতি যে শেক্সপিয়ার রুশো
তার চেয়ে ভালো ছিলো মাঠেতে করানো কিষিকাজ
হায়, কত ভালো হতো যদি ও থাকতো চাষাভুশো!
লেহাপড়া শেহে যারা, তাদের যে আত্মা মরে যায়
শরীলের সুখ পেতে তলোয়ারে দ্যায় তারা ধার
তাদের সর্বাঙ্গ থেকে ভালবাসা স্নেহ ঝরে যায়
জীবনের কারবালায় হয়ে যায় পাষণ্ড সীমার
আজ আমি পাড়াগাঁয়ে একা একা দেহি অন্ধকার
সাত সমুদ্দুর পাড়ে বাস করে ছাওয়াল আমার
৩.
ছাওয়াল আমার করে বিদেশবিভুই-এ বসবাস
সেই দেশে লোহে নাকি চুমা খায় কুহুরির গালে
সে-কি ন্যাংটা দেশ বাবা, মেয়েমানসি শুনি বারো মাস
হাফপ্যান্ট পরে হাটে পথেঘাটে পুরুষের হালে
আমাদের বউমাটা- সেও নাকি ত্যামোনি ছিনাল
বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘোরে, সোয়ামিরে আঙুলে ঘোরায়
সেই দেশে ধর্ম নেই, স্যানে শুধো এজিদের কাল
হোসেনের গলা কাটে সীমারেরা বাতিল ছোরায়
যারা যায় সেই দেশে, তারা আর ফেরে না গেরামে
পাপের নরকে থাহে’ হয়ে যায় শিকারী শকুন
আমার ছাওয়ালও আজ নৃত্য করে ইবলিশের নামে
যে-ইবলিশ চাটে’ খায় এশিয়ার গরিবের খুন
হায় কি বদনসিব, কি আমার অনাথ কপাল,
লেহাপড়া শেখায়ে যে হারালাম সোনার ছাওয়াল
[ কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর, ২০১২]
পরবাসী বাঙালীর বউ
তুমি কি পাগল করা মানুষ কও তো, আসি বলে সেই গেছ চলে
এদিরি তেঁতুলগাছে পেত্য সন্ধ্যেবেলা ডাকে এসে একটা হুতোম
তর্মুজের মতো মিষ্টি নরম মানুষ- কী করে পাষাণ এত হলে
তাই ভেবে দুচোখের পাতায় এহন কত দিন নেই কোনো ঘোম
একটা হুতোম এসে পেত্য সন্ধ্যেবেলা জুড়ে দেয় অলক্ষুণে ডাক
ভয়েতে আমার তাতে জমে যায় বুক, না জানি কার কী কনে হয়!
তুমি তো ভালোই আছো? তাই যেন থাহো, অন্যেরা যেমন থাহে থাক
তুমি ভালো থাকলি জেনো বরফের মতো ঠাণ্ডা থাহে আমার হৃদয়
কেমন কও তো দেহি তোমার আক্কেল, ফোন করছো এত দিন পর!
কাতারে কামাতি গেছ কুমীরের ধন- কী হবে গো এই ধন দিয়ে?
এদিরি শরীলে আজ চিতার আগুন, জ্বলে যায় যুবতী অন্তর
ফিরে আসো, কচুঘেচু খাই তবু থাহি স্বর্গসুখে ভিটেবাড়ি নিয়ে
পাড়ার নটীরা সব বলা-কওয়া করে: ‘ছিনালের এমনি ভাতার
বকনার মতো বউ থুয়ে মানুষটা কি-পরাণে গিয়েছে কাতার!’
[ কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর, ২০১২]
সতত এ নদ
শরীর শীতল করে, ভিতর শীতল করে এই ঘোলাপানি,
এ পানিতে স্নান করে ভোরের দোয়েল আর আমার হৃদয়;
পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ এখনও আগের মতো করে কানাকানি
তখন এ নদ দেখে কত মধু মধুদেশে মহাকবি হয়!
অন্য কোনোখানে গিয়ে বাঁচবো কি একদিনও এ জমিন থুয়ে?
বিদেশবিভুঁই গিয়ে কী করে মানুষ বাঁচে, আমি ভেবে মরি;
আমার কেশবপুর জননীর মতো থাকে অস্থিমজ্জা ছুঁয়ে,
আমার এ কপোতাক্ষ আমাকে প্রশান্তি দেয়া মর্ত্যের অপ্সরী।
আমার হৃদয় রোজ খরসুলা মাছ হয়ে বুজকুড়ি তোলে
ঘোলা এ পানিতে আর ঘুমায় নিশ্চিন্তে এর সবুজ দু’পাড়ে,
যেভাবে ঘুমায় শিশু দুগ্ধ পান করতে করতে জননীর কোলে;
কোন্ রূপ করতে পারে ধরাশায়ী, দেশ যার অস্থিমজ্জাহাড়ে?
আমাকে টানে না পরদেশ, পরনারী কিংবা যক্ষের সম্পদ
যেমন শীতল সুখে চুম্বকের মতো টানে সতত এ নদ।
[আমার কোথাও যাওয়ার নেই, ২০১৭]
গাছীর গান
জিড়ন রসের মতো তোমার যৌবন, যুথিমালা;
তোমার খেজুরগাছে আজ আমি দিনান্তের গাছী,
কাটবো পৌরুষ দিয়ে তোমার দুচোখে যত জ্বালা,
তারপর রস দিও, বসতে দেবো না কোনো মাছি
ছ-কুড়োর মাঠে আজও ছোলার কি-চমৎকার চাষ,
সেই ছোলাগাছ তুলে পুড়াবো উঠানে মাঝরাতে;
তারপর তোমার ঘরে হালাকুর চলবে সন্ত্রাস,
পৌষের পবন আর স্তব্ধ রাত্রি কেঁপে উঠবে তাতে
জিড়ন রসের মতো, যুথিমালা, তোমার যৌবন-
আমার কী চাই আর, আমি এক বুভুক্ষু বাঙ্গাল;
চাইনিজে থাইসুপে মজে না আমার গেঁয়ো মন,
অমৃত আহার মানি যৌবনের ক্ষীর এক থাল
বাপদাদা ছিলো গাছী, অধমেরও একই পরিচয়
জানা আছে কোন্ গাছে কয় পোচে রস আনতে হয়
[আমার কোথাও যাওয়ার নেই, ২০১৭]
পরিচয়
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বট-পাকুড়ের নিচে, হিজলছায়ায়, বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে
কত কাল মহাকাল। নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি;
আমার শরীরে হ্যামের শোণিতধারা। আমার অস্থিতে-হাড়ে
তাঁর পুত্র হিন্দের উজ্জ্বল উপস্থিতি, যাঁহার ঔরশে ছিলো বঙ।
পিতা বঙ থেকে আমি এই বঙ্গে, বয়ে যাই তাঁরই উত্তরাধিকার।
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। পাখি আর আকাশের নানা রঙ
দেখে দেখে আমার দিবস কাটে। কিভাবে হরিণ বাঘের শিকার
হয় বনে-আমি তাও দেখি। কখনো আনন্দে হাসি, কখনো বা
কষ্টে শ্রাবণের মতো আমি কাঁদি। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে
তাজিং ডনের মতো থাকি আমি অবিচল- যেন জন্ম বোবা;
হঠাৎ দুঠোঁটে ফোটে খই, একতারা বেজে ওঠে বাউল এ হাতে।
কোথাও আমার যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে, সভ্যতার প্রায় সমান বয়সী,
প্রথম মানুষ এ দ্বীপের; নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি।
সকালের সূর্য আমার কুশল পুছে, জানায় শুভেচ্ছা আমাকে রাতের শশী।
[আমার কোথাও যাওয়ার নেই, ২০১৭]
একটি হত্যাকাণ্ড ও দেশপ্রেম
তারা তাকে হত্যা করেই ফেললো
কারণ তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে
সে তার জবান খোলেনি একবারও।
সে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পুরোনো কাস্তেটি হাতে নিয়ে
ধানখেতের মাঝখানে।
তার মুখভরা ছিলো ঈশা খাঁর দাঁড়ি।
সে কোনোদিন স্কুলে গিয়েছিল বলে শোনেনি কখনো কেউ।
সত্তর বছর ধরে এ গাঁয়ের আলো ও বাতাসে
রৌদ্র ও বর্ষায়
ফলন্ত বৃক্ষের মতো বেঁচে ছিলো সে।
রাজনীতির আড্ডায়, ফুটবলের মাঠে কিংবা চায়ের দোকানে
তার উপস্থিতি কারো চোখে পড়েনি কখনো।
তাকে শুধু দেখা গেছে মাঠেঘাটে কিংবা বিলে
কখনো লাঙল নিয়ে, কখনো কোদাল, কখনো নিড়ানি—
সাধকের মতো সে নিমগ্ন হয়ে আছে তার নিত্যকার কাজে।
কখনো বা সেচঘরে বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে
শ্যালো মেশিনের পাশে;
কখনো বা দেখা গেছেÑএকা একা
ঠিক করে চলেছে সে ইরি ব¬কের পানির লাইন।
কখনো গাঁয়ের হাঁটে ছুটতে দেখেছে তাকে লোকজন:
কাঁধে তার খেত থেকে তুলে আনা তরতাজা তরকারির স্তুপ।
ক্লাবের ছেলেরা তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
তাদেরকে উসকে দিয়েছিল তার সুখ ও সাফল্যে ঈর্ষান্বিত
এ গাঁয়েরই দুষ্টু কিছু লোক।
ছেলেরা পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তার কাছে;
বলেছিল, “ক্রিকেটে আপনি কোন্ দেশের সাপোর্টার?”
বলেছিল, “আপনাকে কেন দেখা যায় না বিজয় দিবসের
প্রভাতফেরিতে?” বলেছিল, “আপনি কি
এদেশকে ভালোবাসেন না একটুও?”
সে কেবল ফ্যালৃফ্যালৃ করে নির্বাক তাকিয়ে ছিলো
তাদের মুখের দিকে।
তার নিরবতা ভেঙে দিয়েছিল তাদের ধৈর্যের বাঁধ।
তাদের উত্তপ্ত ধমনীর ভেতর এক কড়াই গরম তেলের মতো
টগবগ করে ফুটতে থাকা তাদের বিক্ষুব্ধ দেশপ্রেম
খুনী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর এবং শেষমেশ
হন্যে কুকুরের মতো তাকে হত্যা করে ফেললো, পিটিয়ে।
তারা চলে গেলে, তার লাশ
ঘিরে কেঁদে উঠলো সুগন্ধি বনের বাতাস।
চারদিকের ধানখেত তার শোকে কেঁপে উঠলো থরথর।
মাঠের গরুরা, গরুদের পিঠের উপর বসে থাকা কয়েকটি ফিঙে
আর শূন্য সেচঘর
তার নামে করতে থাকলো আহাজারি।
আর এক নারী,
তার দেশ,
সিক্ত চোখ, আলুথালু কেশ,
উদ্ভিদের মতো নরম মৃত্তিকা ফুঁড়ে জেগে উঠে বলে উঠলো সক্রোধে:
‘তুমুল বর্ষায় ও প্রচণ্ড রোদে
কে আর বেসেছে ভালো তার অধিক আমাকে একদিনও?
গাছের পাতারা সাক্ষী আর জমিনের সব তৃণ,
তার চেয়ে প্রিয় আর ছিলো না কেউই, দুঃখে কি সুখে,
এ মুলুকে।’
তবু তারা দেশময় হেসে চললো বিজয়ের হাসি
এই বলে: ‘ফেলেছি বীরের মতো হত্যা করে তাকে
কারণ আমরা ভালবাসি
আর সে ভালোবাসেনি একবারও এই দেশটাকে।’
[আমার কোথাও যাওয়ার নেই, ২০১৭]
শ্যামল বরণ গা আর শ্যামল বরণ পা
এই গাঁয়ে এক মেয়ে ছিলো, শ্যামল বরণ গা
দেখলে মনে হতো কোনো লজ্জাবতী গাছ
ছুঁয়ে দিলে কুঁকড়ে যাবে, তুলবে না আর পা
ঘা লাগলেই ভেঙে যাবে যেমন ভাঙে কাঁচ
এই গাঁয়ে এক মেয়ে ছিলো, শ্যামল বরণ গা
হাটতো যখন মনে হতো বন-ময়ূরের নাচ
কিন্তু কারো সামনে পড়লে থমকে যেতো পা
যেমন করে চারোর ভিতর থমকে দাঁড়ায় মাছ
সেই যে শ্যামল বরণ মেয়ে, দেখেছি তার রূপ
ফুলে ফুলে নুয়ে পড়া সজনে গাছের ডাল
কৃষ্ণচূড়ার সারা অঙ্গে কুসুমের স্তুপ
কিংবা যেন উথাল গাঙে ময়ূরপঙ্খীর পাল
ঝলসে গেছে তার রূপে চোখ, চোখের হলো কী
চোখ বুজলে শ্যামল বরণ, চোখ মেললেও তাই
হৃদয়গাঙের গহিন জলে শ্যামল মেয়েটি
কালবাউশের মতো মারে নরম পায়ের ঘাই
এখন আমার চতুর্দিকে কিছুই দেখি না
শ্যামল বরণ গা দেখি আর শ্যামল বরণ পা
[বাংলাদেশ, ২০২২]
বাঘের পাড়ায়
বাঘের পাড়ায় আন্ধার রাতে গা ছমছম করে
শুকনো পাতাও পড়ে যদি, হরিণ ভেবে ধরে।
বাঘরা ঘুমায়, বাঘিনীরা এবং তাদের ছা;
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দ্যাখে হরিণচরা গাঁ।
সেই গাঁয়েতে হাজার হরিণ ঘুমায় গায়ে গায়ে
অন্ধকাররা আছড়ে পড়ে তাদের নরম পায়ে।
কি যে নরম মাংস তাদের, নোনতা নোনতা স্বাদ
কিন্তু তাদের ধরতে লাগে হাজার রকম ফাঁদ।
ফাঁদে তারা পা দেয় না, এমনই নচ্ছার!
ইচ্ছে করে সকাল বিকাল মটকায়ে দি ঘাড়।
‘হরিণ! হরিণ!’ বলে হঠাৎ চেঁচায় বাঘের ছা।
“হরিণ কোথায়? ঘুমো এখন।” শাসায় যে তার মা।
বাঘিনীর মা কোথায় ছিলো, বললো এসে, “হুম।
ঠিক বলেছে নাতি আমার। ভাঙলো তোদের ঘুম?
কী এনেছি দেখ্ না চেয়ে!” “দেখি, নানী, কী গো-”
দেখেই নাতি চেঁচিয়ে ওঠে, “ও-মা! এ যে মৃগ!”
মধ্য রাতে বাঘের পাড়ায় চলে ভোজোৎসব
হালুম হুলুম আওয়াজ ওঠে, খুশির কলরব।
বাঘের পাড়ায় জ্যোৎস্নারাতে বসে চাঁদের হাট
সুন্দরী সব বাঘের ঝিরা, সে-কি তাদের ঠাট,
বাঘের বউয়ের লাঙ্গুল ধরে করে টানাটানি-
বাঘের বউ না, বাঘের বউ না, সে যে বাঘের রানী।
বাঘের খালা-ফুফু যত ছিলো আশেপাশে
জ্যোৎস্নারাতে তাদের সাথে হো হো করে হাসে।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যের গায়
জ্যোৎস্নাজলে তখন সারা বন যে ভেসে যায়!
কেওড়াপাতায় জ্যোৎস্না নাচে, নাচে বাঘের মন
হালুম বলে হাঁক মারে সে, কাঁপে গোটা বন।
হরিণেরা বাতাসেতে পেতে রাখে কান
শোনে বাঘদের হাসাহাসি এবং তাদের গান।
বানরগুলো ভয়ে মরে, কামড়ে ধরে ডাল
গহিন বনে যায় পালিয়ে বন-শূকরের পাল।
[বাংলাদেশ, ২০২২]
যেখানে বাংলাদেশ
১.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
মাটির নিঝুম দ্বীপে। সেখানে বাংলাদেশ
রাজকুমারীর মতো রূপকথা হয়ে আছে আজও।
তার রূপে বুঁদ হয়ে আছে নীলাকাশ। বিচিত্র পাখিরা
স্বাধীনতা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় ঝাঁক বেঁধে আকাশের কাছে,
তারপর ফিরে আসে সবুজাভ শীতল জমিনে ফের।
কি-নিশ্চিন্তে কাঁকড়ারা, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা অলস সৈকতে,
মেতে ওঠে আনন্দখেলায়! চেয়ে চেয়ে দ্যাখে তা দুদণ্ড
একটি কচ্ছপ; তারপর ধীর পায়ে নেমে যায় ঢেউ তোলা
অথই পানিতে। শিশির জড়ানো ভোরের রোদ্দুরে
বনের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে একদল চিত্রল হরিণ;
তাদের চঞ্চল পায়ের আঘাতে নিস্তব্ধ মাঠের সুগন্ধি ঘাসেরা
কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন ভয়ে। হঠাৎ কোথাও
ডেকে ওঠে গাঙচিল; সেই শব্দে
খসখস আওয়াজ ছড়িয়ে শুকনো পাতায়, হয়ে যায়
মুহূর্তে উধাও তারা বনের গভীরে। কেওড়ার ডালে বসে
একটি নিসঙ্গ ঘুঘু ডেকে চলে অবিরাম তার খেলার সাথীকে
মাথা কুটে কুটে। সারাদিন বুনো খরগোশ আর কাঠবিড়ালীর
চলে কত লুকোচুরি খেলা বনময়! ডাইনোসরের মতো গুইসাপ
ফণা তুলে চলে হেলেদুলে। সন্ত্রস্ত পেঁচারা দলবেঁধে
উড়ে উড়ে করে চেঁচামেচি। দূর থেকে উঁকি মারে এক জোড়া
লাজুক নেউল; এদিক-ওদিক তাকায় কয়েকবার, তারপর
ছুটে যায় নিরুদ্দেশে মুখ নিচু করে। আলো ও ছায়ায়,
রৌদ্র ও বৃষ্টিতে দুপুর ও বিকেল সেখানে ধরে কত
মোহনিয়া রূপ! সেই রূপে স্নান করে তারপর যখন সেখানে
নেমে আসে সুদর্শনা রাত চাঁদ-তারা সাথে নিয়ে, মনে হয়,
পৃথিবীতে দুচোখ ধাঁধানো এত রূপ দ্যাখেনি কখনো কেউ
এর আগে। সোনারঙ জ্যোৎস্নার জলে ভিজে যাওয়া
কেওড়া পাতার আবডালে আমি যেন দেখতে পাই এক
দুধসাদা রূপসীর মুখ, যে আমাকে অত্যাশ্চর্য তার
সবুজ চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যায় তার হৃদয়ের কাছে,
যে-হৃদয়ে কিলবিল করে বুনোহাঁস, পাতিঘুঘু, চিত্রল হরিণ
আর এক ঝাঁক বুজকুড়ি তোলা খোরশুলা মাছ।
২.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
আমার স্বপ্নের নারকেল জিঞ্জিরায়। সেখানে বাংলাদেশ
সুনীল সাগরপাড়ে নারকেলপাতার ঝড়ে উড়াচ্ছে উদাম চুল।
সে-চুলের সবুজ সুঘ্রাণে দিশেহারা হয়ে উড়ছে বাতাসে
বক আর মেটে চিল। সারা দিন নারকেলবনে আর সাগরের
বুনো জলে খেলা করে বুনো বাতাসেরা।
ঢেউ আর বাতাসের তোড়ে জেলেদের মাছধরা নৌকাগুলো
আছাড়ি পিছাড়ি খায়, যেন ডুবে ডুবে ভেসে ওঠা মৎস্যকন্যার ঝাঁক।
সেসব নৌকার ’পরে শুয়ে শুয়ে পোহায় রোদ্দুর যেন
শীতল পানির মাছ; জেলেদের দুচোখ জুড়ায় তারা তাদের সুরূপে।
লোকালয় থেকে দূরে আছে এক ছেঁড়া দ্বীপ। তার পাড়ে উন্মাতাল
ঢেউ এসে ছুঁড়ে মারে কোরালের স্তূপ। চারদিকে
নারকেল পাতার ঝড় আর সাগরের নিঃশ্বাসের ধ্বনি ছাড়া
আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ যখন নারকেল পাতায় বসে
কণ্ঠ ছেড়ে দিয়ে ডেকে ওঠে একটি নিসঙ্গ চিল,
অলস সৈকতে কুমিরের মতো শুয়ে শুয়ে রোদ-পোহানো সকাল
নড়েচড়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর হাই তুলে, দুই হাতে
ডলে দুই চোখ, আবার ছুটতে থাকে দুপুরের দিকে।
দুপুর গড়িয়ে হয়ে যায় যখন বিকেল, সে আর এ-দ্বীপ ছেড়ে
চায় না কোথাও যেতে এক পা-ও, হাঁটুচুল রূপসীর মতো
মাজা বাঁকা করে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের গা ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গুনতে থাকে সাগরের ঢেউ আর পাড়ে
পড়ে থাকা অজস্র কোরাল।
৩.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
চিলের ডানায় দক্ষিণে সুন্দরবনে। সেখানে বাংলাদেশ
পশুর নদীর পাড়ে গোলপাতার ঘোমটা পরে রাজকুমারীর মতো
রূপকথা হয়ে আছে আজও। কত যে বানর পেঁচা হরিয়াল ঘুঘু
লুকোচুির খ্যালে সারাদিন সুন্দরী কেওড়া আর হিজলের ঘন
পাতার আড়ালে! পাকা মরিচের মতো লালঠোঁট মাছরাঙা
করমজলের পাড়ে ঝুলে থাকা ধুন্দুলের ডালে বসে
সন্ন্যাসীর মতো করে ধ্যান, হঠাৎ বাঘের মতো
ঝাঁপ দিয়ে বুনোজলে ধরে নিয়ে যায় সাদা পেটঅলা মাছ,
যার গায়ে রোদ লেগে ঝকমক করে ওঠে রূপার আঙটির মতো।
গেওয়ার জঙ্গল থেকে উড়ে যায় হঠাৎ একটি দুরন্ত হট্টিটি,
উড়তে উড়তে ছাড়ে হাঁক, বিদ্যুতের মতো তা মুহূর্তে
চিরে নিয়ে যায় যেন সমস্ত অরণ্য, ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে
ছুটতে থাকে মায়াহরিণের পাল লেজ তুলে, দ্যাখে
সুদর্শন ডোরাকাটা বাঘ ছলছল চোখে তাদের সে-দৌড়
আর মহাআক্ষেপে চাটতে থাকে ঠোঁট। কাঠঠোকরারা
পাকা সুপারির মতো শক্ত বৃক্ষদের কাণ্ডে কাণ্ডে ঠোঁট মেরে
ওঠায় বাঁশির মতো সুর; সেই সুরে ভেঙে যায় বনবিড়ালের
ঘুম, হাই তোলে একবার দুইবার, তারপর আবার সে
ঢলে পড়ে অথৈ ঘুমের ভিতর তাঁর নিশ্চিন্ত নিবাসে। সারা বনে,
সন্ধ্যা নামার আগেই, নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা।
চলে যায় অরণ্যবাসীরা তাদের গোপন আস্তানায়। শুধু জোনাকীরা
আলোর মশাল নিয়ে নেমে পড়ে পাহারায় সারা রাত, ঘুরে ঘুরে
দ্যাখে তারা সমস্ত অরণ্য- বাঘদের আর বন্য শূকরের হাত থেকে
আছে কিনা নিরাপদে সব। যখন হঠাৎ চাঁদ মাথার উপর উঠে
ঝরায় বৃষ্টির মতো তার রূপ, ভিজে যায় গাছপালা, ঝোপঝাড়
আর করমজলের পানি; গোলপাতার ভিতর থেকে
বের হয়ে আসে এক অত্যাশ্চর্য মুখ, দুধসাদা;
তার শিশিরের মতো মুখ দেখে আমি অরফিয়ুসের মতো
তুলে নেই হাতে বাঁশি, যা বেহুঁশ হয়ে বাজতেই থাকে অবিরাম;
আমার দুচোখ তাঁকে প্রাণভরে দেখছে তো দেখছেই।
ডেকো না আমাকে আর পাথরের দেশে।
৪.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
লালনের একতারা হাতে আমার পাথরঘাটা বিলে।
সেখানে বাংলাদেশ সারাদিন সারারাত রূপকথা হয়ে আছে আজও।
পদ্ম, শাপলা ও কলমিফুলের তরতাজাঘ্রাণে ভিজে আছে
সারা বিল। উত্তাল যৌবন মেলে ধরা সেইসব ফুলের উপর
নৃত্য করে সকালের মিঠেরোদ প্রজাপতি ফড়িং ও মাতাল মৌমাছি।
পানকৌড়ি কুচবক মাছরাঙা জলপিপি খঞ্জনা ও বালিহাঁস
উড়ে উড়ে সারাদিন খুঁজে ফেরে বিলময় তাদের আহার।
পানি কেটে ছুটে যায় হঠাৎ একটা শোলমাছ
অথবা গজার বিদ্যুতের বেগে; কলার পাতার মতো কেঁপে ওঠে
কুচকুচে পানি আর সেই পানির ভিতর
ঝিরঝির করে কাঁপতে থাকে সুনীল আকাশ। পাখিদের
পাশ দিয়ে হাঁসের মতন ভেসে চলে যায় বৃদ্ধ মেঘা মোল্লা তার
পুরনো তালের ডোঙা নিয়ে; পাখিদের মতো সেও
খুঁজে ফেরে তার জীবিকা এখানে; কত পরিচিত যেন তারা
যুগ যুগ ধরে! স্বপ্নের বিলের চারধারে সুন্দরবনের মতো
দাঁড়িয়ে সবুজ গ্রাম; সেখানে লাজুক হরিণীর মতো রমণীরা
অলস প্রহরে নকশি কাঁথায় বুনে যায় এখনো তাদের
জীবনের রূপকথা। হঠাৎ সন্ধ্যায় নিজঝুম আকাশছোঁয়া
বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে যখন সেখানে উঁকি মারে রূপবতী চাঁদ,
তার রূপে ঝকমক করে ওঠে পাথরঘাটার পানি আর তার
থালার মতন পদ্মের পাতারা। আনন্দে আমার একতারা
বেজে ওঠে পুনরায়। দুধসাদা কোনো রূপসীর কান
শুনছে সে সুর রাত্রি জেগে জেগে।
৫.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
চলন বিলের হরিণচরায়। সেখানে বাংলাদেশ
হলুদ-মসলিন শাড়ি পরে রূপকথা হয়ে আছে আজও
সরিষার খেতের ভিতর। বিলের গহিন থেকে
জংলি বাতাস এসে নিয়ে যায় উড়াড়ে উড়ায়ে তার
শাড়ির আঁচড় আর তার কাকের চোখের মতো হাঁটুছোঁয়া চুল।
যৌবন উপচে পড়া সরিষার ফুলে ফুলে মাতাল মৌমাছি f
করে যায় দুরন্ত দস্যুতা। তাদের বিস্রস্ত ঘ্রাণে মৌ মৌ করে
সারা মাঠ। মান্দারের ডালে বসে একটি হলদে পাখি
কার কথা ভাবে একা চুপচাপ কিছুক্ষণ একমনে!
মহাকালের নৈঃশব্দ ঠোঁটে নিয়ে তারপর হঠাৎ সে উড়ে যায়
হরিণচরার গহিন সবুজে। দোয়েলেরা দলবেঁধে
সাথে করে নিয়ে আসে অজস্র শালিক, খুটে খুটে খায় তারা
ঘাসপোকা ঘুরে ঘুরে। তাদের ডানার ’পরে
সোনারঙ রৌদ্র পড়ে পিছলে পিছলে যায়। আইলের
পাশ দিয়ে মধুচাষীদের রেখে যাওয়া বাক্সবন্দী রানীমাছি
জাদুগ্রস্ত করে রাখে মউ লুটপাটে ব্যস্ত মৌমাছিদেরকে,
উড়ে উড়ে গিয়ে যারা রানীর পবিত্র পায়ে চুমু খেয়ে আসে বারবার।
কত মধু জমে এই বাক্সের ভিতর! সেই মধু চলে যায়
বোতলে বোতলে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে; অতঃপর
ঠোঁটে ঠোঁটে মানুষের লেগে থাকে বাংলার ঘ্রাণ। আমি
বাংলার গান গাই; রূপসী আমার বাংলার গান গাইতে গাইতে
হয়ে যাই আমি পৃথিবীর কবি। পৃথিবী আমাকে চেনে
আমার বাংলার রূপে।
৬.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
জ্যোতির্ময় আমার কেশবপুরে। সেখানে বাংলাদেশ
তাতানো খেজুররসে ভিজে ফুলে ওঠা চিতোই পিঠেয়
মুখ মিষ্টি করে ছড়াচ্ছে বাতাসে বেহেস্তের সুর। সেই সুরে,
ঘুম থেকে উঠে, মিলায় দোয়েল-ঘুঘু কণ্ঠ তাদের; তাদের ঘিরে
ঝাঁক বেঁধে নৃত্য করে দুনিয়ার পেঁচা; চপল ফিঙেরা
সজিনার ডালে বসে উড়ে যায় বারবার, পুনরায় ফিরে এসে
পুলকে নাচায় সরু ডাল লেজ নেড়ে নেড়ে। নারকেল-গাছে
দৌড়োদৌড়ি করে কাঠবিড়ালীরা। হঠাৎ দুড়ুম করে খসে পড়ে
মাটির উপর মুখ খাওয়া নারকেলের মুচি। সেই শব্দে মুখ তুলে
এদিক-ওদিক চায় এক জোড়া বেজি, ঝরা কাঁঠালপাতার ’পরে
খসখস আওয়াজ তুলে ছুটে যায়, অতঃপর, ঝোপের ভিতর।
মান্দার ফুলের ’পরে সকালের রৌদ্র লেগে
লাল টুকটুকে মেয়ের মুখের মতো করে ঝকমক।
কত যে শালিক তার কাঁটাঅলা ডালে বসে জুড়ে দেয় শোরগোল!
কাশবনের ভিতর থেকে কী ভেবে হঠাৎ করে বের হয়ে আসে
একটি শেয়াল; তাকে দেখে পেঁচারা আওয়াজ করে
করে ডাকাডাকি; কয়েকটি ফিঙে তার গার কাছে গিয়ে
ছোঁ মেরে আবার উড়ে গিয়ে বসে কলার পাতায়। তার ভারে
দুলতে থাকে সেই পাতা আর নাচতে থাকে আমার হৃদয়
যেন কাঁদাখোচা পাখি। আমি একতারা হাতে নিয়ে
বের হয়ে যাই লালনের মতো বাংলার পথে পথে।
বাংলার মাটি, পানি ও বাতাস যেন কান খাড়া করে
একমনে শুনতে থাকে ফুটানো রসের মতো উথলে ওঠা
একতারার সুর, যে-সুরে কেবলি মুগ্ধতা, কেবলি স্তুতি আর
আনন্দের শিহরণ।
[বাংলাদেশ, ২০২২]