ওমর বিশ্বাস
১.
নজরুলের প্রথম বই “অগ্নিবীণা”। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে “অগ্নিবীণা”প্রথম প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সালের হিসাবে অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। এর প্রকাশক হলেন গ্রন্থকার, ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেন, কলিকাতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২+৬৬। দাম ছিল এক টাকা। “অগ্নিবীণা”-র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী বীরেশ্বর সেন।
অগ্নিবীণায় কবিতা সংখ্যা ১২টি আর উৎসর্গ কবিতাটি ধরলে কবিতা সংখ্যা ১৩টি। উৎসর্গের কবিতাটি শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ এর প্রতি। অনেকেই উৎসর্গটিকেও কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘উৎসর্গ’টি মূলত একটি গান হিসেবে রচিত। এখানকার কবিতাগুলো হলো প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত্-ইল্-আরব, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী, মোহর্রম।
এখানকার উল্লেখযোগ্য কবিতাটি হলো ‘বিদ্রোহী’, যে কবিতা দিয়ে নজরুল বলা যায় সবচেয়ে বেশি পরিচিত। নজরুলের কাব্যপ্রতিভার স্ফূরিত আগ্নেয়গিরি সকলের মাঝে উদ্গিরণ হয়েছিল। কবিতায় তিনি ‘অগ্নি-কেতন’উড়ান। এতে উদ্গীত বাণীগুলো সেই শুরু হওয়া থেকে আজো অমর হয়ে আছে। এখানকার প্রায় প্রতিটি কবিতাই উল্লেখযোগ্য। বহুল পঠিত হয়ে আছে প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার, শাত্-ইল্-আরব, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী, মোহর্ম এর মতো কবিতাগুলো।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’কবিতাটি “অগ্নিবীণা”গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। তার খ্যাতি কাব্যপ্রতিপত্তি সকল কিছুকে ছাড়িয়ে ধুমকেতুর মতো সামনে এনে দেয় ‘বিদ্রোহী’। তখন থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হলেও এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আরো আগে — প্রায় দুই মাস আগে যখন কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় “মাসিক মোসলেম ভারত”পত্রিকায়। তখন রবীন্দ্রনাথের সময়। তার মধ্যেই নজরুলের আগমন। সে এক ধূমকেতুর মতোনই। তার এই আগমনে কাব্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ করার মতো দিক হলো, অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’পত্রিকায় ‘ধূমকেতু’কবিতাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬শে শ্রাবণ (১১ই আগস্ট, ১৯২২ খৃস্টাব্দ) ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আর এই ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক ছিলেন কবি নিজেই।
রণ-ভেরী কবিতাটি “গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা-তুর্ক-গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালাইতেছিলেন, সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ হইতে দশ হাজার স্বেচ্ছাসৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনিয়া লিখিত”বলিয়া নজরুল নিজেই উল্লেখ করেন। এছাড়া ‘কামাল পাশা’নামে একটি কবিতা ‘অগ্নিবীণা’গ্রন্থে আছে। সেটি একটি দীর্ঘ কবিতা।
২.
নজরুলের আগমন কেমন ছিল? তার আগমন বার্তায় কি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। সবকিছুকে পিছন ফেলে নতুন এক বিদ্রোহ রচনা করেন তিনি কবিতায় যা সব সময় আসে না। সবার মধ্যে আসে না। যুগোত্তীর্ণদের পক্ষে কেবল সম্ভব হয় ভাঙা-গড়ার খেলার মধ্যে দিয়ে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্যের নতুন দ্বার উন্মোচন করার। যারা পারে তারা ধূমকেতুর মতো আসে। তারা যে যার সৃষ্টির পথ নতুন করে আবিষ্কার করেই আসে। সকলকে যে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে আসতে হবে তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি নেতা তিনি নেতৃত্ব দিয়ে আসবে। যিনি সংস্কারক তিনি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে আসবেন। যিনি নায়ক তিনি নায়কের মতো আসবেন। যার যার পথ, পাথেয় ভিন্ন। কিন্তু স্ব-স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতিমান সকলের প্রতিভা অমর সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তারা আসেন ধূমকেতুর মতোই। নজরুল যেমন ধূমকেতু হয়ে ধূমকেতুর মতো আগমন করেন।
“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধুমকেতু!” (ধূমকেতু)
এই দুটি স্তবক তিনি ‘ধূমকেতু’কবিতায় মোট চারবার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি তার আগমন বার্তা সকলকে জানান দিয়ে দেন। তিনি ঘোষণা করেন তার শক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে। তিনি বলিষ্ট কণ্ঠে তার করণীয় কি তা প্রকাশ করেন। তার প্রমাণ তিনি ধূমকেতু কবিতায় যেমন রেখেছেন। তেমনি গোটা অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে সে দিকটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ধূমকেতু কবিতাটিতে ‘আমি’ দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেন জোরালো ও দৃপ্তচিত্তে। মোট ৩০ বার তিনি ‘ধুমকেতু’কবিতায় ‘আমি’উচ্চারণ করেন। এই কবিতায় তিনি নিজের উপর যে বক্তব্য দেন তাতে তার আত্মবিশ্বাস যে কত উচ্চে তা ফুটে ওঠে। তিনি আত্মবিশ্বাসের সেই ঝাঁকুনি দেন যেভাবে, বাস্তবে তার পক্ষেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। তার সেই প্রবল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তার প্রত্যয়দীপ্ত সতত উচ্চারণ হলো,
“আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি!” (ধুমকেতু)
আসলে নজরুল যেখানে ঔপনিবেশবাদের পেটের ভিতর থেকে তাদের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস দেখান সেখানে তার যে কোনো ভয় নেই তা তো স্বাভাবিক। তার পক্ষেই তো তাই ভেদ করে যাওয়া সম্ভব যত দুর্জ্ঞেয়কে। তার পক্ষেই ত্রিশটি বিশ্ব গ্রাস করার কথা শোভা পায়। তার এই দৃঢ়তা কোনো ঠুনকোর বিরুদ্ধে নয়, তিনি তার বাস্তব জীবনেও প্রমাণ করেছেন। তিনি সেই জন্যই সকল সময় সাহসের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন:
আমি সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,
আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান অভিমুন্যে।
শোঁও শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
ঘুর্ পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই,
মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি
করি উল্কা—অশনি—বৃষ্টি, —
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি!
আমি অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি! (ধুমকেতু)
নজরুলের এই ‘আমি’দৃঢ়তর থেকে ক্রমেই দৃঢ়তর হয়। তার আমি, আমার স্বগোক্তি দেখা যায় অনেক কবিতায়। কিন্তু এই আমি’র উচ্চারণ অবিস্মরণীয় ভাবে জ্বলজ্বল হয়ে ফুটে আছে ‘বিদ্রাহী’কবিতার মূলে। মোট ১৪৪ বার সেখানে উচ্চারিত হয়েছে ‘আমি’। এই ‘আমি’র মধ্যে দিয়ে নতুন কিছু পাওয়া যায়, নতুন এক দিগন্ত রেখার সৃষ্টি হয় তার ‘অগ্নিবীণা’কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে। এই আমি কোনো ছলনাও নয়, এই আমি কোনো হালকা বস্তু নয় বা ঠুনকো নয় যা ফু দিলেই উড়ে যায়। এই আমি তেজোদীপ্ত উচ্চারণ হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত। সাহসের সাথে যুক্ত। এই আমি দিয়ে পরিবর্তন, গড়া, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, সংস্কার, নবত্ব প্রমুখের দিকে আহ্বান। এসবের দিকে পথ দেখানো।
নজরুলের আবির্ভাব ধুমকেতুর মতো হলেও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার যোগ্যতা মেধা তাকে সাহিত্যে উচ্চাসনে অধীষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। তিনি কারোর উপর নির্ভর করে নয়, নিজের অসীম সাহস আর আত্মবিশ্বাসে নিজেকে দৃঢ় রেখেছেন। আসন করে নিয়েছেন একজন বিস্ময়কর কবি প্রতিভা দিয়ে। তিনি বারবার যে আত্মপ্রত্যয়ের ঘোষণা দেন, তা যথার্থ, তা তার পক্ষেই মানায়। কেননা, তিনি বলেন:
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! (বিদ্রোহী)
কাজী নজরুল ইসলামের এই যে, “আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!” বলে যে ঘোষণা তাতে বোঝা যায় তার আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা। তিনি নিজেকে “ বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়” বলে যে বলিষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। তিনি কোনো প্রকার পিছপা হননি নিজের অবস্থান থেকে। বরং একে একে ধূমকেতুর মতোই সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। এগিয়ে গেছেন লক্ষ্যপানে। যেখানে গিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা যায়, যেখানে নিজেকে উপযুক্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন সেখানেই তিনি থেমেছেন। তার পথচলা ছিল নির্ভীক। কোনো প্রকার বাঁধাবন্ধনকে তোয়াক্কা করেননি। তিনি নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে এগিয়ে গেছেন, মানুষ-মানবতাকে সাহস যুগিয়েছেন।
তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যেখানে ফুঁসে উঠছেন সেখানেই তার জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছেন, যোগাচ্ছেন সাহস। তার সাহসকে ধারণ করার ক্ষমতা যদি কারোর না থাকে তবু তাকে নির্ভীক হবার সাহস যোগাচ্ছেন। তিনি দুর্নিবার দুর্বিনীত ভাবে সামনে চলার পথ দেখান। তিনি ধ্বংসকে জয় করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি অসুন্দরকে সুন্দর করতে চান। তিনি নিজেকে ক্রমেই সামনের দিকে যেখানে নিয়ে গেছেন তা আপষহীন নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। সেখান থেকেই নতুন সূর্য ওঠার স্বপ্ন তিনি দেখান। তার কাছে আছে সাহসের মন্ত্র, ভয়কে জয় করার মন্ত্র:
ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক্! —
বধূরা প্রদীপ তুলে র্ধ!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর! —
তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক্!
তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক্! (প্রলয়োল্লাস)
৩.
কাব্য সৃষ্টিতে তার অভিনবত্ব এক সাহসী প্রতিভার পরিচয়ে পরিচিত করে। সেখানে তার সৃষ্টির নতুনত্ব আরো বলিষ্ট নজরুলকে তুলে ধরে। ভারতবর্ষব্যাপী বৃটিশ আধিপত্যবাদকে তিনি তুড়ি মেরেছিলেন। তিনি বন্দিশৃঙ্খল ভাঙার মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। ভাঙার মধ্যে দিয়ে তার নতুনত্বে আহ্বান ছিল। সেখানে ছিল অভিনবত্বের যা তার মতো করে আগে কেউ দেখাতে পারেনি। এখানে নজরুল নিজের স্বাতন্ত্র্যকে মেলে দিয়েছেন। তিনি কাউকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হবার সুযোগ দেননি। কেননা তার মতো কাব্যধারা তৈরি করতে তখনও কেউ পারেনি। এখনো কেউ পারেনি। তার শব্দ, বাক্য বক্তব্য, গঠন, আঙ্গিক যেমন স্বাতন্ত্র্য তেমনি প্রতিদ্বন্ধীতাহীন। তার এই প্রয়াস ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবেই তার পথের যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। ফলে তার পদচারণা ছিল বিস্ময়কর। যেমন তিনি বলছেল:
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন —
ঝন রনরন রন ঝনঝন!
সেকি দমকি দমকি
ধমকি ধমকি
দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি
ওঠে চোটে চোটে,
ছোটে লোটে ফোটে
বহ্নি-ফিনিকি চমকি চমকি
ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
রণ ঝনঝন ঝন রণরণ! (আগমনী)
তিনি ভাঙেন, তিনি নতুন করে নতুন আঙ্গিকে সৃষ্টি করেন। মেলে না তা কারো মতো। তিনি যেখানে বিদ্রোহী হবার সেখানে বিদ্রোহী আর যেখানে প্রেমিক হবার সেখানে প্রেমিক। তিনি যেখানে যা প্রয়োজন সৃষ্টির নবো উদ্বোধনে তা করার সাহস রাখেন। তিনি তার বক্তব্য কাব্যেই দিয়েছেন,
“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন বেদন!
আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!” (প্রলয়োল্লাস)
নজরুলের এই সাহস সঞ্চারী ধ্বনিগুলো এসেছে তার নিজের অদম্য সাহস থেকে। আর পরধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হবার প্রত্যাশা তাকে সাহস যোগায়। তার এই সাহস ভারতবর্ষের সংগ্রামী মানুষের প্রেরণা। অগ্নিবীণায় বিদ্রোহের যে সুর তুললেন তা ছড়িয়ে পড়ল মানুষের অন্তরে। সত্য সুন্দরের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, দাঁড়ালেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। তিনি হলেন বিদ্রোহী। তিনি নিজেকে প্রকাশ করলেন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের সমান্তরালে। জীবনবাস্তবতার কঠিন মুহূর্তে যেখানে জীবন আবর্তে জড়িয়ে মানুষ মুক্তির পথ চেয়ে থাকে। তিনি নিজে শান্ত হবেন না যতক্ষণ না তিনি তার মতো করে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না —
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না —
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত। (বিদ্রোহী)
প্রকৃতপক্ষে নজরুল যে যুগের মধ্যে দিয়ে এসেছেন সে যুগ তাকে জয় করার প্রয়োজন ছিল। সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রত্যয়দীপ্ত কাব্যপথের প্রয়োজন ছিল। ঔপনিবেশ পরিবেষ্ঠিত জীবনাচারণে অভ্যস্তদের জন্য প্রবল এক ঝড়ের প্রয়োজন ছিল যা ধূমকেতুর মতো আসবে। যা সব লণ্ডভণ্ড করার আহ্বান জানাবে। যেখান থেকে মানুষ প্রেরণা পাবে মানুষের মুক্তি পথের। সন্ধান পাবে সেই পথের। সেগুলো দেখায় আলোর পথের দিশা। প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণ-ভেরী, শাত্-ইল্-আরব, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী, মোহর্ম কবিতাগুলো কোনো না কোনো ভাবে প্রেরণা যোগায়। মানবতার মুক্তির কথা বলে। বলে আপন শিকড়ের কথা, করণী কি তার কথা। অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সেই পথকে উন্মোচিত করে।
আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ়তা ছাড়া বলিষ্ঠতা অর্জন কঠিন। নজরুল আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চিত্তের ছিলেন। তিনি এই জন্য বলিষ্ঠ ও দৃঢ়তার সাথে পথ চলতে পেরেছিলেন। সেই জন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে ‘আমি’তে স্থির থাকা। তাই তিনি বারবার আমি দিয়ে যে যাত্রা করেন তা তার প্রত্যয়ের পথে যাত্রা। যে ‘আমি’ আর কেউই এভাবে বলেনি।