কাজী জহিরুল ইসলাম
নজরুলের বর্ণাঢ্য জীবনে শুধু দারিদ্রই ছিল না, হাস্যরসেও তার জীবন ছিল পূর্ণ। পেয়েছেন অঢেল সম্মান, জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভিআইপি কবি, মাত্র ২৩ বছর বয়সে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে প্রশংসামূলক পত্র গ্রহণ করেন। এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাটকটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গ পত্রে সম্মান প্রদর্শন করে লেখেন ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’। জেলখানায় নজরুল অনশন করলে কবিগুরু টেলিগ্রাম পাঠিয়ে লেখেন, ‘তোমার কাছে আমাদের সাহিত্যের দাবী আছে’। অথচ তাঁর সমসাময়িক কবি জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণের অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এবং এই ব্যর্থতা তাকে পরবর্তি জীবনে খুবই হতাশ করে তোলে। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কোলকাতার আলবার্ট হলে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু বলেন ভারতবর্ষের এতো জায়গায় ঘুরলাম কিন্তু ‘দূর্গম গিরি কান্তার মরু’-র মতো অসাধারণ গান কোথাও শুনিনি। তিনি বলেন, একদিন যখন ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে তখন আমাদের জাতীয় কবি হবেন কাজী নজরুল ইসলাম। স্বাধীন ভারতের সরকার নেতাজীর কথার গুরুত্ব না দিলেও এই অমর কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
নজরুল মানে দুখু মিয়া; এক দরিদ্র শিশু বা সংগ্রামী কিশোরের মুখটিই আমরা দেখতে পাই। কিন্তু নজরুল যে একজন পরিপূর্ণ সফল মানুষ ছিলেন এটা আমরা ভেবে দেখি না। তিনি যখন যা করতে চেয়েছেন, যখন যা লিখতে চেয়েছেন, যখন যা বলতে চেয়েছেন ঠিক তা-ই করেছেন। চিন্তা এবং কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা সারা জীবন উপভোগ করেছেন। একজন মানুষ যখন তাঁর পছন্দমত জীবনকে যাপন করতে পারেন, তাঁর চেয়ে সফল মানুষ আর কে আছে। ভারতবর্ষের প্রথম বাঙালি মুসলমান চলচ্চিত্র নির্মাতা (পরিচালক) ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সত্যেন্দ্রনাথ দে’র সাথে যৌথভাবে তিনি ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিটির কাহিনীকার ছিলেন গিরীশচন্দ্র ঘোষ এবং তা মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারী। ১৯২৬ সালে তিনি কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচনও করেছিলেন। যদিও জয়লাভ করতে পারেননি।
আজকের এই রচনায় নজরুলের দারিদ্র নয়, দ্রোহ নয়, প্রেম বা মানবতার কথাও নয়, নয় তাঁর গানের সুর, বাণী বা দর্শন, তুলে ধরবো তাঁর রসবোধ। এ এক অন্য ভূবন।
তাঁর গান গাওয়া এবং গান সৃষ্টি নিয়ে প্রচুর মজার গল্প আছে, এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি। গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক শিল্পী। অডিশনের জন্য তাকে পাঠানো হল নজরুলের কাছে। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন। তিনি গান না গেয়ে শুধু কথা বলে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্দেশ্য নজরুলকে বোঝানো যে গান বিষয়ে তিনি সুপণ্ডিত। তিনি কোন কোন বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়েছেন তার ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন। কোন বিখ্যাত ওস্তাদ তার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন সেইসব বলে যাচ্ছেন কিন্তু গান শুরু করছেন না। লোকটি হঠাৎ বলে বসেন, আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের কথা কখনো শুনেছেন? শোনেননি বোধ হয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে। লোকটির বকবকানি আর পণ্ডিতি শুনতে শুনতে নজরুল বিরক্ত হয়ে বলেন, আপনি তো দেখছি একটা জানোয়ার লোক। কী বললেন? ভদ্রলোক নজরুলের কথায় খুব রেগে যান এবং বেশ উষ্মা প্রকাশ করেন। লোকটি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠলে নজরুল বলেন, না দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্পর্কে ‘জানোয়ার’ বিশেষণটি প্রয়োগ করলাম।
ক’দিন পরে সঙ্গীত শিল্পী ইন্দুবালা এসেছেন গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিং স্টুডিওতে। দোতলায় নজরুল বসে আছেন। এক কর্মচারী এসে বলেন, কাজীদা, ইন্দুদি এসেছেন, নিচে নামুন। তিনি হাসতে হাসতে কর্মচারীকে বলেন, আর কত নিচে নামব ভাই?
ক্রমশ নজরুল খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লিখেন, সুর করেন, শিল্পীদের গান শেখান, রেকর্ডিংয়ের আগে গান তুলে দেন। বেশিরভাগ গান গাইছেন তখন কে মল্লিক। একদিন মল্লিকের কাছে এক লোক এলো। তাঁর নাম অধ্যাপক জি দাশ। এসে মল্লিককে ধরলেন, আমি গান গাইতে চাই, আমার গান রেকর্ড করিয়ে দাও। এতো বড় কোম্পানিতে গান গাইতে হলে তো অডিশন দিতে হবে। অডিশন হয়ে গেল। অধ্যাপক বাবু শুধু ফেল করলেন না, একেবারেই অচল মাল। তাঁর গান নেওয়া হবে না শুনে অধ্যাপক এতোটাই ভেঙে পড়লেন যে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। মল্লিক বাবু তাকে যতোই শান্তনা দেন অধ্যাপক বাবুর কান্না ততই বেগবান হয় এবং তিনি হেঁচকি দিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। কান্নার শব্দে কোম্পানির বড়বাবু ছুটে আসেন। সব শুনে তিনি অধ্যাপক বাবুকে বলেন, আপনার তাল-লয়-সুর ঠিক থাকছে না, কিছুদিন চর্চা করে আবার আসুন, তখন দেখা যাবে গান নেওয়া যায় কিনা। অধ্যাপক বড়বাবুর কাছে এই বলে নালিশ করেন যে, কোম্পানির কয়েকজন লোক গান রেকর্ড করা হবে বলে তাঁর ট্যাঁকের টাকায় মিষ্টি খেয়েছেন। তারা বলেছেন, আপনি একজন অসাধারণ শিল্পী। তবে মল্লিক বাবু হিংসে করে আপনাকে কিছুতেই গাইতে দেবে না কারণ আপনি গান করলে মল্লিক বাবুর বাজার পড়ে যাবে। বড়বাবু বুঝতে পারেন লোকটি অতিশয় সরল। অধ্যাপকের কান্না কিছুতেই থামছে না। কি করা যায়? এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কী ব্যাপার? বলেই তিনি অধ্যাপকের কান্নার কারণ জানার চেষ্টা করতে লাগলেন। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। সব শুনে নজরুল বলেন, রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন ওর কাছ থেকে মিষ্টি খাওয়া হয়েছে তখন একটা গান তো রেকর্ড করতেই হবে। মল্লিক তখন চোখ কপালে তুলে বলেন, আরে কাজী’দা কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটি বদ্ধ উন্মাদ। কবি উত্তরে বলেন, আরে মল্লিক, হুজুগে বাঙালি। দেশটাও হুজুগেই মাতে। এই বলে অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে কবি বলেন, শোনো, তুমি কাল এসো, আমি শিখিয়ে তোমার গান রেকর্ড করিয়ে নেব। কবি নজরুল যখন বলেছেন, তিনি তা করবেনই। বড়বাবু আর মল্লিকের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে নজরুলের কাজে বাঁধ সাধে। কাজেই সকলেই তামাশা দেখার অপেক্ষায়।
গান রেকর্ডের সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। অধ্যাপক জি দাশের জন্য বিশেষ গান লিখলেন কবি। অধ্যাপককে কানে কানে বললেন, এই গানের কথা গোপন রাখতে হবে, রেকর্ড বাজারে যাওয়ার আগে কাউকে বলা যাবে না। দীর্ঘ সময় ধরে রিহার্সাল হল। গানের কথাগুলো হচ্ছে-
কলাগাড়ি যায় ভষড় ভষড়
ছ্যকরা গাড়ি যায় খচাং খচ
ইচিং বিচিং জামাই চিচিং
কুলকুচি দেয় করে ফচ…
এমন অদ্ভুত গান শুনে উপস্থিত অন্যরা হেসে গড়াগড়ি যায়। পরের দিন আরো একটি গান লিখে আনলেন কবি। রেকর্ডের দুই পিঠের জন্য দুই গান। এটিও শেখানো হল।
মরি হায় হায় হায়
কুব্জার কী রূপের বাহার দেখো
তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা
উপুড় করলে হয় সাঁকো
খুব গোপনে প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। এমন কী রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হল না কাকে দিয়ে কী গান রেকর্ড করা হচ্ছে। গান রেকর্ড হলো এবং তা যথারীতি বাজারে ছাড়া হল। দুদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বলেন, মার্কেটে খোঁজ নিয়ে দেখো তো গান দুটো বিক্রি হচ্ছে কেমন? বাজার থেকে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বলেন, কাজীদা খুব বিক্রি হচ্ছে আপনার ওই অদ্ভুত গান দুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলাগাড়ি যায় ভষড় ভষড়…
কোম্পানির ম্যানেজার তো দারুণ খুশি। বড়বাবু মল্লিককে ডেকে বলেন, তুমি তো বলেছিলে লোকটা পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে। আরও দু’একটা নাও না ওর গলায়। মল্লিক বাবু দৌড়ে এসে কবিকে কর্তার প্রস্তাব জানালে কবি হাসতে হাসতে বলেন, মল্লিক, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগের মাল একবারই চলে। বাঙালির হুজুগ দ্রুত গরম হয় আবার দ্রুতই ঠান্ডা হয়ে যায়। বলেই জোরে জোরে হাসতে শুরু করলেন নজরুল।
কিছুদিন পর শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গজল লেখানোর জন্য নজরুলকে খুঁজছেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে পাওয়া গেল না। এখানে-সেখানে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজলেন কিন্তু কোথাও তাঁকে না পেয়ে চলে এলেন কবির বাসায়। বাসায় গিয়ে দেখেন গভীর ধ্যানে মগ্ন কবি। টেবিলের ওপর ঝুঁকে ধ্যানস্থ হয়ে কী যেন লিখছেন। আব্বাস উদ্দীনের সাথে কোনো কথা না বলে হাতের ইশারায় কবি তাকে বসতে বলেন। আব্বাসউদ্দীন বসে বসে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করতে করতে জোহরের নামাজের অক্ত হয়ে যায়। আব্বাসউদ্দীন তখন উসখুস করছেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে নজরুল বলেন, কী তাড়া আছে? যেতে হবে? আব্বাস উদ্দীন বলেন, না ঠিক তাড়া নেই, তবে জোহরের অক্ত হয়ে গেছে তো, নামাজ পড়তে হবে। আমি এসেছি একটি ইসলামী গজল নিতে। ওটা না নিয়ে কিন্তু যাচ্ছি না।
নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাকে খুব দ্রুত একটি পরিষ্কার চাদর বের করে বিছিয়ে দেন। এরপর আব্বাস উদ্দীন জোহরের নামাজ আদায় করেন। তিনি সালাম ফিরিয়ে কবির দিকে তাকাতেই কবি তাঁর হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই নাও তোমার গজল’। গজলটি হলো –
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ।
আমি গোনাহগার বে-খবর
নামাজ পড়ার নাই অবসর
তব, চরণ-ছোওয়ার এই পাপীরে কর সরফরাজ।।
তোমার অজুর পানি মোছ আমার পিরহান দিয়ে
আমার এই ঘর হউক মসজিদ তোমার পরশ নিয়ে
যে শয়তান ফন্দিতে ভাই
খোদার ডাকার সময় না পাই
সেই শয়তান থাক দূরে (শুনে) তকবীরের আওয়াজ
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।।
যখন-তখন লিখতে পারতেন নজরুল। এই গজলটির মতো অনুরোধে অথবা কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে তাঁর অনেক লেখা।
তখন ছোটোদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন কবি আলী আকবর। তিনি তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি নজরুলকে দেখাতে নিয়ে আসেন। নজরুল বলেন, আপনার ছড়াগুলো তেমন ছোটোদের উপযোগী হয়নি। আপনি যদি চান তো আমি একটি ছড়া লিখে দিতে পারি। তখনই আলী আকবর সাহেব নজরুলকে অনুরোধ করেন তিনি যেন একটি ছড়া লিখে দেন। আর নজরুলও বসে গেলেন। তৈরী হয়ে গেলো সেই বিখ্যাত ‘লিচু চোর’ ছড়াটি।
বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু বিয়ের আগে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাবা-মায়ের সাথে বসবাস করেছেন। যখন বনগ্রামে থাকতেন, ১৯৩১/৩২ সালের দিকে, নজরুল প্রথম সেই বাড়িতে আসেন। ঝড়বাদলের মধ্যে ঘরে ঢুকেই বলেন, তুমিই তো রানু, ঠিক ধরেছি না? তখন তিনি মাসখানেক ঢাকায় ছিলেন, এই একমাসে রাণু সোমকে অনেকগুলো গান শিখিয়েছেন। সকলেই জানে নজরুল খুব পান খেতেন আর চা পান করতেন। একদিন নজরুল গান শেখাচ্ছেন রানুকে, রানুর মা সর্যূবালা বড় এক পেয়ালা চা নিয়ে এলেন, চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়েই নজরুল গেয়ে ওঠেন, ‘এতো চা এই পেয়ালাতে ঢেলে গো আনলে বলো কে?’ এর পরেই তিনি তৈরী করে ফেলেন সেই বিখ্যাত গান ‘এতো জল ও কাজল চোখে আনলে বলো কে’।
নজরুলকে বাংলা কাওয়ালী কিংবা গজল লিখতে আব্বাস উদ্দীনই অনুপ্রাণিত করেন। নজরুল তখন ম্যাডন থিয়েটারের একজন গীতিকার ও সুরকার। আব্বাস উদ্দীন একদিন নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে সেখানে আসেন। এসেই বলেন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দূ কাওয়ালী গানের রিহার্সাল করছেন। বাজারে আজকাল এসব গান খুব ভালো চলে। আপনি বাংলায় এমন কিছু গান লিখুন। নজরুলের পাশে বসে থাকা গ্রামোফোন কোম্পানির বাঙালি বাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, না, না, বাংলায় ওসব হয় নাকি? ওসব চলবে না বাজারে। কিছুদিন পর বাবু রাজী হলে (আব্বাস উদ্দীনই তাকে রাজী করান) আব্বাস উদ্দীন ছুটে গিয়ে নজরুলকে বলেন, কাজী’দা কর্তা রাজী হয়েছেন, আপনি বাংলা কাওয়ালী লিখুন। কথাটি শোনার সাথে সাথে নজরুল উঠে পাশের একটি রুমে গিয়ে ঢোকেন। ১৫/২০ মিনিট পরে ফিরে এসে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, এই যে নাও। সেটি ছিল, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।
শব্দ ও মানুষের নাম নিয়েও ছিল তার বুদ্ধিদীপ্ত হাস্য-কৌতুক। যেমন এরিস্টোক্র্যাট শব্দের বাংলা করেছিলেন তিনি ‘আড়ষ্টকাক’। রজনীকান্ত দাসকে বলতেন ‘সজনে ঘন্ট খাস’।
নজরুল তাঁর বন্ধু শৈলেনের কাছ থেকে চা খাওয়ার ফন্দি-ফিকির আঁটতেন। একদিন বলেন, তুমি তো আমার কাছে অনেক টাকা পাবে, এবার আমাকে চালাক বানাও, দুপেয়ালা চা খাওয়াও। শৈলেন তো অবাক, অনেক টাকা পাওনা বা চালাক হওয়ার সাথে দু’পেয়ালা চায়ের কি সম্পর্ক? নজরুল বলেন, লাখ পেয়ালা চা খেলে লোকে চা-লাখ (চালাক) হয়, তখন তাঁর হাতে টাকা-পয়সা আসে। লাখ পেয়ালা হতে আমার আর দু’পেয়ালা বাকী আছে। দাও দু’পায়ালা চা খেয়ে চালাক হই, তারপর টাকা- পয়সা আসুক, তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেব। গান, পান আর চা এই তিনে ছিল তাঁর বড়ই আসক্তি। তাঁর নিজের একটি পানপাত্র ছিল যেটিতে পঞ্চাশটি পানের খিলি থাকত। তিনি নিজেই সেটিকে পানের সিন্ধুক নাম দিয়েছিলেন। কেউ তাকে, ‘এতো পান খান কেন?’ জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, গান গাই যে। তবে একবার খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন এক সুদর্শনা। নারীটি অতিশয় এরিস্টক্র্যাট মানে ‘আড়ষ্টকাক’। খুব স্মার্টলি নজরুলকে বলছেন, আপনি কি পানাসক্ত? নজরুলেরও স্মার্ট জবাব, আমি বেশ্যাসক্ত। এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। স্মার্টনেস মুহূর্তেই ম্লান। পরিবেশ হাল্কা করার জন্য নজরুল হাসতে হাসতে বলেন, আমি একটু বেশিই আসক্ত তো, তাই বেশ্যাসক্ত শব্দটি ব্যবহার করেছি।
সাহিত্যিক আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। কারো মতে কবি তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, কারো মতে কোনো এক সম্মেলনে যোগ দিতে সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলেন। দুপুরে খেতে বসে সিরাজী সাহেব কবির পাতে আরো এক টুকরো ইলিশ ভাজা তুলে দিতে গেলে তিনি চেঁচিয়ে বলেন, আরে করো কী, করো কী! আমাকে যে বেড়ালে কামড়াবে। এতো ইলিশ খেলে তো গন্ধে বেড়াল আমাকে মাছ ভেবে কামড়াতে শুরু করবে। খাওয়া দাওয়া শেষে দই পরিবেশন করা হয়। তিনি দই মুখে দিয়েই বলেন, তোমরা কী তেতুল গাছ থেকে দই পেড়ে আনো? লজ্জায় গৃহস্থের মাথা কাটা যায়। দই অধিক টক ছিল বলেই না এই অপমান।
কোনো এক গ্রাম ঘুরে এসে তিনি সওগাত পত্রিকার অফিসে ঢুকে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, “আল্লারে, বিল্লা অক্করে হাল দিয়া উতকা মাইরা বাইরে পৈড়্যা গেছে। আমি জমাইছি মেকুরডা চাইয়া দেহি বিল্লিডা’। ঘরশুদ্ধ লোক হেসে অস্থির। তিনি বলেন, ওই গ্রামের এক বাড়ির জানালা দিয়ে একটি বেড়াল লাফ দিয়ে বাইরে পড়ায় কী ঘটেছিল তা একজন বলছিল। সেটিই আমি ওই লোকের ভাষায় বললাম। সওগাতের তখন বার্ষিক বেরুবে বলে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, দশ মাস মাসিক বেরিয়ে এবার বার্ষিক বেরুচ্ছে।
একজন অবাঙালি ভদ্রলোক নজরুলের খুব ভক্ত ছিলেন। নানানভাবে তিনি কবিকে সাহায্য করতেন। একবার নজরুলের বাড়িতে হিন্দি বনাম বাংলা ভাষা নিয়ে বিতর্ক জমে ওঠে। ওই অবাঙালি ভদ্রলোকও সেই আড্ডায় ছিলেন। তিনি হিন্দি ভাষার পক্ষে ওকালতি করতে গেলে নজরুল বলেন, তোমাদের হিন্দি হচ্ছে শেয়াল-কুকুরের ভাষা। ভদ্রলোক কিছুটা অপমানিত বোধ করেন এবং প্রশ্ন করেন, ‘কেঁও’। নজরুল বলেন, এই তো কুকুরের মতো ডাক দিলে। তিনি তখন হাসতে হাসতে বলেন, ‘হুঁয়া হুঁয়া’ নজরুল সাথে সাথে বলেন, এই তো আবার শেয়ালের ডাক দিলে। এজন্যই বলি, হিন্দি হচ্ছে শেয়াল-কুকুরের ভাষা।
সুফিয়া কামাল নজরুলকে দাদু বলে ডাকতেন। নজরুল প্রায়ই তাঁর বাড়িতে যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। তিনি যেখানেই যেতেন গোয়েন্দার লোকটি কোনো না কোনো অজুহাতে সেখানেই গিয়ে হাজির হতেন। একদিন সাহিত্যের আসরে লোকটির মুখের ওপর দাঁড়িয়ে নজরুল কবিতা পড়ছেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকই’। কবিতার ধরণ শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে চলে যান। সুফিয়া কামাল বলেন, দাদু, তুমি চিনলে কেমন করে? নজরুল বলেন, গায়ের গন্ধে, বড় কুটুম যে।
নজরুলের বন্ধু মইনুদ্দীন থাকেন বেচু ঠাকুরের গলিতে, কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। তিনি একদিন কাজী নজরুল ইসলামকে দাওয়াত করেন। নজরুল সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে এসে মঈনুদ্দিনের ঘরে ঢুকলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে বাসাটি দেখতে লাগলেন। কবি জিজ্ঞেস করেন, এটা কী রে? বন্ধুর উত্তর, রান্নাঘর। আর ওটা? মঈনুদ্দিন বলেন, পায়খানা। কবি বলেন, ধুর শয়তান, পায়খানা কী-রে, ওটা হচ্ছে ‘যায়খানা’। সব খানা তো ওখান দিয়েই যায়। তাঁরপর ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে হো হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাঁর এই প্রাণ খোলা হাসির প্রশংসা করে লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু অনেক পরে এসে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র স্বতন্ত্র কবি বললেও, অনেকদিন তাকে ধর্তব্যের মধ্যে নেননি। এর পেছনে ব্যক্তিগত একটি কারণও থাকতে পারে। কারণ তাঁর স্ত্রী রানু সোমের সাথে নজরুলের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল বলে অনেকেই ধারণা করেন। এই ধারণা মোটেও অমূলক হবার নয়, অমন সুন্দরী কিশোরীকে বাড়ি গিয়ে, একা একা, একমাস গান শিখিয়েছেন নজরুল আর তাঁর সাথে হৃদয়ঘটিত কিছুই ঘটেনি তা কী করে হয়।
নজরুল ছিলেন প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এক মানুষ। সারাক্ষণ আসর মাতিয়ে রাখতেন। হাস্যরস, গান, পান, চা আর হৈ হুল্লোড় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। একদিন নজরুলের নিজের পত্রিকা ধুমকেতুর অফিসে এসে গোপীনাথ নামের এক লোক নানান রকম আজগুবি কাণ্ড-কারখানা দেখে কবিকে বলেন, আপনাদের মনে এতো আনন্দ আসে কোত্থেকে? নজরুল চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বলতেন ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’। এটি ছিল তাঁর আনন্দ প্রকাশের একটি অভিব্যক্তি। তিনি গোপীনাথের প্রশ্ন শুনেও বলেন, দে গরুর গা ধুইয়ে। আনন্দ কোত্থেকে জাগে তাঁর উত্তর নেই। কিন্তু নিরানন্দ কেন হবে তাঁর উত্তর শুনতে চাই তোমার কাছে।
গোপী বলেন, দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচারে অতীষ্ট সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কীভাবে? প্রতিটি ইংরেজ আমাদের শত্রু, তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর আমরা হাসব, গাইব?
নজরুল তাঁর ভরাট কন্ঠে গোপীকে বলেন, শত্রুদের ভাসিয়ে দিতে চাই প্রাণবন্যা, এরই আবাদ করছি আমরা এখানে। গোপীনাথ স্তব্ধ হয়ে যায় নজরুলের জবাব শুনে।
সাহিত্যের সকল শাখায়ই বিচরণ করেননি শুধু এমন কী তিনি বিজ্ঞাপনের ভাষাও লিখে দিয়েছেন। ডোয়াকিন অ্যান্ড সন্স বাদ্যযন্ত্রের কোম্পানি নজরুলের কাছে বায়না ধরলো, তাদের জন্য একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে হবে।
তিনি সাথে সাথে লিখে দিলেন –
কী চান? ভালো হারমোনি?
কাজ কী গিয়ে জর্মনী?
আসুন, দেখুন এইখানে
যেই সুর সেই গানে
গান না কেন, দিব্যি তাই
মিলবে আসুন এই হেথাই
কিননি কিন, ডোয়াকিন…
পার্ক সার্কাস এলাকায় আরো একটি বাদ্যযন্ত্রের কোম্পানি ছিল। বাহাদুর কোম্পানি। ডোয়াকিনের হারমোনিয়াম ভালো বিক্রি হচ্ছে দেখে ওরাও এসে ধরলো নজরুলকে। তাদের দাবী, ওদের কোম্পানির জন্যেও এমন একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে হবে। কী আর করা। তাদের জন্যও লিখে দিলেন –
মিষ্টি বাহা বাহা সুর
চান তো কিনুন বাহাদুর
দুদিন পরে বলবেনা কেউ দূর দূর
যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর
করতে চান কী মনের-প্রাণের ‘আহা’ দূর
একটিবার ভাই দেখুন তবে বাহাদুর…
মোসলেম ভারত পত্রিকায় দুটো কোম্পানির বিজ্ঞাপনই পাশাপাশি ছাপা হতো এবং দুটো কোম্পানির বাদ্যযন্ত্রের বিক্রিই বেড়েছিল।
যখন তখন ছড়া-কবিতা বানিয়ে ফেলতে পারার কারণে শৈশব থেকেই তাঁর কাব্যপ্রতিভা সকলের নজর কাড়ে। রুটির দোকানে আটা ময়াম দিতে দিতে গরমে ঘেমে বানিয়ে ফেললেন দু’লাইন –
মাখতে মাখতে গমের আটা
ঘামে ভিজল আমার গা টা।
খুকী ও কাঠবেড়ালি কবিতাটি কীভাবে তৈরী হল সেই গল্পটি বলি।
কুমিল্লায় গিয়ে তিনি উঠেছেন ইন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়িতে। ভোরে জানালা খুলে দেখেন একটি ছোট্ট মেয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তিনি ভেবেছিলেন বুঝি গাছের ওপর কেউ উঠেছে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। তিনি বেরিয়ে বাগানে চলে যান। গিয়ে দেখেন, না, গাছে তো কেউ নেই। জিজ্ঞেস করলেন, খুকী তুমি কার সাথে কথা বলছো? ছোট্ট মেয়েটি বলে, ওই কাঠবেড়ালির সঙ্গে। ও রোজ এসে পেয়ারা খেয়ে যায়। আমি ওকে ধমকে দিচ্ছে, আর যেন পেয়ারা খেতে না আসে। কাঠবেড়ালির সাথে খুকীর এই কথা বলা নিয়েই তিনি লিখে ফেলেন, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ কবিতাটি।
নজরুল যেমন আমুদে ছিলেন তেমনি মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। কখনো কাউকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতেন না। অবশ্য নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা তেমন কথা বলতেন না, বরং তাঁর কথা শুনতেই সকলে ভালোবাসতেন। তিনি যেমন শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন, তেমনি হামদ ও নাত রচনা করেছেন, গজল-কাওয়ালী লিখেছেন। সকল ধর্মের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আবার কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে কলমও ধরেছেন। বড়ু চণ্ডিদাশের মহান বাণী, ‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই,’ নজরুলের কন্ঠে বেজে ওঠে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীহান’। সারা জীবন ধরে তিনি মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন।
হিন্দু মেয়ে আশালতা বা প্রমীলা দেবীকে নজরুল বিয়ে করেন ধর্মান্তরিত না করে। তাঁরা হিন্দু এবং মুসলিম দুই রীতিতেই বিয়ে করেছেন। তাঁরা তাঁদের চার সন্তানের নাম রাখেন দুই ধর্ম থেকে নাম নিয়েঃ কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ। প্রমীলা দেবী সারা জীবন দুই ধর্ম মেনে চলেছেন। নামাজ পড়েছেন আবার শাঁখা, সিঁদুরও পরেছেন। মৃত্যুর পরেও প্রমীলাকে দুই ধর্ম মেনেই সৎকার করা হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন দৃষ্টান্ত উপমহাদেশে বিরল। এর সবই হয়েছে নজরুলের ইচ্ছায় এবং তাঁর উদার, অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে।
নজরুল ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই এক অপাপবিদ্ধ হৃদয়ের মানুষ। একটি ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত তিনি পূর্ণ গুরুত্ব দিতেন। আর একটি ঘটনা বলেই রচনাটি শেষ করছি। একবার তিনি এক বাড়িতে রিহার্সালে গিয়েছেন। পাশের বাড়িতে একটি বাচ্চা গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছে। শিশুটির সাথে নজরুলের কথা হয়। আলাপচারিতায় জানতে পারেন শিশুটি কোলকাতা শহর দেখতে চায়। নজরুল তাকে শহর দেখাবেন বলে কথা দেন। কিন্তু কবিসুলভ অস্থিরতার কারণে তিনি তা ভুলে যান। পরেরবার যখন আবার দেখা হয় তখন প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে। তিনি তখন শিশুটিকে নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে সারা কোলকাতা শহর ঘুরে বেড়ান। ফিরে এসে দেখেন ট্যাক্সিভাড়া দেবার মত যথেষ্ট অর্থ নেই তাঁর কাছে। তখন সেই ট্যাক্সি নিয়েই এক বন্ধুর বাড়িতে যান। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া মেটান। বন্ধু জিজ্ঞেস করেন, কি পেলে নিজের টাকা ব্যয় করে একটি শিশুকে কোলকাতা শহর দেখিয়ে? তাঁর ঝলমলে মুখে ভোরের উজ্জ্বল আলো, তিনি বলেন, শিশুটির নির্মল হাসি।
[নোট : এই রচনার ঘটনাসমূহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত। কেউ কেউ হয়ত কোনো কোনো অংশ বা পুরোটাই আগেও পড়েছেন। এমনটি ঘটে থাকলে দ্বিতীয়বার পড়ানোর অপরাধ ক্ষমা করবেন।]
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৬ আগস্ট ২০১৯।