spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধনয়ন আহমেদ : কুরআনিক মূল্যবোধের কবি

লিখেছেন পথিক মোস্তফা

নয়ন আহমেদ : কুরআনিক মূল্যবোধের কবি

পথিক মোস্তফা

নব্বই দশক থেকে শুরু করে বাংলাসাহিত্যে এ যাবৎ কালের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ শক্ত একটা অবস্থান করে নিয়েছেন কবি নয়ন আহমেদ। কবিতায় নয়ন আহমেদ তাঁর ভাষা, চিত্রকল্প, উপমা, রূপক ব্যবহারে এক নয়নীয় পরিমণ্ডল তৈরি করে নিয়েছেন ইতোমধ্যে। তিনি বরিশালের অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা এক সাধক কবি। সহজ-সরল জীবনযাত্রার অসাধারণ পরিণত কাব্যবোধের কবি নয়ন আহমেদ। তিনি তাঁর মননের পুরোটা জুড়েই মহান আল্লাহর অস্তিত্বে ও মহত্ত্বে বিশ্বাসী। তাঁকে বলা হয় কোরআনিক ভাষার কবি। আল্লাহর অপার সৃষ্টির সৌন্দর্য-বিলাস কবি লিখে যান আধুনিক ভাষার ঐশ্বর্যে। কতিপয় কথিত প্রগতির লেবাশধারীর ঈর্ষায় কবি কখনো মৌলবাদী হিসেবে গালি হজম করলেও কবিতার বিশালতায় কবির যে নিজস্ব সাম্রাজ্য তৈরি হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে সেই রাজ্যের তিনি সম্রাট হবেন, তা তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা স্বীকার করে নিয়েই তাঁকে দাবিয়ে রাখার অস্ত্র খোঁজে। কিন্তু কবি নয়ন আহমেদ অদম্য, সহজ-সাবলীল মুখের কোণে হাসির রেখা জড়িয়ে রেখে কবিতার ঔজ্জ্বল্য দিয়েই প্রতিপক্ষের কালিমা হটান। সব সমালোচনার আল মাড়িয়েই কবি হাঁটেন বিশ্বাসের রাজপথে। যেমন, সাহিত্য বিশ্লেষকদের তাঁর সম্পর্কে মত হলো– ‘নয়নের বাক্য গঠন কোরানিক অথচ তা অত্যন্ত নতুন, অত্যন্ত মডার্ন। তাঁর কাব্যভাষা তাঁরই নির্মাণ– এক্ষেত্রে তাঁর কক্ষে তিনি অনন্য সাধারণ। তাঁর শব্দ প্রয়োগেও রয়েছে নিজস্ব ভঙ্গিমা। যা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নতুন।’  

কবি নয়ন আহমেদ-এর পিতৃদত্ত বা পোশাকী নাম গোলাম কিবরিয়া। তিনি ১৯৭১ খ্রি. ১৫ অক্টোবর ঝালকাঠি জেলার নলছিটির ভবানিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা– মৌলবি মোহাম্মদ আবদুর রব ও মাতা– আলেয়া বেগম। কবির শৈশব-কৈশোর কাটে নিজ গ্রামের দুরন্ত মাঠে-ঘাটে। ছোটোবেলা থেকেই স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন। তাইতো নিবিড় প্রকৃতিপ্রেম হয়ে উঠেছে কবির কবিতার ভালোবাসা। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রামের বিদ্যালয় থেকেই সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি বরিশাল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। কবি বাংলা সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বরিশাল সরকারি বিএম কলেজ থেকে। ছাত্রজীবন থেকেই কবি বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল, আজকের বার্তাসহ কয়েকটি দৈনিকের সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি হিজলার একটি স্নাতকমানের মাদরাসায় বাংলায় অধ্যাপনা শুরু করেন। দীর্ঘ বছর তিনি এই নিভৃত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের ব্রত পালন করে আসছেন। তাঁর মেধা ও যোগ্যতায় আরো বড় প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সুযোগ থাকলেও তিনি তা করছেন না, কারণ তিনি এক নিভৃতচারী সাধক। প্রচারবিমুখ এই কবি গ্রামীণ প্রকৃতির কাছাকাছি থেকেই সাহিত্যের নিরলস সাধনা করে যাচ্ছেন। 

কবি নয়ন আহমেদের প্রথম লেখা প্রকাশিত বিএম কলেজ বার্ষিকীতে– একটি ছোটোগল্প। এছাড়াও দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল, বিপ্লবী বাংলাদেশ, দৈনিক প্রবাসী, মাসিক কলম প্রভৃতি পত্রিকার তাঁর বেশকিছু গল্প প্রকাশিত হয়।  তবে পরবর্তীতে কবি ছোটোগল্পে খুব একটা মনোনিবেশ করেননি। এই মেধাবী কবি সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ করবেন বলে বিভিন্ন সময় মত ব্যক্ত করেন। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত বিএম কলেজরই একটি ম্যাগাজিনে, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯০-এর ভাষাদিবসে। শিরোনাম ছিলো– ‘ঘর ও আঙ্গিনার কাব্য’ নামে একগুচ্ছ কবিতা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবি নয়ন আহমেদের কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাসাহিত্যের প্রধানতম কবি আল মাহমুদও কবি নয়ন আহমেদের কবিতার প্রশংসা করেছেন তাঁর লেখা সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ ‘নব্বইয়ের কবিতা: গোধুলিসন্ধির নৃত্য’। বাংলাদেশের বহুসংখ্যক সাহিত্য পত্রিকায় কবি নয়ন আহমেদের কবিতা ও তাঁর সম্পর্কে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে– এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বগুড়া থেকে প্রকাশিত ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’, বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘শেকড়’, ‘প্রভা’ ও ‘যোগফল’, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘পরিলেখ’, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মসলিন’, ‘সড়ক’, ‘কবিধ্বনি’ প্রভৃতি। 

কবির ২০২৩ খ্রি. পর্যন্ত নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো– অসম্ভব অহংকার (১৯৯৬), বাসা বদলের গল্প (২০০৪), আমার বিবাহিত শব্দরা (২০১০), খনিঘুম (২০১৫), এককাপ গণযোগাযোগ (২০১৮), মারেফত সিরিজ (২০১৯), নাতিদীর্ঘ দুপুরের ধ্বনি (২০১৯), কিছু মেরুদণ্ডী উচ্ছ্বাস (২০২০) ও তাঁর নাম আহমাদ (২০২৩)। এই প্রতিভাবান নব্বই দশক ও তৎপরবর্তী কবিদের অন্যতম সেরা কবি নয়ন আহমেদ এখনো তাঁর সৃষ্টি-সাধনার যোগ্য পুরস্কার বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেননি। তবুও কয়েকটি সাহিত্য সংগঠন তাঁদের ভালোবাসার স্মারক প্রদান করেছে কবিকে। এর মধ্যে– শব্দশীলন সাহিত্য পুরস্কার-২০০৮, রকি সাহিত্য পুরস্কার-২০১০ ও পরিচয় সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮ উল্লেখযোগ্য।  

কবি নয়ন আহমেদ একজন আপদমস্তক বিশ্বাসী কবি। তিনি সম্পূর্ণই মহান আল্লায় আস্থাশীল কবি। সংশয়বাদীদের দলে তিনি নন। তাঁর কবিতার প্রতিটি বর্ণ-বয়নে লেগে থাকে অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ। তিনি খ্যাতির ঊর্ধ্বে থেকে কবিতার চাষাবাদ করেন। গোধূলির আবির আর প্রভাতের আলো মেখে বেড়ে ওঠে কবির কবিতার শরীর। আর সব কিছুর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান স্রষ্টার নিবিড় অস্তিত্ব। কবি নিজে এবং তাঁর লেখনি সম্পূর্ণই গড়ে ওঠে পবিত্রতম শব্দের ইট-কাঠে। তাঁর কবিতায় আছে মানব-মানবীর জাগতিক প্রেম, সাংসারিক জীবনের দুঃখ-বিরহ-ভালোবাসা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাবলীল বিবরণ, আর প্রভুর প্রেমের অনির্বচনীয় আধুনিক বয়ান। কবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি খুব নিপুণ হাতে সাধারণ দৃষ্টির বাইরে গিয়েও দেখা বস্তুর মাঝে অদেখা স্রষ্টার অস্তিত্ব ফুটিয়ে তোলেন কী নিখুঁত কারুসৌকর্যে! এজন্য কবির এক অনন্য জগৎ তৈরি হচ্ছে। তাইতো বিরুদ্ধবাদীরাও কবির কবিতায় ধর্মের ব্যবহারকে কোনোক্রমে খাটো করার সাহস দেখান না। এ ক্ষেত্রে তিনি এক কুশলী কারিগর। কবির কবিতার বিষয়াঙ্গিক সম্পর্কে নিজেই বলেন-‘আমার মনে আছে– প্রথম মানব-মানবীর কথা। পৃথিবী চাষবাসের কথা–পৃথিবীর ইতিহাসের কথা, সভ্যতার কথা। আমি নূহের সাথে ছিলাম তাঁর নৌকোয়, ঈসার সাথে ছিলাম, নবি মুহাম্মদের সা. সাথে ছিলাম এবং সর্বত্র থাকি আমি– আমি ভবিষ্যতেও থাকবো। আমি কবিতায় সভ্যতা-সংস্কৃতির এই দিকটাকে তুলে আনি, ফুল ও ফসলের ঘ্রাণ আনি, নারীর প্রেম আনি, সূর্যের সাথে উঠি আমি তাই আলো আনি– মার্কস-লেনিন সেখানে ডুবে যায়, তাদের অসারত্ব পাঠ করি প্রিয় কোনো গ্রন্থের মতো– অনন্তলোক আরো বেশি ভালোবাসি বলে মাটি থেকে একটা উঁচু মই সেখানে স্থাপন করি। এই কাজটাই করতে চাই কবিতায়।’ একজন কবিমাত্রই তাঁর রঙিন রাজ্যে গড়ে তোলেন সোনালি শব্দের বাগান। চিত্তাকর্ষক শব্দ আর বাক্যের মোহনীয়তায় পাঠককে টেনে আনার আর ধরে রাখার দায় কবির নয়; এটা কেবল কেতাবি বাক্য। আসলে কবি-সাহিত্যিক পাঠককে আকর্ষিত করার কৌশল নেন বটে। আর সেই টান তৈরি করতে গিয়ে কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক হয়তো মনে করেন, অশ্লীল ভালগারিজমে কাব্য বা গদ্য শরীর ভরে দিলে সমকালীন পাঠক তো তালি বাজাবেন; আর মরে গেলে পৃথিবীর মানুষেরা কে কী বিচার-বিশ্লেষণ করলো সাহিত্যের, কবিতার তাতে কি-ই বা আসে যায়। এমনটি সর্বৈব যে সঠিক, তা নয়। তবে বেশির ভাগ কবি-সাহিত্যিকেইতো আজকাল দেখি, ধর্ম নিয়ে বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে গাত্রদাহ হতে কিংবা কুরুচিকর শব্দের ইঙ্গিতময় পোজ দিয়ে কবিতার বা গদ্যের ক্যানভাস সাজাতে, তাই এ কথা বলা। কিন্তু নিজের কাব্যগাঁথুনিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে মোটেও শঙ্কিত নন কবি নয়ন আহমেদ। তিনিই এ সম্পর্কে বলেন– ‘কবিতায় ধর্মের ব্যবহারে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে আত্মস্থ করে কাব্য চর্চায় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। নজরুলে কি আমরা ধর্মের ব্যবহার দেখি না? তাঁর ‘খেয়াপারের তরণী’ কী কথা বলে? তাঁর অনেক কবিতাই তো ধর্মের বিশাল বলয়কে ধারণ করেছে। তিনি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। ফররুখে আমরা কী দেখি? তাঁর ‘সাতসাগরের মাঝি’ গ্রন্থটিতে ধর্মের ব্যবহার কি ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেনি? আজকের আল মাহমুদও লোকজ জীবনের পাশাপাশি ধর্মীয় মিথ-ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন সচেতনতার সাথে। তবে মনে রাখতে হবে–সবার আগে চাই কবিতা, কবিতা করে তোলা। শ্রেষ্ঠ বা মহৎ কবিতায় ধর্মের আবেগ জড়াজড়ি করে থাকতে পারে। আর এখানে ধর্ম শাশ্বত দর্শনেরই সমার্থক বা প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে। কবিতা সবকিছুর সমন্বয়ে নিজেই একটি ধর্ম– একটি বিকল্প ধর্ম। ধর্মের ব্যবহার করলেও তা বিকল্প। তা কখনোই ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে না; তা কবিতাই, একমাত্র কবিতা। আমি কুরআন থেকে অনেক রহস্য উদ্ধার করি, কিন্তু কুরআন লিখি না। তার ভাষা আমাকে মুগ্ধ করে, কিন্তু আমার ভাষা কুরআন হয় না। আমি কবিতারই লোক–আমি সবকিছুই কবিতা করে ফেলি। আমি ভাষাকে বইয়ে যেতে দেই প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে– জনস্রোতের মধ্যে; কিন্তু রহস্য রেখে দেই আমার হাতে– ও আমারই সৃষ্ট, ও আলাদা। তাই চোখে পড়বে ও তো কবিতা-সুন্দরী। কেন ধর্মের ব্যবহারে কবিতা অসুন্দর হবে? আমি নিশ্চিত– এতে কবিতা আলোময় হয়ে উঠবে।’ এই যে কবির বিশ্বাস, যে কবির কবিতায় এমন চরণ বোনেন, সেই কবি নিশ্চয়ই বিশ্বাসী কবিদের অন্তর্ভুক্ত। কবির ভাষা এমন–

আর দ্যাখো, আমি কবি আল্লা’র রঙে; সবরকম ক্রোধের ঊর্ধ্বে যাই।

ঘৃণার ব্রিজ তুচ্ছ করে যাই।

ঐ সুন্দরী কন্যাটির টেবিল-ক্লথ ধরে যাই।

জানালায় আমার কন্যাই হাত নাড়ে; মানে সালামের বিনিময়

আমি বিনিময়ের গম্বুজ ধরে যাই

সুন্দরতম প্রত্যুষের ইঙ্গিত নিয়ে যাই।

আমি যেতে থাকি

… … … … …

অভিযোগকারীবৃন্দ, দরোজায় কেন ঘৃণার সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে?

তোমাদের ঘৃণার মলাট তোমাদের কাছেই ফেরত যাক।

না, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি– আমি কোনো পরিচর্যাহীন বাজারে যাই না।

‘ইন্নাল্লাহা মা-আছ ছাবেরীন’ আমি তো তাঁর ধৈর্যের বোরাকে চড়েছি।’

কবি নয়ন আহমেদ মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় নত হন। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য অবিরাম এক সচল ভোরের নিবেদন করেন। তিনি মহান রবের কাছে সচল একটা জীবনের জন্য আবেদন করেন। এই পৃথিবীর গতির সাথে তিনি এগিয়ে যাওয়ার বাসনা পোষণ করেন। সদা ঘূর্ণায়মান এই পৃথিবীতে সজীব জীবন-যাপন করাই হলো বেঁচে থাকার আরেক নাম। কবি যেতে চান একটি সুন্দর আগামীর দিকে; কবির গতি একটি মায়া-মায়া সৌন্দর্যের আধার এই পৃথিবীর চতুর্দিকে। যেখানে কবি দেখেন, কুরআনের মধুর তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বাবা ভোরকে নিমন্ত্রণ করছেন, আর সুরা ইয়াছিন তিলাওয়াত করে মা মহান রবের কাছে প্রার্থনা করেন। কবি বলেন–

আমি যাই।

‘ফাবি আইয়ে আলা ই রাব্বিকু মা তুকাযজিবান’ বাবার নিমন্ত্রিত ভোর– যাই।

‘ইয়াছিন। অল কুরআনিল হাকিম …’ মায়ের নিবেদিত প্রার্থনা– যাই।

আপনার সলজ্জ অভিধান ঘাটের মাঝিকে পৌঁছে দেবো।

আমি যাই।     

কবি নিজেই বলেন, কুরআনিক ভাষা তিনি আয়ত্ত করেন, সেই ভাষা তাঁর অনেক পছন্দ, তিনি ভালোবাসেন কুরআনকে। তাইতো তিনি কুরআনিক ভাষায় কবিতা লেখেন, কিন্তু কুরআন লেখেন না। আর একজন বিশ্বাসী কবি এ ধৃষ্টতা পোষণও করেন না কখনো। তিনি আল কুরআনের অসম্ভব সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই ভাষায় কবিতা প্রকাশ করেন। তা শুধুই কবিতা, অন্যকিছু নয়, কুরআন বানানো ব্যর্থ চেষ্টাও নয়। কবির ভাষা এমন–

আমার হাতের মুঠোয় মৃত্যু– মুঠো মুঠো ধ্বংস।

মৃত্যুর আহ্বানেই রক্ত ও মাস্তুল খুলে দিলাম।

তার গৌরব পরলাম আংটির মতো।

শপথ, আমি যাচ্ছি উষ্ণতার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে।

সমস্ত রৌদ্র ও প্রভাত আমার বাহন।

না। কোনো মিথ্যে শপথ আমার কণ্ঠ ধারণ করে না।

জিহ্বা স্পর্শ করে না স্তুতির বোঝা।

আমি আজীবন জেনে আসছি, কিষাণীর জিকিরেই 

ভোর শুরু হয়।

আমি ছাড়া আর কে আনবে ভোর।

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই কবি এগিয়ে যান সত্যের পথে। কবি বলেন, ‘রৌদ্র ও প্রভাত আমার বাহন’; এখানে ‘রৌদ্র ও প্রভাত’ শব্দদ্বয় কবি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। সকল অন্ধকারের জীর্ণতাকে ছাড়িয়ে কবি এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর তাওহিদের আলো ছড়িয়ে দিবেন, তিনি ছড়িয়ে দিবেন রেসালতের প্রভাত। কবি সত্যের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেন। কবি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘কোনো মিথ্যে শপথ আমার কণ্ঠ ধারণ করে না।’ বাঙালি মুসলমানদের আবহমানকালের একটি রেওয়াজ ভোরের জিকির বা সুবহে সাদিকের পর পাড়া-মহল্লায় সুর করে আল-কুরআন তেলওয়াত। কবি এই মিথের ‘জিকির’ শব্দটি ব্যবহার করেও মুসলিম সমাজের একটি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করেছেন। আর বিশ্বাসী কবির প্রত্যয় ‘আমি ছাড়া আর কে আনবে ভোর।’ এই ভোর মহান আল্লাহর তাওহিদের আলোর বিচ্ছুরণ বলে আমরা ধরে নিতে পারি।

কবি লিখে যান নিজের ভাষার বন্ধনীর ভেতর। কবির মনন যেখানে যেমন সায় দেয় কবিতার ভাষা-সওগাতও তেমনি পসরা মেলে। আমরা বাইরে থেকে কবিতার আঙ্গিক বিচার করতে পারি। আমরা পারি কবির জীবনের কর্মযজ্ঞ আর বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা বয়ানকে বিশ্লেষণ করে তাঁর আত্মার আরো কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু মনের বন্দরে নোঙর করে বসতিস্থাপন কোনো পাঠক-সমালোচকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর কবি নয়ন আহমেদের মতো মেধাবী কবিদের কবিতার হেরেমে পৌঁছানোতো আরো বেশি দুঃসাধ্য। তাই কবিকে আমরা বিশ্লেষণ করি বিশ্বাস দিয়ে, তাঁর সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা দিয়ে। কবি নয়ন আহমেদ এতো বেশি আলঙ্কারিক যাদু দিয়ে কবিতার দেহ সাজান সেখানে পৌঁছুতেও সাধনা প্রয়োজন। যেমন কবি যখন বলেন–

কোন বাড়িটির কাছে যাবো!

ইতিহাস পাড়ায় বাঘ আসছে– হালুম, হালুম! 

এখানে কবি কী বলতে চান তা-তো আমরা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। তবে আন্দাজ করতে পারি ইসলামি মূল্যবোধে জাড়িত বিশ্বাসী কবি হয়তো ইসলামের কথাই বলছেন। এটি একটি রূপকধর্মী কবিতা। ‘ইতিহাস পাড়ায় বাঘ আসছে— হালুম, হালুম!’ চমৎকার একটি রূপক এবং মিথের সমন্বয় ঘটেছে এই কবিতায়। ইসলামের মধ্যে আজ এতো বেশি মতভেদ, এতো বেশি ইহুদি-নাসারা আর হিন্দুত্ববাদী মতবাদ ঢুকে গেছে যে, এর সৌন্দর্য দারুণভাবে বিনষ্ট হয়েছে। বিচ্ছিন্ন একেকটি ভেড়ার পাল থেকে যেমন একটি একটি করে ভেড়া বাঘ ধরে নিয়ে যায়, আমাদের ইসলামের সোনালি দিনের, নবি মুহাম্মদ সা. এর সোনালি ইতিহাসের সেই মানুষগুলোকে আজ ধ্বংস করে দিচ্ছে বিজাতীয় থাবা, সংস্কৃতি। কবি আরো বলেন–

কবে বাঘ এসেছিলো আমাদের ইতিহাস পাড়ায়, ঘুমের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর

আর আমাদের মেয়েটিও নান্দনিক ঋতুস্রাব নিয়ে সমর্পিত হতে 

পারলো না কোনো সুন্দরের কাছে।

সে এখন রাখাল বালকের বাঘ দেখে লজ্জার গুহায়

এক প্রস্ত বারান্দায় ভয়– হালুম, হালুম।

কবির রূপক সৃষ্টি চমৎকার নান্দনিকতা দান করে। কবিতার সৌন্দর্য যতো বেশিই হোক, কবি এখানে ইসলামি ঐতিহ্যের একটি চরম বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কবি বলেন আমাদের অজান্তে, অবচেতনেই আমাদের ইতিহাস পাড়ায় বাঘ ঢুকে গেছে। আমাদের ঐক্যকে দিচ্ছে ধ্বংস করে। কবি ইসলামকে একটি সুন্দর সদ্য ঋতুবতী নান্দনিক মেয়ের সাথে তুলনা করেছেন। কী অপরূপ বোধ! যে মেয়েটি কেবল কৈশোর উত্তীর্ণ হলো– সৌন্দর্যের আকর হয়ে উঠছে যে ইসলাম, তা নিয়ে ষড়যন্ত্র আর দ্বিধা-বিভক্তির কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে সে পিছিয়ে পড়ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানময় আর শক্তি-সাহসের জ্বলন্ত অগ্নিবারুদ যে মুসলমানগণ গোটা জাহান শার্দুলের ন্যায় তেজস্বিতায় শাসন করেছে সে আজ রাখাল ছেলের মিথ্যে বাঘের কথা শুনেও ভয়ে লুকায়; কবির আক্ষেপ এমন। কবির আশা এমন যে, ইসলামের গৌরব আর সৌন্দর্যের সুনাম দশদিশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, পৃথিবীর তাবত মানুষ একে স্বাগত জানাবে; আর এই কাজটি করবেন মুসলমানগণই। যেমনটি করেছিলেন, প্রিয়নবি সা. ও তাঁর সাহাবাগণ (রা.)। ইসলাম সুন্দরের ধর্ম, মানুষের মমত্ব আর ভালোবাসার ধর্ম, আর নবিজি সা. প্রতিটি মানুষ শুধু নয়, প্রতিটি প্রাণিকুলের জন্যই ভালোবাসা নিয়ে ধরায় এসেছেন। বনের প্রাণী আর আকাশের পক্ষীকুল সেই নবির প্রেমেডোরে বন্দি হলো, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের মুসলমানগণ সেই ইতিহাস ধরে রাখতে পারলেন না। কিংবা নাস্তিক, মুরতাদ, বিজাতীয়দের কারণে ইসলামের ইতিহাস আজকে ম্লান হচ্ছে, দিকে দিকে নির্যাতিত হচ্ছে। কবির রূপক ভাষায়–

        সেই আঁচল ভরা অহঙ্কার নিয়ে মেয়েটি কোন বাড়িটির কাছে যাবে!

কোনো বাড়ির দরজা কি খোলা আছে– যেখানে খোদাই করা ‘স্বাগতম’

আসুন, আসুন।

‘আপনাদের মেয়েটির জন্য আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম– যার হাতে 

আমাদের ঘরের টেবিল ক্লথ আছে।

চমৎকার একটি রূপকল্প সাজিয়েছেন কবি, ‘ঘরের টেবিল ক্লথ’। টেবিলের সৌন্দর্যবর্ধণের জন্য কাপড়টিও আপনাদের মেয়ের হাতে। অর্থাৎ ইসলাম জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছুই সুন্দর করে তোলে। 

কিন্তু না, কবির সেই ইচ্ছা পূরণ হয় না। আমরা কোনো বাড়িতেই যেতে পারি না। কেউ সৌন্দর্যের আধার হিসেবে আমাদের মেয়েটিকে ডাকে না। আমরাই হয়তো আমাদের মেয়েটিকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদেরকে অর্থাৎ মুসলমানদেরকে নানা রকম প্রলোভন আর মিথ্যা-মরীচিকা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছে। ভুলিয়ে রেখেছে মায়ার ছলনে। যেই জাতি একসময় ছিলো সদা জাগ্রত, তাদেরকে ঘুমপাড়ানি মন্ত্র দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে–

আমরা কোনো বাড়িতেই যেতে পারিনি।

আমাদের জন্য অন্ধকার দিয়ে নির্মিত একটি পালঙ্ক দেয়া হয়েছিলো।

‘আয় ঘুম, আয়।’

আমাদের আহার্য হিসেবে ‘এক ঠোঙ্গা মিথ্যে’ দেয়া হয়েছিলো।

‘আয় ঘুম, আয়।’

কোন বাড়িটির কাছে যাবো!

বাড়িটির মেয়েটি ছিলো আমাদের নিমন্ত্রিত ভোর।

আমরা কোনো বাড়িতেই যেতে পারিনি।

ইতিহাস পাড়ায় বাঘ আসছে– হালুম, হালুম।

‘আয় ঘুম, আয়।’

আমরা কোনো বাড়িতে যাবো না! 

সরাসরি কোনো ইসলামি মূল্যবোধের শব্দ ব্যবহার না করে, খুবই দক্ষতার সাথে কবি নয়ন আহমেদ লিখলেন ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনির্বচনীয় উপাখ্যান। 

সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের সাথে প্রতারণা নিশ্চয়ই ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত অপরাধ। রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দিবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ যে ব্যক্তি সম্পর্কে প্রিয় নবি সা. বলেন, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, সে তো সমাজের বুকে সব থেকে বড় অপরাধী। আর এই অপরাধীরা সমাজে যে-কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে। কবি নয়ন আহমেদও সেই সব সমাজের কীটদের ঘৃণা করেন, তাদের সামাজিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি আবারো সুন্দর কুরআনিক ভাষায় রচনা করেন কবিতার সৌষ্ঠব–

ধানের বীজ ছিটানোর মতো– প্রতারণাকারীগণ উপস্থিত থাকুক।

জাল ফেলে যারা রৌদ্র ধরেছে– ডাকো তাদের। 

অবৈতনিক সংযোগ– তার জালের নাম

ধূর্ততা– তার চোখের নাম;

আর ডানায় যার অযুহাতের পতাকা– সেও হাজির থাকুক।

এই শহরের সম্মানিত কবি আজ বিচারক।

ওহে মাছির পোশাক পরা মেজবানরা,

একটি ক্ষুধার্ত কবর আহার হিসেবে

চাচ্ছে তোমাদের।

আমি, কবরের প্রার্থনা মঞ্জুর করি। 

নীচু মানসিকতার শঠ আর প্রতারকে ভরে গেছে আজ সমাজ। ইসলামের সুন্দর শাশ্বত বিধান থেকে সরে গিয়েই আজ মানুষের এই অধঃপতন। কবি এ-সকল মানুষ যে একদিন কবরের ন্যায় নিস্তব্ধতায় নিজেরাই বন্দি হয়ে যাবে, তাই তিনি বলেন তাঁর সুন্দর কবিতায়। তিনি এই কবিতায় সকল অবিশ্বাসী আর মুনাফিকদের সম্বন্ধে বলেন– ‘ওহে, মাছির পোশাক পরা মেজবানরা’। ‘মাছির’ মতো বিষ বহনকারী– যা এক থেকে অন্যে ছড়িয়ে দেয়; তেমন মুনাফিকদের সম্পর্কে কবি এই রূপকটি ব্যবহার করেন। এই কবিতায় কবির রূপকল্প ও উপমাগুলো অসাধারণ মূল্যবোধের এবং কাব্যিক ব্যঞ্জনাপূর্ণ। যেমন তিনি বলেন– ‘ধানের বীজ ছিটানোর মতো– প্রতারণাকারীগণ উপস্থিত থাকুক।’ ধানের বীজ ছিটাতে গিয়ে প্রতারণা করলে যেমন বীজ উদ্গত না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না, কিংবা কখনোই তাকে পাকড়াও করা যায় না, ইসলামের মধ্যে সুন্দর সমাজের মধ্যে এমন বিনষ্টকারী প্রতারক মুনাফিকের বসবাস রয়েছে। এমনি করেই চলে এই মেধাবী কবির নৈতিক মূল্যবোধপূর্ণ সৌন্দর্যের বয়ান। 

কবি নয়ন আহমেদের কবিতার গভীরে যতো বেশি প্রবেশ করা যায়, ততোই তাঁর অনির্বচনীয় স্বাদ আস্বাদন করা যায়। তিনি কবিতার ভাষা নির্মাণ করেন অসম্ভব গভীর কবিতার মসলা দিয়ে। তিনি কোনো সাধারণ মানের ছান্দসিক বা কাব্যরসিকের ন্যায় দুচারটা ছন্দের মিলতালে কবিতার শরীর গঠন করেন না। তাঁর শব্দচয়ন আর বাক্যবয়নের মধ্যে থাকে সামুদ্রিক গভীর বুদ্ধিমত্তা। তিনি একেকটি শব্দকে তৈরি করেন, একটি ইতিহাসের আস্ত উপাখ্যান। ইসলামের নান্দনিক বোধ ও শান্তির অপরিসীম বার্তা এই পৃথিবীর অবিশ্বাসীরা গ্রহণ না করে যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে তা কবি বলেন রূপকের আবরণে। তবে কবিতার আভরণে তিনি ব্যবহার করেন উজ্জ্বল জরিদার কারুকাজ। কবি এই শাশ্বত সৌন্দর্যকে নির্মাণ করেন উত্তম পুরুষে। নিজের ব্যক্তিত্বের কথনে কবি সকল সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন–

নিজেকে প্রচার করতে ইচ্ছুক হলাম আমি।

বিশুদ্ধতার মতো কবিতা নাজিল করে দিলাম, তাদের।

বললাম:

শেখো আমাকে।

বানান করে করে আমার অবয়ব তৈরি করে নাও।

আল্লাহর কসম, তুমি দৃষ্টি হয়ে যাও।

প্রেম ও দৃষ্টি ছাড়া আমাকে পাবে না! 

কবি এই কবিতায় কাব্যের রূপকের আড়ালে ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য-অনুভূতি যা বিশ্বময় ব্যাপ্ত হলে সকল বিভেদ হানাহানি দূরিভূত হতো; পৃথিবীতে বিরাজিত হতো কেবল শান্তি আর শান্তি। তাই নিজের মধ্যে সেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান কবির। মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন, ‘দৃষ্টি ছড়াতে’ বা ‘চক্ষুষ্মানদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন’ এমন বাক্য। অর্থাৎ নিজের বোধশক্তি প্রসারিত করে, জাগ্রত করে সত্যকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নেয়ার উপদেশ। কবিও তাই বলেন, ‘ আল্লাহর কসম, তুমি দৃষ্টি হয়ে যাও।/ প্রেম ও দৃষ্টি ছাড়া আমাকে পাবে না!’ পৃথিবীর হিংসা-বিদ্বেষ আর জিঘাংসার অবসানের জন্য ইসলাম এসেছে শান্তির অমোঘ বিধান নিয়ে। মহান রবের বাণী হলো- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বিন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।’ সেই পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামকে যারা না মেনে হানাহানিতে লিপ্ত, কবি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন–

নিজেকে প্রচার করতে আমি

স্রোতের মতো বহমান হলাম।

আদেশ করলাম:

গড়ে যাও পৃথিবীকে।

জিঘাংসার দরজাগুলো বন্ধ করে দাও।

এক্ষুণি ডিভোর্স দাও রাস্কেলটাকে।

আমার নাম প্রতিবেশীর মতো মুখস্থ করে নাও।

প্রভুর কসম, আমাকে না চিনলে স্বাধীন হবে না!

আমাকে পোশাকের মতো অনিবার্য করা হলো।

হায়, তবু ইহুদিরা আমাকে নিলো না! 

ইসলামি জীবন-বিধানকে মানা পোশাকের মতোই অপরিহার্য। এর থেকে স্খলিত হলেই বিপদ। এই কবিতার শেষ চরণটিই কবিতার আলো-আঁধারির ভাষাকে স্পষ্ট আলোকে নিয়ে আসে। ইহুদিদের এখানে বিবাদ-বিভাজনের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারাই পৃথিবীর সকল সাম্য আর শান্তির বিনষ্টকারী। তারাই ইসলামের সৌন্দর্যকে গ্রহণ না করে বিভাজিত করে রেখেছে সকল শান্তিকামী মানুষকে।

কবি নয়ন আহমেদ ভোরের প্রতীক্ষা করেন। তিনি ধ্বংসের মধ্যে নতুনের হাতছানি দেখেন। বিশ্বে আজ যেখানেই মুসলমানরা মার খাচ্ছে, যেখানে বিধর্মীরা বিনষ্ট করছে ইসলামের ঐতিহ্য; সেখান থেকেই নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রজন্মকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান কবি। চরম মানবিক আবেদন ফুটে ওঠে কবির কণ্ঠ জুড়ে। কবির কলমে প্রকাশিত হয় হতাশা নয়, আশার বাণী। আফগানিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই চলছে পশ্চিমাদের পেশিশক্তি আর সামরিক আগ্রাসন। মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য পায়তারা করছে ইহুদি-নাসারার দল। তাইতো কবি তাঁর কবিতায় জোগান সাহস, প্রদান করেন প্রেরণার আলো। আফগান ক্ষুধার্ত ও আহত দুই শিশু যাদেরকে খাদ্যের বদলে ছোঁড়া হয়েছিলো বোমা, সেই ভাই-বোন ‘পারমিনা’ আর ‘সাথ’ কে নিয়ে কবি লেখেন আমেরিকাবাহিনীর এক অকথ্য নির্যাতনের দলিল; আর বোন পারমিনাকে শোক ভুলে জাগ্রত হতে বলেন, শক্তি আর সাহস নিয়ে। এদেরই গড়তে হবে মুসলিম-বিশ্ব। কবির ভাষ্য–

ও–পারমিনা, তোমার ভাই সাথ কোথায়? ওকে ডাকো। ওর ক্ষত ভালো হয়েছে? বিনোদনের মতো ঘুড়ি ওড়াতে পারে? তোমার আব্বা তো রোদ আনতে গিয়ে আর ফিরে এলো না! শোক ওড়নায় বেঁধো না, মা-মণি। ব্যথা হবে। দাঁড়াতে পারবে না। সুই আর সুতো নিয়ে এসো! ছেঁড়া আফগানের মতো পৃথিবীটা শেলাই করতে হবে। আবার আবেগ বানাবে না?

ভোর হয়েছে। ওড়নায় ইতিহাসের অগ্নিপিণ্ড বেঁধে নাও। মা-মণি, এবার ঝিকমিক করবে পাকা ধানের মতোন মানুষের স্বপ্ন-সম্ভাবনা।

কবির কবিতায় ইসলামী মূল্যবোধের আরো কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত–

হ্যাঁ, সে একটা দু-কামরার ঘর।

হ্যাঁ, সে একটি ঢাকনাযুক্ত বিস্ময়।

আর আমি তখন হেরাগুহার মতোন সৌন্দর্য ও চুম্বনের আরাধনা করি।

… … … … …

হঠাৎ একদিন একটা শোকসংবাদে বিমর্ষ হয়ে যাই আমরা। পাশের ভাড়াটে রহমান সাহেব

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।

আমরা তখোন পাঠ করি–ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন–

নিশ্চয়ই আমরা প্রেমময় আল্লাহর কাছ থেকে

এসেছি, আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবো।

… … … … …

না, আমি কিছুই হারাতে চাই না।

আমার এই ভাড়াবাড়ির মতো দুনিয়াদারি– অনুমোদন করো, প্রভু।

এই– এইখানে সিগনেচার করো।

বার্জারের মতো রং করা এরাই আমার– আহাল; পরিজন।

প্রভু, এই কাঁচারঙ স্থায়ী করো। 

একজন বিশ্বাসী মানুষের আনন্দ, ভালোবাসা তার বিশ্বাসকে ঘিরে। মহান রবের প্রতি আস্থাই তাকে সর্বাবস্থায় সুখের সন্ধান দেয়। তিনি কখনো হতাশ হন না। কারণ তিনি জানেন, জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছুরই দাতা একমাত্র মহান আল্লাহ। তাইতো সর্বদাই তার আনন্দ, তার সুখ। আর যাদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে, যে আল্লাহে ভরসা রাখতে পারে না, সে কখনো সুখী হতে পারে না। তার মনের ব্যাধি কখনো ভালো হয় না। তাইতো কবি বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী বা অল্পবিশ্বাসীদের আনন্দ ও বেদনা নিয়ে তাঁর কবিতায় বলেন–

নূপুর বাজিয়ে আসে আমার আনন্দ;

নেচে নেচে আসে।

দেখবে, আমার আছে বর্ণময় যৌথ আলো!

গাছের পাতার মতো দৃষ্টিগ্রাহ্য রাত নামিয়ে আনতে পারি।

গয়নার মতো উজ্জ্বল বিস্ময় দ্যাখো।

প্রশংসা করতে পারো।

জেনে রাখো–

অল্পবিশ্বাসীদের অসুখ আর ভালো হবে না!

তবু তাদের জন্য প্রার্থনা করো।

গুজরাটের মুসলমানদের ওপর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচার সকল মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। সেখানে নারীদেরকে করা হয়েছে ধর্ষণ আর শিশুদেরকেও করা হয়েছে নির্মম হত্যা। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বাক-নির্বিকার ভারতীয় হিন্দু নেতারা ও সরকার। এ যেনো ওদের কোনো পুণ্য কর্মের মতোই স্বাভাবিক কোনো কাজ। ভারতের সাবেক এক মুসলিম সেনা কর্মকর্তা সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জমিরউদ্দিন শাহ এই হামলা ঠেকাতে তৎকালীন সরকারের সমালোচনা করেন। এ সম্পর্কে তিনি একটি বই লেখেন। এই ভয়াবহতম ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০০২সালে। ‘সেনাবাহিনীর সাবেক এই উপপ্রধান গুজরাটে দাঙ্গার মোকাবিলায় মোতায়েন করা সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি তার সদ্যপ্রকাশিত বইয়ে দাঙ্গা ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভ‚মিকার কড়া সমালোচনা করেছেন। ‘দ্য সরকারি মুসলমান’ নামে তার ওই বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে ভারতের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও দাঙ্গার সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ওই ভয়াবহ দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতের এখনকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।’ এই সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, সে সময় কমপক্ষে দুই সহস্র মুসলিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে কবির ক্ষোভের উচ্চারণ–

পৃথিবীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করিয়ে দেই

সুন্দর একটি লালা ডিনামাইট। 

ঘৃণা হয়ে ফুটে ওঠে আগুনের কনিষ্ঠ বাচ্চারা।

বোল, হরি বোল।

বোল, হরি বোল।

কে বলেছে এর নাম উৎসব নয়?

এবার, আরামে ঘুমাও শিশুরা।

পৃথিবীর গর্ভাশয়ে সবেগে ছড়িয়ে দেই

আঁধারের উর্বর বীজ।

কী সুন্দর কুৎসিত হয়ে আসে হত্যা ও বলাৎকার! 

বোল, হরি বোল।

বোল, হরি বোল।

গার্মেন্টস-এর কাটিং মাস্টারের মতো টুকরো টুকরো করি

মানবতা।

চুপ, সোনামণিরা! কাঁদে না, কাঁদে না!

এবার, শান্তিতে ঘুমাও শিশুরা! 

কবির উচ্চারণগুলো ক্ষোভ, ঘৃণা আর ব্যঙ্গাত্মক। ওরা মুসলিমদেরকে হত্যা করে উৎসবের আমেজে। 

নয়ন আহমেদ নৈরাশ্যবাদীদের দলে নন; তিনি হতাশার আঁধারে তলিয়ে যেতে চান না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেন– ‘উহারা প্রচার করুক হিংসা-বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;/ আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। / উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,/ আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।’ 

কবি নয়ন আহমেদের কবিতার ভাষাও তেমন ইসলামি মূল্যবোধের মোড়কে মোড়া–

কেউ কেউ ডুবে থাকবে

বাতাসের সমুদ্রে তৃষ্ণার্ত জীবনের মতো।

কেউ কেউ কাঁথার মতো

শেলাই করবে অন্ধকার।  

আলো ফুটবে না

গাছের ডালে ফুটে থাকা ফুলের মতোন।

তুমি গাইবে–

দুঃখসব করে রব রাতি পোহাইল।

কাননে দুঃখগুলি সকলি ফুটিল।

আমি তখন নবিদের মতো রৌদ্র মেলে দিতে 

আসবো।  

কবির আরেকটি অসাধারণ রূপক কবিতায় কবি আমাদের সর্বদা বিপদাপন্ন হৃদয়ের কথা বলেন। মানুষের হৃদয় সব সময় নেকড়ের থাবার মধ্যে বিচরণ করে। এই নেকড়ে হচ্ছে আমাদের নফস বা প্রবৃত্তি। প্রতিনিয়তই আমরা নফসের ধোঁকায় পড়ে যাই। আমরা নফসের ধোঁকায় পড়ে পাপসাগরে ডুবে যাই। আর এই নফস নামক নেকড়েটি আমাদের মধ্যে বিচরণ করে আপনজনের মতো। নানান ভুলভাল বুঝিয়ে আমাদেরকে করে বিপথগামী। এই নফস সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্য– ‘আর আমি আমার নাফ্সকে পবিত্র মনে করি না, নিশ্চয় নাফ্স মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন– ‘নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। এবং সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তাকে (নাফস) কলুষিত করেছে।’ আর তাই কবি নয়ন আহমেদ তাঁর নফস সম্পর্কে বলেন–

একপাল মেষের মধ্যে বিচরণ করে 

আমার অন্তর।

কতো অনুনয় করি:

খাবি সবুজ তৃণের মতো মিহি ভোর।

শাপলা-সুন্দর হয়ে হাসবে কামনা।

… … … … …

হায়, মেষের আবরণে নেকড়ের মধ্যে বিচরণ করে 

আমার অন্তর। 

মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া দুনিয়ার অশ্রু-ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি লাভ কিংবা আনন্দানুভব কোনোটাই পাওয়া সম্ভব নয়। তাইতো আল্লাহ মানুষকে শিখিয়ে দেন ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’ এই পৃথিবীর এতো যে হাহাকার চারিদিকে তা থেকে বাঁচার জন্য একমাত্র উপায় হলো মহান রবের কাছে বিনয়ী হওয়া। তাঁর কাছে অশ্রæসিক্ত হওয়া, নতমস্তকে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা, যেমনটা করেছিলেন নবিগণ। যেমনটা কবি নয়ন আহমেদ বলেন–

হাহাকার ক্যানো চারদিকে?

অবিমিশ্র ক্রন্দন ক্যানো?

দুটো জারুল ফুলের মতো মেলবে না

সুষুপ্ত সৌন্দর্য? বিনয়?

… … … … …

যেনো কয়েকটা স্ট্রবেরি দুলছে হতাশার মতো।

যেনো বহুরঙা দোল খাচ্ছে পাপ।

আমরা পেড়ে আনছি ব্যাধি।

পেড়ে আনছি কয়েকটি মোলায়েম আর্তনাদ।

কে শোধন করে দেবে? কে?

কে দেবে রুগ্ণতার গায়ে লাল জামা?

আমি নবিদের মতো কাঁদবো একরাত।

কবি সর্বদাই আশাবাদী হন। আর এক আল্লাহতে সমর্পিত বিশ্বাসী কবি নয়ন আহমেদ তো আরো বেশি করে স্বপ্ন দেখান হতাশ মানুষকে। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়াই বিশ্বাসীদের মূল ভরসা। যেমনটি আল্লাহ বলেন– ‘আর তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, কেননা কাফির সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।’ আজ যে বর্তমান আমাদেরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখছে, আমরা যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হচ্ছি– সে ভবিষ্যৎ নিয়ে কবি আমাদেরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তিনি বলছেন, এই হতাশার আগামীকাল থাকবে না, একটি সুন্দর আগামী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে–

সেই ঋণদানকারী আগামীকাল

মুচকি হেসে বাড়িয়ে দিলো হাত–

যে রকম হাত বাড়াতেন ইসা নবি, 

যে রকম শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন নবি মুহম্মদ,

যে রকম আমরা বন্ধুদের দিকে চোখে ফুলের পবিত্রতা ছড়িয়ে

বাড়িয়ে দেই দু-চারটে গভীর সু-প্রভাত।

তখন যুগপৎ দুলে ওঠে আগামীকাল।

মানুষ সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠে তার নৈতিক মানবিক সত্তার বিচ্ছুরণে। তাকে যে সকল প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সে কখনো ভুলে যায়। কখনো সে তার আচরণের কারণে হয়ে ওঠে পশুর মতো কিংবা তারও অধম। যেমনটি আল্লাহ বলেন, ‘আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় রয়েছে, কিন্তু তারা তদ্দ্বারা উপলব্ধি করে না; তাদের চক্ষু রয়েছে, কিন্তু তারা তদ্দ্বারা দেখে না। তাদের কর্ণ রয়েছে, কিন্তু তদ্দ্বারা তারা শোনে না। তারাই হলো পশুর ন্যায়, বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হলো গাফিল বা উদাসীন।’ তাহলে দেখা গেলো মানুষই কখনো কখনো তার আচরণের জন্য হয়ে ওঠে নিকৃষ্টতর প্রাণী। কবি সে ক্ষেত্রে বলেন, পৃথিবীতে মানুষই বেশি হানাহানিতে লিপ্ত। তারা প্রেম-ভালোবাসা ঔদার্য কিছুই রপ্ত করে না। তাইতো কবির কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে এমন–

একদা, পাথরের পাশে আমি রাখলাম

দুইটি গোলাপ।

পাথর তার চোখ তুলে

আমার হৃদয় পাঠ করে প্রেমের মুরিদ হলো।

বললো– ‘হে আমার নবি, পড়াও কলমা তোমার।’

মানুষেরই বড় বেশি বক্রস্বভাব।

প্রেম বুঝবে না।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. সবসময় বৈরাগ্যবাদের বিরোধী ছিলেন। এই পৃথিবীর সকল প্রকার বৈধ আমোদ-আহ্লাদ, বিয়ে–শাদির মধ্য দিয়েই জীবনের সৌন্দর্যকে বিকশিত করাই একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের কাজ। প্রিয় নবি সা. তাঁর সাহাবিদেরকে (রা.) নির্দেশ প্রদান করতেন তাঁদের স্ত্রীদের হক আদায় করতে এবং বিয়ে করতে। বৈরাগ্যবাদ তিনি পছন্দ করতেন না। বৈরাগ্যবাদ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী হলো-‘আর বৈরাগ্যবাদ-তা তারা নিজেরাই নতুনভাবে চালু করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আমি তাদের ওপর এ বিধান অপরিহার্য করিনি।’ আর রাসুল সা. বলেন– ‘আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি আমি বেশি আনুগত্যশীল; অথচ আমি রোযা পালন করি, আবার রোযা থেকে বিরতও থাকি। সালাত আদায় করি এবং ঘুমাই ও বিয়ে-শাদি করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ ভাব পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়।’ কবি নয়ন আহমেদের কবিতায়ও এমনই ইঙ্গিতময়তা প্রকাশিত। তিনি তাঁর কবিতায় জীবন-সংসারের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে নির্বাণ লাভের ব্রত থেকে সরে এসে এই সংসারের মাঝেই মানুষের প্রেম-ভালোবাসায় বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পান। তাইতো তিনি বলেন–

আমি একটু দৌঁড়োতে চেয়েছিলাম খরগোশের মতো।

মহামতি গৌতম বললেন, “বন্ধু, এই বৃক্ষতলে কিছুটা জিরিয়ে নিন।’

আমি দীর্ঘলাফ বন্ধ করে থামলাম তার কাছে।

তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন।

আর উঠলেন না।

আমি তার এই নির্বাণ সমর্থন করিনি।

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি আবার এলাম লোকালয়ে।

দেখলাম–মানুষেরা শোকে অধীর হয় আর আনন্দে উচ্ছল।

আমি শোক ও আনন্দকে মাসতুতো বোনের মতোন

নিকট সম্পর্ক বানালাম।

তারপর কাটলো আরো কিছুদিন।

আমিও নির্বাণপ্রাপ্ত হলাম;

দৌঁড়োলাম কচ্ছপের মতো।

কচ্ছপ জানে– দেখতে দেখতে যেতে হয়।

… … … … …

আমি যাবো ঘাসের হৃদয় দেখতে দেখতে

মানুষের প্রেম ও ভালোবাসার নিবিড় সান্নিধ্যে।

কবি নয়ন আহমেদ এগিয়ে চলেন জীবনের বিচিত্র সুখ, আনন্দ, ভালোবাসা আর দুঃখবিলাসী নদীতে সাঁতার কেটে। তিনি ভালোবাসেন মানুষকে; মানুষের বেড়ে ওঠার মতো ভালোবাসা চাষ করেন কবি। তিনি মহান রবের করুণা আর অপার মায়াময় মহাসমুদ্র থেকে মানুষের জন্য তুলে আনেন আঁজলা-আঁজলা আশা-বিশ্বাস। তিনি হতাশার দোকান খুলে বসেন, কিন্তু অসুখী মানুষের তীব্র আনাগোনা দেখে কবি ব্যথিত হন। অসুখী মানুষের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি, যা কখনো সারবে না। আর সে মানুষের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অন্তরে আছে ব্যাধি, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যেবাদী।’ কবি নিজেও এই ব্যাধিযুক্ত হতাশার জীবন থেকে ফিরে আসেন–

একদিন আমি দোকান খুলে বসি।

বেচি আর্তনাদ;

তীব্র অসুখ।

দেখি, অসুখী মানুষের প্রতিকৃতি।

শূন্যতার বিশাল গহ্বর।

আহা, আমি কাফের হয়ে গেছি!

একদিন তওবা পড়ে আমি রোদের ব্যবসা করি।

বেচি আশা ও আশ্বাস;

অবিনাশী প্রেম।

দেখি, মানুষের অপার সম্ভাবনা। 

প্রতিনিয়তই আমাদেরকে শয়তান ইবলিশ নানানভাবে ধোঁকায় ফেলতে ব্যস্ত। কু-প্রবৃত্তির প্ররোচণায় আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকি পাপের অতলে। আমাদের জীবন হারাতে বসে অন্ধকারের কালো রাজ্যে। কামনার আগুনে আমরা জ্বলতে থাকি, সে আস্তে আস্তে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে আমাদেরকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যায়। আমরা ভুলতে বসি আমাদের মনুষ্যত্ব, আমাদের মূল্যবোধ। তাইতো কবি বলেন–

আমি প্রত্যহ দোহন করি কালো পাপ।

দোজখের গাভীটি চায় কামনার কচি ঘাস।

আবদার বাড়ে তার খুকির লাল জামার মতোন।

বলি: রোদ খা।

আমি দোহন করবো আলো।

তবু হে আজাব,

তুমি আমার ভেতরে এতো চুল্লি জ্বালো!

দোজখে কে থাকে ভালো? 

পার্থিব জগতের নানান ঔজ্জ্বল্য, চাকচিক্য আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আমাদের পার্থিব শিক্ষা-দীক্ষা কতোই জ্ঞানের আয়োজন, কিন্তু কেবল তাতে কি জীবন আলোকিত হয়; অন্তরের অন্দরে পবিত্রতার আলো জ্বলে? জ্বলে না। সে জন্য দরকার মহান আল্লাহর প্রিয় রাসুল সা. এর প্রদর্শিত পথে চলা। আর সেই পথে ও মতেই রয়েছে মানুষের মুক্তি আর আসল নৈতিক মানবিক মূল্যবোধ। কবির ভাষা–

আমাকে দেয়া হলো কিছু পার্থিব রোদ।

আমি এই পবিত্রতা ক্রিমের মতো মাখি।

তবু অন্তর যে লাবণ্য ধারণ করে না!

আমি কি কালো ও মিথ্যাকে মুছে দিতে জানি!

ও পয়গম্বর, রোদে ধৌত হবার কৌশল শিখিয়ে দিন।

আমি হবোই আনন্দের তালবেএলেম।

আমি মুছবো শ্লেটের মতো কালো! 

মানুষের মনের মধ্যে যে কামনার আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে তাকে নিজের মতো করে নাফসের অনুগত না হয়ে আদর্শিক উপায়ে ব্যবহার করতে হয়। যেমন, মানুষ হারিকেনের চিমনির মধ্যে আটকে রেখে আগুনকে ব্যবহার করে; যাতে সে বাইরে বেরিয়ে পড়ে সবকিছু জ্বালিয়ে না দেয়। কবি তাঁর কবিতার বয়ানে বলেন–

আমি, হারিকেনের চিমনির মতোন আবৃত করেছি বাসনা-আগুন।

পবিত্র হও।

বিকশিত করো।

আশা করি, রুটি বানাতে পারঙ্গম হবে।

উন্মুক্ত করো না।

দোজখ তৈরি হবে।

ক্ষীণ হবে বাঁচার কামনা।

… … … … …

বাসনাকে দোজখের লাকড়ি বানিও না।

কবি নয়ন আহমেদ-এর ভালোবাসাময় হৃদয়ের এক অনন্য উচ্চ-মহান নিদর্শন হলো রসুল প্রেমের কবিতাজারক। ২০২৩খ্রি. প্রকাশিত যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘তাঁর নাম আহমাদ সা:’-এ তিনি সব বেড়া ছিন্ন করে আরো বেশি রসুলপ্রেমী হয়ে উঠেছেন। তবে তিনি আবেগমথিত কাব্যরসে কোনোক্রমেই তারল্যের আশ্রয় নেননি। বরং প্রিয়নবির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের অনন্ত সুধা হয়ে উঠেছে কাব্যরসিকেরও তৃষ্ণা নিবারক। কবির ভাষায়–

ছড়িয়েছি উজ্জ্বল দিন।

এই মননশীল আলোর শপথ: 

        আমি আপনাকে ভালোবাসি।

রাতের তরল প্রসাদনযুক্ত ছায়া লেপন করেছি।

এই মেধাবী রাতের শপথ:

        আমি আপনাকে ভালোবাসি।   

… … … 

পৃথিবীর জন্য ভালোবাসার রুটি প্রস্তুত করুন।

এতিম ও আর্তজনে ছড়ান প্রশ্রয়।

ঢেলে দিন গলিত করুণা; মধুবর্ষী জীবন।

অনিবার্য সৃষ্টির শপথ:

আমি আপনাকে ভালোবাসি। 

কবির অন্যান্য কবিতার গ্রন্থগুলোতেও এই বিশ্বাসের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। নব্বই দশকের কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে কবি নয়ন আহমেদের বিশ্বাস ও কবিতার মাধুর্য সম্পর্কে আরেক বিশ্বাসী কবি আল মাহমুদের মন্তব্যটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন

‘নয়ন আহমেদ, সায়ীদ আবুবকর, খৈয়াম কাদেরের কবিতায় দৃশ্যের চালচিত্রের ফুটো দিয়ে একটি অদৃশ্য জগতের আভাস আমরা পাই। সেই অদৃশ্য জগৎ সম্বন্ধে যে প্রত্যয়বোধ এইসব কবিরা উত্থাপন করতে চেয়েছেন, তা তাদের ভবিষ্যৎ গন্তব্যেরই দিক নির্দেশনা।’ 

অসাধারণ মেধাবী কবি নয়ন আহমেদের কবিতারা এগিয়ে চলে সহজ-স্বাভাবিক সারল্যের পথ ধরে। কিন্তু কী অসম্ভব সৌন্দর্যই না ছড়িয়ে যায়! তিনি ধর্মীয় অনুভূতিকে, মহান আল্লাহর প্রতি তীব্র বিশ্বাস আর আস্থা রেখেই নিজের কবিতার শরীর গঠন করেন। তিনি ইসলামি মূল্যবোধের একজন চিরন্তন ধারক-বাহক। তাঁর হৃদয়ের প্রতিটি কোঠায় ছড়িয়ে আছে বিশ্বাসের আভা। তবে তিনি তাঁর কবিতার ভাষাকে উন্মুক্ত করে দিলেও বোধকে করেন একান্তই আপনার অনুগামী। তাইতো বেশিসংখ্যক পাঠকই তাঁর কবিতার বাহ্যিক স্বাদের আস্বাদ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হন, কারণ তাঁর কবিতার অন্তরে-অন্দরে প্রবেশে কখনো কখনো ক্লান্ত হতে হয়। তবে বিশ্লেষণী কাব্যিক মনোভাব নিয়ে সে স্বাদ আস্বাদনের চেষ্টা করলে দেখা যাবে, কবি নয়ন আহমেদের কাব্য মহান প্রভু আল্লাহর অপার সৌন্দর্য ও তাঁর সৃষ্টির অপরূপ লীলাভূমিতে অবাধ বিচরণ করছে। কবির কবিতা অপার দিগন্ত প্রসারী। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন যুগ ও সময়কে ধারণ করেই; তবে তিনি কালোত্তীর্ণ হবেন এমনটাই আশা করছি আমরা। 

লেখক: কবি, গবেষক ও প্রভাষক (বাংলা) 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা