spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতানির্বাচিত কবিতা : আবু রাইহান

নির্বাচিত কবিতা : আবু রাইহান

একটি আনন্দময় দুপুর যাপনের বেদনাময় স্মৃতি

শ্রীমধুসূদন তোমার নামের গুনে কপোতাক্ষ নদে আজও
প্রতিবন্ধী আজমল মিঞা ভ্রমণ পিপাসুদের নিয়ে ডিঙ্গি নৌকা বায়
নদীর বিস্তৃত দুপারে সারি সারি গাছের আড়ালে সবুজ নির্জনতা
অলস দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক ভেসে আসে,
মহিলারা নিশ্চিন্ত মনে ছাগল চরায়,
নিস্তরঙ্গ নদীর জলে ভাসে না কোনো প্রিয়তম মুখ!
কেবল তোমার ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে,যখন রোদ পড়ে আসে
কবিতার লাজুক শব্দরা সব হারিয়ে যায় সাগরদাঁড়ির বাঁকে
কত দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে আছে দত্তবাড়ির বাস্তুভিটের পুকুর ঘাট
আর ঘাসে,
একটি আনন্দময় দুপুর যাপন.….
আজীবনের বেদনাময় স্মৃতি হয়ে যায় শুধু তোমাকে ভালোবেসে।

ক্ষুধার বোধ

চায়ে ডোবানো লেড়ো বিস্কুটে জড়ানো আছে
ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি
আর বিশুদ্ধ ভালোবাসার টান
দৃশ্যকল্পে আজও জেগে ওঠে মায়ের মাটির উনানে
ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি থেকে আসা ফ্যানের সুঘ্রাণ…..!
এখন ক্ষুধা ছাড়া মায়ের আর কোনো বোধ কাজ করে না
এসব কথা ভেবে অব্যক্ত কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি
বাইরের তখন দিগন্ত আঁধার করা
সজল শ্রাবণ মেঘ থেকে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে বৃষ্টি।

এই অস্থায়ী পৃথিবীর মায়া

এখন রাতে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে
মৃত্যুর ভাবনা আসে
শেষ বিদায়ের অনিবার্য মুহূর্তটা কল্পনার চিত্রকল্পে ভাসে

মৃত্যুর বিচ্ছেদ অনন্তকালের, আমাকে বেদনাতুর করে
ঘুম না আসা পর্যন্ত ভাবনার জালে আটকে পড়ি
অন্ধকার চতুস্কোণ ঘরে
ঠিক বুঝতে পারিনা চাঁদ না নদী কে আমার আপনজন
আমাকে বিভ্রান্ত করে এই অস্থায়ী পৃথিবীর মায়া
আর ব্যর্থতার সব দহন।

হে অনন্ত জলরাশি

কক্সবাজার সৈকতে সন্ধ্যা নেমে এলে
দিকচক্রবাল জুড়ে অলৌকিক মায়া খেলা করে
সবুজ ম্যানগ্রোভে ঘেরা মহেশখালীর সুউচ্চ পাহাড়ে
তখন পাখিরা ফেরে ঘরে
নিজেকে খুব অসহায় আর ক্ষুদ্র মনে হয় গোধূলির
এই রহস্যময় মহাজাগতিক প্রহরে
ভেসে যায় সব অভিমান দরিয়ানগরের জলে
হে অনন্ত জলরাশি আমাকে ভেড়াও শান্তির কূলে।

ঘুম ভেঙে যায় শোবেসাদেকের ভোরে
আজানের সুর শুনি তন্দ্রার ঘোরে।

চাঁদ রাতের অলৌকিক আলো

ইফতারের এক কাঙ্খিত সন্ধ্যায়
নিভে গিয়েছিল আমার পিতার জীবন
তাই গোধূলি সন্ধ্যায় বিষন্নতায় ছেয়ে থাকে আমার মন।

পশ্চিম আকাশে যখন দেখা দেয় শওয়ালের অলৌকিক চাঁদ
আত্মশুধির মাসের শেষে বিশ্ব মুসলিম জাহানে
জেগে ওঠে ঈদের আনন্দময় সুখ
আর আমি সিক্ত নয়নে খুঁজে ফিরি
হারিয়ে ফেলা আমার প্রিয় বাবার মুখ।

ইথার তরঙ্গে ভেসে আসে নজরুলের ঈদের গান
চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ঈদ রাতের আনন্দময় আলো
তবুও কেন যে অব্যক্ত এক বেদনাবোধে
ক্ষতবিক্ষত হয় আমার প্রাণ!

চান্দ্র মাসের গণনায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়
আবর্তিত হয় উৎসবের কাল
লাচ্ছা-সিমুই আর আতরের সুঘ্রাণে-
বিশুদ্ধ ভালবাসার কথা বলে ঈদের মায়াবী সকাল।

প্রিয় নদীটির কথাও রাখি সংগোপন

ধানসিঁড়ি নদীটির খোঁজে কেটে গেল একটি জীবন
হায় চিল,বিলুপ্তপ্রায় বিষন্ন ডানার অসহায় চিল
মৃত পশুর মাংসের খোঁজে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকো
ভাগাড়ের পাশে মরা গাছের শুকনো ডালে
নাগরিক সভ্যতার দূষিত সব আবর্জনা
ভেসে যায় মজে আসা খালে
হারিয়ে ফেলার ভয়ে এই পড়ন্ত বেলায় দেখা হয়ে যাওয়া
প্ৰিয় নদীটির কথাও রাখি সংগোপন।
হে ধূসর জীবনানন্দ…
ঘাস আর ফড়িং এর নয়,
নেটে ঘেরা আমাদের জীবন
কি ভীষণ নিঃসঙ্গ, একাকী আর নির্জন।

প্রগাঢ় শূন্যতার নিজস্ব অন্ধকার

বিনম্র জ্যোৎস্না আমাকে ভালোবাসার কাছে নতজানু হতে শিখিয়েছিল
অথচ কত দিন হলো আমি বিশুদ্ধ জ্যোৎস্না গায়ে মাখিনি
রাত্রির নির্জনতায় খোলা প্রান্তরে বসে কেবল আকাশের তারা গুনেছি
সান্ধাকালীন বিবর্ণ চাঁদকে কোনদিন আপন বলে ভাবতে পারিনি
রাতের ব্যালকনিতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে অভিমানী চাঁদ
ফিরে গেছে নিজস্ব ঠিকানায়
নিঃস্বপ্ন রাত্রিরা এখন নিদারুন ক্লান্তিতে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে
প্রগাঢ় শূন্যতার নিজস্ব অন্ধকারে…..।

রাতের বিশ্বাসী স্পর্শ

দৃশ্য যতই সুন্দর হোক বারবার দেখতে দেখতে
এক সময় হারিয়ে যায় দৃশ্যের সব মায়া
অন্ধকার হয়তো কোনো দেখার বিষয় নয়, কেবল অনুভবের
তবুও আমি রাত্রি নিবিড় হলে আলোর বিপরীতে
অন্ধকারে খুঁজি নিজের ছায়া ।

এখন আমার চলাচল রাত্রির ভিতর…
প্রকৃত অনুভূতি জাগ্রত হলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে অন্ধকার ঘর
বিশুদ্ধ ভালবাসায় জারিত হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠ জুড়ে
গভীর প্রশান্তি,স্বর্গীয় আবেশে কাটে দিনরাত্রির প্রহর।

রাতের বিশ্বাসী স্পর্শে জেনেছি প্রেম আর প্রত্যাখ্যানের
দীর্ঘস্থায়ী ইশারা
অনন্ত আনন্দময় জীবনের আশায় প্রার্থনায় নতজানু হলে
তখনই কেবল ঝরতে পারে অনুশোচনার অশ্রুধারা।

লেখক পরিচিতি

জন্ম : পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামের সরবেড়িয়া গ্রামে ১৯৭০ সালে। বর্তমানে কর্মসূত্রে বন্দর শিল্পনগরী হলদিয়ার বাসিন্দা। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় এম এসসি এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে বায়ো-টেকনোলজিতে এম.টেক। পেশায় হলদিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বায়ো-টেকনোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র ‘দিনদর্পণ’ পত্রিকার অ্যাসোসিয়েট এডিটর(সাহিত্য সম্পাদক)। ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রমিতাক্ষর’ এর যুগ্ম সম্পাদক। ‘সাহিত্যের প্রমিতকথন’ ই-ম্যাগের সম্পাদক। নব্বইয়ের দশকের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি,সাংবাদিক, নিবন্ধ ও গল্প লেখক। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলা কাব্য সাহিত্যে ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘স্বপ্নের কবি আল মাহমুদ’, ‘স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক মুসলিম কবি ও সাহিত্যিক’,‘ভারত উপমহাদেশের ‘আজাদী’র লড়াই উপেক্ষিত ইতিহাস’ প্রবন্ধগ্রন্থ এবং ‘নিষিক্ত ভালোবাসা’, ‘সংকেতময় বিস্ময়’,‘ভালোবাসার খোয়াবনামা’, ‘নদীর কাছে জলজ ছায়া’ এবং ‘ভালোবাসা লিখি রাত্রির খামে’ কাব্যগ্রন্থ। পেয়েছেন ‘নিষিক্ত ভালোবাসা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘কুসুমের ফেরা’ সাহিত্য পত্রিকার ‘কবি জসীমউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার-২০১৫’,‘টার্মিনাস’ সাহিত্য পত্রিকা পুরস্কার-২০১৭,‘বঙ্গপ্রদেশ’ পত্রিকার ‘বঙ্গরত্ন সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’, বাংলাদেশে ‘কবি সাযযাদ কাদির স্মৃতি সম্মাননা-২০২০’,বাংলাদেশের ‘রবীন্দ্র-নজরুল ফাউন্ডেশন’ এর ‘সংহতি সম্মাননা-২০২০’,বাংলাদেশ টাঙ্গাইল কবিতা উৎসবে ‘মুজিববর্ষ স্মারক সম্মাননা-২০২০’, আলোপথ পত্রিকা ও পাবলিক নিউজ ভয়েস সম্মাননা -২০২০, NRB News 24.Com সম্মাননা ২০২১, সংলাপ সাহিত্য পুরস্কার-২০২১,বনানী সাহিত্য পত্রিকার ‘কবি বিনোদ বেরা স্মৃতি সম্মাননা-২০২২’ সালাম বাংলা সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রাফিকুর রহমান স্মৃতি সম্মানননা ২০২৩ ইত্যাদি।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. একরাশ শুভেচ্ছা।
    অসাধারণ সব কবিতা। প্রতিটি কবিতা এক একটি জীবন বোধের নিবিড় উচ্চারণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ