১.
পাখি-স্বভাব
একদিন পাখি উড়ে যাবে জানি দূরে
পরিযায়ী সুখ উষ্ণ বাতাসে ম্লান
পাখিরা স্বভাবে হয়ে থাকে ভবঘুরে
বনে ও গৃহে জল পেলে করে স্নান।
বক্ষে যে তার চিরতৃষ্ণার হু হু
কিছুতে পরাণ হয় না শীতল, হয় না।
স্বাগত জানায় নতুন আকাশে মেঘ
বৃক্ষেরা দেয় ভালোবেসে পাকা ফল
যদি বেড়ে যায় মৌসুমি বায়ু-বেগ
ঝড়ো-রাত্রিতে অরণ্যে ভাসে জল
ভালোবেসে গাছ দেহ খুলে দেয় গৃহ
পাখি-হৃদয়ের উষ্ণতা নিস্পৃহ
বক্ষে যে তার চিরতৃষ্ণার হু হু
কিছুতে পরাণ হয় না শীতল, হয় না।
হেম্পস্টেড, নাসাউ। ২৬ মে ২০২১।
২.
চাঁদ ওঠে রোজ আপেল গাছে
সন্ধ্যা হলে চাঁদ ওঠে রোজ আপেল গাছে সারি সারি
পথের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ম্যাগনোলিয়া,
চেরিফুলের টহল গাড়ি।
আলো ছড়ায় চতুর্দশী…
সেই আলোতে পথ দেখা যায়, একটু দূরে
বরুণ গাছের ঘাটে বাঁধা আমার বাড়ি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ এপ্রিল ২০২১।
৩.
ডিম
ডিম পেড়ে খাবো তাই বাড়িয়েছি আকাশে দু’হাত।
বিশাল অনড় ডিম গোলগাল ঝুলে আছে
সুবৃহৎ নীল গাছে,
সেই থেকে কাছিমের সাথে শুরু হয় সংঘাত।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৫ এপ্রিল ২০২১।
৪.
এই বৃষ্টি
শব্দটি ঝড়ের? না বৃষ্টির?
এই খরাক্রান্ত সময়ে তা ছিল নিতান্ত স্বস্তির;
কিন্তু আমি কেন হয়ে উঠি এতোটা অস্থির?
এই ঘন বর্ষা, এ-তুমুল বৃষ্টি,
কোথাও কি আওয়াজ তুলছে নতুন সৃষ্টির?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৫ এপ্রিল ২০২১।
৫.
মহাকালের ঘড়ি
মেঘের নিচে দালান সারি সারি
ক্লান্ত ডানা সন্ধ্যারেখায় খোঁজে আপন বাড়ি।
ঝিরিঝিরি বইছে হাওয়া ধীরে
যেতে যেতে আলোর রেখা তাকায় ফিরে ফিরে।
রঙের খেলা, আকাশ কোজাগরী
ঘণ্টা বাজায় কোথাও কী এক মহাকালের ঘড়ি?
লোয়ার ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২।
৬.
মেয়েটির হাত ধরে ফেলি
আলোতে নয়, অন্ধকারে নয়,
কবিতার ভেতরে আমি তার কম্পিত হাত দুটি
ধরে ফেলি মধ্য-যৌবনে।
ওর ঠোঁটে রোপণ করেছি সুপ্রাচীন দুটি বাংলা অক্ষর
যে দুটি অনিন্দ্য অক্ষরের নিচে শুভ্র পায়রা-যুগলের ঠোঁট ছিল নতমুখে লজ্জিত।
আমি ওর কস্তুরী নাভীর ঘ্রাণ নিতে
সহসা একটি তিন অক্ষরের শব্দ ঠেসে দিই সকলের সামনেই;
বুকের বারুদ জ্বলে উঠেছিল ধ্রুপদী ছন্দের ভেতরে,
শুধুমাত্র দুটি জমজ শব্দের স্পর্শে।
তখনো রচনা করিনি তেমন কামতৃষ্ণ একটি পঙক্তি,
শৃঙ্গারের জন্যে তবু উন্মুখ ছিল দশটি অনুপ্রাস,
কবিতার ভেতরে কী দারুণ পড়ছিল ওর ঘন নিঃশ্বাস।
তখন আলো ছিলো না পৃথিবীতে, ছিলো না
লুকোবার জন্যে কোনো অন্ধকার,
শুধু ছন্দ ছিল, পর্ব ছিল, চিত্রকল্পের অরণ্য ছিল বিমূর্ত এক,
আর ছিল দুর্ণিবার ক্ষুধা…
আমি সেই ভয়ানক ক্ষুধার ভেতরে মেয়েটির হাত ধরে ফেলি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ অক্টোবর ২০২২।
৭.
নদীর কষ্ট
আস্তে ধীরে বৈঠা মারো নদীর বড়ো কষ্ট হয়
যখন-তখন পা ভেজালে গাঙের পানি নষ্ট হয়।
ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ৩০ জুন ২০২২
৮.
তুমি আমার ষড়ঋতু
তোমার বুকে যখন ওঠে কালবোশেখী ঝড়
আমি তখন ভয়ের ভিটে নড়বড়ে এক ঘর।
তোমার চোখে বর্ষা নামে যদি
আমি হবো কীর্তিনাশা নদী
শরৎ যদি মেঘের ভেলা তোমার কালো চুলে
পথ হারাবো আমি তখন পথের কথা ভুলে।
অঙ্গে যখন হেমন্ত রঙ কাচা-হলুদ সোনা
অবাক চোখে দেখবো শুধু কিচ্ছুটি বলবো না।
শীতের রাতে যদি তোমার হু হু করে মন
আমি হবো উষ্ণ আলিঙ্গন।
বসন্ত কি তোমার দেহে হাসে?
আমি তবে কোকিল হবো ভরা ফাগুন মাসে।
ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ১৭ মে ২০২২।
৯.
গ্রন্থ
গ্রন্থের কী আছে মেরুদণ্ড,
সোজা হয়ে দাঁড়াবার?
বরং নিবিড়ভাবে তুমি পাঠ করো আমাকে প্রত্যহ,
আমিই প্রধান গ্রন্থ এই পৃথিবীর।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৫ মার্চ ২০২১।
১০.
দ্য ওপেন বুক
“দ্য বুক ইজ ওপেন, ইউ ক্যান রিড”
অথচ আমাকে অনেকগুলো বোতাম খুলতে হলো,
বেশ কয়েকটা প্যাচ খুলতে হলো
এবং
একটি আন্ধা গিট্টু,
এরপর রেহেলের ওপর বসিয়ে দিই
পৃথিবীর আদিম গ্রন্থখানি,
পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে আমি ডুব দিই
জ্ঞানের গভীরায়।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১ জুলাই ২০২৩।
১১.
আগ্রহে আগ্রহ দেখাইনি
নিজের পায়ের ইচ্ছেকে কখনও মূল্য দিইনি
নিজের আগ্রহে আগ্রহ দেখাইনি কোনোদিন।
ঘ্রাণ শুধু নিয়েছি ফুলের ইচ্ছেতেই,
ক্ষুধার্ত দুপুরে ডেকেছে সুস্বাদু ব্যঞ্জন
জাতিসংঘ ভবন স্বপ্নের ভেতরে টেনে ধরেছে গোটানো হাত,
বিমান দিয়েছে খুলে পেটের বোতাম,
এই অভিজাত শহর, ন্যুয়র্ক, আমাকে জাপটে ধরে আছে
এক দশকের অধিক সময় ধরে।
বাসের হাতল ধরেছিল অপরিণত, অস্থির হাত,
কলেজের সেই সব অপেক্ষার দিনে,
দেহকে ঝুলিয়ে রাখতে দূরের কারো জন্যে…
হাতেরা কখনোই নিজেদের হাত হয়ে ওঠেনি,
চোখেরা কি দেখেছে নিজেদের কোনো দৃশ্য?
আমার নিঃশ্বাসেরা শুধু একবার নিঃশ্বাসের
প্রয়োজনে
আসা-যাওয়া করুক ফুসফুসের গহনে,
অন্তত একটিবার…
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
১২.
বিভ্রান্তি
বনের ভেতরে পথ হাঁটে না কখনো একমুখী
শতধারা-প্রস্রবণ কাকে না বিভ্রান্ত করে,
সুবিধেটা এই, বিভ্রান্তির ধাক্কা আমাদের উড়তে শেখায়
বিভ্রান্ত না হলে মানুষ উড়তে পারে না, প্রকৃতপক্ষে বিভ্রান্তিই মানুষের ডানা।
তাকে নিয়ে যায় জানা-অজানা রাস্তায়।
রিয়াদ বিমানবন্দর। ১৬ অক্টোবর ২০২৩।
১৩.
ভয়
দুঃসংবাদের মতো একটা দুর্গন্ধ এসে লাগছে নাকে।
ঘরদোর সব ঝকঝকে পরিস্কার,
কাচের শার্শি ঠেলে ছুটে আসা রোদের মার্বেলগুচ্ছ
ওক কাঠের পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভয়।
দখিনের জানালা খোলা,
হেমন্তের হলুদ বাতাশ নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে আঁকছে আতঙ্কের এলোমেলো পদরেখা।
বোধের নতুন এক স্বদেশ গড়ে উঠছে নিঃসঙ্গতার ইনক্যুবেটরে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৭ নভেম্বর ২০২৩।
১৪.
পালক
গত কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি আমার বগলের নিচে মোলায়েম কিছু পালকের দলা,
প্রথমে তেমন বুঝে উঠতে পারিনি,
ভেবেছিলাম বালিশ ছিঁড়ে-টিরে গেছে,
তুলা লেগে আছে বুঝি;
যখন বুঝতে পারি প্রকৃতপক্ষে খুব বড়ো একটি ঘটনা ঘটে গেছে,
বগলের লোমগুলোর মেটামরফোসিস ঘটেছে,
ওরা রূপান্তরিত হয়েছে একগুচ্ছ নরোম পালকে,
তখন আনন্দ এবং বেদনার মাঝখানে যে অনুভূতি,
যেটাকে হয়ত বিস্ময় বলে,
সেইরকম একটি কপারের পেন্ডুলাম হয়ে দুলতে শুরু করি।
দুই এলবোর মাংসপেশিতে শিনশিনে যন্ত্রণা ছিল বেশ কিছুকাল,
এক বন্ধুর পরামর্শে টেনিস এলবো ব্রেইজ পরেও থেকেছি কিছুদিন,
কোনো লাভ হয়নি,
ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছিল, এবং চারদিন আগে
কনুইয়ের নিচের অংশের পেছনদিকটা লম্বালম্বি ফেটে গেল;
সেখানে গজিয়ে উঠলো কাশবনের মতো শুভ্র,
অথচ ধারালো, দুই সারি পালক।
কখনো রোমান পাদ্রির ঢোলাঢালা গাঢ় কালো রঙের কেশক,
কখনো আরব্য মওলানার বিশাল শুভ্র জেলাবির নিচে
পালকগুলো লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও
কাল রাতে যখন কাঁধ ফুড়ে, বাহু ফুড়ে
গজিয়ে উঠলো দীর্ঘ কিছু নতুন পালক
তখন আর অগুলোকে ইয়োম কিপুরের দিন রাবাই যে খোলামেলা শাদা কিত্তেল পরেন
তা দিয়েও কিছুতেই ঢেকে রাখা যাচ্ছিল না,
এমন কী অরহতের সেলাইবিহীন গেরুয়া চীবরেও না।
প্রথমে আমার স্ত্রী এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পাড়ার লোকদের হাতে ধরা পড়ে যাই।
আমার কী এখন উঁচু কোনো দালানের ছাদ থেকে,
অথবা নিরাবরণ কোনো পর্বতের চুড়ো থেকে লাফিয়ে পড়াই উচিত হবে না?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১২ ডিসেম্বর ২০২৩।
১৫.
জন্মগ্রাম
কুয়াশা-নেকাবে ঢাকা আম্মার মুখ
ঘরের রোয়াকে দাদী কাশে খুক খুক
বড় বুবু কাকভোরে
ঢুলুঢুলু ঘুম-ঘোরে
আঁতালের মুখ খুলে অবাক তাকায়
ছাড়া পেয়ে রাতা-নড়ি ডানা ঝাপ্টায়।
উঠানে হাঁসের ঝাঁক ডাকে প্যাঁকপ্যাঁক
আঁধার কুয়াশা ফুঁড়ে কে এসেছে দ্যাখ
আলপথে এঁকেবেকে
ভোররাতে লঞ্চ থেকে
নেমে এলো পায়ে হেঁটে বড় কাকাবাবু
শীতের দাপটে তার দেহখানি কাবু।
পূবের আকাশ থেকে চোখ মেলে নামে
ঢাকা ছিল লাল ভোর রাত্রির খামে
মেঠো গোপাটের পথে
কত কত দূর হতে
কুয়াশার জল কাদা দুই পায়ে মেখে
কালের কুটুম যায় পদছাপ রেখে।
উঠানের ধান খুঁটে খাচ্ছে শালিক
পুকুরে হাঁসের ঝাঁক দক্ষ নাবিক
দুই পায়ে দাঁড় টানে
টুনটুনিদের গানে
সুর তোলে হরিয়াল মগডালে বসে
সকাল মধুর হয় খেজুরের রসে।
শিমের মাচায় নাচে চড়ুইয়ের ঝাঁক
হাত থেকে ভাপা পিঠা কেড়ে নেয় কাক
শাদা গরুটির শিঙে
বসে আছে কালো ফিঙে
বিড়াল-কুকুর হাঁটে খুব চুপি চুপি
বাঁশঝাড় থেকে ডাকে জোড়া-তিলাঢুপি।
দেলুতি নদীর নাম বুঝি শোনো নাই
ছোটো নদী বয়ে চলে প্রেমে আইঢাঁই
বুক তার ছায়া ছায়া
এ-গাঁয়ের সব মায়া
বেদনা ও সুখ দুখ দেলুতির জলে
হাজার বছর ধরে ধীরে বয়ে চলে।
সন্ধ্যায় শাঁখ বাজে মিনারে আজান
মিলেমিশে শান্তির অনুসন্ধান
ভালোবাসা কী অসীম
হিন্দু ও মুসলিম
ভেদাভেদ নেই কোনো সকলে সমান
মাথার ওপরে নীল একই আসমান।
আঁকাবাঁকা মেঠো পথ সারা গাঁও জুড়ে
ছুটে গেছে দূর থেকে আরো বহু দূরে
সেই পথে চোখ রেখে
কার লাগি চেয়ে থেকে
জোহর, আসর শেষ, মাগরিবও পাড়?
এই বুঝি এলো কেউ ভালোবাসবার।
আম, জাম, লিচু, কলা, ঔষধি গাছ
ডোবা, নালা পুকুরের জল ভরা মাছ
হাজার গানের পাখি
দেলুতির কালো আঁখি
মাথার ওপর খাড়া ঘোড়ানিম, বট
যান্ত্রিক গাড়ি নেই, নেই যানজট।
জন্মের গাঁওখানি থেকে থেকে ডাকে
জীবনের সব পথ রাস্তার বাঁকে
সেই ডাক শুধু শুনি
স্বপ্নের বীজ বুনি
রোজ রাতে ঘরে ঘরে ভালোবাসা নামে
ফিরে যাবো আমি সেই জন্মের গ্রামে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৫ জানুয়ারি ২০২১।
১৬.
শিল্প
ক.
রোজ রাতে একটি কলম ঠোঁট ঘষে তোমার খাতায়।
চুমুর চিহ্নেরা আঁধারে সাঁতার কেটে কেটে ঘুম ভাঙায় শিল্পের।
খ.
কী-বোর্ডের বুতামে চাপ দিলেই একটি
অদৃশ্য পাখি ঠোকর দেয় স্ক্রিনে
ঠোকরাতে ঠোকরাতে স্ক্রিন রক্তাক্ত করে ফেলে সে,
আঙুল বড়ো নির্মম শিল্পী।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১০ জানুয়ারি ২০২১।
১৭.
বনসাই
ইচ্ছে করে ভোরের রোদে নরোম কাদা হই
আমার বুকে ঘাসের ডগা বাতাসে হইচই।
ইচ্ছে করে রোদের রেণু সারা অঙ্গে মাখি
ধুলোর নিচে, ঘাসের কাছে একটু আরো থাকি।
বৃক্ষ থেকে হলুদ পাতা নৃত্য করে নামে
এই পাতাটি পড়লো গিয়ে দূরের কোনো গ্রামে।
ইচ্ছে করে এখন আমি সে-দূর গ্রামে যাই
এই শহরে আমি তো এক
কাচের ঘরে সাজিয়ে রাখা বিনিদ্র বনসাই।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১ ডিসেম্বর ২০২০।
১৮.
কবিতা আমাকে লেখে
আমি কি কবিতা লিখি
লিখেছি কি কোনোকালে?
কেউ কি কবিতা দেখেছে আমার চোখে,
নাসিকার কুঞ্চনে
অথবা আমার হাসিমাখা দুই গালে?
কখনো কি কোনো ভুলে
কবিতার পাখি বাসা বেঁধেছিল চুলে?
মেঠো রাস্তায় যখন আমার পদদ্বয় আঁকে দূর
হাতেরা যখন নির্মাণ করে গৃহগল্পের ঘোর
কোথাও কি আমি না জেনে অথবা জেনে
রচনা করেছি কবিতার মতো অনিন্দ্য কিছু ভোর?
কবিতাকে আমি ডাকিনি কখনো এসো
আমার সঙ্গে পা ফেলে তুমিও হাঁটো
আসলে কি জানো কবিতাকে আমি দেখিনি কখনো।
কেমন দেখতে? সুন্দরী বুঝি? লম্বা অথবা খাটো?
গোপন কথাটি বলছি এবার শোনো
কবিতা আমাকে লিখে রাখে রোজ রাতে
আমাকে লিখছে সে অনবরত
গোধূলি সন্ধ্যা অথবা লাল প্রভাতে
কবিতা আমার দেহের গভীরে এঁকে দেয় রোজ ক্ষত।
কবিতা আমাকে লিখে রাখে রোজ হেসে হেসে দুলে দুলে
আমাকে সে লেখে কালের খাতাটি খুলে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৪ জানুয়ারি ২০২১।
১৯.
চেয়ার
এতো বড় এবং দানবীয় একটি চেয়ার
আমি দেখে এসেছি আল্পস পর্বতশৃঙ্গের নিচে, জেনেভায়।
শহরের কেন্দ্রে স্থাপিত বিশাল চেয়ারটি
জাতিসংঘ ভবনের দিকে মুখ করে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে তিন পায়ে।
ওর ভাঙা চতুর্থ পা ক্ষয়ে ক্ষয়ে পৃথিবীকে
প্রত্যহ জানিয়ে দেয় কোনো চেয়ারই অবিনশ্বর নয়।
এমন একটি দানবীয় চেয়ার এখন
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে
সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।
এই চেয়ারের সুবিশাল চারখানা পা-ই অক্ষত এবং মজবুত
যা নির্মিত হয়েছে রাইফেলের কঠিন ইস্পাত দিয়ে,
ডানিয়েল বারসাতের চেয়ারের মতো এই চেয়ারটির রঙও লাল
কোনো দক্ষ ভাস্কর কিংবা পেইন্টার নয়, সুবৃহৎ এই শিল্পকর্মের শরীরে
লাল রঙ মাখাতে নিয়োগ দেয়া হয় দেশের শিক্ষিত পুলিশবাহিনী
ওরা এর গুণগত মান,
উদ্দেশ্যের প্রকৃত দর্শন বিবেচনা করে
এদেশের মানুষের দেহ থেকে লাল রঙ এনে
পেইন্ট করেছে অতিকায় চেয়ারটি।
চেয়ারের নিচ দিয়ে ক্রমাগত বয়ে চলা জনস্রোত
ছুটতে ছুটতে ভয়ে শিউরে উঠছে এর বিশাল উচ্চতা দেখে
এবং কখনোই তারা মাথা উঁচু করে
দেখার সাহস করে না চেয়ারে উপবিষ্ট ভয়ানক দানবকে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৫ ডিসেম্বর ২০২০।
২০.
টেলিফোন
জল কাদা ভেঙে যে উঁচুতে এসে দাঁড়ালাম
সেখানে তিনটি রাস্তা,
সাপুড়ের ঝাঁপি থেকে নেমে গেছে তিনদিকে।
জানি না গন্তব্য কোনোটির,
শুধু জানি এদের একটি নির্জনতা ভেঙে ভেঙে
আমাকে আলোর কাছে নিয়ে যাবে;
যদিও প্রগাঢ় অন্ধকারে নেই আপত্তি, ছিল না কোনো কালে।
অপেক্ষাকৃত দূর্গম রাস্তায়
পা বাড়াতেই পাতারা সশব্দে বেজে ওঠে অকস্মাৎ,
যা লেখা ছিল না স্ক্রিপ্টে।
আমি কান পাতি বৃক্ষের বিশাল কাণ্ডে, গাছের খোড়লে;
টেলিফোনের ওপাশে প্রমত্ত ঝড়ের কণ্ঠ।
ভয়াবহ দিনের গোপন সংবাদ দেয় সে আমাকে।
বৃক্ষশাখা থেকে হ্যাচকা-টানে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিই,
মুহূর্তে ঝুলিয়ে দিই শূন্যে, বাতাসের কানে;
সমস্ত অরণ্য নিভে যায় লজ্জাবতী পাতার স্বভাবে,
নিভে যায় এক অশুভ শব্দের কম্পন-সন্ত্রাসে।
এলিপন্ড পার্ক, নিউইয়র্ক। ৫ ডিসেম্বর ২০২০।
২১.
হেঁটে যাই
কেমন আছেন, শরীর ভালো তো?
একথা বলেই একটি হলুদ পাতা হঠাৎ ঝরিয়ে দিল গাছ।
কোথায় ছিলেন এতোদিন, পুকুরের জলে
দেখিনি তো ছায়া, প্রশ্ন করে মাছ।
অনেকটা নিচে নেমে আসে ভবঘুরে মেঘেদের দল,
বৃষ্টিহীন রৌদ্রদিনে আচমকা
কে নামিয়ে দিল নুনমাখা এই জল?
রোদের রেখায় উড়ে উড়ে বলছে পথের ধুলো,
ভয় নেই, সহস্রাব্দের আঁধারে
আমরা জাগিয়ে রাখবো পায়ের চিহ্নগুলো।
আমি হেঁটে যাই দূরে, দু’পায়ের নিচে শুকনো পাতার গান,
হৈমন্তী বাতাস এসে দাঁড়ায় সটান,
আবার হবে তো দেখা?
আমি হাঁটি, দূর থেকে আরো দূরে, একা।
ওয়ান্টাই, লঙ আইল্যান্ড। ২৯ নভেম্বর ২০২০।
২২.
আফ্রিকা
কিছুক্ষণ পরে উড়ন্ত জাহাজ নেমে যাবে ঘাসে,
ধুসর ঘানায়। আকান স্বর্ণমৃত্তিকা ছুঁয়ে মেলে দেবে
ধাতব ডানার স্বপ্ন, গাল্ফ অব গিনির আকাশে;
ছুটে যাই দূরে, মারাকেশ থেকে সুদূর এন্টেবে;
ঔপনিবেশিক বিষবাষ্পে মৃত্যু, নতুন স্বপ্নের;
কাসাবার মূল প্রতিদিন পোড়ে হীরের আগুনে,
গোত্রদ্বন্দ্বে কাগেরা নদীর জল কান্না ও রক্তের
স্রোতে ভাসে, উবাঙ্গি প্রমত্ত কালো মানুষের খুনে।
নীল হেলমেট পরা প্যারাট্রুপারদের মহড়া
কী মেটাবে ক্ষুধা, টুপটাপ শব্দে পড়বে কী ঝরে
খাদ্যবৃষ্টি এক সুন্দর সকালে? ভেজাবে কী খরা?
এ-ঘন সবুজ, কালো আফ্রিকার নিগূঢ় অন্তরে
খুব সহসা কী উঁকি দেবে উদ্দিপ্ত আলোর রেখা,
দ্রোহের আগুন ফুড়ে রক্তাক্ত ক্লিভিয়া দেবে দেখা?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ নভেম্বর ২০২০।
২৩.
কানিংহাম পার্কের বক্তারা
দুপুরে কানিংহাম পার্কে গিয়ে দাঁড়ালাম।
মাথার ওপরে ন্যাড়া গাছ ছায়া দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, ওরা
কষ্টের হলুদ পাতা ঝরায় অশ্রুর মতো, বেশ কিছু।
অবাক কাণ্ডটি ঘটে গেল ঠিক তখনই।
প্রথমে সিমফুলের মতো আমার সুপ্রিয় কান দুটি
মাথার দুপাশ থেকে নেমে যায় অ্যাম্পিথিয়েটারের উন্মুক্ত মঞ্চে,
দেখাদেখি কী অবলীলায় লাফ দেয় উন্নত নাসিকা,
চোখেরাও চিরকালের কোটর ছেড়ে একজোড়া স্বাধীন শালিক;
হাত দুটো, এই তো সুযোগ — বলে নেমে যায় ওভাল মঞ্চের দিকে,
পায়েরা দেহের ভার মাটিতে নামিয়ে রেখে বিদ্রোহ ঘোষণা করে,
এবং আমার অতি গোপন অঙ্গটিও শেষমেশ নির্লজ্জের মতো
ভেংচি কেটে উঠে গেলো প্রকৃতির মঞ্চে।
এ-এক অদ্ভুত জনসভা।
আমারই অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে নানান ভঙ্গিমায়,
একমাত্র এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ দর্শক আমি,
বসে আছি হেমন্তের শূন্য গ্যালারিতে।
নিষিদ্ধ শব্দের এক দীর্ঘ তালিকা কর্ণযুগল
পাঠ করে শোনায় কোরাস সঙ্গীতের মতো,
চোখেরা জানায় সেইসব দৃশ্যের গোপন কথা,
যা আমি কৌশলে লুকিয়ে রেখেছি সমস্ত জীবন পৃথিবীর কাছ থেকে।
যে গোপন ঘ্রাণে মাতাল হয়েছি নিষিদ্ধ আঁধারে
তাও আজ প্রকাশিত নাসিকার উচ্চারণে।
আমার সরব জিহ্বা, ঠোঁট,
দুঃসাহসী হাত ও কঠোর পরিশ্রমী পদযুগল অচেনা পৃথিবীর প্রাণী,
সাক্ষ্য দিচ্ছে আমারই বিরুদ্ধে,
ঘোষণা করছে তুমুল, তুমুল অসহযোগিতা।
আমার গোপন অঙ্গ
নিষিদ্ধ অন্ধকারের গল্পগুলো মার্বেলের মতো সহসা ছড়িয়ে দেয়
নির্লজ্জ আলোর নিচে।
কী বোকার মতো আমি সারা জীবন দূরের
শত্রুদের ধাওয়া করেছি শুধু।
কানিংহাম পার্ক, নিউইয়র্ক। ২১ নভেম্বর ২০২০।
২৪.
সময়
রাত বারোটায় মিনিটের কাটা বড়
অস্থির, কামান্ধ,
উপগত হয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা
ঘন্টার কাটার ওপর, আঁতুড়ঘর কাঁপিয়ে তখন
কাঁদে নতুন দিবস।
ভোরের রেখার ওপর পৃথিবী শেখে হামাগুড়ি,
দেখায় উজ্জ্বল দাঁতের ঝিলিক
দুপুরে হাঁটতে শুরু করে বয়োসন্ধির বিকেল ছোঁবে বলে;
সন্ধ্যার মেহেদী মেখে বসে পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে।
রাতে সে মিলিত হয় সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ আগস্ট ২০২০।
২৫.
অন্ধকার -৪
জল-জঙ্গল, আলো-পর্বত পার হই,
পথে পথে প্রত্যহ ছড়িয়ে দিই কম্পিত পায়ের দস্তখত।
দুহাতে ছিঁড়তে থাকি নূরের রূপালি পর্দা
ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছিঁড়ে ফেলি সত্তর হাজার।
কে তুমি দাঁড়িয়ে আছো উল্টোদিকে ফিরে,
এতো দূর গোপন গভীরে?
দেখা দাও, তোমার পবিত্র মুখ দেখবো বলেই
সমস্ত জীবন অন্ধ করে রেখেছি দুচোখ;
আর কোনোদিকে হাঁটেনি আমার দুপা;
অন্য কোনো নাম উচ্চারণ করেনি আমার জিহ্বা তুমি ছাড়া;
কে তুমি দাঁড়িয়ে আছো রহস্যের কেন্দ্রে?
দেখা দাও,
তোমাকে দেখবো বলে দেখিনি নারীর গোপন,
তোমার পবিত্র কণ্ঠ শুনবো বলেই তো কর্ণকুহর রেখেছি আজন্ম অশ্রুত।
ঘুরে দাঁড়াও হে মহাপরাক্রম,
তোমার চোখের ফুল থেকে টেনে নিই প্রত্যাশিত ঘ্রাণ
এই নাসারন্ধ্র আজও রেখেছি অনাঘ্রাত শুধু তোমার চোখের ঘ্রাণ নেব বলে।
ফিরিয়ে দিও না,
কবুল করো হে দয়াময় আমার মেরাজ।
এ-কী! কে তুমি?
এক সুবৃহৎ অন্ধকার! সকল দৈর্ঘ্যের চেয়ে দীর্ঘ
সব উচ্চতার চেয়ে উঁচু
অন্তহীন গভীরতার চেয়েও গভীর।
তবে কী আলোর কেন্দ্রে অন্ধকার থাকে?
অন্ধকারের ভেতর নড়ে উঠছে এ-কার মুখ?
আমি কি নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি না?
গভীর আঁধারে এক সঙ্গে বেজে ওঠে
মহাকালের সকল প্রাণ,
যারা ভূমিষ্ট হয়েছে, যারা মৃত এবং যারা জন্ম নেয়নি এখনও
কী এক অদ্ভুত শব্দসঙ্গীত ধ্বনিত হচ্ছে,
ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে আঁধারের রূপ
যেন এক সুগভীর অন্ধকারে নিয়ত ছুটছে অগণিত স্রোতধারা
সকল সৃষ্টির শেকড় এ-অন্ধকারে
আজ, এ-মুহূর্তে টের পাচ্ছি আমার ভেতরে এক সুগভীর অন্ধকার প্রবাহিত
যাকে আমি এতোকাল জেনেছি অবচেতন বলে
সে তো এই অন্ধকার, যার প্রবাহ এখানে এসেই মিশেছে
যেমন নদীরা ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের বুকে নেমে যায়।
তবে কি সমস্ত জীবন হেঁটেছি আমি নিজের দিকেই
আলো খুঁজতে খুঁজতে শেষমেশ পৌঁছে গেছি নিজের কাছেই,
এক অন্তহীন অন্ধকারে?
এটাই কি জীবাত্মার সর্বশেষ পরিণতি?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০।