তৈমুর খান এর কবিতা
১
সম্পর্ক
💚
আমিও পুরোনো শব্দের কাছে আসি
উলঙ্গ হই
সব ইন্দ্রিয় মরে গেলেও চৈতন্য মরে না
জেগে থাকে নিশিরাত, একাকী মুহূর্তগুলি
কথা ও কথার সূর্য সব ডুবে যায় একে একে
তবু আঁধারে খেলা পাতি
ইচ্ছা গড়াই রোজ কুসুমের কাছে
কথা নেই, কথা নেই আর — তবু মনে হয় কথা আছে
উলঙ্গ হই
বিষাদ আমাকে দ্যাখে
তার সঙ্গেই শয্যা পাতি
কেউ আর অবৈধ ভাবে না
আমরা চৈতন্যের ঘরে আছি
সংসারী নই তবুও সংসার হয়
পুরোনো সম্পর্কগুলি এভাবেই বাঁচে ।
২
পুরোনো প্রেমিক
💚
কত তির বিঁধে আছে বুকে
তবুও নতুন আলোর গানের কাছে
সুর চাইতে এসেছি
সব ক্ষত ঢেকে আবার জ্যোৎস্নায়
কিছুটা উপশম চেয়েছি
ওদের বারান্দায় নেমেছে কত সাদা পাখি
রোদের সুস্পষ্ট উচ্চারণগুলি তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে স্বরলিপি
গড়ে যাচ্ছে শূন্যতায়, উচ্ছ্বাসে
ভোরবেলার দিকে কোনও নক্ষত্রের কাছে
নিজের জাগরণ লুকিয়ে
এখনও লজ্জানত আমি
৩
মহাপ্রস্থান
💚
ভাঙা ভাঙা চৈতন্য, দ্রাবিড় দিনের রাস্তায়
কোথায় চলেছি?
দেখা হবে না কারও সঙ্গে
নতুন কোনো মুখের আভাসও জেগে উঠবে না
রাত্রির কলোনিতে দেহ বিক্রি করছে সভ্যতা
ভ্রষ্ট রাজনৈতিক চরিত্রদের কাছে।
তীব্র পিপাসায় বিষণ্ণ জল পান করে এগিয়ে চলেছি
কেউ কি আলো হবে আমার?
কেউ কি ছায়া-মুকুলের ঘ্রাণ হবে?
বুকের আঁচল খসে পড়লে তার
একটা নতুন পৃথিবী গঙ্গা-যমুনার ধারায় বয়ে যাবে
আর দেহটি তরণি আমার
নিরুদ্দেশের গান শুনতে শুনতে সম্মোহনের তীর খুঁজে পাবে।
৪
কম্পিত বঙ্গদেশ, দগ্ধ বাংলা ভাষী
💚
ভাষাহীন হয়ে যেতে থাকি
আনমনে তোমারই নূপুর বাজে
রাঙা সূর্য তোমার মুখেই লেগে থাকে
জ্যোৎস্নায় শাড়িপরা রাতে
তুমিই ধারণাতীত লাজুক রূপসী
আমি কম্পিত বঙ্গদেশ, দগ্ধ বাংলাভাষী
উদাসীন চেয়ে চেয়ে দেখি
আমারই রক্তে প্রবাহিত নদী
শ্যামল সবুজ মাঠ, কাতর আত্মীয়
কারা এসে দাগ কাটে?
দাগে দাগে অন্ধকার
মৃত প্রজ্ঞার কাছে একা একা কাঁদি
সমৃদ্ধির হাতটুকু ধরবে না এসে?
রাখালিয়ার শেষে বাজাবে না বাঁশি?
মৃদঙ্গে আবার তবে গৌরাঙ্গ হই
গৃহসন্ন্যাসী
মুখর বাংলায় অমরত্ব খুঁজে দেখি…
৫
এখন এবার
💚
শয্যা পেতে দাও
এখানে বিশ্রাম নিই।
ঘুমের সাধ জেগে আছে
আর কোনো স্বপ্ন নেই।
কত বৃষ্টি, কত গর্জন গেল
পাড়া ভর্তি এখন নির্জন
রাজনৈতিক দৃশ্যগুলি অন্তর্হিত হলে
স্বর্গের আভাস দেখা যায়।
৬
হাঁটতে বেরিয়ে
💚
উচ্চ রক্তচাপ,থাইরয়েড আর মধুমেহ
নিয়ে
বেশিদূর হাঁটা যায় না
মৃত্যুর ভাবনাগুলি কুকুর হয়ে
দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি
শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টি হলো না
বিকেলগুলি আরোগ্যহীন
নষ্ট সভ্যতার বাঁশি বাজিয়ে
চলে যাচ্ছে
রাত্রির দিকে
৭
মুখ
💚
পৃথিবীজুড়ে ধর্মরা ঘর বানাচ্ছে
পৃথিবীজুড়ে মানবেরা মরে যাচ্ছে
বহুদিন পর কোনো প্রত্নসন্ধানী
এই পথে আয়না নিয়ে এলে
ইতিহাসেরা মুখ দেখবে:
কোথাও রক্তাক্ত মুখ
কোথাও বিদ্বেষের নৃশংস গর্জন…
৮
জাগরণ
💚
ভোর হবে বলে রাত জেগে আছি
জাগরণগুলি তবে কার কাছে শোবে?
এক অদ্ভুত বিশ্বাসে
আমাদের কষ্টগুলি
ঘর ঘর জাগরণ পোষে!
৯
শেষরাতের স্বপ্ন
💚
বিচক্ষণ ধ্বংসের রাতে
মুঠো খুলে দেখি
কার ছোঁয়া লেগে আছে হাতে!
১০
পরিপ্রেক্ষিত
💚
মুখ ভার।
ঘনঘোর এ-মনের আকাশের নিচে
নষ্ট ময়ূরগুলি
নাচে।
১১
নিষিদ্ধ রমণী
💚
কার হাত আমাকে রোজ টানে!
নিষিদ্ধ রমণী সেও
দেখা হয় স্বপ্নের বাগানে।
১২
কল্যাণী
💚
আজ আর কল্যাণী নেই?
শুধু তাকে ডাকি বারেবারে
আমাদের শোকাবহ জুড়ে
ভীরু তমসার গান ঝরে
কে দেবে আলো জ্বেলে তবে?
সন্ধ্যার পানপাত্রে মদিরা ঢেলে
সাজাবে টেবিলে?
আর সস্নেহ উষ্ণতার স্পর্শে জাগাবে!
আমরা সবাই কল্যাণ
আমাদের ঘরকন্না জুড়ে
থাকে কল্যাণী
তার কাছে সান্ত্বনা পাই বলে
আমরা এখনও আত্মহত্যা করিনি
কত সংকট আজ তার হচ্ছে যুগ
আমাদের অসহায়তায় ডুবে যাচ্ছে চাঁদ
কল্যাণী দেখে যাও তোমার কল্যাণেরা আজ পুষেছে বিষাদ!
১৩
পাঠশালা
💚
প্রাচীন স্কুলগুলি স্মৃতির রোদ্দুরে জেগে আছে
আমরা চট পেতে বসি বটের ছায়ায়
নীলজামা গায়ে, দ্রুত পাখিদের আনাগোনা
পর্যাপ্ত রঙের ভাষা মেলে দেয়;
ভাষার সংস্কৃতি বোঝে নবীন সাধনা।
বর্ণপরিচয় হাতে ঈশ্বর দাঁড়ান
ঈশ্বরের দীর্ঘছায়ায় আমরা মুগ্ধতা ভিক্ষা করি
পাতা উল্টাই শুধু
জীবনখাতায় ছবি আঁকি
কত ছবি!
ছবিরাও প্রাণ ফিরে পায় রোজ
পাঠশালা হেসে ওঠে; আর সব প্রাচীন পদ্ধতি।
১৪
ঝড়
💚
ঝড় আসছে।
আমরা মরুর উট। কথা বলি না। চেঁচাই না।
ঝড় সামলে নিই বালিতে মুখ গুঁজে।
যারা ঝড় আনছে তারাই শুধু চেঁচাচ্ছে।
আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আর নিয়ত বাঁশি বাজিয়ে দিচ্ছে।
কোলাহলে কোলাহলে একটা দেশ
ক্রমশই দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কেবলই।
দেশের বসন্তকে শুষে নিচ্ছে গ্রীষ্ম।
দেশের শরৎকে ঢেকে দিচ্ছে শীত।
বর্ষা আনছে দুর্যোগের মেঘ। ঘন কালো মেঘ।
ঘনঘন বজ্র ছুঁড়েছে এসে।
কার কী সফলতা এখন?
ভাবতে ভাবতে রাত নামছে।
বার্ধক্য এসে পিঠে বসছে আমাদের।
কয়েকটি মরুর পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে।
আমরাই শুধু বাকি যৌবনটুকু
দিয়ে যেতে চাই মরু সভ্যতাকে।
যারা ঝড় আনছে তারা কেউ সভ্য নয়
যুদ্ধবাজ ধ্বংসকারী গভীর মিথ্যুক…
১৫
কথা হল তাই
💚
সত্যের সরবত দাও আনুগত্যের গ্লাসে
অনুরাগ যেন মিশে থাকে ওই স্নেহের হাতে।
দু’দণ্ড কাছে বসো হোক অন্ধকার
আমাদের নিজস্ব আলো আছে;
উপলব্ধি জ্বালাবে এসে আলো
আমরা সবাই তখন স্বয়ংসিদ্ধ আলোকিত।
১৬
খিদে
💚
পালাতে পারি না কোথাও
আমি ও আমার ছায়া কাছাকাছি থাকি
দুপুরে গরম ভাতের ঘ্রাণ এলে
খিদে পায়
রোজ রোজ খিদে পায় শুধু!
এই পুকুরের ঘাটে দু’দণ্ড বসি
বহু পুরনো সিঁড়িতে দেখি নূপুরের শব্দ লেগে আছে
আলতা পরা খালি পা কার উঠানামা করে?
দুয়ার খোলা আছে
বাগানের হাওয়া আসছে বসন্তের আমন্ত্রণ নিয়ে
সব কুঁড়ি ফুটবে এবার অনুরাগের পরশ পেয়ে!
পালাতে পারি না,
মাঝে মাঝে কোকিলের মতো ডাকি—
কেন ডাকি?
আমার ছায়াটি বোঝে সব, শুধু আমিই বুঝি না;
আমার শুধু খিদে পায়
এ আর এক অন্য খিদে—
খিদের আগুনে হৃদয় সেঁকি!
১৭
প্রস্তুতি
💚
তোমার আঁচলে কত নক্ষত্র ফুটেছে
বিচিত্র আলোর ঝিকিমিকি
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি!
ওখানে হৃদয় রাখবো তোমার আলোয়
ওখানেই রেখে দেবো আমার বাঁশির সুর
ওখানে কখনো হবে না অন্ধকার!
শুধু রাত্রির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা যায়?
মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে জীবনের আয়ু হলো ক্ষয়
অন্ধকারে নিজেকেও বিশ্বাসঘাতক মনে হয়
সারারাত যদিও জেগে থাকি
সারারাত যদিও নক্ষত্রফুল কুড়াই
তবু এক উজ্জীবনের ডাক আসে শুনি
দীর্ঘশ্বাসগুলি লুকিয়ে ফেলি
আর তৃষ্ণাগুলি অস্বীকার করি
গভীর নির্জনে একা চুপি চুপি যাই…
১৮
এই জন্ম
💚
যে শব্দ গান হয়নি
আমি সে শব্দের কাছে যাইনি কোনোদিন;
যে মেঘ বৃষ্টি দেয়নি
আমি কি সেই মেঘের কাছে গেছি?
আমার শস্যের ক্ষেতে শব্দ আর গান
আমার মাথার ওপর মেঘ আর বৃষ্টির সম্মোহন।
এই জন্ম শুধুই বাঁশি
এ জীবন শুধুই ভেজা ভেজা অভিমান
দুপুর বিকেল হয়ে আসে
বিকেল রাত্রির ডাক পায়—
গেরুয়া আলোর পথে নামে রাঙাচেলি
রাত্রিতে হেসে উঠবে অদ্ভুত জ্যোৎস্নায়!
বিশ্বাসের ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
অলৌকিক সমুদ্রের নৌকাগুলি ছেড়ে যায়
একে একে সমস্ত নাবিকেরা সাদা পোশাক পরে
আমিও ধূসর গন্ধ মুছে ফেলি মনে মনে
উপলব্ধির সব জানালায়
আমার আসক্তি তীব্র হলে
আবার আবার মেঘ জমে
শব্দেরা গান হয়ে ফেরে।